ভারতের নতুন ওয়াকফ আইন অন্যায্য ও অযৌক্তিক
২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৯ এএম | আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৯ এএম

ভারতে হিন্দুদের স্বার্থে তাদের ‘দেবোত্তর’ সম্পত্তির ন্যায় মুসলমানদের স্বার্থে তাদের ‘ওয়াকফ’ সম্পত্তিও ১৯৯৫ সাল থেকে কেবল মুসলিম স্বার্থেই ব্যয়িত হয়ে আসছিল। কিন্তু গত ৫ এপ্রিল নতুন ওয়াকফ বিল পাস করা হয়। যেখানে সে দেশে বসবাসকারী দ্বিতীয় বৃহত্তম সংখ্যালঘু ২৫ কোটি মুসলমানের ধর্মীয় অধিকার লংঘিত হয়েছে। এটা করতে গিয়ে ভারত সরকার সংবিধানের ১৪, ২৫, ২৬, ২৯ ও ৩০ অনুচ্ছেদ লংঘন করেছে। উক্ত ওয়াকফ সম্পত্তিতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছিল। এখন বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে গড়িয়েছে। যেখানে মুসলমানদের পক্ষ থেকে ৪টি পিটিশন জমা পড়েছে। বর্তমান ওয়াকফ বিলে দু’জন হিন্দু সদস্য রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। মুসলমানদের মধ্যে দু’জন নারী সদস্য, যারা বিধবা, বিবাহ বিচ্ছিন্ন বা অনাথ হবেন। মুসলমান সদস্য কেবল তিনি হ’তে পারবেন, যিনি ৫ বছর ইসলাম পালন করেছেন ওয়াকফে দানের অধিকার কেবল তারই থাকবে। অথচ, হিন্দুদের ‘দেবোত্তর’ সম্পত্তিতে মুসলমান সদস্য থাকার কোনো অধিকার নেই। মোদি সরকার কেন মুসলমানদের ওয়াকফ সম্পত্তি দখলে এতটা উন্মুখ? প্রশ্নটির উত্তর রয়েছে সারাদেশে ওয়াকফ সম্পত্তির বিরাট তালিকার মধ্যে। রেল ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পর সবচেয়ে বেশি স্থাবর সম্পত্তির মালিক ভারতীয় ‘ওয়াকফ বোর্ড’। আনুমানিক ৯ লাখ ৪০ হাজার একর জায়গা জুড়ে ৮ লাখ ৭০ হাজার সম্পত্তি রয়েছে তার হাতে। মোদি সরকার এই বিপুল সম্পত্তির দখল ও পরিচালনার ভার নিজের হাতে নিতে চায়। কংগ্রেসের এক নেতার কথায় মোদির বিজেপিতে ন্যায়বিচারের কোনো অংশ নেই। তারা টোটাল কন্ট্রোলে বিশ্বাসী। সেই কন্ট্রোল পেতে মুসলিম সমাজকে বশ করা জরুরি। প্রয়োজনে ভয় দেখিয়েও। যেমন জীবন ও সম্পত্তি হানির ভয় দেখাচ্ছে উত্তর প্রদেশের হিন্দু সরকারের ‘বুল ডোজার’ নীতি। ধর্মস্থান আইনের তোয়াক্কা না করে দাবি উঠছে মসজিদ খোড়ার। দেখা হচ্ছে সেটার নিচে কোনকালে মন্দির ছিল কি না। তাদের অভিন্ন দেওয়ানী বিধির একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে মুসলমানদের কোনঠাসা করা।
আসাম ও ঝাড়খন্ডে জিগির উঠেছে ‘ল্যান্ড জিহাদে’র। মুসলমানরা নাকি জবরদস্তি করে হিন্দুদের জমি লিখে নিচ্ছে। মুসলমানরা নাকি শিক্ষিত ও সংগঠিত হচ্ছে সরকারি দখল নিতে। ভারতের একমাত্র মুসলিম প্রধান রাজ্য জম্মু-কাশ্মীরের চরিত্র বদল ও দ্বিখ-িত করণের উদ্দেশ্যও হিন্দু আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা। নতুন ওয়াকফ আইন এই উগ্র হিন্দুত্ববাদী টোটাল কন্ট্রোলেরই আরেক অধ্যায়। মুসলিম স্বার্থের ঘোর বিরোধী এই বিলটি সে দেশের উচ্চ ও নিম্ন উভয় কক্ষেই পাস হয়েছে। লোকসভার ভোটাভুটিতে ২৮৮-২৩২ ভোটে বিলটি পাস হয়। কেবল সংখ্যার জোরে এটি পাস করা হয়েছে। কারণ, গণতন্ত্র যুক্তিতে চলে না, চলে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতে। শাসক দল সেই জোরেই এই চরম অনৈতিক ওয়াকফ বিলকে পাস করে নিয়েছে। অথচ, একই জিনিস হিন্দু বা জৈন এন্ডাওমেন্ট বোর্ডে অথবা শিখদের গুরু দোয়ারা প্রবন্ধক কমিটিতে করা হচ্ছে না। ফলে গোটা পদক্ষেপটাই অসাংবিধানিক ও মুসলিম স্বার্থ বিরোধী। অথচ, ভারতের মুসলিমদের জন্য এই ওয়াকফ সম্পত্তির গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ, এগুলি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মসজিদ-মাদরাসা-ইয়াতিমখানা বা কবরস্থান হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
ঐতিহাসিক ঐতিহ্য অনুযায়ী ভারতে বহু ভবন ও জমি-জমা এতকাল আইনগতভাবে বৈধ ওয়াকফ সম্পত্তি হিসাবে স্বীকৃতি পেয়ে আসছে। সেগুলো হয়তো শুধু মুখের কথায় (ওরাল ডিক্লারেশন) বা সামাজিক রীতি-নীতি মেনে দান করা হয়েছিল। যেহেতু সেগুলো বহুদিন ধরে মুসলিম সমাজ ব্যবহার করে আসছে, তাই তাদের ওয়াকফ হিসাবে স্বীকৃতি পেতে অসুবিধা হয়নি। কিন্তু এখন নতুন আইনে বলা হয়েছে, কোনো সম্পত্তিকে ওয়াকফ বলে দাবি করতে হ’লে সংশ্লিষ্ট ওয়াকফ বোর্ডকে তার স্বপক্ষে বৈধ নথিপত্র জমা দিতে হবে। তাই নতুন ওয়াকফ আইনে সম্ভবত সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হলো কোনটাকে ওয়াকফ সম্পত্তি বলে চিহ্নিত করা হবে, সেই সংজ্ঞাটাই পাল্টে দেওয়া। বিতর্কিত কেসগুলিতে বিশেষ করে সেই জমিটা যদি সরকারি মালিকানাধীন খাস জমি বলে দাবি থাকে, সেখানে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার সরকারের উপরেই ন্যস্ত থাকবে। দ্বিতীয়ত নতুন আইনে অমুসলিম ব্যক্তিরাও ওয়াকফ বোর্ড ও ট্রাইব্যুনালের সদস্য হিসাবে নিযুক্ত হতে পারবেন। তৃতীয়ত এতদিন ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে বিতর্কের ক্ষেত্রে ওয়াকফ ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্তই ছিল চূড়ান্ত। কিন্তু নতুন আইনে বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপেরও সুযোগ রাখা হয়েছে, যার অর্থ যেকোন পক্ষ চাইলে আদালতের শরণাপন্ন হতে পারবে। এছাড়া নতুন আইনে দেশের সব ওয়াকফ সম্পত্তির জন্য একটি কেন্দ্রীয় নিবন্ধন সিস্টেম গঠনেরও প্রস্তাব করা হয়েছে। আইনটি বলবৎ হওয়ার ৬ মাসের মধ্যে সব বিদ্যমান ওয়াকফ সম্পত্তিকে ঐ রেজিস্টারে নথিভুক্ত করাতে হবে। নতুন করে কোনো সম্পত্তিকে যদি ওয়াকফ হিসাবে নথিভুক্ত করাতে হয়, তাহলে সেটার জন্য আবেদনও এই সিস্টেমের মাধ্যমেই সংশ্লিষ্ট ওয়াকফ বোর্ডের কাছে পেশ করতে হবে। কোনো ওয়াকফ সম্পত্তির সার্ভে বা সমীক্ষা করানোর দরকার হলে তাতেও সরকারের ভূমিকা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি থাকবে। বস্তুত তারা এ ক্ষেত্রে ওয়াকফ বোর্ডের চেয়েও বেশি ক্ষমতাশালী হবে।
এভাবে নতুন ওয়াকফ আইনকে সংস্কারের নামে এমন একটি জটিলতার মধ্যে নিক্ষেপ করা হয়েছে, যা ভারতীয় মুসলমানদের ধর্মীয় অধিকার চূড়ান্তভাবে লংঘন করেছে। উক্ত আইন পাশের ফলে বহু মসজিদ ও মাদরাসার জমি উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হাতে বেদখল হয়ে যাবে বলে আশংকা করা হচ্ছে। আমরা এই আইনের তীব্র প্রতিবাদ করছি এবং আইনটি পুনর্বিবেচনার জন্য ভারত সরকারের প্রতি দাবি জানাচ্ছি। সাথে সাথে সে দেশের জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ অর্থাৎ ২৫ কোটি মুসলমানের ধর্মীয় ঐতিহ্য, অধিকার, সংস্কৃতি ও স্বার্থ অক্ষুণœ রাখার আহ্বান জানাচ্ছি, যাতে মুসলমানদের ওয়াকফকৃত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মাদরাসা, কবরস্থান ও ইয়াতিমখানাগুলি রাষ্ট্রীয়ভাবে দখলের পথ খুলে দেয়া না হয়।
লেখক: আমীর, আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ ও প্রফেসর (অব.) আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

২০০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি, এআই প্রযুক্তিতেও আমিরাতের পাশে যুক্তরাষ্ট্র!

মোরেলগঞ্জে পানি তালের কদর সারাদেশে

দুর্দান্ত ইয়ামালে বার্সার লিগ শিরোপা পুনরুদ্ধার

ফিলিস্তিনিদের ৬০০ ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দিল ইসরাইল

গোপালগঞ্জে বাস-ট্রাক সংঘর্ষে নিহত ৩, আহত ২৮

লাইভ চলাকালীন জনপ্রিয় টিকটকারকে গুলি করে হত্যা

পটুয়াখালীতে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ এর উদ্যোগে অবহিতকরণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত

ভারতে সন্দেহভাজন ‘১৪৮ বাংলাদেশিকে’ ত্রিপুরায় স্থানান্তর, হতে পারে পুশ ব্যাক

বাড়ল ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতির সময়সীমা

কৃষ্ণচূড়ার নান্দনিক সাজ এখন আর খুব একটা চোখে পড়ে না শেরপুর গারো পাহাড়ে!

ভারতের আরও একটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবি পাকিস্তানের

পাকিস্তানের জন্য স্থগিতই থাকছে সিন্ধু পানি চুক্তি, জানাল ভারত

আটঘরিয়ায় বিএনপি-জামায়াত সংঘর্ষ; মোটরসাইকেল ও অফিস ভাঙচুর, আহত ৫

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সমাবেশ আজ

গরু নিয়ে যাওয়া সেই স্বেচ্ছাসেবক দল নেতাকে বহিষ্কার

ট্রাম্প-পুতিন সরাসরি বৈঠক ছাড়া ইউক্রেন সংকটের সমাধান অসম্ভব: রুবিও

ইসরায়েলি হামলায় গাজায় একদিনেই নিহত ১৪৩ ফিলিস্তিনি

স্থূলতা কেবল একটি অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার চেয়ে অনেক বেশি কিছু

সাবেক সেনাসদস্যদের আবেদন সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়েছে : আইএসপিআর

তেজগাঁওয়ে শিশু রোজা মনি মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায় বিচার দাবি ড্যাবের