নদীর পানি ও প্রকৃতির ওপর আধিপত্যবাদের আগ্রাসন
১৮ এপ্রিল ২০২৩, ০৭:২০ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০৭:২৮ পিএম
তীব্র দাবদাহে জনজীবনে চরম দুর্ভোগ নেমে এসেছে। আবহাওয়া ক্রমেই চরমভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিনের অনাবৃষ্টি, নাব্য হারানো ও দূষণে উপযোগিতা হারানো নদ-নদীগুলো গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের কোটি কোটি মানুষের তৃষ্ণা মেটাতে, প্রাণ শীতল করতে কিংবা ফসলের মাঠগুলোকে সবুজ রাখতে পারছে না। হিমালয়ের সব বরফ গলে শেষ হয়ে যায়নি। ক্লাইমেট চেঞ্জ এক্সপার্টরা বরফ গলা বৃদ্ধি পেয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে হিমালয়ে বরফ গলা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে উজান থেকে নেমে আসা আমাদের নদ-নদীগুলোতে প্রবাহ বেড়ে যাওয়ার কথা। আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও নদী আইন অমান্য করে ভারত আমাদের প্রায় সবগুলো নদীতে বাঁধ নির্মাণ ও পানি প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে একটি চরম ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। ইতিহাসের পরিক্রমায় দেশভাগ হলেও ভূপ্রাকৃতিক কারণে পাহাড় ও নদ-নদীর উৎসস্থলগুলো অবিভাজ্য ও প্রতিবন্ধকতামুক্ত রাখার কোনো বিকল্প নেই। যৌথ নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা ও নদীর প্রবাহ ঠিক রাখা শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, পুরো অববাহিকা অঞ্চলের কোটি কোটি মানুষের জীবনযাত্রা, কৃষি, পরিবেশ, খাদ্যনিরাপত্তা ও অর্থনীতির জন্য একটি জীবনমরণ সমস্যা। বিশ্বের আর কোনো অঞ্চলে কোনো আঞ্চলিক শক্তির দ্বারা আন্তর্জাতিক নদীর উপর এমন বল্গাহীন-বেপরোয়া নিয়ন্ত্রণের কোনো উদাহরণ নেই। ভূপ্রাকৃতিকভাবে কৌশলগত অবস্থানের সুযোগে ভারত তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে আন্তর্জাতিক নদীর আঞ্চলিক পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিপজ্জনক খেলায় মেতে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে ভারতের সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক এজেন্ডার মূল টার্গেট পাকিস্তান ও বাংলাদেশ হলেও ১৯৬০ সালে বিশ্বব্যাংকের মধ্যস্থতায় সম্পাদিত ইন্ডাস ভ্যালি পানিচুক্তির কারণে এই দুই দেশের মধ্যে এক প্রকার ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান বজায় থাকলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তার নিয়ন্ত্রণ পুরোটাই ভারতের হাতে। গত ৬ দশকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে অন্তত তিনটি সম্মুখ যুদ্ধ এবং বেশকিছু সীমান্ত সংঘাত থেকে শুরু করে পারমানবিক যুদ্ধের হুমকির সম্মুখীন হলেও দুই দেশের মধ্যকার পানিচুক্তি ও সিদ্ধু নদীর পানিবন্টন চুক্তির বড় কোনো ব্যত্যয় ঘটতে দেখা যায়নি। একেকটি দেশ ও অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি, কৃষ্টি-কালচার, ডেমোগ্রাফি, খাদ্য নিরাপত্তা ও মৌলিক অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সেখানকার নদনদী, পাহাড়, উর্বর সমভ’মি ও সামুদ্রিক সম্পদের উপর নির্ভরশীল। সুপেয় পানির উৎসগুলো রুদ্ধ করে দেয়া হলে মানুষের বাসযোগ্যতা ও নিরাপত্তার জন্য অন্য সব সম্পদ কোনো কাজে আসেনা। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যৌথ নদীর পানি থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করে ভারত মূলত বাংলাদেশের উপর তার আধিপত্যের থাবাকে সুদৃঢ় রাখতে চাইছে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারা রুদ্ধ করে অগণতান্ত্রিক পন্থায় একটি বশংবদ শাসকগোষ্ঠির ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার মধ্য দিয়ে ভারতীয় শাসকরা বাংলাদেশের সত্যিকারের কণ্ঠস্বরকে রুদ্ধ করে দেশের অস্তিত্বকেই ক্রমশ চরম হুমকির মুখে ঠেলে দিতে শুরু করেছে।
জ্বালানি তেলের যুদ্ধের সময় দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। ফসিল ফুয়েল বা জ্বালানি তেলের নানাবিধ বিকল্প থাকলেও পানির কোনো বিকল্প নেই। ক্লাইমেট চেঞ্চ, খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশগত সুরক্ষার ইস্যুগুলোকে সামনে রেখে মানব সমাজ আগামিতে সবচেয়ে বড় যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের আশঙ্কা করছে তা হতে পারে সুপেয় পানির সংকট। বিশেষত যৌথ নদীর উৎসগুলোতে আঞ্চলিক শক্তির নিয়ন্ত্রণ বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘাতের মূল কারণ হয়ে দেখা দিবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন। তবে তেলের জন্য যুদ্ধের বহু আগে থেকেই ক্ষমতাধর রাজা-মহারাজারা সুপেয় পানির উৎসের উপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ভাটির অপেক্ষাকৃত দুর্বল জাতিকে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ ও পদানত করার চেষ্টা করেছে। খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় সহশ্রাব্দে মেসোপটেমিয় সভ্যতায় লাগাশের রাজা উরলামা প্রথমে তার প্রতিদ্বন্দ্বী জনপদ উম্মার গিরসা নগরীকে পানি বঞ্চিত করতে আন্ত:সীমান্ত নদীতে ফিডার ক্যানেলে অতিমাত্রায় পানি প্রত্যাহারের মধ্য দিয়ে পরিকল্পিতভাবে নদীকে শুকিয়ে গিরসা নগরীকে পানিশূন্য করে দিয়েছিল বলে ইতিহাস রয়েছে। উরলামার পুত্র ক্ষমতায় এসে গিরসা নগরীর সুপেয় পানির উৎসগুলো বন্ধ করে দিয়েছিলেন। প্রাচীন ইতিহাসে ব্যাবিলনের রাজা হাম্মুরাবি নানা কারণে বিখ্যাত। হাম্মুরাবির প্রপৌত্র আবিশ তাইগ্রিস নদীতে বাঁধম নির্মান করে পানি প্রত্যাহারের মাধ্যমে স্বাধীনতাকামী বিদ্রোহী জনগোষ্ঠিকে দমন করেছিলেন। খৃষ্টপূর্ব অষ্টম শতকে পশ্চিম এশিয়ায় এসিরীয় রাজা দ্বিতীয় আরগন ও তার প্রতিদ্বন্দ্বিরা পরষ্পরকে শায়েস্তা করতে নদনদীর পানিকে অন্যতম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। এসিরিয়া-ব্যাবিলন থেকে গ্রীক-রোমান, মিশরীয়-চৈনিক সভ্যতায় পানিকে কৌশলগত যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। খ্রষ্টীয় প্রথম শতকের শুরুর দিকে জেরুজালেমের ইহুদিদের উপর নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা হিসেবে রোমানরা খাল কেটে জেরুজালেমের নদীর পানি প্রত্যাহার করতে শুরু করলে হাজার হাজার ইহুদি প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসলে রোমান আততায়ী গুপ্তচরদের ছুরিকাঘাতে শত শত ইহুদি হতাহত হয়। খৃষ্টীয় ষোড়শ শতকের প্রথমদিকে জার্মান ও ডাচ নেদারল্যান্ডের সাথে স্পেনীয় সা¤্রাজ্যবাদীদের ৮০ বছরব্যাপী যুদ্ধের শুরুতে ডাচরা স্পেনীয় সৈন্যদের বিপদে ফেলতে নদীর পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিল। তারা নদীর বাঁধ ছেড়ে দিয়ে আল্কামার শহরটিকে বন্যায় ভাসিয়ে দিয়ে পুরো বাহিনীকে বিপন্ন করে তুলেছিল। অন্যদিতে স্পেনিশ হাবসবার্গ শাসকরা ডাচ অর্থনীতি ও জীবনযাত্রাকে বিপন্ন করতে রাইন নদীর উজানে বাঁধ নির্মান ও পানি প্রত্যাহার করে নদী শুকিয়ে কৃষি, নেভিগেশন সিস্টেমসহ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সংকটময় করে তুলেছিল। সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে চীনের মিং ডায়নেস্টির শেষ রাজারা কাইফেং অঞ্চলের গণবিদ্রোহ দমন করতে হোয়াং হো ও ইয়েলো নদীর সংযোগ খালগুলোকে বন্ধ করে দিয়েছিল। কথিত আছে, এর ফলে কাইফেং অঞ্চলে ৩-৪ লাখ লোকের মৃত্যু হয়েছিল।
মানুষের সভ্যতা অনেক দূর এগিয়েছে। বিশ্ব ক্রমশ ছোট হয়ে এখন আমরা বিশ্বায়ণের যুগে প্রবেশ করেছি। যুদ্ধ-বিগ্রহ এখন অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কৌশল ও পুঁজির প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দিতায় পরিনত হয়েছে। তবে দুইটি মহাযুদ্ধে কোটি কোটি মানুষের জীবনহানি ও শত শত সমৃদ্ধ জনপদ ধ্বংসের পর যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি রোধে জাতিসংঘ সহ বেশকিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা গড়ে ওঠার পরও যুদ্ধ বন্ধ হয়নি। সা¤্রাজ্যবাদের জিওস্ট্রাটেজির কবলে পড়ে শান্তিপূর্ণ জনপদগুলো অশান্ত-রক্তাক্ত হয়ে আছে। আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী শক্তির ক্রুড়-চানক্যবাদী নিয়ন্ত্রণ কৌশলের কারণে আমাদের হাজার বছরের ভূপ্রাকৃতিক ঐতিহ্য ও জীবন-জীবীকার মূল উৎস হিসেবে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের নদীগুলো বিপন্ন হওয়ার সাথে সাথে ভাটি বাংলার ২০ কোটি মানুষের জীবনে অশেষ দুর্ভোগ নেমে এসেছে। ফারাক্কার প্রভাবে হুগলি-ভগিরথী অববাহিকার কোটি কোটি মানুষও এখন দুর্ভোগের সম্মুখীন হয়েছে। সেখানকার পরিবেশবাদী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত এখন ফারাক্কা বাঁধ ডিকমিশন্ড করার দাবি তোলছেন। মূলত আধিপত্যবাদী রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কারণে গড়ে ওঠা পুরনো বড় বড় ড্যামগুলো এখন বিশ্বের বিভিন্ন জনপদের জন্য পারমানবিক বোমার ক্ষতির চেয়েও ধ্বংসাত্মক পরিনতি ডেকে আনতে শুরু করেছে। এক সময়ের মাইটি প্রমত্তা পদ্মা-যমুনার বুকে অসংখ্য ধু ধু বালুচর। অসংখ্য শাখানদীর হাজার হাজার কিলোমিটার নৌপথ শুকিয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পর প্রথমে সেখানে নতুন ভূমিতে ফসলের সমারোহ ঘটলেও দিনে দিনে সে সব বালুচর উঁচু হয়ে মরুভ’মির মত উষর ও বিরাণ হতে শুরু করেছে। বাংলাদেশে শীত-বসন্ত পেরিয়ে বৈশাখের আগমন ঘটলেও বৃষ্টির দেখা না পাওয়া এবং অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গে গরমের পারদ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার মধ্য দিয়ে জনজীবনে নাভিশ্বাস অবস্থা, উজানে নদীগুলোকে রুদ্ধ করে দেয়ার সাথে সাথে অপরিকল্পিত উন্নয়ন, নগরায়ণ ও পরিবেশ বিনাশি উদ্যোগ বাস্তবায়নের ফল। আমাদের জনগণ রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে লাখো মানুষের জীবনের বিনিময় হাজার বছরে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেও সে রাষ্ট্রের লক্ষ্য ও প্রত্যাশার ভীতগুলো ক্রমে দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। তথাকথিত উন্নয়নের ডামাঢোল বাজিয়ে মানুষের নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণভাবে বেঁচে থাকার শেষ অবলম্বন ধসে যেতে শুরু করেছে। আমাদের নদ-নদীর পানি বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত, আমাদের আকাশ ও নি:শ্বাসের বাতাস বিশ্বে সবচেয়ে বেশি দূষণে আক্রান্ত। আমাদের রাজধানী শহরটি বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য শহরগুলোর শীর্ষে অবস্থান করছে। লাখো মানুষের প্রাণের দামে অর্জিত রাষ্ট্রের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জনগণের সেবক হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গণতান্ত্রিক সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে জনগণের শাসকে পরিনত হয়েছে। আমরা এখন উন্নয়ন, ডিজিটালাইজেশনের শ্লোগান তুলে জনগণের উপর বাড়তি ঋণ ও করের বোঝা চাপিয়ে প্রমত্তা পদ্মার উপর সেতু নির্মাণ করে আত্মতুষ্টিতে বুঁদ হয়ে থাকলেও পদ্মা-তিস্তা বাঁচিয়ে পুরো অঞ্চলের প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষায় চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছি।
অর্ধ শতাব্দী ধরে চলা ভারতীয় পানি আগ্রাসন ও ষড়যন্ত্রের শিকার বাংলাদেশ। আন্তর্জাতি নদীর উপর একতরফা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ভারতের চানক্যবাদী নীতি-কৌশল দ্বিপাক্ষিক উদ্যোগের নামে ভারতের ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিয়ে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বাংলাদেশ। ফারাক্কা প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরুর পরও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এই প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় প্রকাশিত হয়েছিল। পাকিস্তানের বাঁধার মুখে এই প্রকল্প কখনো চালু করা যাবে কিনা তাই ছিল আলোচ্য বিষয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কোনো পানিচুক্তি ছাড়াই ১৯৭৪ সালে মাত্র ৪০ দিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা প্রকল্প চালু করার কথা বলে বাংলাদেশকে বোকা বানিয়ে পানি প্রত্যাহার অব্যাহত রেখে বাংলাদেশকে নানামুখী বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জিয়াউর রহমান যথেষ্ট সময় পেলে হয়তো এই সমস্যার একটি সম্মানজনক সমাধান হতে পারত। দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় সত্তুরের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে এবং জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৩১তম সম্মেলনে বাংলাদেশ যৌথ নদীর অমিমাংসিত পানি সমস্যা ইস্যুটিকে তুলে ধরলে ভারত এ বিষয়ে আলোচনায় সম্মত হলেও আদতে কোনো কাজ হয়নি। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭৭ সালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই’র সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় কিছুটা অগ্রগতি হওয়ার সাথে সাথে ৫ বছর মেয়াদী একটি গঙ্গা পানি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। জিয়ার মৃত্যুর পর ১৯৮২ সালে চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে এরশাদের ৮ বছর এবং বিএনপি সরকারের ৫ বছরে সেটি আর নবায়ণ হয়নি। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করার কিছুদিনের মধ্যেই নতুন করে গঙ্গার পানিচুক্তি হলেও গ্যারান্টি ক্লজ ছাড়া সে চুক্তি কখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। বাংলাদেশ কখনোই পানির ন্যায্য হিস্যা পায়নি। ভারতের অনীহা ও আধিপত্যবাদী আচরণের কারণে বছরের পর বছর ধরে যৌথ নদী কমিশনের কোনো বৈঠক হয়নি। নদীর অববাহিকা অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় যৌথ নদীর উপর বাংলাদেশের অধিকারের প্রশ্নটি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শুরু থেকেই ভারত আন্তর্জাতিক নদী আইনের দাবি ও ন্যায্যতা অস্বীকার করে বাংলাদেশের সাথে টালবাহানা ও প্রতারণামূলক আচরণ করে দেশের পানি সম্পদ ও নদীব্যবস্থাপনাকে একটি অনিশ্চিত হুমকির মুখে ঠেলে দেয়। লোক দেখানো গঙ্গার পানিচুক্তি এবং তিস্তার পানি চুক্তি নিয়ে দীর্ঘ টালবাহানা থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে, যৌথ নদীর পানিকে ভারত আমাদের বিরুদ্ধে পানি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। বিশ্বসম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণের আগে গঙ্গা নদীকে আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে স্বীকৃতি দিতেই কুণ্ঠিত ছিল তারা। দেশপ্রেমিক দূরদর্শি রাজনৈতিক নেতা মাওলানা ভাসানী শুরুতেই ভারতের দূরভিসন্ধি বুঝতে পেরেছিলেন। কোনো চুক্তি ছাড়াই ফারাক্কা প্রজেক্ট চালুর পর তা অব্যাহত রাখার প্রতিবাদে ৯০ বছর বয়েসী মাওলানা ভাসানী ১৯৭৬ সালের মে মাসে লাখ লাখ মানুষকে নিয়ে ফারাক্কা লং মার্চ করে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন। দেশে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং স্থিতিশীল জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার না থাকায় ১৯৭৭ সালের পানিচুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কোনো সরকারই যৌথ নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় যৌথ নদীর পানির অধিকারের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কোনো বিষয় নেই। এটি রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার সাথে সম্পর্কযুক্ত সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর বিষয়। দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ফলপ্রসু না হওয়ায় সত্তুরের দশকেই বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে তোলা হয়েছিল। তার কিছু সুফলও পাওয়া গিয়েছিল। শেখ হাসিনা সরকারের আমলেই সমুদ্রসীমার অমিমাংসিত বিরোধ নিস্পত্তির জন্য বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্থ হয়ে মিয়ানমার ও ভারতের সাথে বিরোধ নিস্পত্তি করতে হয়েছে। গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা এবং তিস্তার পানিচুক্তিসহ যৌথ নদীর পানি প্রত্যাহার বন্ধে বাংলাদেশকে এখন সর্বাত্মক লড়াইয়ে নামতে হবে। চুয়ান্নটি অভিন্ন নদীর উপর নিজেদের একতরফা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ভারত বাংলাদেশকে দাবার ঘুটির মত নিয়ন্ত্রন করতে চাইছে। পানি বঞ্চিত করে বাংলাদেশকে মরুভূমিতে পরিনত করার ভারতীয় দূরভিসন্ধি এখন অনেকটাই স্পষ্ট। একইভাবে ব্রহ্মপুত্রসহ ভারতের বেশ কয়েকটি বড় নদীর উৎস তিব্বতে হওয়ায় এসব নদীর উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ চীনের হাতে। তিব্বতে ব্রহ্মপুত্রের নাম ইয়ারলং সাংবো। ইয়ারলং সাংবোতে বেশ কিছু বাঁধ ও ফিডার ক্যানেল নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহার করে নিলে তিস্তার উজানে ব্রহ্মপুত্র, যমুনার মত নদনদীর অববাহিকার অস্তিত্ব চরম হুমকির মুখে পড়বে। যৌথ নদীর পানি নিয়ে বাংলাদেশের সাথে ভারতের অন্যায় আচরণ চীনকেও ভারতের সাথে একই ধরণের আচরণ করতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। ইয়ারলং সাংবো প্রকল্প নিয়ে ভারতের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশিত হয়েছিল। ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা একে চীনের ‘হাইড্রো-হেজিমন’ বলে উল্লেখ করছেন। চীন, ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে নিয়ে একটি অববাহিকা ভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার কথা বলা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরেই। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পানি বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন সময়ে এ বিষয়ে মতামত দিয়েছেন। অববাহিকাভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ এগিয়ে নেয়ার পাশাপাশি তিস্তা ব্যারাজ ও ডেল্টা প্রকল্পের মত বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো এগিয়ে নিতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিয়ে বাংলাদেশকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে ন্যুনতম আপস অথবা সময় ক্ষেপনের আর কোনো সুযোগ নেই।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস
শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া
ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল
‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’
প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের
প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া
মুসলিম চিকিৎসক
শীর্ষে দিল্লি
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান