শ্রেষ্ঠ রাত লাইলাতুল কদর
১৭ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:০৬ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০৬:১১ পিএম
একজন পাপীষ্ঠ নরাধম যদি তার কৃত পাপের জন্য জীবনের কোনো শুভক্ষণে অনুতপ্ত হয়ে পূন্যের আকাক্সক্ষী হয় তবে কী সুযোগ রয়েছে প্রায়শ্চিত্তের? নাকি কৃতকর্মের জন্য সমুচিত শাস্তি অবশ্যম্ভাবী? এমনটি যদি হয়, তবে আখেরি জমানার স্বল্পায়ু উম্মতগণ কীভাবে জীবনে পাপস্খলন ঘটিয়ে পূণ্যের অধিকারী হবে, পাপীদের মনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব এবং মানসিক হতাশার অবসান ঘটিয়ে জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মোহাম্মদ (সা.) সেই চৌদ্দশত বছর আগে বলে গেছেন পাপ করলেও মানুষ পূন্যের অধিকারী রয়েছে। তবে কীভাবে একজন মানুষ তার পর্বত প্রমাণ পাপ থেকে মুক্তি লাভ করবে? কারণ, পাপের মুক্তির জন্য বহু বছরের এবাদত যথেষ্ট নয়। স্বল্প আয়ুষ্কালের একজন মানুষের পক্ষে পাপের মার্জনার্থে এতবছর উপাসনা করাও অসম্ভব। এমতাবস্থায় ইসলাম তার অনুসারীদের নিরাশ করেনি। দোজাহানের প্রিয় নবী রাসূলেপাক (সা.) উম্মতদের আশ্বস্ত করে বলেছেন, সমস্ত জীবনেরসমূহ গোনাহ মার্জনার জন্য একটি রজনীর এবাদতই যথেষ্ট। এজন্য শত সহ¯্র বছরের নিরবচ্ছিন্ন উপাসনার প্রয়োজন নেই। স্বয়ং আল্লাহ পাক উম্মতে মোহাম্মদীদের এ ধরনের সুবর্ণ সুযোগ করে দিয়েছেন, যাতে স্বল্পায়ুর একজন মহাপাপীও তার পর্বত প্রমাণ পাপ একটি রাতের এবাদতের মাধ্যমে জীবনকে নিষ্পাপ করতে পারে। বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে এ ধরনের সুবর্ণ সুযোগ সম্পন্ন দুটি রজনী রয়েছে। একটি লাইলাতুল বরাত, অপরটি লাইলাতুল কদর। মাহাত্ম্য এবং মর্যাদার দিক দিয়ে এ দুই শ্রেষ্ঠ রাতের মধ্যে লাইলাতুল কদরের তাৎপর্য সর্বাধিক। কদরের পরেই বরাতের শ্রেষ্ঠত্ব নিরূপিত। মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহতায়ালা সর্বোত্তম রাত লাইলাতুল কদর উম্মতে মোহাম্মদীকে উপহার দিয়েছেন, যে রাতের মহানতা অন্যান্য সহস্র রাতের চেয়েও বেশি। পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক এ ফজিলতময় এবং তাৎপর্যশালী রজনীকে লাইলাতুল কদর নামে অভিহিত করেছেন। কুরআনেপাকে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা এ রাতের মহিমা বর্ণনা করেছেন। বলেছেন: নিঃসন্দেহে এ রাত হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। এ রাতের মহানতা অপরিসীম।
লাইলাতুল কদর সম্পর্কে পবিত্র কুরআন শরিফে বিস্তৃত আলোচনা করে বলা হয়েছে যে, শবে কদর এমন একটা পূন্যময় রাত, যার মহিমা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। সে আল্লাহর সবচেয়ে স্নেহধন্য, যে শবে কদরের সমগ্র রাত আরাধনায় নিমগ্ন থাকবে প্রতিপালকের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য, আর মানবজাতির মধ্যে সে অধিক সৌভাগ্যবান, যার ভাগ্যে জুটেছে শবে কদরের রাতে উপাসনা করার সুবর্ণ-সুযোগ। অন্য হাজার মাস কঠোর ইবাদত করলে যে পরিমাণ পূন্য হাসিল হয় তার চেয়েও অধিক সওয়াব সঞ্চিত হয় কেউ যদি শবে কদরের রাতের প্রতিটি মুহূর্ত অতিবাহিত করে এবাদতের মাধ্যমে।
যেহেতু শবে কদরের একটি রাতের ফজিলত হাজার মাসের থেকেও উত্তম, তাই যে ব্যক্তি একটি রাত এবাদত করল আল্লাহর বিবেচনায় সে ব্যক্তি যেন সুদীর্ঘ এক হাজার মাস শুধু উপাসনা করে কাটালো, যার সুবাদে অনায়াসে লাভ করল পরম করুণাময়ের নৈকট্য। সেই সঙ্গে আমলনামায় সংযোজিত হলো অসীম সওয়াব। পরকালের জন্য অবারিত হয়ে গেল বেহেস্তের দ্বার। তাই হযরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন: হে মানবজাতি, তোমাদের কৃত পাপের জন্য দয়াবান আল্লাহর কাছে আজ রাত কায়মনোবাক্যে ক্ষমা প্রার্থনা করো, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের মার্জনা করবেন। কেননা শবে কদরের রাতে করুণাময় খোদা তাঁর নিজ করুণা বলে পৃথিবীর সকল পাপী-তাপীর সমূহ গোনা মার্জনা করে থাকেন। এ মহিমাময় রাতে আল্লাহতায়ালা তাঁর বান্দাদের জন্য অত্যন্ত মেহেরবান হয়ে উঠেন এবং বিশেষভাবে ক্ষমা প্রদর্শন করেন।
রমজান মাসকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করে একেকটি ভাগের একেকটি পৃথক বৈশিষ্ট্য কুরআনে বর্ণনা করা হলেও শেষ দশদিন হচ্ছে সর্বাধিক মর্যাদাশালী এবং বিশেষ ফজিলতপূর্ণ। কারণ, এ দশদিনের মধ্যেই লুক্কায়িত রয়েছে সর্বশ্রেষ্ঠ রাত পবিত্র লাইলাতুল কদর। এ রাতে ফেরেশতাগণের পক্ষ থেকে মুমিনদের প্রতি বর্ষিত হয় অজ¯্র সালাম ও মোবারকবাদ। শবে কদর সহ¯্র মাসাপেক্ষা উত্তম, এ জন্যই এ রাতেই ইসলামের হƒদপিন্ড কুরআন শরীফ লৌহে মাহফুজ থেকে পৃথিবীর আকাশে অবতীর্ণ হয়। পরে এ মহাগ্রন্থ হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর মাধ্যমে পৌঁছেছে মাটির মানুষের কাছে। রমজানের শেষ দশদিনের মধ্যে নিহিত রয়েছে মহান শবে কদরের ফজিলতময় রাত। তবে এ দিনগুলোর কোন রাত শবে কদর তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি। শুধু বলা হয়েছে, তোমরা এ দশদিনের মধ্যে মহিমাময় রাতকে অনুসন্ধান কর। তাই শবে কদরের সঠিক রাত তারিখ নিয়ে মতান্তর রয়েছে। হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর মতে, শেষ দশদিনের একটি বেজোড় তারিখেই রয়েছে শবে কদরে রাত। বেজোড় তারিখগুলোর ২৭ রমজানেই শবে কদর অতিবাহিত হওয়ার অধিকতর সম্ভাবনা রয়েছে বলে ইসলামী বিশেষজ্ঞদের ধারণা। ২৭ রমজানের দিকে মতামতের ঝোঁক বেশি থাকায় ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা এ তারিখকে শবে কদর বলে বিশ্বাস করেন। উলামায়ে কেরামদের পক্ষ থেকে মহিমান্বিত এ রাতের নির্দিষ্ট তারিখ অনুল্লেখিত থাকার পেছনে নানা কারণ বিভিন্ন যুক্তির সঙ্গে বর্ণনা করা হয়েছে। শবে কদর পাবার লোভে প্রত্যেক রাতের প্রতি যাতে সম্মান প্রদর্শন করে বিশেষ আগ্রহ সহকারে এবাদত বন্দেগি করা হয় তার জন্য শবে কদরের সঠিক তারিখ স্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়নি। শবে কদর লুক্কায়িত রাখার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে এটাই। শ্রেষ্ঠ ঐশ্বীগ্রন্থ আল কুরআনকে শবে কদরের রাতেই নাজেল করা হয়েছে। তাই আল্লাহ তায়ালা লাইলাতুল কদরের নামানুসারে কুরআন মজিদের একটি সুরার নাম রয়েছে সুরাতুল কদর এবং এতেই বিধৃত রয়েছে কদরের অপরিসীম মাহাত্ম্যের কথা। এ সুরাতে কুরআন এবং পবিত্র এ রাত স¤পর্কে ঘোষণা দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: তোমরা কি জান, আমি কুরআনকে কদরের পবিত্র নিশিতে নাজেল করেছি। তাই এ রাতকে করেছি হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ। এ রাত ফেরেস্তাকুল এবং হযরত জিব্রাইল (আ.) আল্লাহতায়ালার অনুমতিক্রমে পৃথিবীতে অবতরণ করেন। তাই রাতটি পুরোপুরি শান্তিময়। ভোর পর্যন্ত মাটির মানুষের উপর রহমতের বারি বর্ষণ করা হয়। ইচ্ছা করে থাকলে যে কোনও মানুষই এ রাতে পূন্যস্নাত হতে পারে।
সৃষ্টিলোককে আল্লাহতায়ালা তাঁর নিজস্ব পরিকল্পনা মাফিক পরিচালনা করেন। সে পরিকল্পনা বাস্তাবায়নের ক্ষেত্রে বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে একটি দিনকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। সে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী দিনকে লাইলাতুল কদর বলে অভিহিত করা হয়েছে। সৃষ্টিলোক পরিচালনার যাবতীয় সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত রূপ নেয় এ রাতে এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব আল্লাহ ফেরেস্তাদের উপর অর্পণ করেন। আর আল্লাহতায়ালার সমস্ত সিদ্ধান্তকে কার্যক্ষেত্রে রূপায়িত করেন, তারই সদা অনুগত ফেরেস্তারা।
ফজিলত রহমত ও বরকতময় রাতের সঠিক তারিখ সবার অজ্ঞাত থাকায় ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের রমজানের শেষ দশদিন এতেকাফে নিমগ্ন থাকেন। শবে কদর অনুসন্ধানই এতেকাফের মুখ্য উদ্দেশ্য। কোনো নীরব স্থানে নিরালায় বসে নিবেদিতচিত্তে মহৎ সাধনায় ধ্যানমগ্ন হওয়ার নাম এতেকাফ। ইসলামের পারিভাষিক অর্থে ইবাদতের উদ্দেশ্যে যাবতীয় সাংসারিক কাজকর্মসহ পার্থিব চিন্তা-ধান্দা ছেড়ে মসজিদে পারলৌকিক চিন্তায় বিভোর থাকাকে বলা হয় এতেকাফ।
রমজানের কুড়ি তারিখ সন্ধ্যায় এতেকাফের জন্য ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মসজিদে প্রবেশ করেন আর ঈদের নতুন চাঁদ দেখার পর ভঙ্গ করেন এতেকাফের কঠোর সাধনা। রমজানের বিশ তারিখ থেকে শেষ রমজান পর্যন্ত এতেকাফ সুন্নতে মোয়াক্কাদা। কারণ, রমজানের শেষ দশদিন বিশ্বনবী এতেকাফ পালন করতেন। এতেকাফ মানুষকে আত্মবিশ্লেষণ এবং আত্মজিজ্ঞাসার সুযোগ দেয়। এতেকাফকারীর সমস্ত পাপ মার্জনা করার জন্য আল্লাহতায়ালা দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ। এতেকাফ করে অসহায় মানুষ সর্বতোভাবে সকল সাংসারিক কাজকর্ম ত্যাগ করে আত্মনিবেদন করে তার প্রতিপালকের চরণতলে। তাই এতেকাফকারীর শয়ন-স্বপ্ন সব কিছুই এবাদতের মধ্যে গণ্য হয়।
মানুষ বৈষয়িক সম্পর্ক ছিন্ন করে অখন্ড মনোযোগের সঙ্গে মহাপ্রভুর ধ্যানে লিপ্ত হোক, আল্লাহ এটাই বেশি পছন্দ করেন। জীবন ধারণের তারতম্য রেখা বজায় রেখে মানুষের চলার সার্বক্ষণিক অনুভূতিকে সতেজ রাখে উপাসনা। এতেকাফ প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক কুরআনে এরশাদ করেছেন যে, নিশ্চয়ই রাত্রি জাগরণ অসৎ প্রবণতা দূরীকরণ ও কুপ্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার একটি সহজ উপায়। বলা হয়, হে মানব, দিনের বেলা থাকে তোমার বহু কর্মব্যস্ততা। সুতরাং রাতের নিস্তব্ধ পরিবেশে তোমার প্রভূকে একান্তে স্মরণ কর আর আত্মা-মন-হƒদয়কে নির্দ্বিধায় সমর্পণ কর বিশ্ব প্রভুর পদতলে।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস
শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া
ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল
‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’
প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের
প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া
মুসলিম চিকিৎসক
শীর্ষে দিল্লি
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান