কেমন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রয়োজন
০৩ মার্চ ২০২৫, ১২:০১ এএম | আপডেট: ০৩ মার্চ ২০২৫, ১২:০১ এএম

আমাদের দেশে ‘ইসলামী শিক্ষা’ কথাটি অস্পষ্টতার অন্ধকারে নিমজ্জিত। এদেশে ইসলামী শিক্ষা বলতে প্রচলিত প্রাচীন পদ্ধতির মাদরাসা শিক্ষাকেই বুঝানো হয়ে থাকে। সময়োপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা এখানে বলতে গেলে একেবারেই অনুপস্থিত। ফলে সমাজে উন্নতি ও মর্যাদা লাভের উদ্দেশ্যে সচেতন ও উচ্চ শিক্ষিত অভিভাবকগণ তাদের সন্তানদেরকে এ শিক্ষা দিতে রাজি হন না। বিপরীতে দেশে প্রবর্তিত আধুনিক শিক্ষাকেই আমরা আদর্শ শিক্ষা মনে করে থাকি, যদিও কোনো ইসলামপন্থী লোক সন্তুষ্টচিত্তে এ ধরনের শিক্ষাকে সমর্থন করেন না।
এমতাবস্থায় যারা ইহ ও পরজাগতিক জীবনে মর্যাদাশীল হতে চান, তারা এ দুটি শিক্ষাব্যবস্থার কোনোটিকেই পূর্ণাঙ্গ আদর্শশিক্ষা বলে স্বীকার করেন না। স্বাধীনতার পর অধিকাংশ সময় ধরে দেশটিকে শাসন করেছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ সরকার বিগত ১৭ বছরে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরুপে ধ্বংস করেছে। ফলে দেশের সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থায় সংকট চরমে পৌঁছেছে। এ সংকটাপন্ন অবস্থায় রাষ্ট্রের হাল ধরেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার কাছে এ শিক্ষাসংকট থেকে জাতি মুক্তির আশা করছে। মুক্তিলাভের এ আকঙ্ক্ষা থেকেই কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এ আলোচনার অবতারণা করছি।
প্রথমত, শিক্ষা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। প্রয়োজনীয় গুণাবলি ও জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় তাকেই শিক্ষা বলা যেতে পারে। আর এ ধরনের পরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থাপনা একমাত্র মানুষেরই প্রয়োজন। অন্যান্য জীব-জানোয়ারের জন্য এ ব্যবস্থার কোনো প্রয়োজন নেই।
দ্বিতীয়ত, মানুষের জন্য শিক্ষাব্যবস্থা রচনাকালে মানুষের সঠিক পরিচয়টিও জানা দরকার। মানুষ শুধু দেহসর্বস্ব জীব নয়। মানুষকে দেহসর্বস্ব জীব মনে করলে শিক্ষাব্যবস্থায় তাদের আত্মার বিকাশ লাভের কোনো বন্দোবস্তই থাকবে না। আবার মানুষের বস্তুগত প্রয়োজনের দিকটি উপেক্ষা করাও যাবে না। এটাকে উপেক্ষা করে একমাত্র আত্মিক উন্নতির উদ্দেশ্যে যে শিক্ষা পদ্ধতি গৃহীত হবে, তা মানুষের পক্ষে কল্যাণকর হওয়াও সম্ভব নয়।
মানুষ সৃষ্টিজগতের বহু রহস্য উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে এবং প্রত্যেক যুগেই বস্তুজগতের বিভিন্ন শক্তিকে নিজের উপকারে ব্যবহার করেছে। কিন্তু ওহীর জ্ঞান ব্যতীত কোনোকালেই মানুষ তার নিজের প্রকৃত পরিচয় লাভ করতে সক্ষম হয়নি। আধুনিক বিজ্ঞান মানুষকে এতো বিপুল শক্তির অধিকারী করেছে যে, মানুষ আজ পাখির চেয়েও দ্রুত উড়তে সক্ষম হয়েছে। এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে বিচরণের ক্ষমতাও তারা লাভ করেছে। কিন্তু ‘প্রকৃত মানুষ’ হিসেবে দুনিয়ায় জীবনযাপন করার উপযোগী শিক্ষা থেকে আধুনিক মানুষ বঞ্চিত রয়ে গেছে। ওহির জ্ঞান থেকে দূরে থাকার কারণে মানুষ নিজেকে ভালোভাবে চিনতে পারেনি। শুধু বিবেকবুদ্ধি প্রয়োগ করে মানুষ নিজেকে চিনতে চেষ্টা করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে। অথচ শুধু বিবেক দ্বারা মানুষ নিজেকে কখনও চিনতে পারবে না। আর এ কারণেই আল্লাহ নবীদের মাধ্যমে যুগে যুগে মানুষকে আত্মজ্ঞান দান করেছেন।
তাই মানুষের প্রকৃত পরিচয় পেতে হলে আমদেরকে কোরআনের দ্বারস্থ হতে হবে। কোরআন অন্যান্য জীবের সাথে মানুষের যে ব্যবধান নির্দেশ করে তা এই যে, ‘মানুষ নৈতিক জীব’ আর অন্যান্য জীব নৈতিকতার বন্ধন থেকে মুক্ত। ভালো ও মন্দ, সৎ ও অসৎ, সত্য ও মিথ্যার বিচার করার ক্ষমতা মানুষ ছাড়া আর কোনো জীবের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায় না। মিথ্যা বলা যার অভ্যাস সে মানুষটিও ‘মিথ্যা বলা অন্যায়’ বলে স্বীকার করে। কিন্তু তাকে মিথ্যুক বললে সে ক্ষেপে যায়। এই একই কারণে সে ‘মিথ্যুক’ উপাধিতে ভূষিত হতে পছন্দ করে না। ‘চুরি করা খারাপ’, এ কথা স্বীকার করে বলেই চোর প্রকাশ্যে চুরি না করে গোপনে চুরি করে। ভালোমন্দের এই বিচারজ্ঞানই মানুষকে অন্যান্য জীব থেকে পৃথক করেছে। যারা এই নৈতিক দিককে উন্নতি করার চেষ্টা করে না, কোরআন তাদেরকে পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট বলে আখ্যায়িত করেছে।
কোরআন হাত. পা, চোখ ও কানবিশিষ্ট শরীরটিকে প্রকৃত মানুষ মনে করে না। কোরআনের মতে, দেহ সৃষ্টির বহু পূর্বে মানুষ সৃষ্টি হয়েছে। কোরআনের পরিভাষায় সেই মানুষ হলো ‘রূহ’ বা আত্মা। এ আত্মাই নৈতিকতার আধার। আত্মাকে উন্নত করার ব্যবস্থা না করলে এ দেহ পশুর ন্যায় আচরণ করবে। দেহের যত সব বস্তুগত দাবি আছে তা পূরণের জন্য মানবদেহ সকল সময়ই মুখিয়ে থাকে। পেট খালি হলেই সে খাদ্যের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মানুষ সেই খাদ্য চুরি করে আনলো নাকি পরিশ্রম করে অর্জন করলো, সে বিষয়ে পেটের কোনো মাথাব্যাথা নেই। পেটের প্রয়োজন খাদ্য। অন্যায়ভাবে খাদ্য এনে দিলেও পেট নিশ্চিন্তে সেই খাদ্য খেতে থাকে। কিন্তু তখন রূহ এতে বাধা প্রদান করে। রূহ বলতে থাকে যে, কাজটা অন্যায় হচ্ছে। সুতরাং তুমি এটা খেওনা। কিন্তু দেহ আত্মার কথায় কর্ণপাত করে না। উভয়ের মধ্যে একটি যুদ্ধ চলতে থাকে। এভাবেই সৃষ্টিজগতে দেহ এবং আত্মার মাঝে বিশ্বমানের এক বিরাট যুদ্ধ চলমান রয়েছে। আত্মা ও দেহের মধ্যে অপেক্ষাকৃত যে শক্তিশালী হবে সেই এ যুদ্ধে বিজয়ী হবে।
দেহ যদি অসুস্থ হয় তাহলে তার চাহিদা ক্ষীণ হয়ে পড়ে। অসুস্থ দেহ তার আকর্ষণীয় বস্তুর দিকে আর ধাবিত হতে পারে না। তেমনি বিবেক অসুস্থ হলেও তার অপরাধবোধ হ্রাস পায়। পাপ করেও তার মধ্যে অনুশোচনা জাগ্রত হয়না। উল্টো সে চাপাবাজি ও ধান্ধাবাজিতে সক্রিয় হয়ে পড়ে। এভাবে বারে বারে সে বিবেকের বিরুদ্ধে চলতে চলতে তার বিবেকশক্তি একেবারেই লোপ পায়। একসময় সে নিজেকে পশুর পর্যায়ে নিয়ে যায়। তখন পরিবার, সমাজ এবং দেশ ভয়ানকভাবে ক্ষতির মুখে নিপতিত হয়। দেশে তখন রুচির দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ে। সমাজ, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের বিনাশ সাধিত হয়। আমাদের বর্তমান সমাজের প্রতিচ্ছবি এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। এমতাবস্থায় মানব প্রজন্মের সুষ্ঠু বিকাশ সাধনে দেহ ও আত্মার সমন্বয় সাধন একান্ত প্রয়োজন। এ সমন্বিত কাঠামোর উপরই মানব জীবনের পরিপূর্ণ শান্তি ও নিরাপত্তা নির্ভর করছে।
মানুষকে যারা আত্মাবিহীন এক জড় পদার্থ মনে করেন, তারা শিক্ষাব্যবস্থাকে তৈরি করার বেলায় মানুষের শুধু বস্তুগত প্রয়োজনকে গুরুত্ব দেয়। এ ব্যবস্থায় মানুষের প্রকৃত পরিচয়কে উপেক্ষা করা হয়। ফলে তারা মানুষকে অন্যান্য জীবের ন্যায়ই দেহসর্বস্ব জীব মনে করে এবং সেভাবেই মানব জাতির শিক্ষা কারিকুলাম তৈরি করে। পাশ্চাত্য সভ্যতা মানুষকে দেহসর্বস্ব একটি জীব মনে করে থাকে। তারা ধর্মনিরপেক্ষ ও খোদাবিমুখ বলেই আত্মাকে চেনার সুযোগ পায়না। তারা মানুষকে আত্মাপ্রধান হিসেবে বিবেচনা করেনা। আর এ কারণেই ডারউইনরা মানুষকে বানরের উন্নত সংস্করণ প্রমাণ করার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে। এ মতাদর্শে বিশ্বাসীরা মানুষকে অন্যান্য পশুর ন্যায় গড়ে তুলবার উপযোগী শিক্ষা কারিকুলাম তৈরি করেছে বারবার। বিগত ১৭ বছর যাবত বাংলাদেশে এ জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা জাতির উপর চাপিয়ে দিয়েছিল ডারউইনের অনুসারীরা। এ শিক্ষা দ্বারা বাংলাদেশে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটেনি। ফলে তাদের পতনের পরেও দেশের সর্বক্ষেত্রে অস্থিরতা কাজ করছে। চারিদিকে আমরা তাদের পশুত্বের বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাচ্ছি।
বিপরীতে যারা মানুষকে শুধুমাত্র আত্মসর্বস্ব মনে করেন অথবা যারা জৈবিক প্রয়োজনের দিকে মনোযোগ দেন না, তারা কেবল আধ্যাত্মিক উন্নতির উদ্দেশ্যে শিক্ষার প্রচলন করেছেন। তাঁরাও মানুষের উপযোগী প্রকৃত শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। এ শিক্ষা মানুষকে যতই খোদাভীরু ও ধর্মপ্রাণ হওয়ার অনুপ্রেরণা দান করুক না কেন, বাস্তব জীবনে বস্তুগত প্রয়োজনের তাগিদ তাকে ঈমানের বিপরীত পথে ঠেলে দিচ্ছে। এই প্রকার শিক্ষাও মানুষের স্বভাবের বিপরীত। তাই যে শিক্ষা মানুষের আত্মা ও দেহকে এক সুন্দর সামঞ্জস্যময় পরিণতিতে পৌঁছিয়ে এ জগতের রূপ-রস-গন্ধকে নৈতিকতার সীমার মধ্যে উপভোগ করার যোগ্যতা দান করে, সেই শিক্ষাই মানুষের প্রকৃত শিক্ষা। যে শিক্ষা প্রাকৃতিক শক্তিসমূহকে মানবতার উন্নতি ও নৈতিকতার বিকাশে প্রয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করে, তাই মানুষের উপযোগী শিক্ষা। আর জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উন্নতি দান করা সত্ত্বেও যে শিক্ষা মনুষ্যত্ব ও আত্মার উন্নতিকে ব্যাহত করে তা প্রকৃতপক্ষে মানব-ধ্বংসী শিক্ষা, তাকে কিছুতেই মানুষের উপযোগী শিক্ষা বলা চলে না।
সুতরাং বর্তমানে সময়োপযোগী একটি শিক্ষা ব্যবস্থার রূপরেখা জাতির সামনে পেশ করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। শিক্ষাব্যবস্থাপনা কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে দেশবাসীরও সুস্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। এতদসম্পর্কিত একটি শিক্ষা কারিকুলাম জাতির কাছে উপস্থাপন করা সময়ের দাবি।
লেখক: অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

পাবনায় চররে জমি দখল নিয়ে সংর্ঘষে গুলবিদ্ধি ৫

আইএমএফের ঋণের কিস্তি নিয়ে আশাবাদী বাংলাদেশ

মার্কিন উচ্চশিক্ষার চরম পতন

পরিশুদ্ধ-পরিবর্তিত বিএনপিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আনতে হবে-সাহাদাত হোসেন সেলিম

গাজায় ইহুদী হামলায় ৬০ ফিলিস্তিনি শহীদ

জাতিসংঘের দুটি আঞ্চলিক সংস্থায় নির্বাচিত হলো বাংলাদেশ

রাজনৈতিক দল গঠন এখন ছেলেখেলা!

সাভারে অজ্ঞাত নারীর অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

নর্থ সাউথে ভর্তি পরীক্ষা দিলেন উপদেষ্টা আসিফ

কোরআনবিরোধী নারী সংস্কার প্রস্তাবনা দেশের জন্য হুমকি স্বরূপ

পাকিস্তান-ভারতকে ‘সর্বোচ্চ সংযম’ দেখাতে বলল জাতিসংঘ

‘সর্বাত্মক যুদ্ধের’ হুঁশিয়ারি পাকিস্তানের

নারী কমিশনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে

তারেক রহমান ‘নিয়তির সন্তান’

অতিদারিদ্র্য বৃদ্ধির শঙ্কা

২৪ ঘন্টায় গ্রেফতার ১০৭২ আ’লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ৫ নেতা গ্রেফতার

পারভেজ হত্যা মামলায় প্রধান আসামি মেহেরাজ রিমান্ডে

আ.লীগের ধর্ম বিষয়ক উপকমিটির সদস্য সন্তোষ কুমার রিমান্ডে

চট্টগ্রামে পেট্রোল বোমায় দগ্ধ মহিলার মৃত্যু

রাজধানীর প্রধান সড়কে ব্যাটারি রিকশা বন্ধের দাবি মোটরসাইকেল চালকদের