ভারতের সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র
২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৯ এএম | আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৯ এএম

দেশ ভাগাভাগিতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অনেক এলাকা থেকে পাকিস্তানকে বঞ্চিত করা হয়েছে। লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন ছিলেন ভারতের শেষ গভর্নর জেনারেল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর বিশেষ অনুরোধে ১৯৪৭ সালে মাউন্ট ব্যাটেন ভারতে আসেন। তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না মুসলমানদের কপালে দুর্যোগের ঘনঘটা কালো মেঘের রূপ নিচ্ছে। ভারতে পা দিয়েই লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন তার নিয়োগকৃত বৃটিশ আইনজীবী সিরিল জন রেডক্লিফ নেহেরু, গান্ধি ও বল্লব ভাই প্যাটেলের পরামর্শ অনুযায়ী খুব দ্রুততার সাথে ভারত ও পাকিস্তানের মানচিত্র নির্ধারণ করেন। ১৯৪৭ সালে ১৭ আগস্ট রেডক্লিফের আঁকা এই সীমানার কারণে প্রায় ১৪ মিলিয়ন মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণার পর যে সহিংসতা সংঘটিত হয় তাতে অনুমান করা হয় প্রায় ২০ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ আহত হয়। সীমানার উভয় পাশে ঘটা তান্ডব দেখার পর রেডক্লিফ তার কাজের জন্য পূর্বনির্ধারিত তখনকার ৩ হাজার পাউন্ড পারিশ্রমিক প্রত্যাখ্যান করেন। এই সীমানা নির্ধারণে তিনি মোটেই সন্তুষ্ট নন।
এই ঘটনার নেপথ্যে ছিলেন জওহরলাল নেহেরু ও মহাত্মা গান্ধি। তাদের এই চানক্যবুদ্ধির কাছে হেরে যায় পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ, জম্মু কাশ্মিরের দুই তৃতীয়াংশ ভারতের কাছে বিকিয়ে দিয়ে হেরে যায় জম্মু কাশ্মিরের শেখ আবদুল্লাহ, পাঞ্জাব ও হায়দ্রাবাদকে পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করতে না পেরে হেরে যায় হায়দ্রাবাদের ‘নিজাম’। পুনরায় ভারতের কাছে হেরে যায় পাকিস্তান ১৯৭১ সালের যুদ্ধে। হেরে যান শেখ মুজিব ভারতের সাথে ২৫ বছরের গোলামি চুক্তি করে। হেরে যান শেখ মুজিব ভারতীয় পরামর্শে সেনাবাহিনীর বিকল্প রক্ষীবাহিনী গঠন করে। প্রবাসী সরকার গঠন প্রক্রিয়ায় ভারতকে প্রাধান্য দিয়ে হারে ১৯৭১ সালের প্রবাসী সরকার। হারে বাংলাদেশ ১৬ ডিসেম্বরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক আতাউল গনি ওসমানীকে আসতে বা উপস্থিত হতে না দেওয়ার কারণে। আত্মসমর্পণ দলিলে বাংলাদেশের কোনো সাক্ষর রাখা কেন হয়নি তার উত্তর এখনো পাওয়া যায়নি। স্বাধীনতা ওখানেই বিতর্কিত একটি অধ্যায়ে রূপ নেয়। এখানেও হেরে যায় তৎকালীন আওয়ামী লীগের প্রবাসী সরকার এবং বিশিষ্ট সেক্টর কমান্ডাররা। ১৯৭১ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭২ মার্চ পর্যন্ত ১২০ দিন ভারতীয় সৈন্যদের থাকা খাওয়া, এমন কি লুটপাটে সুযোগ করে দেয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। পাকিস্তানের কয়েক হাজার কোটি টাকার ফেলে যাওয়া ভারী অস্ত্র ভারতীয় সৈন্যরা নিয়ে যায়। নিয়ে যায় বাংলাদেশের ভারী শিল্প কারখানার মেশিনারি ও যন্ত্রপাতি, যার মূল্য কয়েক হাজার কোটি টাকা।
জিয়াউর রহমান ও এরশাদের শাসনামলে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালি নিধন প্রক্রিয়ায় সন্তু লারমাকে ত্রিপুরার আগরতলায় মেহমান খানায় রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করার মহাপরিকল্পনায় আঞ্জাম দেয় ভারত সরকার। এখানেও হেরে যায় জিয়া ও এরশাদ। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অক্লান্ত পরিশ্রমে দক্ষিণ এশিয়ার ৭টি দেশ নিয়ে গঠিত হয় ‘সার্ক’। সেটাও ভারতীয় ষড়যন্ত্রে অকার্যকর করে দেওয়া হয়। এরপর শেখ হাসিনা তার শাসনামলে ভারতের সাথে একাধিক চুক্তি করে। ভারতীয় পরিকল্পনায় সন্তু লারমার সাথে হয় পার্বত্য চুক্তি। এর পর ৩০ বছরের ফারাক্কার পানি চুক্তি, যাকে বলা যায় প্রয়োজনে নয়, অপ্রয়োজনে পানি ছেড়ে বিপদ বাড়িয়ে দেওয়ার চুক্তি। এর পর বিগত ১৬ বছরে ভারতের ৭টি রাজ্যে অবাধ পণ্য ও গণ পরিবহন চলাচলের ব্যবস্থা করা। শুল্কমুক্ত এই করিডোর দেওয়ায় বাংলাদেশকে প্রতি বছর অর্থনৈতিক দৈন্যদশা একেবারে চরম পর্যায় নিয়ে যায়। করিডোরের রাস্তা মেরামতও বাংলাদেশকে তার নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করে দিতে হয়। ফেনী নদীতে ব্রিজ বানিয়ে পরিবহন চলাচলে ভারতেকে বাণিজ্যিক সুবিধা দিয়ে হেরে যায় শেখ হাসিনা। অভিযোগ আছে, বাংলাদেশের এনএসআই, ডিজিএফআই ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর লোকজন দিয়ে পরিচালিত করা হয়েছে। ভারতীয়দের সহযোগিতায় পিলখানায় ৫৭ জন সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৭ জনকে খুন করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
পদ্মা ব্রিজ দিয়ে ভারতের যানবাহন ও মালামাল নিয়ে বাংলাদেশে আসতে পারবে কিন্তু বাংলাদেশের যানবাহন পদ্মা ব্রিজ দিয়ে ভারতে ঢুকতে পারবে না, এমন সমঝোতাও ছিল। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের যাতায়াত ব্যবস্থার যে উন্নয়ন করেছে তা ভারতের নির্দেশে তাদের সুবিধার্থে করা হয়েছে। একাধিক করিডোরে শুধু একটি দেশ অবাধে চলাচল করার সুযোগ পাবে। কিন্তু বাংলাদেশ তার প্রতিবেশী রাষ্ট্র নেপাল ও ভুটানে যেতে পারবে না! এরকম দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। বাংলাদেশের সাথে ভারতের বাণিজ্য ছিলো একতরফা। ভারত সফরে গিয়ে দেখেছি, চীন থেকে যেসব মালামাল ভারতে আসে, সেই মালামাল বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বেশি দামে ভারত থেকে কিনে আনে। ভারত দুইদিক থেকেই বাণিজ্যিক মুনাফা অর্জন করতো। ভারত তার নিজের ব্যবসায়িক একক আধিপত্য বজায় রাখার জন্য ইউরোপ ও আরব রাষ্ট্রে বাংলাদেশের গার্মেন্ট ও কাঁচামালের ব্যবসায় ধস নামিয়ে দেয়। বাংলাদেশের প্রবাসী কর্মজীবী মানুষ ভারতের কারণে গুণগত মানের চাকরি পায় না। বাংলাদেশের শ্রমিকরা বহির্বিশ্বে বৈষম্যের শিকার হয়। এখানেও বাংলাদেশ ভারতের কাছে কূটনৈতিক বাণিজ্যে হেরে যায়। শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একবার টিভি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ভারতের উন্নতি আমাদের উন্নতি, আমাদের উন্নতি ভারতের উন্নতি’। এরকম কূটনৈতিক আলাপ কোথাও আছে বলে জানা নেই। ইউরোপ সফরে গিয়ে (২০২২) আমি এ দৃশ্য স্বচোখে দেখেছি, ভারতের বড় বড় কোম্পানি একচেটিয়া ব্যবসা করে বিদেশে ভালো অবস্থানে আছে।
বাংলাদেশেও ৫৪ বছর ধরে ভারতের ব্যবসা বাণিজ্য সচল আছে। আমাদের ইলিশ মাছের আড়ত চাঁদপুরে এখন ইলিশ মাছ নেই বললেই চলে। কোনো বাধা বিপত্তি ছাড়াই বাংলাদেশের নদীতে ভারতীয় মৎস্যজীবীরা ইলিশ মাছ ট্রলার নিয়ে এসে নিজেরাই ধরে নিয়ে যায়। শেষ অবধি আমাদের জেলেরা জালে মাছ পায় না। অতি সত্য কথা চেপে রাখা যায় না। তাই শেখ হাসিনা নিজেই বলেছিলেন, আমি ভারতকে যা দিয়েছি, ভারত আজীবন মনে রাখবে। এখানে চরমভাবে ভারতের কাছে হেরে যান পতিত ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকার। মায়ানমার থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বিগত কয়েক বছর আগে নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশের উখিয়া, টেকনাফে আশ্রয় নেয়। পরবর্তী সময়ে শরনার্থী হিসেবে তাদের জন্য আলাদা বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশন এবং জাতিসংঘের অর্থায়নে তারা বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশে থাকবে, এটা মেনে নেওয়া য়ায় না। এখানেও হাসিনা সরকার মায়ানমারের সাথে কূটনৈতিকভাবে হেরে যায়। মূল কথা হলো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি পুরোপুরি ভারত নিয়ন্ত্রণ করতো।
ভারতের অনুমতি ছাড়া বাংলাদেশের হাসিনা সরকার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারতো না। এসব কর্মকা-ে বাংলাদেশকে পরাধীনতার চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে বলে মনে হয় না। ভারতীয় মিডিয়া মিথ্যা বলায় চ্যাম্পিয়ন। তাদের কিছু মিডিয়ার কাজই হচ্ছে বাংলাদেশ নিয়ে মিথ্যা গল্প সাজিয়ে প্রচার চালিয়ে যাওয়া। বাংলাদেশের মিডিয়ার উচিত সত্য প্রচারের মাধ্যমে এর উপযুক্ত জবাব দেওয়া। দেশ স্বাধীনের পর থেকে সীমান্ত এলাকায় প্রায় সময়ই বিএসএফ বাংলাদেশের মানুষ হত্যা করছে, যা চলমান আছে। মৃত্যুর সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ফেলানীকে হত্যা করে তার লাশ তারকাঁটার বেষ্টনীতে ঝুলিয়ে রাখা হয়, অনেকটা পৈশাচিক কায়দায়। এসব ব্যাপারে হাসিনা সরকার কোনো প্রতিবাদ করতো না। উল্লেখ্য, ভারত চাইতো না বাংলাদেশ একটি সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠুক। এজন্য হাসিনার মাধ্যমে ২০১৩ সালে ৫ ও ৬ মে শাপলা চত্বরে অনুষ্ঠিত হেফাজতের শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশ ভন্ডুল করে দেয় হয়। সমাবেশটির উদ্দেশ্যে ছিল মহানবীর সম্পর্কে অপ্রীতিকর মন্তব্য করার শাস্তি হিসেবে একটি ব্লাসফেমি আইন প্রণয়ন এবং প্রকাশ্যে নারী পুরুষের অনৈতিক মেলামেশা ও কর্মকা- নিষিদ্ধ করার জন্য সরকারকে আহবান জানানো।
ভারত যে একটি সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন রাষ্ট্র সেটা উপলব্ধি করা যায় তখন, যখন প্রায়ই ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের উপর নিপীড়ন, নির্যাতন ও হত্যা এবং মসজিদ-মাদরাসায় হামলা করা এবং কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়। উল্লেখ্য, ভারত ইসরাইলের সবচেয়ে বড় বন্ধু। ইসরাইলের কাছ থেকে মুসলিম নিধনে বুদ্ধি পরামর্শ নেয় ভারত। ভারতের অন্যতম বড় শ্রমবাজার ইসরাইল। এ থেকে স্পষ্ট বুঝা যায়, স্যাকুলার রাষ্ট্রের লেবেল লাগিয়ে সংখ্যালঘু মানুষের দমন-পীড়ন চালিয়ে যাওয়া এটা ভারতের রাষ্ট্রীয় দর্শন।
লেখক: গ্রন্থকার, গবেষক এবং আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক।
harunrashidar@gmail.com
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত

ওষুধের দাম কমাতে পদক্ষেপ ট্রাম্পের

চীনা বিমানের কাছে পরাস্ত রাফাল সোশ্যাল মিডিয়ায় হাসির খোরাক ভারত

এরদোগানের সঙ্গে ফোনালাপ পুতিনের

ফের বিটকয়েনের দাম ১ লাখ ৫ হাজার ডলার ছাড়াল

মার্কিন-চীন বাণিজ্যের অবনতি রোধ করতে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে ঝুঁকছে নেক্স গ্লোবাল

গাজা যুদ্ধ সামরিক আগ্রাসনের মাধ্যমে সমাধানযোগ্য নয় : জার্মানি

ইউরোপে বন্দি থেকেও ফিলিপাইনে জয়ী হতে যাচ্ছেন দুতার্তে

ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সংলাপ চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা

ফ্যাসিস্ট এমপি মমতাজ বেগম গ্রেফতার

কোটচাঁদপুরে আম সংগ্রহ শুরু

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় অচল: দক্ষিণাঞ্চল অচলের ঘোষণা

সুন্দরবনের চারপাশে ১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা জারী করে প্রজ্ঞাপন

নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির এক দশক পূর্তিতে দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য আয়োজন

করিডোর নিয়ে গোটা দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ, বিপন্ন হতে পারে সার্বভৌমত্ব: দরকার জাতীয় ঐক্য

সিলেটে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের এক নেতাকে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ

মাগুরায় আওয়ামী লীগ এর সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ায় জামায়াতের শুকরানা মিছিল

নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের কোরআন বিরোধী প্রস্তাব বাতিল করতে হবে

জকিগঞ্জে আ. লীগ ও অঙ্গসংগঠনের ২৬ নেতা কারাগারে

জেপি মরগান পেমেন্টসের ‘ওয়্যার ৩৬৫’ চালু করলো ব্র্যাক ব্যাংক