ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

৫ আগস্টের আয়নায় দেখা ৭ নভেম্বর

Daily Inqilab ড. আসাদুজ্জামান রিপন

০৮ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশে যে গণভ্যুত্থানটি ঘটেছে তাতে করে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ চলার পথে অনেকগুলো নতুন সুযোগ ও সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশকে একটি স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার অব্যাহত প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রূপান্তরের সুযোগ এসেছে।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতা লাভ করল, তখন নতুন প্রজাতন্ত্র একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে উঠবে এমন আকাক্সক্ষাই ছিল মানুষের মাঝে। কিন্তু তখনকার শাসকদল আওয়ামী লীগ মানুষের আকাক্সক্ষাকে অশ্রদ্ধা করে দেশে চরম অগণতান্ত্রিক একদলীয় স্বৈরশাসন চালু করেছিল। ঠিক গত ১৬ বছরে বাংলাদেশে বিরোধীদের খুন, গুম, মামলা দিয়ে কারাগারে আটক করে, লুণ্ঠন আর জনগণের ভোটাধিকার হরণের বাহন হয়ে উঠেছিল শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসন। ৭২-৭৫ সালে শেখ মুজিবের শাসনামলটা প্রায় অমনই ছিল। এমন প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে থাকা দক্ষিণপন্থী নেতৃত্বের একটি অংশের হাতে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার কাঠামোর একনায়ক শেখ মুজিবের সরকারের পতন ঘটে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদলীয় ফ্যাসিবাদী শাসন কাঠামোতে নেতৃত্বের পরিবর্তন ঘটে। এ জাতীয় উপদলীয় অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব পরিবর্তনের ইতিহাস বিশ্বে ভুরি ভুরি। কখনো সেটি রক্তাক্ত পথেও হয়ে থাকে। ফ্যাসিবাদী সরকার ও দলীয় কাঠামোতে রক্তাক্ত উপদলীয় অভ্যুত্থানের নজির পৃথিবীতে বহু আছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ আফগানিস্তানেও সোভিয়েত জামানায় এ রকম পরিবর্তন দেখা গেছে। বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বাকশাল ব্যবস্থার প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব তারই দলের অন্যতম নেতা খন্দকার মোশতাক আহমেদের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হন। সপরিবারে নিহত হন। এমন ধরনের পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই পাল্টা অভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ার সুযোগ থাকে। হয়েছিলোও তাই। ৩ নভেম্বরে সেনাবাহিনীর একটি অংশ খন্দকার মোশতাকের সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে। ৩ নভেম্বর সেনাবাহিনীর এই অংশটির ভূমিকা ও উদ্দেশ্য দেশের সাধারণ মানুষের কাছে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল। এমনকি সেনাবাহিনীর সাধারণ জওয়ানদের মধ্যেও সন্দেহ-অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়। এর প্রধান কারণ ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান ঘোষক তৎকালীন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করা। দেশের মানুষ ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে এমন ধারণা জন্ম নিয়েছিল যে, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে যে ক্যু’টি সংগঠিত হয়েছিল তা মূলত তৎকালীন পতিত স্বৈরাচারী সরকারের অনুসারীদের পুনর্বাসনের পথ খুলে দেয় কিনা এবং এতে করে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ঝুঁকির মধ্যে পড়ে কিনা।

এই আশঙ্কা নস্যাৎ করতে সশস্ত্র বাহিনীর দেশপ্রেমিক সদস্যগণ ৭ নভেম্বর জনগণের সমর্থনে অভ্যুত্থান সংঘটিত করেন এবং তাদের সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করেন। ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানটি বাংলাদেশকে এক নতুন অভিমুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। সেই নবযাত্রাটি ছিল গণতন্ত্রের পথে চলা, মানবাধিকারের প্রতি রাষ্ট্র ও সরকারের দায়বদ্ধ হওয়া, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তোলার স্বপ্ন দেখাতে ধর্ম-বর্ণ ভাষা নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান মর্যাদায় পরিচিতি লাভের চেতনায় জাতীয় সংহতি সৃষ্টি করা। এই মহান কাজটি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বেই সূচিত হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর থেকে।

২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের অনেক তরুণ এটাকে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলতে চেয়েছেন। এটাকে কেউ কেউ ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ হিসেবে ভাবতেও পছন্দ করেছেন। যদি রিপাবলিকের ধারণাটি কেউ বিবেচনা করতেও চান তাহলেও ৫ আগস্টের নতুন প্রেক্ষিতকে অন্তত ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ দাবি করা যৌক্তিক হবে না। কেননা, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরে সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একদলীয় ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থার বিলোপ হওয়ার ঐতিহাসিক ঘটনায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের নতুন যাত্রা শুরু হয়েছিলো সেটাকে অন্তত সেকেন্ড রিপাবলিক বলা যায়।

বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকটি অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটেছে। ঐসব ঐতিহাসিক ঘটনায় ছাত্র-শ্রমিক সাধারণ মানুষ এমনকি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও নানাভাবে নানা প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছেন। ৭ নভেম্বরে তো সৈনিকেরা যখন ট্যাংক নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন তখন তাদের সাধারণ মানুষ ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়ে ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থার পতনে সমর্থন জানিয়েছিল।

এমন অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র, তরুণ, যুবক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের সাথে সৈনিকদের মেলবন্ধনের ঘটনা নতুন করে দেখা গিয়েছিল যখন শেখ হাসিনার নির্দেশ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা অমান্য করেছেন মানুষের বুকে গুলি ছুড়তে রাজি না হয়ে। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরে সিপাহী-জনতার যে মেলবন্ধন সৃষ্টি হয়েছিল অমন দৃশ্য দেখা গেল ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে।

যুগে যুগে গণঅভ্যুত্থানের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য মোটামুটি একই। প্রতিটি গণঅভ্যুত্থান নতুন করে স্বপ্ন দেখায় মানুষকে। আবার সজাগ না থাকলে স্বপ্নগুলো চুরি হয়ে যায়! এমন বেহাত হয়ে যাওয়া স্বপ্নের কথা আমরা বহুবার শুনেছি। আর ক্ষোভ বুকে পুষে আবার সময় সুযোগে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রুখেও দাঁড়িয়েছে এদেশের মানুষ বারবার।

লেখক: এক সময়ের খ্যাতিমান ছাত্র নেতা, বর্তমানে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

চা শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করুন
দুর্নীতি ও অর্থপাচারের বিস্ময়কর রেকর্ড
সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে জাতি ঐক্যবদ্ধ
সংস্কার ও জাতির স্বপ্ন
জাতীয় ঐক্য দৃঢ় ও সুসংহত করতে হবে
আরও

আরও পড়ুন

‘চিঠি কিংবা টেলিফোনে নয়, এবার সরাসরি সালমান খানকে হত্যার হুমকি দিলেন বিষ্ণোই গ্যাংয়ের সদস্য’

‘চিঠি কিংবা টেলিফোনে নয়, এবার সরাসরি সালমান খানকে হত্যার হুমকি দিলেন বিষ্ণোই গ্যাংয়ের সদস্য’

বাল্টিমোর সেতু ধসের নেপথ্যের কাহিনি

বাল্টিমোর সেতু ধসের নেপথ্যের কাহিনি

আশুলিয়ার হত্যা মামলার আসামি পটুয়াখালী থেকে গ্রেপ্তার

আশুলিয়ার হত্যা মামলার আসামি পটুয়াখালী থেকে গ্রেপ্তার

বিকেলে ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সংলাপে বসছেন প্রধান উপদেষ্টা

বিকেলে ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সংলাপে বসছেন প্রধান উপদেষ্টা

ভারতের অপকর্ম অপপ্রচার বন্ধে পুরো জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ

ভারতের অপকর্ম অপপ্রচার বন্ধে পুরো জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ

কলকাতার হাসপাতাল বাংলাদেশীদের চিকিৎসা না দেওয়ার খবর ‘মিথ্যা’: ভারতীয় মিডিয়া

কলকাতার হাসপাতাল বাংলাদেশীদের চিকিৎসা না দেওয়ার খবর ‘মিথ্যা’: ভারতীয় মিডিয়া

মানিকগঞ্জে সই নকল করে ৩৩ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ

মানিকগঞ্জে সই নকল করে ৩৩ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ

অভিভাবকের কাছে ইউএনও’র খোলা চিঠি

অভিভাবকের কাছে ইউএনও’র খোলা চিঠি

৬০ বিজিবির অভিযানে ৪৪ লক্ষ টাকার ভারতীয় মালামাল জব্দ

৬০ বিজিবির অভিযানে ৪৪ লক্ষ টাকার ভারতীয় মালামাল জব্দ

উপায়ান্তর না দেখে বাংলাদেশিদের চিকিৎসায় অতিরিক্ত ছাড়ের ঘোষণা দিলো কলকাতার হাসপাতাল

উপায়ান্তর না দেখে বাংলাদেশিদের চিকিৎসায় অতিরিক্ত ছাড়ের ঘোষণা দিলো কলকাতার হাসপাতাল

আশুলিয়ায় ছাত্র-জনতা হত্যা মামলায় আ.লীগ নেতা গ্রেপ্তার

আশুলিয়ায় ছাত্র-জনতা হত্যা মামলায় আ.লীগ নেতা গ্রেপ্তার

বিএনসিসির সহায়তায় দেশ নিরাপদ জায়গায় এসেছে : সেনাপ্রধান

বিএনসিসির সহায়তায় দেশ নিরাপদ জায়গায় এসেছে : সেনাপ্রধান

রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসককে রাঙ্গামাটি প্রেস ক্লাবের বদলিজনিত বিদায় ও ফুলেল শুভেচ্ছা

রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসককে রাঙ্গামাটি প্রেস ক্লাবের বদলিজনিত বিদায় ও ফুলেল শুভেচ্ছা

দৌলতপুরে ৭৯৫ রোহিঙ্গার জন্মনিবন্ধন: ইউপি চেয়ারম্যান ও সচিবের আইডি সাময়িক বন্ধ

দৌলতপুরে ৭৯৫ রোহিঙ্গার জন্মনিবন্ধন: ইউপি চেয়ারম্যান ও সচিবের আইডি সাময়িক বন্ধ

নারী নির্যাতন বন্ধে পুরুষদের বেশি এগিয়ে আসতে হবে

নারী নির্যাতন বন্ধে পুরুষদের বেশি এগিয়ে আসতে হবে

কাপ্তাইয়ে রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ দু'ই সদস্যকে সংবর্ধনা ও তিতুমীর একাডেমির শিক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠিত

কাপ্তাইয়ে রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ দু'ই সদস্যকে সংবর্ধনা ও তিতুমীর একাডেমির শিক্ষার্থীদের বিদায় অনুষ্ঠিত

পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের পতাকা অবমাননার ঘটনায় গ্রেপ্তার ৩

পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের পতাকা অবমাননার ঘটনায় গ্রেপ্তার ৩

সিংগাইরে দুধর্ষ ডাকাতি, ১০ লক্ষ টাকার মালামাল লুট

সিংগাইরে দুধর্ষ ডাকাতি, ১০ লক্ষ টাকার মালামাল লুট

সালথায় ঘরের চালা কেটে শিশুকে জিম্মি করে প্রবাসীর বাড়িতে ডাকাতি

সালথায় ঘরের চালা কেটে শিশুকে জিম্মি করে প্রবাসীর বাড়িতে ডাকাতি

বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর নব বিমানসেনা দলের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকওয়াজ অনুষ্ঠিত

বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর নব বিমানসেনা দলের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকওয়াজ অনুষ্ঠিত