রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরানো নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রচেষ্টা

Daily Inqilab ইনকিলাব

১৬ মার্চ ২০২৫, ১২:০২ এএম | আপডেট: ১৬ মার্চ ২০২৫, ১২:০২ এএম

গত শুক্রবার কক্সবাজারের উখিয়ায় শরণার্থী শিবিরে প্রায় এক লাখ রোহিঙ্গার সাথে ইফতারে যোগ দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও সফররত জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, রোহিঙ্গারা যেন আগামী বছর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে তাদের নিজ বাড়িতে ফিরে গিয়ে ঈদ উদযাপন করতে পারে, সে লক্ষ্যে জাতিসংঘের সাথে সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে তার সরকার। আন্তেনিও গুতেরেস বলেছেন, এবারের সফরে আমি দুটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা পেয়েছি। প্রথমত, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায়। তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সার্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে, যাতে মিয়ানমারে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং তাদের অধিকার সুরক্ষিত থাকে। অতীতে তারা যে নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হয়েছে, তা দূর করে তাদের মর্যাদা নিশ্চিত করা জরুরি। দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গারা ক্যাম্পে আরো ভালো জীবনযাত্রার সুযোগ চায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা তাদের খাদ্য নিরাপত্তাকে চরম ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। এ সংকট মোকাবেলায় আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং আন্তেনিও গুতেরেসের কথা থেকে এটা স্পষ্ট, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরাতে ও তাদের জীবনযাপন উন্নত করতে তারা আন্তরিক এবং এতে আন্তর্জাতিক সহায়তা ও উদ্যোগ জরুরি।

রোহিঙ্গা সংকট কোনো স্থানীয় বা আঞ্চলিক নয়। এটি আন্তর্জাতিক সংকট। মিয়ানমারের জান্তা সরকার ও উগ্র বৌদ্ধরা ২০১৭ সালে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের উপর ভয়াবহ হত্যা, নির্যাতন, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া, উচ্ছেদ করে দেশ থেকে বিতাড়িত করে। তাদের সাংবিধানিক, নাগরিক, রাজনৈতিক অধিকার আগেই কেড়ে নেয়া হয়। প্রায় দশ লাখের বেশি রোহিঙ্গা সে সময় বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। মানবিক কারণে বাংলাদেশও তাদের আশ্রয় দেয়। এরপর থেকে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরানো নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করলেও তাতে কোনো কাজ হয়নি। এ নিয়ে বহু দেনদরাবারও হয়। মিয়ানমারের জান্তা সরকার তা থোরাই কেয়ার করে। অন্যদিকে, বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার ভরণ-পোষণ, স্থান সংকুলান, নিরাপত্তা বিধান ও সার্বিক ব্যবস্থাপনা করতে গিয়ে বাংলাদেশের হিমশিম খেতে হচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে বাড়তি চাপের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের খাদ্যসহ অন্যান্য খরচ যোগান দিলেও বাংলাদেশের জন্য বাড়তি দশ লাখের বেশি লোকের স্থান দেয়া ও ব্যবস্থাপনা করা যথেষ্ট চাপের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। রোহিঙ্গাদের কেন্দ্র করে অনেক দেশি-বিদেশি এনজিও সেখানে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। জাতিসংঘের হয়ে যারা কাজ করছেন, তারাও কক্সবাজারের বিভিন্ন ফাইভ স্টার ও উন্নত হোটেলে মাসের পর মাস রাজার হালে থাকছেন। এতে জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ দেয়, তার বড় একটি অংশ এই প্রতিনিধিদের বিলাসবহুল জীবনযাপনের পেছনে ব্যয় হয়ে যায়। এতে রোহিঙ্গাদের সহযোগিতায় ঘাটতি দেখা দেয়। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের কিছু দেশ রোহিঙ্গাদের সহায়তামূলক বরাদ্দ কমিয়ে দেয়ায় তাদের ভরণপোষণ এখন আরও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। বাংলাদেশ এমনিতেই অর্থনৈতিক সংকটে রয়েছে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক এই সংকট প্রকট হয়ে উঠলে বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে। আমরা মনে করি, রোহিঙ্গাদের দেখাশোনা করার জন্য বিদেশিদের এখানে পাঠানোর প্রয়োজন নেই। আমরাই রোহিঙ্গাদের শৃঙ্খলার মধ্যে রেখে সার্বিক ব্যবস্থাপনার কাজ করতে সক্ষম। রোহিঙ্গাদের জন্য দরকার প্রকৃত ও পর্যাপ্ত সহায়তা যাতে তারা নির্ভার ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারে।

রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরানো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য প্রভাবশালী দেশ বিগত প্রায় ছয় বছর ধরে বহু বড় বড় কথা বলেছে। হুমকি-ধমকিও দিয়েছে। তাতে মিয়ানমার কোনো রা করেনি। ফলে তাদের হুংকার কেবল লিপসার্ভিসে পরিণত হয়েছে। এখন এ নিয়ে একেবারেই চুপ মেরে আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শরনার্থী হওয়া সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না কেন? এভাবে আর কতকাল একটা জাতি-গোষ্ঠী অস্তিত্ব সংকটে থাকবে? আন্তর্জাতিক মহলের মানবাধিকার ঢংকা কোথায় গেল? জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তেনিও গুতেরেস সফরে এসে নিজ চোখে রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতি দেখেছেন এবং বুঝেছেন। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, তিনি এ ব্যাপারে কি পদক্ষেপ নেন। বিশ্ব সম্প্রদায়কে কিভাবে সংকট সমাধানে উদ্যোগী করেন। আমরা আশাবাদী, ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গুতেরেস একমত হয়ে রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরানোর যে কথা বলেছেন, তা শিঘ্রই বাস্তবায়নের সূচনা রেখা দেখা যাবে। তবে রোহিঙ্গাদের শুধু ফেরানোর জন্য ফেরানো যাবে না। তারা যাতে মিয়ানমারের নাগরিক, সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক অধিকারসহ সকল রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা লাভ করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরানোর সকল বন্দোবস্ত করা। জাতিসংঘ, ওআইসি, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশ ও সংস্থাকে এ ব্যাপারে আরো সক্রিয় হতে হবে।

 


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

নানা ইস্যু সামনে এনে মাঠ গরমের চেষ্টা
বদর যুদ্ধের তাৎপর্য ও শিক্ষা
মিছিল-সমাবেশ প্রসঙ্গে হাইকোর্টের নির্দেশনা
জুসের নামে আমরা কী খাচ্ছি?
দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগে অর্থপাচার
আরও
X

আরও পড়ুন

পি কে হালদারের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের নির্দেশ

পি কে হালদারের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধের নির্দেশ

রমজানে পুরান ঢাকায় ইফতারির পাশাপাশি ভিড় থাকে স্থাপত্য দর্শনেও

রমজানে পুরান ঢাকায় ইফতারির পাশাপাশি ভিড় থাকে স্থাপত্য দর্শনেও

নারায়ণগঞ্জে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ডিবি পরিচয়ে কোটি টাকা ছিনতাই

নারায়ণগঞ্জে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ডিবি পরিচয়ে কোটি টাকা ছিনতাই

ধর্ষণ ও নির্যাতন রোধে দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত করুন: টিআইবি

ধর্ষণ ও নির্যাতন রোধে দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত করুন: টিআইবি

এসএসসি-দাখিল পরীক্ষায় বসছে ১৯ লাখ শিক্ষার্থী

এসএসসি-দাখিল পরীক্ষায় বসছে ১৯ লাখ শিক্ষার্থী

স্ত্রী-সন্তানসহ পাপন ও হানিফের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

স্ত্রী-সন্তানসহ পাপন ও হানিফের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

মেঘনা ব্যাংকের নতুন চেয়ারপারসন উজমা চৌধুরী

মেঘনা ব্যাংকের নতুন চেয়ারপারসন উজমা চৌধুরী

হাসিনার আস্থাভাজন সচিব ও আমলাদের অপসারণ দাবিতে বিক্ষোভ

হাসিনার আস্থাভাজন সচিব ও আমলাদের অপসারণ দাবিতে বিক্ষোভ

জুলাই বিপ্লবে শহীদ এবং আহত ৮৫০ পরিবারের পাশে দাঁড়াবে জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন

জুলাই বিপ্লবে শহীদ এবং আহত ৮৫০ পরিবারের পাশে দাঁড়াবে জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন

জুলাই পরবর্তী বাংলাদেশের শঙ্কা উত্তরণে ফ্যাসিস্টদের অপতৎপরতা রুখতে হবে

জুলাই পরবর্তী বাংলাদেশের শঙ্কা উত্তরণে ফ্যাসিস্টদের অপতৎপরতা রুখতে হবে

কৃষি বিপ্লব ঘটিয়ে দেশে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে বিএনপি -কৃষকদলের আলোচনা সভায় বক্তারা

কৃষি বিপ্লব ঘটিয়ে দেশে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করবে বিএনপি -কৃষকদলের আলোচনা সভায় বক্তারা

বেপরোয়া গাড়ি চাপায় নারীর মৃত্যু

বেপরোয়া গাড়ি চাপায় নারীর মৃত্যু

অবাধ নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতায় যাবে প্রিন্স

অবাধ নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপি ক্ষমতায় যাবে প্রিন্স

কলাপাড়ায় স্কুলছাত্রীর রহস্যজনক মৃত্যু

কলাপাড়ায় স্কুলছাত্রীর রহস্যজনক মৃত্যু

রাজবাড়ীতে নারী ও শিশু নির্যাতনের প্রতিবাদ

রাজবাড়ীতে নারী ও শিশু নির্যাতনের প্রতিবাদ

মেডিক্যাল কলেজ বন্ধের ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ

মেডিক্যাল কলেজ বন্ধের ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ

জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক জুনায়েদের নেতৃত্বে আসছে নতুন রাজনৈতিক দল

জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক জুনায়েদের নেতৃত্বে আসছে নতুন রাজনৈতিক দল

দখলে-দূষণে অস্তিত্ব সঙ্কটে কুমার নদ

দখলে-দূষণে অস্তিত্ব সঙ্কটে কুমার নদ

ধামরাইয়ে বেপরোয়া মাটি ব্যবসায়ীরা

ধামরাইয়ে বেপরোয়া মাটি ব্যবসায়ীরা

চিলমারী-রৌমারী রুটে ৯০ দিন ফেরি বন্ধ

চিলমারী-রৌমারী রুটে ৯০ দিন ফেরি বন্ধ