বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি : ফ্যাসিবাদের পক্ষাবলম্বনে কুগেলম্যান
১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০২ এএম
UNB-তে প্রকাশিত (২৩/৯/২০২৪) US-Bangladesh relations might change if Trump comes to power: Kugelman শিরোনামে মাইকেল কুগেলম্যানের সাক্ষাৎকার পড়ে মনে হলো বিষয়গুলো পাঠকের সামনে তুলে ধরা দরকার। তিনি যেভাবে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করছেন তার জবাব নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে দেওয়া লেখক সমীচীন মনে করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বাংলাদেশ সম্পর্কে অযাচিত মন্তব্য করে বিতর্কের সৃষ্টি করেছেন। আমেরিকার এই ব্যক্তির মতামত প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের একাধিক গণমাধ্যমে। তিনি মার্কিন পলিসিকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করেছেন, যা একতরফাভাবে শেখ হাসিনা ও ভারতের পক্ষাবলম্বন ছাড়া আর কিছু নয়।
বাংলাদেশকে আনরেস্ট করার জন্য কুগেলরা এখন অতি তৎপর হয়ে উঠেছেন। তিনি যেন ট্রাম্পের হয়ে ওকালতি শুরু করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতায় আসীন হলে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নতুন মাত্রা পাবে কিংবা ড. ইউনূসের সরকার চাপে থাকবেÑ এ ধরনের আপ্তবাক্য আত্মতৃপ্তি দিতে পারে কিন্তু লেখক সম্পর্কে আমাদের নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে। তিনি প্রথম থেকেই একপেশে। তার লেখনিতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হাসিনা ও ভারতের পক্ষপাতিত্ব দৃশ্যমান। তিনি যেন বর্তমান পরিস্থিতিতে আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে খাটো করে দেখছেন। ছাত্র আন্দোলন ও হাসিনার পলায়ন নিয়ে ভিন্ন ন্যারেটিভস সৃষ্টি করছেন। তার উদ্দেশ্য, সাধারণ মানুষ যেন ভাবে হাসিনা ফিরে আসবেন।
২.
একথা সত্য, অতীতে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ট্রাম্প যা যা করেছেন তা থেকে তাঁর কর্মকা- ও নীতি সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে ধারণা করা যায়। অবশ্য আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়লেও অঞ্চল হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় ট্রাম্পের সম্ভাব্য প্রভাব খুব বেশি পড়বে বলে মনে হয় না। এক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের সম্পর্কের ধারাবাহিকতা মোটাদাগে প্রায় অভিন্ন থাকবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ইন্দো-প্যাসিফিক নীতির আলোকেই আবর্তিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক নীতি বা কৌশলে চীনকে মোকাবেলা তা যে সরকারই আসুক একই ধরনের হবে। বিশেষ করে এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব কমাতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বাড়াতে দৃষ্টি থাকবে ট্রাম্পের। ফলে ভারত-বাংলাদেশ উভয় দেশই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশ যাতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চীনের খুব কাছে না যায় তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করবে ট্রাম্প প্রশাসন।
মাইকেল কুগেলম্যানের মতে, ‘ট্রাম্পের বিজয়ের প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি পড়তে পারে বাংলাদেশে। শেখ হাসিনার সরকার উৎখাত হওয়ার পর সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে পুরোপুরি নতুনত্ব এসেছে। বাংলাদেশ স্থিতিশীল, পুনর্গঠিত ও সংস্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়ন সহযোগিতা, মানবিক সহায়তা গুরুত্ব পাচ্ছে। আমার মনে হয় না, ট্রাম্প প্রশাসন এই সম্পর্ককে এই কাঠামোতে রাখার চেষ্টা করবে। আমি মনে করি, যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিযোগিতাকে গুরুত্ব দিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কে বেশি গুরুত্ব দেবে। অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস অতীতে ট্রাম্পের কড়া সমালোচনা করেছেন। তাঁদের দুজনের রাজনীতির ধরন এক নয়। রাজনীতি ও বৈশ্বিক বিষয়ে তাঁদের দুজনের ভাবনায় অনেক পার্থক্য আমার মনে হয়, এ বিষয়ে আমাদের দৃষ্টি রাখতে হবে। আমি মনে করি, ট্রাম্প প্রশাসন ও ড. ইউনূসের সরকারÑউভয়েই সফল ও স্বাভাবিক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক দেখতে চাইবে। তবে এই সম্পর্কের শুরুর দিকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।’ (মানবজমিন, ৭ নভেম্বর ২০২৪)। মাইকেল কুগেলম্যান ৩রা নভেম্বর করা টুইট পোস্টে বাংলাদেশকে একটি ‘আউটলায়ার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বলেছেন, ‘এটি দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশের মধ্যে একটি দেশ, যেখানে নির্বাচনের ফল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উল্লেখযোগ্যভাবে এবং সম্ভবত ক্ষতিকরভাবে প্রভাবিত হতে পারে।’
কুগেলম্যানের বক্তব্য কোন কিছুর ইংগিত বহন করে না। তার বক্তব্যে বাংলাদেশকে নতজানু করে রাখা রাজনৈতিক দেশদ্রোহী অলিগার্কিদের মতামতের প্রতিফলন ঘটেছে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আকাক্সক্ষা প্রকাশিত হয়নি। তিনি যেন একটি বিশেষ দেশ ও দলের পক্ষে কথা বলছেন। বলা যায়, এরা লবিস্ট হয়ে কিছু টাকার বিনিময়ে এসব লিখছেন। তবে জনগণ সজাগ থাকলে ভারত ফ্যাসিস্ট হাসিনার পক্ষে থেকেও স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে পারবে না। বাংলাদেশের ভালমন্দ এদেশের জনগণই দেখবে। তাছাড়া আমাদের পররাষ্ট্র নীতিতে ‘সবার সাথে সম্মানজনক বন্ধুত্ব কোনো শত্রুতা নয়’Ñনীতি মেনে চলা হচ্ছে। বাংলাদেশীদের ভাগ্য আমেরিকা বা ভারত নির্ধারণ করার ক্ষমতা রাখে না। তারা শুধু ভালো মন্দের সাথী হতে পারে। বাংলাদেশীরাই তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করবে।
অর্থাৎ জন আকাক্সক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল ছাত্র-জনতা ও রাজনৈতিক দলের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফল। সেখানে বিশ্বের অন্য কোন দেশের অবদান নেই। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে এনে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের বাস্তবতা ভিন্ন। জনগণ এক থাকলে কেউ এদেশকে বিপথগামী করতে পারবে না।
বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে অতীতে মার্কিন রাজনীতিকদের, বিশেষ করে ডেমোক্র্যাট নেতাদের ভালো সম্পর্ক দেখা গেছে। বাইডেনের আমলে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে উন্নয়ন, সংস্কার ও অন্যান্য সহায়তা বা সমর্থন করছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প বর্তমান সম্পর্কের কাঠামোকে সমর্থন করবেনÑ এটাই স্বাভাবিক। কারণ আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট বদল হলেও বৈদেশিক নীতিতে খুব বড় পরিবর্তন হয় না। এর পিছনে যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থা বা কাঠামোগুলোর একটা শক্তিশালী ভূমিকা থাকে। ৬ নভেম্বর(২০২৪) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব জানিয়েছেন যে, রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট, দুই পার্টির সিনিয়র নেতাদের সঙ্গেই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ভালো সম্পর্ক থাকায় এবং দুই শিবিরেই তার বন্ধু থাকায় এই নির্বাচনের ফলাফলে দুই দেশের সম্পর্কে কোনও প্রভাব পড়বে না।
কিন্তু মনে রাখা দরকার মার্কিন পলিসি সবসময় নিজেদের স্বার্থ ষোল আনায় বুঝে নেয়। তাদের কাছে জাতীয় স্বার্থ মুখ্যNational interest is the conception which nations apply in trying to influence the world environment to their advantage. (W W Rostow). নিজেদের সুবিধায় পৃথিবীর পারিপাশির্^ক অবস্থাকে ব্যবহারের এই কৌশলকে বলে- Machiavellian Diplomacy. যে কোনো পন্থায় বা কৌশলে আত্ম স্বার্থ উদ্ধারের এই নীতি মার্কিনি কূটনীতি। এজন্য ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেই সবকিছু বদলে দিতে পারবেন না।
৩.
যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাচনের ঠিক চার দিন আগে ৩১ অক্টোবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ বিবৃতি দেন রিপাবলিকান প্রার্থী বিজয়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিষ্টান এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুর ওপর বর্বরোচিত সহিংসতা ও লুটপাটের আমি তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। কমলা ও বাইডেন হিন্দুদের ব্যাপারে নির্বিকার থেকেছেন, কিন্তু আমরা আবার শক্তিশালী আমেরিকা গড়ব ও শান্তি ফিরিয়ে আনব।’ তিনি আরো বলেছিলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে ‘পুরোপুরি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি’র মধ্যে রয়েছে। ট্রাম্পের এমন মন্তব্য বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য নেতিবাচক সংকেত বলে মনে করেছেন মাইকেল কুগেলম্যান ও বাংলাদেশ বিরোধীরা।
কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলোÑ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী বাংলাদেশের সংখ্যালঘু এবং ভারতীয় ভোটারদের দলে টানতেই সামাজিকমাধ্যম এক্সে বিবৃতি দিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। উপরন্তু ট্রাম্পের এমন মন্তব্যকে শেখ হাসিনার ছেলে জয়ের যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়োগের ফল হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
এক্সে দেওয়া পোস্টে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিজের ‘ভালো বন্ধু’ বলেও আখ্যা দিয়েছেন ট্রাম্প। লিখেছেন, তিনি (ট্রাম্প) নির্বাচিত হলে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারত্ব আরও জোরদার করা হবে। একদিকে বাংলাদেশে ‘বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি’ চলছে বলে মন্তব্য, একইসাথে আবার ভারতের সঙ্গে ট্রাম্পের সুসম্পর্কের ইঙ্গিতÑএ বিষয়ে আমাদের মতামত হলোÑ ট্রাম্পকে ব্যবহার করে বাংলাদেশকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে ভারত। আসলে ট্রাম্প স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু মোদি ও ভারত। ট্রাম্প ক্ষমতায় আসীন হয়ে আগের মতোই চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করতে পারেন। সেটি হলে যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু হিসেবেই পাশে থাকবে ভারত। আর ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকায়, বাংলাদেশকেও পাশে চাইবেন ট্রাম্প। অর্থাৎ ভারতকে পাশ কাটিয়ে বা দূরে ঠেলে বাংলাদেশ যেন কিছু না করে, ট্রাম্প সেই সতর্কতামূলক বার্তাও হয়তো দিতে পারেন।
তার উল্লিখিত বক্তব্য রাজনৈতিক কূটাভাষ ছাড়া আর কিছু নয়। ইতোমধ্যে পাচারকৃত টাকা দিয়ে হাসিনাপুত্র জয় লবিস্ট নিয়োগ করেছে। মার্কিন নির্বাচনের আগে ট্রাম্পকে দিয়ে বাংলাদেশের বিষয়ে অযাচিত মন্তব্য করিয়েছে। আসলে ট্রাম্প যা বলেছেন, তা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘটার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কারণÑক) মার্কিন পলিসি এক দু’মাসের মধ্যে পরিবর্তন হবে না। খ) তাদের প্রায়োরিটি অন্যত্র। ট্রাম্প যুদ্ধ বন্ধ ও অর্থনীতি সমৃদ্ধ করতে তৎপর হবেন। তার কাছে অর্থনীতি ও নিরাপত্তা প্রধান ইস্যু। তিনি নির্বাচনের আগে এই স্লোগানে সরব ছিলেন। আসলে এটি এক ধরনের ন্যাশনালিস্ট পয়েন্ট অব ভিউ। একারণে নির্বাচনে জয়ী হয়ে ৬ নভেম্বর (২০২৪) এক ভাষণে সমৃদ্ধ আমেরিকা গড়ার অঙ্গীকার করেছেন তিনি। তার সমর্থকদের বলেছেন, তিনি ‘শক্তিশালী, নিরাপদ এবং সমৃদ্ধ’ আমেরিকা তৈরি না হওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম নেবেন না। অর্থাৎ ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে হাসিনা ও দোসরদের খুশি হবার কিছু নাই। এছাড়া ছাত্রসমাজ ও রাজনৈতিক দলগুলো শঙ্কিত নয়।
২০১৪ সালের মে মাসে ভারতে মোদি ক্ষমতায় এলে বিএনপি জনে জনে মিষ্টি মুখ করিয়ে ভেবেছিল বিজেপি হাসিনার বিরুদ্ধে থাকবে। কিন্তু রাজনৈতিক অঙ্গনে বিএনপি কোনো সুবিধা করতে পারেনি। (ভারতের কংগ্রেস ষড়যন্ত্র করে ২০০৯ সালে হাসিনাকে ক্ষমতায় আনে।) সেসময় বিএনপি মনে করেছিল, মোদি তাদের নৈতিক সমর্থন দিবেন। কিন্তু কংগ্রেসের চেয়ে মোদি অতিবেশি হাসিনা ঘেঁষা হয়ে উঠেন। এজন্য ট্রাম্প ইস্যুতে সাধারণ মানুষের উপর নির্ভর করতে হবে। তারাই নির্ধারণ করবে ভালোমন্দ। ফ্যাসিবাদীদের খুশি হওয়ার কিছু নেই। লেখাবাহুল্য, ফ্যাসিবাদকে পুনর্বাসন করতে চাইলে পুনরায় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হবে। যেমন আফগানিস্তানে হয়েছে (২০০১-২০২১)। সেখানে শেষ পর্যন্ত মানুষ জয়ী হয়েছে। ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে মনে হচ্ছে, কুগেলম্যান আমাদের রাজনীতি শেখাচ্ছেন। কিন্তু এখনকার মানুষ সচেতন। পাশর্^বর্তী রাষ্ট্রগুলো ভারতের বিরুদ্ধে। এর বাইরে আছে মুসলিম জনগোষ্ঠী, যারা দীর্ঘ ঐতিহ্য ধারণ করে বসবাস করছে। আমরা জানি, ভারতে বাবরি মসজিদ কিংবা গো মাংস ইস্যুতে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নির্যাতন করা হচ্ছে। এই নির্যাতনের ঘটনাগুলো বাঙালি মুসলমানকে বিচলিত করে। কিন্তু বাংলাদেশে মুসলিমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বসবাস করছে। আশ্চর্য হলোÑ মুসলিমদের উপর আধিপত্য করার জন্য ভারত হিন্দুত্ববাদী শক্তি প্রয়োগ করেছে।
অন্যদিকে হাসিনার ভোট-ব্যাংক হিন্দু জনেগোষ্ঠীর উপর গত ১৬ বছরে নির্যাতন হয়েছে। একদিকে নির্বাচনে সংখ্যালঘু ইস্যু অন্যদিকে ভয়াবহ অত্যাচার, জমি দখল প্রভৃতি ঘটনায় নিজেদের সমর্থকদের উপর নির্যাতন, জুলুমÑউভয় দৃষ্টান্ত রয়েছে আওয়ামী শাসনামলে। যদিও ভারত বাংলাদেশের সরকারে বা রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় হিন্দুদের প্রতিষ্ঠা করেছে। পিলখানায় সেনাসদস্যদের ২০০৯ সালে হত্যা করা হয়েছে। ভারতের হাইকমিশনার বলেছিলেন, হাসিনার ক্ষমতা শেষ হলে ২ লক্ষ মানুষ জবাই হবে। কিন্তু ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানের পর দেখা গেল আওয়ামী লীগের বড় নেতারা সকলেই জীবিত। কেউ মরেননি। হত্যার শিকারও হননি কেউ। রক্তগঙ্গা বইয়ে দেওয়ার কথা একসময় আওয়ামী লীগই বলেছিল। তার মানে তারা এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হোকÑঅপচেষ্টার এই রাজনীতিতে বিশ^াসী।
৪.
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ছাত্র-জনতা ফ্যাসিস্ট সরকারের উপর প্রতিশোধ নেয়নি। যদিও ১৬ বছরের শাসনকালে তারা দেখেছে খুনি হাসিনা অর্থ পাচার, ব্যাংক লুট, ঋণের বোঝা বাড়িয়ে মানুষকে শোষণ করেছে। তারাও জানত ক্ষমতার বাইরে গেলে তাদের কর্মফলের জন্য খারাপ পরিণতি অপেক্ষা করছে। হাসিনা পলায়নের পর বাস্তবে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করেছে। অথচ অতীতে দেখা গেছে, গণবিপ্লবের পর নেতাকর্মী বা শাসকশ্রেণির দোসরদের হত্যা করা হয়েছে। যেমন, ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব কিংবা ১৯৪৯ সালের চীনের বিপ্লবের পর বিপ্লবের শত্রুরা নিহত হয়। মার্ক্সবাদে বিপ্লবে হিংসার প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃত। ৫ আগস্টের পর ছাত্র-জনতা আইন হাতে তুলে নেয়নি। হিংসা পরিহার করে নতুন বাংলাদেশ নির্মাণে আত্মনিয়োগ করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের আগে ট্রাম্পকে দিয়ে মিথ্যা বিবৃতি করা হয়েছিল। এদেশে সংখ্যালঘু অত্যাচারের কাহিনি সম্পূর্ণ মিথ্যা। ৫ আগস্টের পর ভারত পানি ছেড়ে দিয়ে বন্যার সৃষ্টি করে। ফলে বিপ্লবের নেতা-কর্মী ত্রাণ বিতরণ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। একই সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের জীবন ও মালামাল রক্ষার জন্য দেশনায়ক তারেক রহমান নির্দেশ দিলে মানুষ সতর্ক হয়। বিপ্লবের পর মনে হয়েছিল হাসিনার দোসরদের মেরে ফেলা হবে কিন্তু বাস্তবে বিজয় ছিল জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে। ৫ আগস্ট মানুষ বাঁচানোর প্রত্যয়ে আবির্ভূত হয় বিপ্লবীরা। ৭ আগস্ট তারেক রহমান নেতা-কর্মীকে ধর্মীয় পরিচয় যাইহোক ধর্ম-বর্ণ-নির্বেশেষ মানুষের পাশে ঢাল হয়ে থাকার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নৈরাজ্যকারীরা ষড়যন্ত্রকারীÑ এই কথা প্রচার হবার পর স্বাভাবিকভাবে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
দেশনায়ক তারেক রহমানের কথা অনুসারে এদেশ সম্প্রীতির দেশ। এ ভূখ- সকলের। দলমত নির্বিশেষ সকলের। বাংলাদেশের সঙ্গে পাশর্^বর্তী মুসলিম রাষ্ট্রের মধ্যে ঐক্য দরকার। চিন্তা-কর্ম ও অনুভূতির ঐক্য জরুরি। ভারতের আগ্রাসনকে মোকাবেলা করার জন্য ধর্মীয় অনুভূতির জায়গা থেকে মুসলিমরা এক ধরনের সাংস্কৃতিক বন্ধনে আবদ্ধ থেকে অন্যায়কে মোকাবেলা করতে পারে। যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমরা সম্প্রীতির মধ্যে বসবাস করে সেখানে তারা নিরাপদ ও ঐক্যবদ্ধ থাকলে ভারতের নির্যাতিত মুসলিমরা বেঁচে থাকার শক্তি ও সমর্থন পাবে। নিরাপত্তা ও স্বাধীনতাভাবে ধর্ম পালনে নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে মুক্তি পাবে। বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক বদরুদ্দীন উমর লিখিত ‘সাম্প্রদায়িকতা’ গ্রন্থটি পাঠ করলে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম জনগোষ্ঠীর অবস্থা জানা যাবে। ট্রাম্পের ধর্মীয় নিপীড়নের মন্তব্য বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের ক্ষেত্রেও বেশি প্রযোজ্য।
৫.
মাইকেল কুগেলম্যানের মন্তব্যের সূত্র ধরে আরো বলা যায়, আমেরিকা সব দিকেই নিজেদের স্বার্থ বা প্রয়োজনের দিকেই বেশি গুরুত্ব দেবেÑএটাই যাথার্থ। ব্যবসা-বাণিজ্য, কৌশলগত, ভূরাজনৈতিক, এমন নানা দিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের একটা সম্পর্কের আগ্রহের জায়গা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নিজে কে বাংলাদেশের উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে উল্লেখ করে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে এশিয়ার সংযোগস্থল এবং বঙ্গোপসাগরের সাথে থাকায় সেখানে ভূরাজনৈতিক একটা আগ্রহ রয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশকে ‘উঠতি বাজার’ বিবেচনায় ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের জায়গা অত্যধিক। উদাহরণ হিসেবে বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সরঞ্জাম, বোয়িং বিমান, গ্যাস বা এলএনজির কথা বলা যায়। এছাড়া বাংলাদেশের বহু মানুষ আমেরিকায় বসবাস করে, পড়াশোনা করতে যায়। মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও গুরুত্বের জায়গা রয়েছে, প্রযুক্তিগত দিক দিয়েও ক্রেডিট কার্ড বা কম্পিউটার ব্যবহার করতে গেলেও তাতে কোনও না কোনওভাবে যুক্তরাষ্ট্র লাভবান হয়। সবমিলে বলা চলে, ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে সমর্থ হবেন বলে জনগণ বিশ্বাস করে। পররাষ্ট্রনীতির দিক থেকে আগামীতে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহাসিক সম্পর্ক আরও জোরদার হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারস্পরিক সহায়তা আরও বৃদ্ধি পাবেÑ এটাই জনমানুষের প্রত্যাশা।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান এবং অধ্যাপক, থিয়েটার এন্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ঘোষণা করা হয়েছে মেলন মিউজিক অ্যাওয়ার্ড ২০২৪ - এর মনোনীতদের নাম
চীনে বহুতল ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত ৭
সরিষাবাড়ীতে বিএনপির বিশাল জনসভা - দেশপ্রেমের আহ্বান শামীম তালুকদারের
মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের ‘ধর্মযুদ্ধে’ নামতে বললেন মহারাষ্ট্রের উপমুখ্যমন্ত্রী
বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশে খেলাধুলার সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত করা হবে - মেজর হাফিজ।
৫ আগস্টের বিজয়ে তারেক রহমান পনেরো বছর ধরে নেতৃত্ব দিচ্ছেন
পুলিশকে জনগণের বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে: আইজিপি
নারায়ণগঞ্জে হরতালের সমর্থনে মিছিল
জুলাই-অগাস্ট অভ্যুত্থানে শহীদদের নামে উপজেলা পর্যায় হবে স্টেডিয়াম
বিশ্বজনতার নজর আমেরিকায় কেন?
অর্থনীতি ও নির্বাচনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে
হতাশ মুসলিম ভোটাররা
ঘুরে দাঁড়িয়ে মালদ্বীপকে হারাল বাংলাদেশ
বাইডেন প্রশাসনের নিন্দা জানালেন মার্কিন সিনেটর
অস্ট্রিয়ায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করছে রাশিয়া
চীনের নতুন মেগাপোর্ট উদ্বোধন
দ্বিগুণ সাহায্য চায় ভঙ্গুর দেশগুলো
গালওয়ান সীমান্ত নিয়ে বিভেদ ভুলে যাচ্ছে ভারত ও চীন
ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি নিয়ে ট্রাম্পকে যে আহ্বান জানাল হামাস
ব্রিটেনে পুরুষদের ফুসফুস ক্যান্সারের হার সর্বাধিক