শিশুর নিরাপদ খাদ্য
০৮ জুন ২০২৩, ০৮:২৯ পিএম | আপডেট: ০৯ জুন ২০২৩, ১২:০২ এএম
ছোট্ট সোনামনি অধরা। হাতের কাছে যা পায় তাই মুখে দেয়। কোনটি ভালো কোনটি মন্দ এটা বুঝার বা ভাবার অবকাশ তার নেই। এতে কি ক্ষতি হবে, না ভালো হবে এটা বুঝে না অধরা। তাই প্রতিটি বাবা-মায়ের মত ওর দিকেও বিশেষ করে মায়ের বেশি নজর রাখতে হবে। আমরা জানি শিশুর খাওয়া-দাওয়া, স্বাস্থ্য সচেতনতার কোনো ত্রুটি রাখে না বাবা-মা। সামর্থ্য অনুযায়ী সব বাবা-মাই চান তার শিশুকে দুনিয়ার সেরা জিনিসটি কিনে দিতে, সবচেয়ে পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাবার খাওয়াতে।
সন্তানের খাবার জোগাড় করতে বাবার কঠোর পরিশ্রম, মায়ের কত আয়োজন। কত দরিদ্র বাবা-মা নিজেরা না খেয়ে সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেন। ধনী পিতা-মাতা শহরের সেরা ও দামি রেস্টুরেন্ট থেকে নানারকম বিলাসী খাদ্যদ্রব্য কিনে তুলে দেন সন্তানের মুখে। এসব কিছুই শিশুকে সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, তার শরীর ও মন ভালো রাখার জন্য। কিন্তু আসলেই কি আমাদের দেশের শিশুরা এমনকি বড়রা যে খাবার খায় তা স্বাস্থ্যকর ও সঠিক পুষ্টিসম্পন্ন। ভেজালমিশ্রিত খাবার খেয়ে স্বাস্থ্য রক্ষা তো দূরের কথা আমাদের শিশুরা বরং বেশী বেশী রোগাক্রান্ত হচ্ছে। সুষম ভাল খাবার খেতে পারলে শিশুদের অনেক রোগ থেকেই বাঁচিয়ে রাখা যায়।
শিশুর প্রধান খাদ্য দুধ। শিশুর জীবন রক্ষা ও বৃদ্ধিতে সহায়তা ও পুষ্টির যোগান দেয় দুধ। গুঁড়ো বা তরল দুধে সাধারণত পানি, ময়দা, কর্নফ্লাওয়ার ইত্যাদি মিশিয়ে দুধের পরিমাণ বাড়ানো হয়। এ ধরনের ভেজাল মিশ্রণে শিশুর শরীরে পুষ্টির ঘাটতি হলেও মারাত্মক প্রতিক্রিয়া বা জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কোনো রোগ হয় না। কিন্তু দুধ হিসেবে ছোট্ট সোনামনিদের আমরা যা পান করাই তা যদি দুধ না হয়ে ইউরিয়া, তরল ডিটারজেন্ট, একটু চিনি, ভেজিটেবল অয়েল, দূষিত পানি ইত্যাদির মিশ্রণে সৃষ্ট একটি তরল সাদা পদার্থ হয় তাহলে সেটা হবে শিশুর জীবনের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ।
নিয়মিত খাওয়ানোর ফলে এ ধরনের ভেজাল মিশ্রিত খাবার শিশুর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট করাসহ সমস্ত শরীরের স্বাভাবিক ক্রিয়াই ধ্বংস করে দেয়। উদাহরণস্বরূপ সীসা ও ক্রোমিয়ামযুক্ত লবণ খাওয়ার ফলে শিশুর রক্তস্বল্পতা, প্যারালাইসিস, মানসিক প্রতিবন্ধকতা ও মস্তিকের ক্ষতি হয়। অন্যদিকে গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভপাত ঘটতে পারে। তেলে ভাজা খাবার যেমন বেসনের তৈরি আলুর চপ, বেগুনি, পেঁয়াজু ইত্যাদি; বিভিন্ন মিষ্টান্ন যেমন-লাড্ডু, বরফি, জিলাপি ইত্যাদি; গ্রিল-চিকেন, পোলাও ইত্যাদির রং চকচকে হলুদ ও লোভনীয় করার জন্য কাপড়ের কারখানায় ব্যবহৃত রাসায়নিক রং ব্যবহৃত হয়। এগুলো খাদ্যে ব্যবহারের জন্য অনুমোদিত রংসমূহের দামের চেয়ে সস্তা বলে খাদ্য প্রস্তুতকারী ও ব্যবসায়ীরা কম দামি বিষাক্ত রং ব্যবহার করেন।
খাদ্যে ভেজাল মিশ্রণ যে শুধু বেআইনি তাই নয়, অনৈতিকও। মশলায় ইট ও কাঠের গুঁড়ো, বালি, খড়ের গুঁড়ো মেশালেও না হয় মানা যায়। কিন্তু এর সাথে যদি ঘোড়ার মল বা গরুর গোবর মেশানো হয় তাহলে তা মানুষের নৈতিকতার কোন পর্যায়ে পড়ে তা নির্ণয় করা মুশকিল। আসলে মানুষ নামক অমানুষের পক্ষেই সম্ভব কার্বাইড দিয়ে ফল পাকানো, ফরমালিন দিয়ে মাছ তাজা রাখা, ২০ টাকার করমচা বিষাক্ত রং ও চিনি দিয়ে সেদ্ধ করে ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা, তেলের বদলে মবিলে খাবার ভাজা, রং দিয়ে মাসের ডালকে সোনালি মুগ আর মটরডালকে সবুজ মটরশুঁটি বলে চালানো। ভেজাল মিশ্রিত সরিষার তেল খাদ্যদ্রব্যে ব্যবহারের ফলে শোথ রোগ হয়। এছাড়া শিশুর শরীরের বিভিন্ন স্থান ফুলে যাওয়া, জ্বর হওয়া, নাড়ি স্পন্দনের নিম্নগতি, যকৃতের আকার বড় হওয়া, শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা ইত্যাদি হতে পারে। এসবের ফলে কিডনি, যকৃত, হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে শিশু মারা যেতে পারে।
বাইরের বা দোকানের তৈরি খাবার নিরাপদ নয় মনে করে মায়েরা চেষ্টা করেন শিশুকে যতটুকু সম্ভব ঘরে তৈরি খাবার খাওয়াতে। শিশুর টিফিন বা বিকালের নাস্তা তৈরির একটা বড় উপাদান হলো ময়দা। কিন্তু ময়দা তো শুধু ময়দা নয় এ যে বালি, মাটি, সাবান গুঁড়ো, চকের গুঁড়ো ইত্যাদির মিশ্রণে তৈরি ককটেল। বেসন দিয়ে মজাদার নাস্তা তৈরি করে দেবেন, তাও তো ভেজালকারীদের থাবামুক্ত নয়। বেসনেও ধুলাবালির পাশাপাশি কাঠের গুঁড়ো, চা পাতার ফেলে দেয়া গুঁড়ো, কফি গুঁড়ো মেশানো হয়। লবণে মেশানো হয় কাপড় ধোয়ার সোডা। সুতরাং লবণে আয়োডিন দূরের কথা লবণ ঠিকমতো লবণ কি না তা নিশ্চিত করা জরুরি। বাচ্চাদের কাছে লোভনীয় করার জন্য অনেক মিষ্টান্ন অ্যালুমিনিয়ামের ফয়েলে মোড়ানো থাকে যা শিশুরা মিষ্টির সাথে খেয়ে থাকে। অ্যালুমিনিয়াম স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর।
ঘি দিয়ে হালুয়া তৈরি করে শিশকে দেবেন, উপায় নেই কারণ ঘিতে মেশানো হয় প্রাণিজ চর্বি, বিষাক্ত রাসায়নিক রং, মিষ্টি কুমড়া ইত্যাদি। সেমাই ছোট-বড় সবার পছন্দ। কিন্তু সেমাই তৈরি ও ভাজা হয় চর্বিতে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে, শুকানো হয় অপরিচ্ছন্ন স্থানে খোলা আকাশের নিচে। এসব খেলে শিশুর ডায়রিয়া, আমাশয়সহ অন্যান্য রোগ যেমন কিডনি বিকল, পাকস্থলি বা যকৃতের ক্যান্সার, সিরোসিস, মাথা ধরা, মেজাজ খিটখিটে ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। শিশুদের জন্য তৈরি জুস, চকোলেট, টিনজাত খাদ্য ইত্যাদিতে স্বাদ বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন অ্যাডিটিভ মেশানো হয়। তাই এ ধরনের খাদ্যদ্রব্য খাওয়ার পর শিশুদের মধ্যে অধিক দুরন্তপনা, কম ঘুম, লেখাপড়ায় অমনোযোগিতা দেখা দেয়।
ভেজালকারীদের নিষ্ঠুর কবল থেকে মুক্ত নয় অসুস্থ শিশুও। তাই তো জ্বরের সিরাপ খেয়ে, কাশির সিরাপ খেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে নিষ্পাপ শিশু। ভেজালকারী পরিণত হয় হত্যাকারীতে। ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো প্যারাসিটামল তৈরির সময় প্রোপিলিন গ্লাইকোলের পরিবর্তে এথিনিল ও ডাইথোনিল গ্লাইকোল ব্যবহার করে, লাভের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য বিবেকহীন ওষুধ প্রস্তুকারীরা প্রোপিলিন গ্লাইকোলের সাথে বিষাক্ত উপাদান মিশিয়ে থাকে। কিন্তু প্রোপিনিল গ্লাইকোলে কি পরিমাণ ভেজাল আছে তা বের করা ওষুধ প্রস্তুতকারীদের পক্ষে অসম্ভব নয়। আরেকটি কথা, প্যারাসিটামল সিরাপে প্রোপিনল গ্লাইকোলের মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণ শিশুর কিডনি, লিভার এবং মস্তিষ্কের ক্ষতি করে। ওষুধ প্রশাসনের মতে, এর মাত্রা ০.১%-এর বেশি হওয়া উচিত নয়।
এ চিত্র শুধু বাংলাদেশেরই নয়। প্রতিবছর বিশ্বে ভেজাল খাবার খেয়ে প্রায় ১৮ লাখ শিশু মারা যায়। প্যারাসিটামল খেয়ে শিশু মৃত্যুর ঘটনা নতুন নয়। বাংলাদেশে ১৯৯০-৯২ সালে এ সিরাপ খেয়ে ৩৩৯টি শিশু মারা যায় বলে ধারণা করা হয়। নাইজেরিয়াতে ২০০৬ সালে শিশু খাদ্য খেয়ে ৮৪ জন শিশু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। কফ সিরাপ খেয়ে ১৯৯৬ সালে হাইতির ৮৫ জন, ১৯৯০ সালে নাইজেরিয়ায় ৪৭ জন মৃত্যুবরণ করে।
খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে জনগণকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। এ সম্পর্কিত দেশের আইন জেনে খাদ্য ও ওষুধে ভেজাল প্রদানকারীদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে সোপর্দ করতে হবে। বাংলাদেশের ‘পিওর ফুড অর্ডিন্যান্স ১৯৫৯’ অনুযায়ী খাদ্যে বিষাক্ত বা বিপজ্জনক রাসায়নিক দ্রব্যাদি, বিষাক্ত রং, নেশাজাতীয় দ্রব্য যেমনÑ ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ফরমালিন, কীটনাশক, অপরিশোধিত তেল, সুগন্ধ তৈরিকারী রাসায়নিক দ্রব্যাদি মেশানো সম্পূর্ণ নিষেধ। নিম্নমান সম্পন্ন পচা-বাসি খাবার বিক্রয় ও দ্রব্যের গায়ে মিথ্যা লেভেল বা প্রচারণা আইনত দ-নীয়।
আমাদের এ শিশু গড়বে আগামীর সমাজ ও দেশ। একটি অসুস্থ বিকলাঙ্গ শিশুর কাছে আমরা ভালো কিছু আশা করতে পারি না। ভেজাল খাবার ও ওষুধ গ্রহণের ফলে একটি-দুটি শিশুই নয় বরং দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠী আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন রোগে, ঢলে পড়ছে মৃত্যুর কোলে। এর ফলে সব নাগরিক সম্মুখীন হচ্ছে আর্থিক, মানসিক ও শারীরিক ক্ষতির। এ অন্যায়-অনাচার সহ্য করা উচিত নয় বরং গ্রাম-শহর সকল নাগরিকের উচিৎ ঐক্যবদ্ধ হয়ে এ ভেজালকারীদের প্রতিরোধ করা। এ লক্ষ্যে প্রয়োজন শক্তিশালী কনজ্যুমার সোসাইটি গঠন করে মিলিতভাবে অধিক শক্তি নিয়ে প্রতিরোধ করা। প্রতিটি মা-বাবার উচিৎ ভেজাল ও শিশুর জন্য বিপজ্জনক খাদ্যদ্রব্য বর্জন করা।
আলম শামস
কবি ও সাংবাদিক
প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি : ফেন্ডস কমিউনিটি সোসাইটি
আর. কে. মিশন রোড, ঢাকা
Email: [email protected]
বিভাগ : স্বাস্থ্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
পঞ্চম কিস্তি আসতে চলছে জনপ্রিয় সিরিজ 'আউটার ব্যাংকস' এর, কি আছে সিরিজটিতে?
জয়সোয়ালের রেকর্ডে পার্থে ভারতের দাপুটে দিন
ভোটবাক্স বোঝালো মমতাতেই ভরসা বাংলার
সংসদে আরও এক গান্ধী, অভিষেকেই বড় জয়ের পথে প্রিয়াঙ্কা
ছ’মাসেই পুরো বদল! মহারাষ্ট্রে ঝড় বিজেপির
আগে স্থানীয় নির্বাচন, পরে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের পরামর্শ
জুলাই বিপ্লবে ছাত্র আন্দোলনে গুলি করা সেই তৌহিদ গ্রেপ্তার
রমজানে বাজার সহনশীল রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে : বাণিজ্য উপদেষ্টা
গণ-আন্দোলনে শহীদ পরিবারের অন্তত একজনের চাকরির ব্যবস্থা করা হবে : সারজিস আলম
অনুমোদিত ৩৫০% নগদ লভ্যাংশ শেয়ারহোল্ডারদের বিতরন করল ওয়ালটন
আমতলীতে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে সাংবাদিকের ওপর সন্ত্রাসী হামলা। আহত -২
শিবালয়ে পরকিয়া প্রেমের বলি নুরজাহান ৪দিন পর পাষ-প্রেমিক আলিফ গ্রেফতার
ভূঞাপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে ময়লা-আবর্জনার ভাগার
শাহজাহান ওমরের বিরুদ্ধে আরও এক মামলা
ধর্মগ্রন্থের পরে সত্য হিসেবে মানুষ সংবাদপত্রকে মনে করতো - বিটিভি মহা পরিচালক
নেতানিয়াহুকে গ্রেপ্তারে ‘প্রস্তুত’ ইউরোপের যে ৭টি দেশ
প্রথম বার চার দরজার বিলাসবহুল গাড়ি আনছে জাগুয়ার
৪ মাস যেতে না যেতেই ভেস্তে গেছে কোটি টাকার সোলার ফেনসিং প্রকল্প!
২৯ বছর পর অবশেষে আলোর মুখ দেখলো শেরপুর আন্তঃজেলা পৌর বাস টার্মিনাল
মোটরসাইকেলের ভয়ংকর নেশা, বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল, ৫ মাসে নিহত হয়েছে ১৪ জন