জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ

Daily Inqilab ইনকিলাব

০৩ মার্চ ২০২৫, ১২:০১ এএম | আপডেট: ০৩ মার্চ ২০২৫, ১২:০১ এএম

‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’ নামে নতুন একটি দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে গত শুক্রবার। দেশে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা অনেক। তারপরও নতুন একটি দলের আবির্ভাবকে সবাই স্বাগত জানিয়েছে। এই দল ছাত্রদের দল, তরুণদের দল হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, অংশ নিয়েছেন, সেই ছাত্র-তরুণদের একাংশ এ দল গঠন করেছেন। যারা দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট শাসন উৎখাতে করেছেন, ঘৃণ্যতম ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাসহ তার সাঙ্গপাঙ্গদের পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছেন, সেই ছাত্র-জনতার তরুণ নেতাদের দ্বারা গঠিত দলের প্রতি মানুষের সহানুভূতি থাকা স্বাভাবিক। দলের আহ্বায়ক যিনি নির্বাচিত হয়েছেন সেই নাহিদ ইসলামের বয়স মাত্র ২৬ বছর। নাহিদ ইসলাম অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য ছিলেন। তিনি উপদেষ্টার পদ ছেড়ে দিয়ে নতুন দলের প্রধানের দায়িত্ব নিয়েছেন। বলা বাহুল্য, তারুণ্যের উচ্ছ্বাস, প্রাণশক্তি ও গৌরবজনক অতীত দলটির সম্বল। বিশ্বের সবদেশে সবকালে আন্দোলন-সংগ্রাম, পরিবর্তন-অভ্যুত্থান, বিপ্লব ইত্যাদির ক্ষেত্রে তরুণরাই নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছেন। আমাদের দেশেও ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৯’র গণ আন্দোলন, ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ, ৯০’র গণআন্দোলন এবং ২০২৪’র গণঅভ্যুত্থান তরুণরাই সংঘটিত করেছেন, নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে অতীতে তরুণরা কখনো রাজনৈতিক দল গঠনের চিন্তা করেননি। এবারই ব্যতিক্রম এবং তা অভিনন্দনযোগ্য। দলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দলের নেতারা বিভেদ-বিভাজনের রাজনীতি পরিহার করে ঐক্যের রাজনীতির অঙ্গীকার করেছেন। সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সংবিধান প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত করেছেন। ভেঙ্গে পড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রতিজ্ঞা করেছেন। পুরনো রাজনৈতিক বন্দোবস্তের স্থলে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মাধ্যমে গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সোচ্চার হয়েছেন। নতুন দলের স্লোগান হলো: ‘স্টুডেন্ট ফার্স্ট, বাংলাদেশ ফার্স্ট’। এর সঙ্গে ১৯৭৮ সালে বিএনপি প্রতিষ্ঠার সময় ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ’, স্লোগানের কথা স্মরণযোগ্য। দলের পক্ষে বলা হয়েছে, নতুন দল মধ্যপন্থা অনুসরণ করবে। ধর্মীয় মূল্যবোধের পরিপন্থী কিছু দলের রাজনীতিতে থাকবে না।

নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠা কিংবা সেকেন্ড রিপাবলিক কায়েমের ক্ষেত্রে নতুন দল কতটা সফল হবে, নতুন সংবিধান প্রণয়নেও বা কতদূর কী করতে পারবে, তা নিয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। তবে পুরানো রাজনীতির ধারা ও শাসন ব্যবস্থার যে ব্যাপক সংস্কার ও পরিবর্তন দরকার, তাতে সন্দেহ নেই। অন্যদিকে সংবিধান ইচ্ছামত কাটাছেঁড়া হওয়ার কারণে এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, তা আগাপাছতলা সংস্কার বা সম্পূর্ণ নতুন করে রচনা করার তাকিদও উচ্চারিত হরয়েছে। বলা হয়ে থাকে, ফ্যাসিবাদের উত্থান ও প্রতিষ্ঠার যাবতীয় অনুকূল ব্যবস্থা সংবিধানের মধ্যেই রয়েছে। এমতাস্থায়, গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মানবাধিকার, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে এই সংবিধান রেখে তা হবে না। রাজনীতি, শাসন, সংবিধান ইত্যাদির ইতিবাচক পরিবর্তন জাতি ও জনগণের আকাক্সক্ষার অপরিহার্য অংশও বটে; তবে তা কোনো দল বিশেষের পক্ষ থেকে চাইলেই হবে না। এ ব্যাপার দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার, ঐকমত্য লাগবে। আশার কথা, এক্ষেত্রে একটি সাধারণ রাজনৈতিক ঐকমত্য আছে। কিন্তু তার খুঁটিনাটি নিয়ে কাজ করা এবং সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নেয়া এবং সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা খুব সহজ ও স্বল্প সময়ের ব্যাপার নয়। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী সমন্বয়করা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করবে, এ রকম তথ্য চাউর হওয়ার পর থেকেই বিষয়টি বিভিন্ন মহলে আলোচনায় এসেছে। অনেকে জোর সমর্থন করেছে, অনেকে নিম সমর্থন করেছে, বিরোধিতা তেমন একটা দেখা যায়নি। এটি দলটির পথচলার জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক। তবে, এ কথা মনে রাখতে হবে, দল গঠন করা যতই সহজ হোক, দল চালানো, জনপ্রিয়তা অর্জন করা, তৃণমূলে প্রতিষ্ঠা পাওয়া এবং চূড়ান্ত লক্ষ্য- ক্ষমতায় যাওয়া মোটেই সহজ নয়। দলের সুনির্দিষ্ট আদর্শ, লক্ষ্য ও জনবান্ধব কর্মসূচি এর জন্য আবশ্যক ও জরুরি। দলের বিকাশ-বিস্তার ও প্রিয়তার জন্য নেতাকর্মীদের ক্লিন ইমেজের প্রয়োজনীয়তাও অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে প্রধান শর্ত হচ্ছে সততা, সচ্চরিত্রতা এবং সর্বপ্রকার দুষকর্ম ও দুর্নীতি থেকে মুক্ত থাকা। দুঃখজনক হলে বলতে হচ্ছে, ছাত্র সমন্বয়কদের একাংশের বিরুদ্ধে নিয়োগ-বদলি বিশেষ করে ডিসি নিয়োগে তদবির, চাঁদাবাজি, চাপসৃষ্টি, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও বিভিন্ন অনৈতিক কাজকর্মের অভিযোগ উঠেছে। দুর্নীতি, দুষ্কৃতি, চাঁদাবাজি, তোলাবাজি, অর্থ আত্মসাৎ ও পাচার ইত্যাদি পতিত স্বৈরাচারের বৈশিষ্ট্য ছিল। বিএনপির নেতাকর্মীদের কেউ কেউ দখলবাজি, চাঁদাবাজি ইত্যাদিতে এর মধ্যেই লিপ্ত হয়ে পড়েছেন। ছাত্র-সমন্বয়কদের বিরুদ্ধেও যদি অনুরূপ অভিযোগ ওঠে, তবে তরুণ নেতৃত্বের প্রতি গণআস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে কি?

অভিযোগ উঠেছে, জাতীয় নাগরিক পার্টি গঠনের পেছনে অন্তর্বর্তী সরকারের সায় ও সমর্থন রয়েছে। কোনো কোনো উপদেষ্টার মদদও আছে। এর আগে দলের প্রাথমিক কাজকর্মে কোনো কোনো উপদেষ্টার অংশ নিতেও দেখা গেছে। প্রধান উপদেষ্টা একদা বলেছিলেন, ছাত্ররাই তার নিয়োগদাতা। ছাত্রদের নতুন দল গঠনের প্রশ্নেও তিনি ইতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করেছেন। দলের আত্মপ্রকাশ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঢাকায় লোক আনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অন্তত একটি জেলা থেকে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে যে, লোকজন আনার জন্য সরকারিভাবে বাস রিকুইজিশন করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব এ প্রসঙ্গে বলেছেন, বাস রিকুইজিশনে সাহায্য করলেও কোনো খরচ দেয়নি জেলা প্রশাসন। ঘটনা যাই হোক, এটা কোনো ভালো নজির হয়নি। নতুন এই দলকে অনেকে কিংস পার্টির সঙ্গে তুলনা করছেন। এই তুলনা সরকার ও দল- কারো জন্যই ইতিবাচক পারসেপশান তৈরি করে না। অন্তর্বর্তী সরকার দল নিরপেক্ষ, অরাজনৈতিক। এই বৈশিষ্ট্য তাকে রক্ষা করতে হবে। ইতেমধ্যেই এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিষয়টি প্রধান উপদেষ্টাকে দেখতে হবে এবং সরকারের দলনিরপেক্ষতা রক্ষা করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক অভিলাস থাকা উচিৎ নয়। যে অভিযোগ উঠেছে তা নিরসনের দায়িত্বও সরকারকেই নিতে হবে। অন্যদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতৃবৃন্দকেও স্মরণ রাখতে হবে, কিংস পার্টির ট্যাগ তাদের দলের গায় যেন না লাগে। লাগলে দলের বিকাশ, প্রতিষ্ঠা ও জনপ্রিয়তা বাধাগ্রস্ত হবে। একই সঙ্গে দলের ও নেতৃবৃন্দের ক্লিন ইমেজের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। কোনোভাবেই যেন তাতে কালিমা না পড়ে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

ছোট দলগুলোর ভবিষ্যৎ
ভারতের সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র
ভারতের নতুন ওয়াকফ আইন অন্যায্য ও অযৌক্তিক
পাকিস্তান-ভারতের উত্তেজনা কমাতে পারস্পরিক আলোচনা জরুরি
পোলট্রিশিল্প রক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে
আরও
X

আরও পড়ুন

পাবনায় চররে জমি দখল নিয়ে সংর্ঘষে গুলবিদ্ধি ৫

পাবনায় চররে জমি দখল নিয়ে সংর্ঘষে গুলবিদ্ধি ৫

আইএমএফের ঋণের কিস্তি নিয়ে আশাবাদী বাংলাদেশ

আইএমএফের ঋণের কিস্তি নিয়ে আশাবাদী বাংলাদেশ

মার্কিন উচ্চশিক্ষার চরম পতন

মার্কিন উচ্চশিক্ষার চরম পতন

পরিশুদ্ধ-পরিবর্তিত বিএনপিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আনতে হবে-সাহাদাত হোসেন সেলিম

পরিশুদ্ধ-পরিবর্তিত বিএনপিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আনতে হবে-সাহাদাত হোসেন সেলিম

গাজায় ইহুদী হামলায় ৬০ ফিলিস্তিনি শহীদ

গাজায় ইহুদী হামলায় ৬০ ফিলিস্তিনি শহীদ

জাতিসংঘের দুটি আঞ্চলিক সংস্থায় নির্বাচিত হলো বাংলাদেশ

জাতিসংঘের দুটি আঞ্চলিক সংস্থায় নির্বাচিত হলো বাংলাদেশ

রাজনৈতিক দল গঠন এখন ছেলেখেলা!

রাজনৈতিক দল গঠন এখন ছেলেখেলা!

সাভারে অজ্ঞাত নারীর অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

সাভারে অজ্ঞাত নারীর অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার

নর্থ সাউথে ভর্তি পরীক্ষা দিলেন উপদেষ্টা আসিফ

নর্থ সাউথে ভর্তি পরীক্ষা দিলেন উপদেষ্টা আসিফ

কোরআনবিরোধী নারী সংস্কার প্রস্তাবনা দেশের জন্য হুমকি স্বরূপ

কোরআনবিরোধী নারী সংস্কার প্রস্তাবনা দেশের জন্য হুমকি স্বরূপ

পাকিস্তান-ভারতকে ‘সর্বোচ্চ সংযম’ দেখাতে বলল জাতিসংঘ

পাকিস্তান-ভারতকে ‘সর্বোচ্চ সংযম’ দেখাতে বলল জাতিসংঘ

‘সর্বাত্মক যুদ্ধের’ হুঁশিয়ারি পাকিস্তানের

‘সর্বাত্মক যুদ্ধের’ হুঁশিয়ারি পাকিস্তানের

নারী কমিশনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে

নারী কমিশনের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে

তারেক রহমান ‘নিয়তির সন্তান’

তারেক রহমান ‘নিয়তির সন্তান’

অতিদারিদ্র্য বৃদ্ধির শঙ্কা

অতিদারিদ্র্য বৃদ্ধির শঙ্কা

২৪ ঘন্টায় গ্রেফতার ১০৭২ আ’লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ৫ নেতা গ্রেফতার

২৪ ঘন্টায় গ্রেফতার ১০৭২ আ’লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ৫ নেতা গ্রেফতার

পারভেজ হত্যা মামলায় প্রধান আসামি মেহেরাজ রিমান্ডে

পারভেজ হত্যা মামলায় প্রধান আসামি মেহেরাজ রিমান্ডে

আ.লীগের ধর্ম বিষয়ক উপকমিটির সদস্য সন্তোষ কুমার রিমান্ডে

আ.লীগের ধর্ম বিষয়ক উপকমিটির সদস্য সন্তোষ কুমার রিমান্ডে

চট্টগ্রামে পেট্রোল বোমায় দগ্ধ মহিলার মৃত্যু

চট্টগ্রামে পেট্রোল বোমায় দগ্ধ মহিলার মৃত্যু

রাজধানীর প্রধান সড়কে ব্যাটারি রিকশা বন্ধের দাবি মোটরসাইকেল চালকদের

রাজধানীর প্রধান সড়কে ব্যাটারি রিকশা বন্ধের দাবি মোটরসাইকেল চালকদের