ঢাকা   মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৪ | ২১ কার্তিক ১৪৩১

অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রবাসীদের প্রত্যাশা

Daily Inqilab মুহাম্মদ আনোয়ার শাহাদাত

০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৭ এএম | আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৭ এএম

গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছরের আওয়ামী শাসন থেকে দেশ মুক্ত হয়েছে এবং নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়েছে। এই অভ্যুত্থানের ফলে বিশ্ববাসী আবারও দেখল মুক্তির জন্য, অধিকার আদায়ের জন্য বাংলাদেশের মানুষ কীভাবে আত্মত্যাগ করে। কীভাবে চেতনার সামগ্রিক ও সফল বিস্ফোরণের মাধ্যমে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করতে হয়। রক্তনদী পেরিয়ে তারুণ্যের প্রবল প্রাণশক্তিতে উদ্ভাসিত এই নতুন দিনে মানুষের আনন্দ-উচ্ছ্বাস যেমন প্রবল, তেমনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আশা-প্রত্যাশাও অনেক। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনে দীর্ঘদিনের দম বন্ধ হয়ে আসা জনজীবনে স্বস্তি ফিরে আসলেও দেশের প্রশাসন থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি সেক্টর দুর্বৃত্তদের করায়াত্তে, যার ফলে বর্তমান সরকারের (অন্তর্বর্তীকালীন) সামনে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ দেশকে সামগ্রিকভাবে দুর্নীতি আর অপশাসনের কবল থেকে মুক্ত করা এবং ভঙ্গুর অর্থনীতিকে আবার দাঁড় করানো। সাথে রয়েছে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন এবং দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত জঞ্জাল সরিয়ে একটি স্বাভাবিক ও বৈষম্যহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।

ফ্যাসিস্ট সরকার পতনে দেশের ছাত্র-জনতা যেভাবে আন্দোলন করেছে প্রবাসীরাও নিজ-নিজ অবস্থান থেকে সাহস ও সহযোগিতা দিয়ে গেছে শত প্রতিকূলতার মাঝেও। প্রবাসীরা বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি। বিশ্বের ১৭৪টি দেশে বর্তমানে ১ কোটিরও অধিক বাংলাদেশি অভিবাসী কর্মরত রয়েছে। প্রবাসে থাকা এসব বাংলাদেশি প্রতিনিয়ত রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের রিজার্ভ চাঙ্গা রাখে এবং দেশের উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখে। যুগের পর যুগ প্রবাসে জীবনযুদ্ধে লিপ্ত প্রবাসীরা দেশের মানুষের মতো আজকে আশাবাদী সুন্দর ও বৈষম্যহীন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার। রাষ্ট্র সংস্কারের এই নব প্রয়াসে প্রবাসীরাও আশায় বুক বাঁধছে, এবার হয়তো একটি সুন্দর, শোষণমুক্ত বাংলাদেশ উপহার পাওয়া যাবে এবং প্রবাসবান্ধব কিছু কার্যকর পদক্ষেপ এই সরকার নেবে। প্রবাসীদের জন্য অতীতের সরকারগুলো বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও তা অপ্রতুল এবং অনেক ক্ষেত্রেই প্রবাসীদের সমস্যা সমাধানে কিংবা জীবনমান উন্নয়নে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার মতো নয়। সময় এসেছে অভিবাসন খাতে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসার। অভিভাসন খাতে সময়োপযোগী, প্রবাসবান্ধব, বাস্তবায়ন যোগ্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করা অতীব জরুরি। একজন প্রবাসী হিসেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে কিছু চাওয়া সংক্ষেপে তুলে ধরছি।
ঘুষহীন, প্রতিবন্ধকতাহীন, দ্রুত সময়ে এবং সঠিক তথ্য সম্বলিত পাসপোর্ট নিশ্চিত করা। উল্লেখ্য যে, অধিকাংশ প্রবাসী বাংলাদেশির বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীদের পাসপোর্টে ভুল তথ্য উল্লেখ করা হয়। সেটি নাম, জন্ম তারিখ, স্থায়ী ঠিকানা, বর্তমান ঠিকানা সর্বেেক্ষত্রেই পরিলক্ষিত হয়, যা একজন প্রবাসীর জন্য মারাত্মক সমস্যা এবং বিড়ম্বনার বিষয়।

ভিসার ধরন, কর্মঘণ্টা, বেতন, কর্মপরিবেশ, ছুটি, বাসস্থান ইত্যাদি যেন পুরোপুরি নিশ্চিত করা যায় সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানি এবং অভিবাসী শ্রমিকদের মাঝখানে ভিসা ব্যবসায়ী, দালাল বা অন্য কোনো এজেন্ট যেন দুর্নীতি কিংবা প্রতারণার আশ্রয় নিতে না পারে সে ব্যাপারে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা এবং প্রতারণার আশ্রয় নেয়া এজেন্সিগুলোকে জবাবদিহি ও আইনের আওতায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। অভিভাসন প্রক্রিয়াকে আরো সহজতর করা এবং অভিবাসন ব্যয় হ্রাস করার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

বাজেটে অভিবাসন খাতে যথাযথ বরাদ্দ দেয়ার দীর্ঘদিনের দাবিকে বাস্তবে রূপদান করা এবং রাষ্ট্র সংস্কারের নীতি নির্ধারণে প্রবাসীদের প্রতিনিধিত্ব রাখা।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশ দূতাবাসকে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। দূতাবাসের কার্যক্রমকে আরো গতিশীল, প্রবাসবান্ধব এবং নিরপেক্ষ করার ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখে আসছি, যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তখন সেই সরকার বা দলের অনুগত বা মদদপুষ্ট ব্যক্তিবর্গ দূতাবাসের হর্তা-কর্তা হয়; ফলে সাধারণ প্রবাসীরা ন্যায্য সেবা থেকে বঞ্চিত হয় বা সেবা পেতে গেলে দলীয় বিবেচনা বা দলীয় দালালদের মাধ্যমে অসদুপায়ে সেবা নিতে হয়। এসব অনিয়ম থেকে দূতাবাসগুলোকে মুক্ত করতে হবে এবং উপযুক্ত ও দেশপ্রেমিক কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে। দূতাবসাগুলোতে রাষ্ট্রদূত বা অন্যান্য উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে যে দেশে নিয়োগ দেয়া হবে সেই দেশের ভাষা, সংস্কৃতি ও আইন-কানুন এবং সাথে আন্তর্জাতিক অভিবাসন আইন, মানব পাচার, কূটনৈতিক শিষ্টাচার সম্পর্কে জ্ঞান রাখে এমন ব্যক্তিবর্গকে নিয়োগ দিলে প্রবাসীদের সমস্যা সমাধানে এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সহজ হবে।

প্রবাসে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেই বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা সর্বোচ্চ এবং অধিকাংশ অদক্ষ শ্রমিক। আমাদের এই ‘অদক্ষ শ্রমিক’ ব্র্যান্ড থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। প্রবাসে আসার আগে প্রত্যেককে কোনো না কোনো একটি বিষয়ের কারিগরি শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে। বিভিন্ন দেশের শ্রমবাজারের চাহিদা গবেষণা পূর্বক কোনো ধরনের যোগ্যতা ও প্রশিক্ষণ আমাদের দরকার সেরকম উপযুক্ত কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে।
বিপুল সংখ্যক নারী শ্রমিকের ব্যাপারে সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং দূতাবাসগুলোর পরিষেবা এবং তদারকি বাড়ানো খুবই জরুরি। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের তথ্য মতে, প্রবাসী বাংলাদেশি নারী শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ২০ লাখ। অথচ, এই বিপুল সংখ্যক নারী শ্রমিকের দেখ-ভাল করার মতো উপযুক্ত জনবল ও কর্মকৌশল আমাদের দূতাবাসগুলোর নেই। তাই এই ব্যাপারে দ্রুত ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

রেমিট্যান্স পাঠানোর বৈধ চ্যানেলগুলোকে আরো গতিশীল, কার্যকর, নিরাপদ ও সহজতর করার উদ্যোগ নিতে হবে এবং রেমিট্যান্সের উপর প্রণোদনা আরো বাড়িয়ে ৪-৫ শতাংশ করা দরকার।
প্রবাসের নানান জটিলতায় অবৈধ হওয়া, কারাগারে বন্দি, অসুস্থ কিংবা দুর্ঘটনা বা রোগের কারণে মৃত্যুবরণকারী শ্রমিকদের জন্য দূতাবাস, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকলকে সর্বদা মানবিক ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। বিপদগ্রস্ত বা মৃত্যুবরণকারী শ্রমিককে বিনা খরচে দ্রুত দেশে পাঠানোর এবং ক্ষতিপূরণ আদায়ের সকল ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, ওয়েজ আর্নাস কল্যাণ বোর্ড, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয় ও দপ্তরকে প্রকৃত অর্থেই প্রবাসীদের কল্যাণে কাজ করা নিশ্চিত করতে হবে। প্রবাসীদের অবসরকালীন সময়ের জন্য অবসর ভাতা চালু করতে হবে, যাতে করে জীবনের মূল্যবান সময়, শারীরিক সামর্থ্য সব শেষ করে দেশে আসার পর যেন কোনো প্রবাসীকে দুর্বিষহ জীবন কাটাতে না হয়।

আশাকরি, অন্তর্বর্তী সরকার হাজারো প্রতিকূলতা এবং সীমাবদ্ধতার মাঝেও একটি সুন্দর, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন এবং কল্যাণমুখী শাসন ও রাষ্ট্রব্যবস্থা উপহার দেবে এবং প্রবাসীদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পুরো অভিবাসন প্রক্রিয়াকে ঢেলে সাজাবে।

লেখক: সৌদি প্রবাসী কবি ও প্রাবন্ধিক।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

মেসিকে নিয়ে বড় পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের

মেসিকে নিয়ে বড় পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের

‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে’ বিএনপির সঙ্গে কাজ করতে তৈরি আছি: হাছান মাহমুদ

‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে’ বিএনপির সঙ্গে কাজ করতে তৈরি আছি: হাছান মাহমুদ

দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গে দলের কোনো নেতা-কর্মীকে ছাড় দেওয়া হবে না : যুবদল সভাপতি

দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গে দলের কোনো নেতা-কর্মীকে ছাড় দেওয়া হবে না : যুবদল সভাপতি

ঢাকা মেডিকেলের সিসিইউতে ভর্তি শাজাহান খান

ঢাকা মেডিকেলের সিসিইউতে ভর্তি শাজাহান খান

আলোকচিত্রশিল্পী ড. শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে তদন্ত স্থগিত

আলোকচিত্রশিল্পী ড. শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে তদন্ত স্থগিত

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ওলামা মাশায়েখ মহাসম্মেলন কাল

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ওলামা মাশায়েখ মহাসম্মেলন কাল

ব্র্যাক ব্যাংকের ৩০,০০০ কোটি টাকার রিটেইল ডিপোজিট মাইলফলক

ব্র্যাক ব্যাংকের ৩০,০০০ কোটি টাকার রিটেইল ডিপোজিট মাইলফলক

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে গবেষণায় জোর দিতে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার পরামর্শ

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে গবেষণায় জোর দিতে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার পরামর্শ

ব্রাহ্মণপাড়ায় জেলেকে পিটিয়ে হত্যা

ব্রাহ্মণপাড়ায় জেলেকে পিটিয়ে হত্যা

কুয়াকাটায় দুই নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু

কুয়াকাটায় দুই নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু

কলারোয়ায় হাজার হাজার ছাগলের মৃত্যু

কলারোয়ায় হাজার হাজার ছাগলের মৃত্যু

হত্যা মামলায় নিরপরাধ ব্যক্তিদের ফাঁসানোর প্রতিবাদ

হত্যা মামলায় নিরপরাধ ব্যক্তিদের ফাঁসানোর প্রতিবাদ

শিয়ালের কামড়ে নারী ও শিশুসহ আহত ৯

শিয়ালের কামড়ে নারী ও শিশুসহ আহত ৯

লোহাগাড়ায় ইউপি সচিবের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ

লোহাগাড়ায় ইউপি সচিবের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ

বন্দরগুলোর অবৈধ সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া হবে : নৌপরিবহন উপদেষ্টা

বন্দরগুলোর অবৈধ সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া হবে : নৌপরিবহন উপদেষ্টা

পঞ্চগড়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান

পঞ্চগড়ে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান

ধামরাইয়ে পুলিশ ক্যাম্পে ঝুলছে তালা

ধামরাইয়ে পুলিশ ক্যাম্পে ঝুলছে তালা

ভোগান্তির আরেক নাম আশাশুনি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

ভোগান্তির আরেক নাম আশাশুনি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স

যশোরে বিএনপি নেতার আদালতে আত্মসমর্পণ

যশোরে বিএনপি নেতার আদালতে আত্মসমর্পণ

যশোর শহরজুড়ে রাস্তার পাশে ময়লার ভাগাড়

যশোর শহরজুড়ে রাস্তার পাশে ময়লার ভাগাড়