ফিলিস্তিন মুক্তির প্রতিশ্রুতি
১৩ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:২০ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০৫:৩৯ পিএম
বিংশ শতাব্দীর ৪০ এর দশকে ইহুদিবাদী ইসরাইল কর্তৃক ফিলিস্তিনের ভূমি ও পবিত্র কুদ্স দখলের পর একটি কঠিন সময়কাল অতিবাহিত হয়েছে এবং সেখানকার রাজনৈতিক জীবনে অনেক উত্থান-পতন হয়েছে। ইসরাইলে দখলদার সরকার গঠনের পর আরব বিশ্বের পক্ষে কয়েকটি দেশ (মিশর, সিরিয়া ও জর্ডান) এই শাসন ব্যবস্থার মোকাবিলা করতে শুরু করে। কিন্তু ১৯৬৭ সালের ছয়দিনের যুদ্ধ ও ১৯৭৩ সালের রমজানের যুদ্ধে ইসরাইলের কাছে আরব দেশগুলোর হতাশাজনক পরাজয়ের পর কুদস শরীফ ও ফিলিস্তিনের মুক্তির বিষয়টি অস্পষ্টতা ও অচলবস্থার মধ্যে পড়ে। মিশর ও ইসরাইলের মধ্যে ১৯৭৮ সালে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষরের ফলে অধিকৃত ফিলিস্তিন এবং এর নিপীড়িত ও বাস্তচ্যুত জনগণের অবস্থা আগের চেয়ে আরও কঠিন হয়ে পড়ে। মিশর ছাড়াও কয়েকটি আরব ও ইসলামি দেশের মধ্যে ইহুদিবাদী ইসরাইলকে মোকাবিলার নীতিতে পরিবর্তন আসে এবং তারা ইসরাইলের সাথে আপসকামী নীতি গ্রহণ করে।
এই পরিস্থিতি ইহুদিবাদী ইসরাইলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইসলামি বিশ্ব ও মুসলিম জাতিগুলোর ঐক্য ও সংহতিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে এবং ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসলামি সরকারগুলোর মধ্যে বিভেদ ও বিভক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রকৃতপক্ষে এই পরিস্থিতি ও সময়টুকুতে ইসরাইলই ময়দানে বিজয়ীর বেশে আবির্ভূত হয় এবং তারা নিজের অস্তিত্বকে বৈধতা দেয়ার নিমিত্তে মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাজনৈতিক অগ্রযাত্রার সূচনা করে।
কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের বিজয় ফিলিস্তিন ইস্যুর পরিবর্তন প্রক্রিয়ায় একটি টার্নিং পয়েন্ট হয়ে ওঠে এবং ইরানের ইসলামি বিপ্লবের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম খোমেইনী (রহ.) দখলদার ইহুদীবাদী সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পতাকা উড্ডীন করেন এবং কুদ্স শরীফ ও ফিলিস্তিনের ইসলামি ও পবিত্র ভূমির মুক্তির বিস্মৃত লক্ষ্য ও আদর্শকে পুনরুজ্জীবিত করেন।
ইমাম খোমেইনী (রহ.) এর পক্ষ থেকে রমজান মাসের শেষ শুক্রবারকে আল কুদস দিবস নামকরণ ছিল একটি বৃহৎ বুদ্ধিবৃক্তিক ও গঠনমূলক রাজনৈতিক উদ্যোগ, যা ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক মুক্তি সংগ্রামের পথকে পাল্টে দেয় এবং এই পথটিকে আলোকিত ও মসৃণ করে তোলে। এই উদ্যোগ ও নামকরণ কয়েকটি দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশ্বের সমস্ত মুসলিম ও এমনকি বিশ্বের অন্যান্য মুক্তিকামী জাতির জন্যও এর সুস্পষ্ট বার্তা রয়েছে।
পবিত্র রমজান মাসের শেষ শুক্রবারকে ‘বিশ্ব কুদস দিবস’ হিসেবে নামকরণের গুরুত্ব ও এর বার্তা বিভিন্ন দিক থেকে বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করা যেতে পারে, যার মধ্যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক্ নিচে উল্লেখ করা হলো।
প্রথমত: বিশ্ব কুদস দিবসের সর্বাগ্রে যে বার্তা ও অর্জন, তা হলো পবিত্র কুদস ও ফিলিস্তিনের ভূমির বিষয়টি বিশ্ব জনমতের ইস্যু ও সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে এবং এটি আর ভুলে যাওয়ার নয়। আর এই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু থেকে বিশ্বের জনমতকে বিচ্যুত করার জন্য ইহুদিবাদী ইসরাইল ও তার মদদদাতা পশ্চিমা শক্তিগুলোর প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তাই ফিলিস্তিনের দখলকৃত অঞ্চলের অভ্যন্তরীণ ঘটনা ও তেলআবিবের কর্মকর্তাদের অপরাধযজ্ঞের বিষয়টি পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো এড়িয়ে গেলেও স্বাধীন গণমাধ্যমগুলো এ বিষয়ে দৃষ্টি রেখেছে।
দ্বিতীয়ত: বিশ্ব কুদ্স দিবস নামকরণের আগ পর্যন্ত ফিলিস্তিন ইস্যুটি ছিল সরকারি সম্পর্কের কাঠামোর মধ্যে, তাও আবার কয়েকটি প্রভাবশালী আরব রাষ্ট্রকেন্দ্রিক। কিন্তু বিশ্ব কুদস দিবস ফিলিস্তিন ইস্যুকে একটি সরকারি ফাইলবন্দি বিষয় থেকে জনগণের ইস্যুতে পরিণত করেছে ও জাতিগুলোকে একত্রিত করেছে। এই অর্জন কিছু আরব ও ইসলামি সরকারের আপস প্রক্রিয়াকে প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে এবং ফিলিস্তিন সংকট নিরসনের বিষয়টি সরকারগুলো থেকে জাতিসমূহের প্রধান দাবিতে পরিণত হয়েছে।
তৃতীয়ত: আজ ফিলিস্তিন ইস্যু ও কুদ্স শরীফের ভাগ্য কেবলমাত্র একটি ফিলিস্তিনি ও এমনকি একটি আরবীয় ইস্যু নয়, এটি সমগ্র ইসলামি বিশ্বের ও সমস্ত মুসলমানের বিষয়। এই ভাবনা থেকে ফিলিস্তিনি আদর্শ ও এর মুক্তি আন্দোলনকে ঘিরে ইসলামি বিশ্বের সকল সক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধাকে একত্রিত করা সম্ভব এবং এই প্রক্রিয়া শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তিনে দখলদারিত্বের অবসান এবং ফিলিস্তিনিদের পূর্ণ অধিকার নিশ্চিত হওয়ার মাধ্যমে পরিণতি লাভ করতে পারে।
চতুর্থত: বিশ্ব কুদ্স দিবসের আন্দোলন ফিলিস্তিনের ইসলামি দিকগুলো ছাড়াও এর অন্যান্য মানবিক ও আইনগত দিকগুলোও উত্থাপন এবং বিশ্ব জনমতের কাছে তা অনুসরণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রাথমিক দৃষ্টিতে বিশ্বের কোনো কোনো জাতির জন্য ফিলিস্তিন ইস্যুটি কেবল একটি আরবীয় বা ইসলামি সমস্যা ছিল। কিন্তু কুদ্স দিবসের বৈশ্বিক আন্দোলন একে একটি সর্বজনীন ইস্যুতে পরিণত করেছে এবং এর মানবিক ও আইনগত দিকগুলোও তুলে ধরছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আজ বিশ্বের কোনো কোনো অমুসলিম জাতিও ফিলিস্তিন সমস্যা এবং ফিলিস্তিনি জনগণের কঠিন পরিণতির বিষয়টি উপলব্ধি করছে এবং মানবিক ও আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে ফিলিস্তিনের মজলুম জনগণকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
নিঃসন্দেহে এই ভূখ-ের দখলদাররা ফিলিস্তিনি জনগণের প্রাথমিক মানবাধিকার হরণ করেছে এবং তাদের খোদা প্রদত্ত ও স্বাভাবিক জীবন যাপনের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। এ কারণে মুসলিম ও অমুসলিম জাতি নির্বিশেষ বিশ্বের সকল মানুষ ফিলিস্তিনি জনগণের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে আসছে এবং এটি বিশ্ব কুদ্স দিবস আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা ও অর্জন ছাড়া আর কিছুই নয়।
পঞ্চমত: বিশ্ব কুদ্স দিবসের নামকরণ ও এর বড় অর্জন সম্পর্কে চূড়ান্ত ও শেষ কথা হলো, এই রাজনৈতিক উদ্যোগ ফিলিস্তিনি জাতি এবং বিশ্বের অন্যান্য ইসলামি ও স্বাধীনতাকামী জাতির মুক্তি সংগ্রামের পথে একটি সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছে এবং তাদেরকে ফিলিস্তিনের নিপীড়িত জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং দখলদার ইহুদিবাদীদের হাত থেকে এই পবিত্র ভূমিকে মুক্ত করতে আশাবাদী করেছে।
অন্যকথায়, আজকের বিশ্ব কুদ্স দিবস ফিলিস্তিনের মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেয় এবং এই উজ্জ্বল পথের ধারাবাহিকতা নিশ্চিতভাবে আল কুদসের আদর্শের উপলব্ধি এবং দখলদার ইহুদিবাদীদের হাত থেকে ফিলিস্তিনের ভূমিকে মুক্ত করার মধ্য দিয়ে শেষ হবে। এটি এমন এক প্রত্যয়, যার লক্ষণগুলো এখন অতীতের তুলনায় আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এবং তেলআবিব ও অধিকৃত অঞ্চলের বর্তমান ঘটনাবলি তারই সূচনা ও আভাষ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।
লেখক: কালচারাল কাউন্সেলর, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান দূতাবাস, ঢাকা।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
গুমের দায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২২ সদস্য চাকরিচ্যুত
কুরস্ক অঞ্চলের ৪০ ভাগ খোয়ানোর স্বীকারোক্তি ইউক্রেনের
মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ চীনের সাথে কাজ করতে আগ্রহী: বাণিজ্য উপদেষ্টা
হাজীদের সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষায় সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ধর্ম উপদেষ্টা ড. খালিদ হোসেন
শরীয়তপুরে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের যৌথ কর্মী সভা
মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় সিকিউরিটি গার্ড নিহত
পাকিস্তানকে উড়িয়ে দিল জিম্বাবুয়ে
১৫ দিন রিমান্ড শেষে কারাগারে আব্দুর রাজ্জাক
লক্ষ্মীপুরে ১২০ টাকায় পুলিশে চাকরি পেলেন ৫০ জন
নির্বাচিত সরকারই দেশকে পুনর্গঠন করতে পারে : তারেক রহমান
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জেলা কমিটিতে অচেনা ৭ জন
মৌলভীবাজারে কৃষি ও প্রযুক্তি মেলা শুরু
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের মডেল উদ্ভাবন
ব্রহ্মপুত্রে অবৈধ ড্রেজার বসিয়ে চলছে বালু ব্যবসা
বাঘায় কৃষি শ্রমিককে গলা কেটে হত্যা
কেশবপুরে অবৈধ ইটভাটা বন্ধে বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ
হামলার শিকার হয়েও মুখ খুলতে পারছে না বোয়ালমারীর বহু পরিবার
ইসলামী আন্দোলনের গণসমাবেশে আ.লীগ নিষিদ্ধের দাবি
বিপিএলের প্রথম দিনই মাঠে নামছে বসুন্ধরা-মোহামেডান
সাগরে মিলছে না আশানুরূপ ইলিশ হতাশায় মীরসরাইয়ের জেলেরা