ভাষণ-উপদেশ নয়, কাজে মনোযোগ দিন
২৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:২৩ পিএম | আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:২৩ পিএম
সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত ‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ : অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রসঙ্গ’ শীর্ষক এক সংলাপে বিশেষ বক্তার বক্তব্যে অন্তর্বর্তী সরকারের জাতীয় শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ও সিপিডির ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘সবাই সংস্কার নিয়ে কথা বলছি। কিন্তু গরিব মানুষের কথা ভাবছি না। ভূমিহীন কৃষকের কী হবে, পোশাক কর্মীদের মজুরি কত হবে, এসব নিয়েও ভাবতে হবে।’ তাঁর এ বক্তব্য উপদেশমূলক এবং এর গ্রাহ্যতা অস্বীকার করা যাবে না। তবে এ মুহূর্তে উপদেশ-পরামর্শ যতটা প্রয়োজন তার চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন কাজ করার। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য নিজেও স্বীকার করেছেন, দেশে এখন যে সরকার দায়িত্ব পালন করছে, তা কোনো স্বাভাবিক সরকার নয়। মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের পর একটি আন্দোলনের মুখে এ সরকার এসেছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের একটা ছেদ পড়েছে, যাতে মানুষের মধ্যে নতুন প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। বলাবাহুল্য, গণঅভ্যুত্থানে উৎখাত হওয়া স্বৈরাচারের আমলে রাষ্ট্রযন্ত্র ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশনসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থা কার্যকরযোগ্যতা হারায়। মত প্রকাশের অধিকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, সুশাসন, নাগরিক নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা সবকিছু হারিয়ে যায়। এমন একটা অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। সরকারের অভীষ্ট লক্ষ্য ও কাজের পরিধি অনেক বেশি। রাষ্ট্রসংস্কার এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর তার প্রধানতম কাজ। সরকার এ দুই লক্ষ্য সামনে রেখে কাজ করে যাচ্ছে। যেহেতু প্রশাসন ও পুলিশসহ সব ক্ষেত্রেই ভগ্নদশা, সুতরাং নানাভাবে কাজ ব্যাহত হচ্ছে; তাতে কাক্সিক্ষত গতি আসছে না। এই সঙ্গে চলছে পতিত স্বৈরাচারের ঘাপটিমেরে থাকা দোসরদের অসহযোগিতা এবং হাসিনা-মোদির নানামুখী ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত। কত রকমে, কতভাবে যে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত চলছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ইতোপূর্বে আমরা একাধিকবার এই নিবন্ধে লাগাতার ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের বিবরণ উল্লেখ করেছি। সরকার ও জাগ্রত জনতার প্রতিরোধে সব ষড়যন্ত্র-চক্রান্তই ব্যর্থ হয়েছে। পরিশেষে হিন্দুদের ঢাকামুখী লংমার্চও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে, আশা করা যায়। পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের মদদেই যে এই কর্মসূচি, তাতে পর্যবেক্ষক মহলের কোনো সন্দেহ নেই।
এতে কোনো সন্দেহ নেই, দেশের অর্থনীতি মারাত্মক বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। পতিত স্বৈরাচার অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ শেষ করে দিয়ে গেছে। ঋণের ভারে দেশের মানুষ ন্যুব্জ-কুব্জ দশায় উপনীত। অর্থ চুরি, পাচার ও লুটপাটের উৎসব চলেছে গত সাড়ে ১৫ বছর। এ মুহূর্তে অর্থনীতি পুনরুদ্ধার একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতি পুনর্গঠন ও গতিশীল করার কাজ করে যাচ্ছে। আশার কথা, এর মধ্যেই অর্থনীতির সূচকগুলো ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করেছে। দেশের অর্থনীতির সঙ্গে মানুষের অর্থনীতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। স্বৈরাচারের আমলে লুটপাটতন্ত্র চালু থাকায় মানুষ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে। সমাজে বৈষম্য বেড়েছে। সরকারের চামচবাজি করে কিছু মানুষ অর্থ-সম্পদের পাহাড় গড়লেও মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তে, নিম্নবিত্ত দরিদ্রে এবং দরিদ্র অতি দরিদ্রে পরিণত হয়েছে। পণ্যমূল্য, বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের মূল্য এত বেড়েছে যে, অতীতের সর্বোচ্চ রেকর্ড স্পর্শ করেছে। অধিকাংশ মানুষ একবেলা-দু’বেলা না খেয়ে কোনো রকমে জীবনধারণ করছে। সাম্প্রতিক কয়েক মাসে দফায় দফায় বন্যা ও ফসল হানির কারণে মানুষের জীবনধারণের কষ্ট আরো বেরেছে। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়লেও আয় বাড়েনি। উল্টো অনেকের আয় কমেছে এবং অনেকে কর্ম হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছে। মূল্যস্ফীতি হ্রাস, আয় বৃদ্ধি এবং অধিক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়নি। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। এজন্য ব্যবসায়ীদের এগিয়ে আসতে হবে। যারা উদ্যোগী, তাদের উদ্যম নিয়ে ব্যবসায়ে নিয়োজিত হতে হবে। বিনিয়োগ বাড়লে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, মানুষের আয় বাড়বে, ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। উৎপাদন বাড়বে, রফতানি বাড়বে, রফতানি আয়ও বাড়বে। সরকারকে এমন ব্যবস্থা ও আয়োজন করতে হবে, যাতে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হয়; কোনোভাবেই অনীহ না হয়। ব্যবসায়ের পরিবেশ ও সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, পতিত স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে দেশের কিছু ব্যবসায়ীর ভূমিকা কারো অজানা নেই। তাদের কারো কারো বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে। অন্যদের বিরুন্ধে নেওয়া হবে বলে প্রতীয়মান হয়। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে যাদের ব্যাপারে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াতে কারো দ্বিমত থাকতে পারে না। তবে তাদের প্রতিষ্ঠানের যাতে ক্ষতি না হয় সেটা দেখতে হবে। তাদের প্রতিষ্ঠানে বহু মানুষের কর্মসংস্থান আছে। কর্মসংস্থান ও উৎপাদন বজায় রাখতে হবে। ব্যক্তির উদ্যাম ও উদ্যোগ প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের জন্য যে ভূমিকা রাখতে পারে, প্রশাসক নিয়োগে সে ভূমিকা আশা করা যায় না। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রণিধানযোগ্য।
বিদ্যমান পরিস্থিতি ও বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের বড় রকমের একটা সম্ভাবনা রয়েছে। গার্মেন্টসহ অন্যান্য পণ্যের বিপুল রফতানি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। গার্মেন্ট আমাদের প্রধান রফতানিপণ্য এবং মোট রফতানি আয়ের তিন চতুর্থাংশের বেশি আসে এ খাত থেকে। পণ্যের মান ও প্রতিযোগিতামূলক দাম অক্ষুণ্ন রাখতে পারলে এ খাত থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলার আয় আসতে পারে ২০৩০ সালের মধ্যে। অন্যান্য পণ্যের রফতানিতেও আয় ৫০ বিলিয়ন ডলার হতে পারে। তথ্য প্রযুক্তি খাত থেকেও আসতে পারে বিলিয়ন ডলার, যদি দৃশ্যমান সম্ভানাকে আমরা ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারি। যেসব সম্ভাবনা সামনে দেখা যাচ্ছে, তা কার্যকর করতে পারলে দেশে একটা কর্ম ও উৎপাদনের জোয়ার আসবে। অবিলম্বে এ ব্যাপারে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। অর্থনীতি ও রাজনীতির সম্পর্ক ওতোপ্রোত। অর্থনীতি রাজনৈতিক স্থিতি নির্মাণে সহায়তা করে। আর রাজনৈতিক স্থিতি অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে। আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ সংস্কার ও নির্বাচন। অর্থনীতি এ থেকে বিযুক্ত নয়। সরকারের যারা উপদেষ্টা এবং যারা সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন কর্মসূত্রে যুক্ত, তাদের দায়িত্ব হলো, সরকারের লক্ষ্য বাস্তাবায়নে যথোচিত দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়া। তাদের এখন কাজের সময়। উপদেশ দেয়া, ভাষণ দেয়া, সেমিনার বা সভায় বক্তৃতা দেয়া তাদের কাজ নয়। এসব থেকে বিরত থাকাই তাদের উচিত। আমরা লক্ষ করছি, উপদেষ্টাদের কেউ কেউ এবং দায়িত্বশীলদের অনেকে কাজের চেয়ে কথা বলতেই বেশি উৎসাহ বোধ করছেন। কথায় বলে, বেশি কথা মানে অকাজের কথা। তাই কথা বাদ দিয়ে কীভাবে সংস্কার কাজ ত্বরান্বিত করা যায় এবং কীভাবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে কাক্সিক্ষত নির্বাচন সম্পন্ন করা যায়, সেদিকে মনোযোগ দেয়াই তাদের একান্ত কর্তব্য হওয়া উচিত।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
মাদক থেকে সমাজকে বাঁচাতে হলে কোরআন ও হাদিসের সঠিক শিক্ষা সন্তানদের দিতে হবে -ধর্ম উপদেষ্টা
উৎপাদনে ২১১৩ পোশাক কারখানা, বন্ধ ৬টি
হাবের বার্ষিক সাধারণ সভা চেম্বারকোর্টে স্থগিত
লগি বৈঠার তান্ডবকারীদের বিচার দাবীতে পঞ্চগড়ে গণ অবস্থান
বিশেষ অভিযান জোরদার করার নির্দেশ আইজিপির
‘সংবিধানের দোহাই দিয়ে অযথা সময়ক্ষেপন করবেন না'
জিয়াউর রহমান, তারেক রহমান ও বাংলাদেশ
বগুড়ায় সাবেক এমপি রিপুর দেহরক্ষী নিঝুম জনতার হাতে আটক।। পরে পুলিশে সোপর্দ
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরকারি কারিকুলামে ইসলামী শিক্ষা
সঠিক অবস্থানেই আছে বিএনপি
প্রকাশ্যে এলো ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবির
ইসরাইলে ট্রাক হামলায় হতাহত ৪১
সুদানে আবারো আধাসামরিক বাহিনীর হামলায় নিহত ১২০
ধিক্কারের মুখে বক্তৃতা থামাতে বাধ্য হলেন নেতানিয়াহু
আগামী ২ নভেম্বর ঢাকায় আলা হযরত কনফারেন্স
তাইওয়ানে বিলিয়ন ডলার মূল্যে মার্কিন অস্ত্র বিক্রি, চীনের হুঁশিয়ারি
ইউরোপজুড়ে চ্যালেঞ্জের মুখে মুসলিমরা
ড্রোন অনুপ্রবেশের অভিযোগ উ.কোরিয়ার, নিশ্চুপ সিউল
নিউ ইয়র্কে ট্রাম্পের সমাবেশে অশোভন ও বর্ণবাদী মন্তব্য
গণভবন জাদুঘরে ‘আয়নাঘরের রেপ্লিকা’ রাখার নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার