মাওলানা মুহিউদ্দিন খান : তার অবিস্মরণীয় অবদান
২০ মার্চ ২০২৫, ১২:২৫ এএম | আপডেট: ২০ মার্চ ২০২৫, ১২:২৫ এএম

১৯ রমজান, ইংরেজি ২০১৬ সাল। সারাদিন খুব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে গ্রীণ রোডের একটি হাসপাতালে পরিবারের সবাই বসে আছি। আসরের নামাজ জামাতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মামাদের ডাক এলো আইসিউতে। আইসিওর বেডে শুয়ে আছেন অর্ধশতাব্দী ধরে ইসলামের খেদমত করা জীবন্ত কিংবদন্তি মাওলানা মুহিউদ্দিন খান (রহ.)। যন্ত্রের হার্টবিটের দিকে আমরা তাকিয়ে জোরে জোরে কালেমা পড়ছিলাম। ঠিক মাগরিবের আগ মুহূর্তে যন্ত্রটি স্টপ হয়ে গেল। চিকিৎসক তাঁর হাত ধরে বললেন, তিনি আর নেই। সেই সময় হাসপাতালে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটলো। বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম আমরা সবাই। আমাদের পরিবারে বটবৃক্ষ, দেশ ও জাতির বটবৃক্ষ মাওলানা মুহিউদ্দিন খান আর নেই। মুহূর্তে সারাদেশে খবর ছড়িয়ে পড়লো। হাসপাতাল ছুটতে আসতে শুরু করলেন বিশ্ব বরেণ্য আলেমে দ্বীনের অসংখ্য ভক্তানুরাগী। আমার সৌভাগ্য মাওলানা মুহিউদ্দিন খান (রহ.) এর রক্তের ধারায় পৃথিবীতে মহান আল্লাহ আমাকে পাঠিয়েছেন। দেখতে দেখতে কীভাবে নয় বছর কেটে গেল তিনি আর আমাদের মাঝে নেই।
বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী এই মানুষটির কথা কে না জানে। তার অবদান সম্পর্কেও কমবেশি সবার জানা। তাফসিরে মাআরিফুল কুরআনের অনুবাদ লিখে সবার মাঝে বেশ বড়সড় জায়গা করে নিয়েছেন। রাজনীতি ও লেখালেখির প্লাটফর্মে সমান তালে হেঁটেছেন জীবন-বিপ্লবের বাঁকে বাঁকে। মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের জন্ম ৭ বৈশাখ ১৩৪২ বাংলা, জুমার আজানের সময় ময়মনসিংহের মাতুলালয়ে। ইসলামি সাহিত্য ও সাংবাদিকতা জগতে তিনি জীবন্ত কিংবদন্তি। বাংলা ভাষায় সিরাত চর্চার প্রবর্তক, মাআরেফুল কুরআনের অনুবাদ, ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো দুষ্প্রাপ্য ও উচ্চাঙ্গের কিতাবাদি সহজ-সরল, সাবলীল ভাষায় সবার বোধগম্য করে প্রকাশ করে তিনি আমাদের কাছে দূর আকাশের দীপিত তারকা হয়ে আছেন। এছাড়া বংলাদেশের ইসলামি রাজনীতি, তাহজিব তামাদ্দুনের তিনি ছিলেন পুরোধা।
মাওলানা মহিউদ্দীন খান ছিলেন সমকালীন মুসলিম মনীষাদের অন্যতম, যার প্রতিটি কথা হয় গ্রন্থিত। জীবনের প্রতিটি দিক একেক ইতিহাস। প্রতিটি বক্তৃতা সংকলিত। রচিত পুস্তক হয় চিরন্তন সাহিত্য। চিন্তার প্রতিটি ক্ষণ হয়ে উঠে দিব্যদৃষ্টির বার্তা। উপলব্ধি ও মূল্যায়ন হয় ইতিহাসের আক্ষরিক পথ নির্দশন। লেখনি ও সম্পাদনার কাজে তিনি এগিয়ে গিয়েছেন বহুবিস্তৃত দূর সীমানায়। সম্পাদনা করেছেন মাসিক মদীনা। সম্পাদিত, অনূদিত ও সংকলিত বইয়ের সংখ্যাও কম নয়। সংকলিত যেমন : রওযা শরীফের ইতিকথা, দরবারে আউলিয়া, হায়াতে মাওলানা হুসাইন আহমাদ মাদানী ও দেওবন্দ আন্দোলন, কুড়ানো মানিক [১-৪ খন্ড], কোরআন পরিচিতি, আধুনিক বাংলা-আরবি এবং আধুনিক আরবি-বাংলা অভিধান আল-কাউছার। অনূদিত যেমন : মাওলানা ফযলে হক খয়রাবাদী কৃত আযাদী আন্দোলন, শহীদ হাসানুল বান্নার রচনাবলী, ইমাম গাজালীর [৪৫০-৫০৫ হি.] জগত বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ইয়াহইয়াউ ঊলুমিদ্দীন [১-৫ খ-], উপমহাদেশের প্রথম মুহাদ্দিস শায়খ শারফুদ্দিন আবূ তাওয়ামার ছাত্র শায়খ ইয়াহইয়া মুনায়েরী কৃত মারেফাত জ্ঞানের রতœ ভা-ার, জালালুদ্দীন সুয়ূতী [৮৪৯-৯১১হি.] কৃত বিখ্যাত সীরাত গ্রন্থ খাসায়েসুল কুবরা, মুফতী ইয়ার মুহাম্মদুল্লাহ খান কৃত দালায়েলুস সুলূকের অনুবাদ ইসলামী তাছাউফের স্বরূপসহ আরও অনেক গ্রন্থের কাজ তিনি সফলভাবে সম্পাদনা করেছেন।
ষাটের দশক থেকে তিনি দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রবেশ করেন। প্রথমে তিনি মাওলানা আতহার আলী (রহ.) প্রতিষ্ঠিত নেজামে ইসলাম পার্টির কেন্দ্রীয় দায়িত্বে সমাসীন ছিলেন। পরবর্তীতে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সাথে ইসলামী শাসনতন্ত্রের জোরদার আন্দোলন চালিয়ে জমিয়তের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ২৫/২৬ ডিসেম্বর ঢাকার পটুয়াটুলী জামে মসজিদের দ্বিতীয় তলায় জমিয়তের কাউন্সিলে তিনি জমিয়তের মহাসচিব নির্বাচিত হন। এই অধিবেশনেই তানজিমুল মাদারিস গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৮৮ সালের ২৮ মার্চ জমিয়তের সহ-সভাপতি এবং ২০০৩ সালের ১ জুন নির্বাহী সভাপতি নির্বাচিত হন। এছাড়া তাঁর আরও অনেক পরিচয় আছে। তিনি সাপ্তাহিক মুসলিম জাহানের প্রতিষ্ঠাতা। রাবেতা আলমে ইসলামীর কাউন্সিলর। মু’তামারুল আলম ইসলামীর বাংলাদেশ শাখার প্রেসিডেন্ট। জাতীয় সীরাত কমিটি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। নাস্তিক-মুরতাদ প্রতিরোধ আন্দোলন ইসলামী মোর্চার সভাপতি। ইসলামী ঐক্যজোটের প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান। জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরামের প্রধান।
আধুনিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ইসলাম চর্চার অন্যতম পথিকৃৎ তিনি। তাকে অনুসরণ করে এবং তার পৃষ্ঠপোষকতার মধ্য দিয়ে এদেশে অসংখ্য লেখক অনুবাদক ও গবেষক তৈরি হয়েছেন। বাংলাদেশের সম্ভ্রান্ত এমন কোন মুসলিম পরিবার পাওয়া যাবে না যাদের ঘরে তার সম্পাদিত মাসিক মদীনার একটি কপি পৌঁছেনি। ষাটের দশকের প্রথম দিকে ১৯৬১ সালে তার প্রতিষ্ঠিত মাসিক মদীনা পত্রিকা এদেশের সবচেয়ে বহুল প্রচারিত জনপ্রিয় বাংলা পত্রিকা। দেশে বিদেশে যার পাঠক সংখ্যা কয়েক লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। বাংলা ভাষায় ইসলামী পত্রিকার নতুন এই ধারার পথপ্রদর্শক তিনি। তার অমর কীর্তি মাসিক মদীনার অনুকরণে অনেকগুলো ইসলামী ম্যাগাজিন এদেশে পরবর্তীতে চালু হয়ছে। উম্মাহর চিন্তা ও বাঙালি মুসলমানের সুখ-দুঃখের কথা ফুটিয়ে তুলতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সাপ্তাহিক মুসলিম জাহান। এটাও বাংলা ভাষা ও সাংবাদিকতায় প্রথম কোন ইসলামি ধারার সাপ্তাহিক। তার স্বপ্ন ছিল দৈনিক মুসলিম জাহান তৈরির। সামাজিক বৈরী পরিবেশ ও রাজনৈতিক হিংস্রতার ফলে দৈনিক মুসলিম জাহান প্রতিষ্ঠা করতে না পারলেও সাপ্তাহিক মুসলিম জাহানের মাধ্যমে যে কর্মী বাহিনী ও কলম সৈনিক তিনি তৈরি করেছিলেন তারাই পরবর্তীতে জাতীয় দৈনিক ও মিডিয়াতে সাংবাদিকতায় অনেক বড়ো অবস্থানে কাজ করছেন। তার অমর কীর্তি ঐতিহ্যবাহী মদীনা পাবলিকেশন্স। মকসুদুল মুমিন আর নেয়ামুল কোরআনের অশুদ্ধ পাঠ চর্চা থেকে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাঙ্গালী মুসলমানকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন বিশ্ব সাহিত্যের ইসলামি বিশাল ভান্ডারের সাথে। শুধু ইসলামি বইকে বট তলা থেকে আধুনিককরণই করেননি বরং আজ থেকে অর্ধ শতাব্দি আগে এমন মান ও শৈল্পকতার সাথে ইসলামি বইয়ের সমাহার নিয়ে একটি প্রকাশনীর যাত্রা করলেন তখন বাম পাড়াতেও এমন মান সম্পন্ন প্রকাশনা চোখে পড়েনি। মদীনা প্রাবলিকেশন্সের পথ ধরে পরবর্তীতে শতশত ইসলামি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে। বাংলা বাজারে ইসলামি টাওয়ার আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল ইসলামি বই বাজার নিয়ে। এর পেছনে যে মানুষটি শক্তি সাহস ও প্রেরণা হিসাবে কাজ করেছেন তিনি মাওলানা মুহিউদ্দীন খান।
বিশ্বের বরেণ্য ইসলামি স্কলার ও পন্ডিতদের আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান রাবেতা আল আলম ইসলামীর তিনি বাংলাদেশের প্রথম সদস্য। দীর্ঘদিন রাবেতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিশ্ব সংস্থার নির্বাহী পর্ষদের দায়িত্ব পালন করেছেন। ফলে আরব বিশ্ব ও বিশ্বের বড়ো বড়ো প-িতদের সাথে তার কাজ করার সুযোগ হয়েছে। রাবেতার মাধ্যমে এদেশে অসংখ্য মসজিদ মাদরাসা দাতব্য চিকিৎসালয় তিনি তৈরি করেছেন। সংক্ষিপ্ত মারিফুল কোরআনের অনুবাদ ও সৌদি বাদশা ফাহাদ বিন আব্দুল আজিজের সৌজন্যে ও মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের তত্ত্বাবধানে বাংলাভাষাভাষি মানুষদের জন্য কোটি কপি মারিফুল কোরআন তরজমা ও কোরআন শরিফ বিনামূল্যে বিতরণ হয়েছে। কয়েকযুগব্যাপী এই বিতরণ তার এক অসামান্য মকবুল একটি খেদমত।
তিনি ছিলেন চলন্ত এক বিশ্বকোষ। মাসিক মদীনাকে ঘিরে তিনি যে প্রশ্নোত্তর বিভাগ চালু করেছিলেন তা, খান সাহেবর এক অমর জ্ঞান ভান্ডার। প্রতি মাসে শতাধিক প্রশ্ন উত্তর নিয়ে এই বিশাল আযোজন ছিল মদীনা পত্রিকার মূল আর্কষণ। এককভাবে ৭০ বছর যাবৎ কয়েক লক্ষ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তিনি। মহাকাশ, বিজ্ঞান, ফেকাহ, কোরআন, হাদীস, মনীষা, বিভিন্ন সভ্যতা, এমন কোনো বিষয় নেই যার উত্তর তিনি দেননি। ‘সমকালিন জিজ্ঞাসা’ জবাব নামে যা শতাধিক খ-ে প্রকাশিত হয়েছে, যা বিশ্ব ইতিহাসে একক এক বিশ্বকোষ বা জ্ঞান ভান্ডারের মর্যাদা লাভ করেছে। এ ধরনের আরো বহু খিদমত তার রয়েছে, যার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিলেও বিশাল গ্রন্থ হয়ে যাবে। তার মৃত্যু দিবসে আমরা তাকে স্মরণ করছি এবং তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
লেখক: প্রধান সহ-সম্পাদক, আলোকিত বাংলাদেশ
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

‘খুব ভালো চুক্তি’র ভবিষ্যদ্বাণী, চীনা প্রেসিডেন্টের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ট্রাম্প

নাইটক্লাবের ছাদ ধসে মারা গেলেন গায়ক রুবিও, নিহত বেড়ে ১৮৪

যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি দূতাবাস অভিমুখে মার্চ ফর প্যালেস্টাইনে জবির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা

সড়কে ছিল না যানজট, পরীক্ষার্থীদের মুখে ছিল স্বস্তির হাসি

হিন্দি ইন্ডাস্ট্রির কেউ আমার কথা ভাবেনি–জিৎ

প্লট দুর্নীতি : হাসিনা-পুতুলসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

বায়ুদূষণের শীর্ষে দিল্লি, ২৮তম ঢাকা

ডোমিনিকান রিপাবলিকে নাইটক্লাবের ছাদ ধস : নিহত বেড়ে ১২৪

গাজায় আবাসিক ভবনে ইসরায়েলি বিমান হামলা, নিহত অন্তত ৩৮

দুপুরের মধ্যে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের পূর্বাভাস

টঙ্গীতে র্যাবের অভিযান মহানগর তাঁতীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকসহ ৫জন গ্রেফতার

হিলিতে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভাবে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এসএসসি পরীক্ষা

সুন্দরবনে ডাকাতদের কবল থেকে ছয় নারীসহ ৩৩ জেলে উদ্ধার

ইয়েমেনের বন্দরশহরে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলা : নিহত বেড়ে ১৬

গাজায় অভিযানে আপত্তি, পাইলটসহ বিমানবাহিনীর ৯৭০ কর্মীকে বহিষ্কারের হুমকি ইসরাইলের

শহীদদের রক্তের সাথে কোন আপোষ বরদাস্ত করা হবে না: ইশরাক

মেসির জোড়া গোলে দুর্দান্ত প্রত্যাবর্তনে সেমিতে মায়ামি

সৌদি আরবে নতুন ১৪টি তেল ও গ্যাসের খনির সন্ধান

দাউদকান্দিতে মাদ্রাসায় সংবর্ধনা ও দোয়া মাহফিল

করতোয়া নদীর ১০.৭৫ একর জমি উদ্ধার