মস্তিষ্কের টিউমার বাড়ছে
১২ জুলাই ২০২৪, ১২:০১ এএম | আপডেট: ১২ জুলাই ২০২৪, ১২:০১ এএম
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, মোট দুই লাখ ৬০ হাজার মানুষ প্রতি বছর ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত হয়। আর ব্রিটেনের এক জরিপে প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ছয়জন প্রতি বছর ব্রেইন টিউমারে আক্রান্ত হয়ে থাকে। টেনটোরিয়াম নামক একটি পর্দা দিয়ে আমাদের ব্রেইনকে দুইটি কম্পার্টমেন্টে ভাগ করা যায়। একটি উপরের প্রকোষ্ঠ ও আরেকটি নিচের প্রকোষ্ঠ। একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের উপরের প্রকোষ্ঠে শতকরা ৮০-৮৫ ভাগ টিউমার হয়ে থাকে এবং নিচের প্রকোষ্ঠে শতকরা ১৫-২০ ভাগ টিউমার হয়। শিশুদের ক্ষেত্রে উপরের প্রকোষ্ঠে শতকরা ৪০ ভাগ এবং নিচের প্রকোষ্ঠে শতকরা ৬০ ভাগ টিউমার হয়ে থাকে। ব্রেন টিউমার বা ক্যান্সারের উৎপত্তি প্রধানত দুটি উৎস থেকে একটি হলো অন্য কলা বা কোষ থেকে উৎপন্ন ম্যালিগন্যান্ট টিউমার, যা মস্তিষ্কে রক্ত সংবহন, লসিকাগ্রন্থি যেমন সিএসএফের সাহায্যে মেটাসটেসিস বা দ্বৈতীয় হিসেবে আসে। দ্বিতীয়টি মস্তিষ্ক বা ব্রেনের প্রাইমারি বা মস্তিষ্কের কোষ কলা থেকে প্রত্যক্ষভাবে তৈরি প্রাথমিক টিউমার।
> ব্রেইন টিউমার কি?
মস্তিস্কের কোনো বিশেষ অঞ্চলের কোষ যখন অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়ে যায়, তখন তাকে ব্রেইন টিউমার বলে। ব্রেইন টিউমার দুই রকমের। একটি হলো নির্দোষ বা বিনাইন টিউমার। এটি শরীরে থাকলে তেমন কোনো সমস্যা হয়না। কেননা, এটি দেহের এক জায়গায় স্বাভাবিক কোষের মতো বিভাজিত হয়। চারদিকে ছড়ায় না এবং এদের বৃদ্ধিও ধীরে। দ্বিতীয় রকমের টিউমারটি হলো দোষী বা ম্যালিগন্যান্ট, যাকে ক্যান্সার বলা হয়। এটি স্বাভাবিক কোষের চেয়ে খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ৪৫ এর বেশি বয়সী ব্যক্তিদের ক্যান্সারে মৃত্যুর হার বেশি এবং শিশুদের মধ্যে ছয় থেকে নয় বছর বয়সীদের মধ্যে এই মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনক।
>কারণ:-
মস্তিষ্কের টিউমার যেকোনো বয়সে হতে পারে। শিশুদের যত ক্যান্সার হয় তার দ্বিতীয় কারণ এটি। কিন্তু এর কারণ জানা যায় না। তবে কিছু জিনের মিউটেশনে এটি হতে পারে। এ ছাড়া রেডিয়েশনেও হতে পারে টিউমার।
> যে কারণে ব্রেন টিউমার হয়ঃ-
টিউমার বিভিন্ন কারণের জন্য হতে পারে। ব্রেন টিউমার তখনি হয় যখন মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কোষগুলির ডিএনএ-তে কোন ত্রুটি থাকে। আবার অনেক সময় বংশগত কারণে ব্রেন টিউমার হয়ে থাকে। অর্থাৎ বাবা, মা বা আত্মীয় কারো ব্রেন টিউমার থাকলে।
> ব্রেইন টিউমারের উপসর্গঃ-
নতুন করে মাথাব্যথা হলে সতর্ক থাকুন।
প্রায়ই বিশেষ করে সকালে বমির ভাব বা বমি হওয়া।
কোনও কোনও সময় দেখা যায় মাথাব্যথা চলতেই থাকছে, বারবার হচ্ছে কিংবা থেমে গিয়ে আবার নতুন করে শুরু হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া জরুরী।
কিন্তু মাথা যন্ত্রণার চরিত্র যদি হঠাৎ করে পরিবর্তিত হয় এবং তা ক্রমাগত বাড়তে থাকে তাহলে সতর্কতার প্রয়োজন আছে। এক্ষেত্রে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া জরুরি।
শরীরে কোন একটি দিক কি অবস অনুভূত হচ্ছে ? কোনও কোনও সময় ব্রেইন টিউমার এর উপসর্গ মাথাব্যথা নাও হতে পারে। হঠাৎ দেখা গেল শরীরে কোন একটা দিকে অনুভূতি কম হচ্ছে বা আস্তে আস্তে কোন একটি দিক অবশ হচ্ছে। অনেক সময় হাঁটাহাঁটিতে ভারসাম্যের অভাবে লক্ষ্য করা যায়। তাহলে অবশ্যই যত দ্রুত সম্ভব স্নায়ু রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হবে।
হঠাৎ করে চোখে দেখতে কি অসুবিধা হচ্ছে ? চোখের কোন একটা দিক ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে ? চোখের দুই দিকে কি আঁধার নেমে আসছে ? তাহলে অবশ্যই স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞকে দেখান।
একজন সুস্থ মানুষের ব্যবহারে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে ? কথাবার্তায় অসংলগ্নতা দেখা যাচ্ছে ? সে ক্ষেত্রে অবশ্যই টিউমারের সম্ভাবনা থেকে যায়। দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া জরুরী।
হঠাৎ করে কিছু কথা ভুলে যাওয়া অর্থাৎ সামান্য কয়েক দিন আগের কথা ভুলে যাওয়া - এই ধরনের উপসর্গ মস্তিষ্কে টিউমারের লক্ষণ হতে পারে।
হঠাৎ শরীরে খিচুনি ধরা বা কোন একটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গে খিঁচুনি ধরা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ব্রেন টিউমরের অন্যতম লক্ষণ।
কোন ক্ষেত্রে কী লক্ষণ দেখা দেবে এটা সম্পূর্ণভাবে নির্ভও করছে মস্তিষ্কের কোন জায়গায় টিউমরটি তৈরি হয়েছে তার উপর।
> রোগ নির্ণয়ে নিচের পরীক্ষাগুলো সহায়কঃ
ব্রেনের সিটিস্ক্যান, এমআরআই ও প্রয়োজনে পেট স্ক্যান।
ব্রেইনের এনজিওগ্রাম
লাম্বার পাংচার করে সিএসএফ পরীক্ষা।
স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারিতা দেখার জন্য ইলেকট্রো এনকেফালোগ্রাফি বা ইইজি।
স্নায়ুতন্ত্রের পরিবহন ক্ষমতা বা নার্ভ কন্ডাকশন টেস্ট বা ইলেকট্রোমায়োগ্রাফি।
সিটি গাইডেড এফএনএসি বা ব্রেনির টিসু বায়োপসি।
> ব্রেন টিউমারের হাত থেকে নিরাপদ থাকা উপায় :-
প্রথমেই বলা হয়েছে যে, ব্রেন টিউমার দেখা দেওয়ার সঠিক কারণ এখনও শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে কিছু সাধারণ নিয়ম ও স্বাস্থ্যকর জীবন ব্যবস্থা ব্রেন টিউমারকে দূরে রাখতে কাজ করবে বলে বিশ্বাস করে বিশেষজ্ঞরা। যার মাঝে রয়েছে-
ক্যানসার প্রতিরোধী খাবার গ্রহণ
প্রচুর পরিমাণ প্রাকৃতিক খাদ্য উপাদান থেকে ক্যানসার বিরোধী উপাদান পাওয়া যায়। আপেল, আঙ্গুর, ব্রকলি, গাজরের মতো উপকারী এই সকল খাদ্য উপাদানগুলোকে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় রাখার চেষ্টা করতে হবে।
পর্যাপ্ত ঘুম- চোখ ও মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দেওয়ার জন্য প্রতিটি পূর্ণবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমাতে হবে।
মোবাইলের সীমিত ব্যবহার- মোবাইল ফোন থেকে নিঃসৃত রশ্মি ব্রেন টিউমার দেখা দেওয়ার সম্ভবনাকে বাড়িয়ে দেয়। তাই মোবাইল ফোন যথাসম্ভব কম ব্যবহার করতে হবে।
ধূমপান বর্জন করা- সন্দেহাতীতভাবে এই বিষয়ে একমত পোষণ করতেই হবে, ধূমপান ক্যানসারের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। এছাড়া ব্রেন টিউমারের ঝুঁকি বৃদ্ধিতেও অবদান রাখে এই বদ অভ্যাসটি।
নিয়মিত শরীরচর্চা করা, মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি মূলক কাজ করা (ধাঁধা কিংবা গণিত সমাধান), মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। পাশাপাশি সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে, উপোরক্ত লক্ষণ সমূহ প্রকাশ পেলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। বিজ্ঞানের আধুনিক প্রযুক্তি বিকাশের ফলে উন্নত পরীক্ষা–নিরীক্ষার মাধ্যমে সহজেই মস্তিষ্কের টিউমার নির্ণয় করা যায়। সম্পূর্ণ ও সঠিক চিকিৎসায় অনেক রোগীই সুস্থ হয়ে পুরোপুরি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারেন।
পরিশেষে বলতে চাই, উপযুক্ত চিকিৎসার সাহায্য নিয়ে ব্রেন টিউমারের কবল থেকে মুক্তি পাওয়া খুব কঠিন নয়। আর ব্রেইন টিউমারের চিকিৎসা ব্যয়বহুল। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এই চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা দুরূহ। তাই দরকার সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা। চিকিৎসার জন্য পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি করা, আক্রান্তদের মানসিকভাবে শক্তি জোগানো, সুস্থদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি। কিছু রোগের জন্য রোগী দায়ী থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের বিভিন্ন দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানের অবহেলাও এর জন্য দায়ী; যেমন, খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধের কারণে সৃষ্ট রোগের জন্য দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়ী করাই যায়। তাদের নিয়ন্ত্রণ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তাই হয় ভেজাল খাদ্য বন্ধ করতে হবে, অন্যথায় রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দিতে হবে। বাংলাদেশ যদিও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় অনেক উন্নতি করেছে, কিন্তু বড় রোগের চিকিৎসায় কোটি কোটি রোগীকে টেকসই সেবা দিতে পারছে না। তাহলে গরিব মানুষের ব্যয়বহুল চিকিৎসার দায়িত্ব কে নেবে? অবশ্যই সরকারকে নিতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঘোষণা অনুযায়ী, সবার জন্য বড় রোগের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে, কোটি কোটি অসুস্থ নাগরিক নিয়ে উন্নত দেশ গড়া সম্ভব নয়। তাই রোগের সব উৎস যে কোনো উপায়ে বন্ধ করতে হবে। তাই সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন যাপন, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া ও নিয়মিত শরীরচর্চা করে ব্রেন টিউমার ঠেকানো যায়। অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা উচিত। রেডিয়েশনের ব্যপারেও সতর্ক থাকতে হবে। কোনও সমস্যা হলে অবশ্যই সময় নষ্ট না করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
কলাম লেখক ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
ইমেইল: [email protected]
বিভাগ : স্বাস্থ্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
পরলোকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং :ভারতে ৭ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা
কালীগঞ্জে রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীর সংবাদ সম্মেলন
গ্রাম আদালত সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরিতে সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত
মিসরে প্রেসিডেন্ট সিসির বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ
কুর্দি যোদ্ধাদের ভয়ঙ্কর হুঁশিয়ারি এরদোগানের
৩৫শ’ এজেন্টের অধিকাংশই গুজরাটের পাচারকারী
৫ সাংবাদিককে হত্যা করল ইসরাইল বিমান
তুষারপাতে অচল হিমাচল দুই শতাধিক রাস্তা বন্ধ
ক্রিপ্টো রিজার্ভ গড়বেন ট্রাম্প?
মোজাম্বিকে কারাদাঙ্গায় নিহত ৩৩, পলাতক ১৫০০ কয়েদি
গাজায় যুদ্ধবিরতি বিলম্বে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ হামাস-ইসরাইলের
পাকিস্তানে সড়ক অবরোধে শতাধিক শিশুর প্রাণহানি
আফগানিস্তানে ৭১ সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছে পাকিস্তান
শুধু নারীদের জন্য
নিথর দেহ
আত্মহননে
জকিগঞ্জে প্রাক্সিসের ৭ দিনব্যাপী ইংলিশ স্পিকিং চ্যালেঞ্জ কম্পিটিশনের পুরস্কার বিতরণী
মাদ্রাসার ছাদ থেকে পাইপ বেয়ে নামার সময় পড়ে গিয়ে শিশুর মৃত্যু
গাজীপুরে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাকে ছাড়িয়ে আনতে থানায় বিএনপি নেতাদের ভিড়
শুধু নামেই জিমনেসিয়াম