ভবিষ্যৎ প্রজন্মের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে

Daily Inqilab কামরুল হাসান দর্পণ

২০ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:২৭ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১১:২৪ পিএম

নগর কিংবা গ্রামের পাড়া-মহল্লায় উঠতি বয়সের একশ্রেণীর কিশোর যেভাবে মাদকাসক্ত ও অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠেছে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এসব কিশোরের আচার-আচরণ এতটাই দুর্বিনীত যে, সমাজের অভিভাবক শ্রেণী পর্যন্ত ত্রস্ত অবস্থায় থাকে। এরা আবার সংঘবদ্ধ হয়ে ‘গ্যাং’ গড়ে তোলে, যাদের বলা হয় কিশোর গ্যাং। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে পারস্পরিক কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে এরা। আরেক এলাকার গ্যাংয়ের সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত হয়। মারামারি এমনকি খুনোখুনিও করে। নিজেরা তো মাদকাসক্ত হয়ই, মাদক ব্যবসায়ও জড়িয়ে পড়ে। মাদক থেকে সব ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জেলে গেলেও তারা শোধরায় না। জেলে যাওয়া-আসা তাদের জন্য কোনো বিষয় নয়। জেল থেকে বের হয়ে পুনরায় একই অপকর্মে জড়ায়। বিগত কয়েক বছর ধরে গড়ে উঠা কিশোর গ্যাং সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য এক ভয়ানক সমস্যা হয়ে উঠেছে। ভবিষ্যত প্রজন্মের কিশোররা গ্যাং কালচারে জড়িয়ে অপ্রতিরোধ্য ও দুর্দমনীয় হয়ে উঠেছে। উঠতি বয়সী কিশোররা যেভাবে বিপজ্জনক ও বিপথে ধাবিত, তা সচেতন মহলকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধের ধরণ দেখে প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আমরা কোথায় ঠেলে দিচ্ছি? তাদের দেখার কি কেউ নেই? রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহর, পাড়া, মহল্লায় যেভাবে কিশোর গ্যাং সৃষ্টি হয়েছে এবং ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে চলেছে, তাদের রুখবে কে? যদি রোখার কেউ থাকত, তাহলে বাড়ন্ত বয়সে একজন কিশোরের সন্ত্রাসী, মাস্তান হয়ে উঠার কোনো কারণ থাকতে পারে না। এই বয়সে তাদের যেখানে স্কুলে যাওয়া-আসা এবং পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকার কথা, সেখানে গ্যাং তৈরি করা বা গ্যাংয়ের সাথে জড়িয়ে পড়ার কথা নয়। এক্ষেত্রে গ্যাংয়ের সাথে জড়িত কিশোরের বাবা-মা যে প্রধানত দায়ী তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। এরপর দায়ী, জনপ্রতিনিধি, সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এবং স্কুল-কলেজের শিক্ষক। এসব অভিভাবক তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছে না বলেই কিশোররা বিপদগামী হয়ে উঠছে। যেসব কিশোর গ্যাং চক্র গড়ে উঠেছে, তাদের অপকর্মের ধরণ দেখলে আঁৎকে উঠতে হয়। খুন, ইভটিজিং, ধর্ষণ, চুরি, ছিনতাই, মাদক সেবন ও কেনাবেচা, আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মারামারিসহ হেন কোনো অপকর্ম নেই, যা তারা করছে না।

দুই.
পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারাদেশে প্রায় শতাধিক কিশোর গ্যাং রয়েছে। শুধু রাজধানীতেই রয়েছে ৬০টি। এসব গ্যাংয়ের প্রতিটির সদস্য সংখ্যা গড়ে ১৫ জন। এ হিসেবে সারাদেশে প্রায় দেড় হাজার কিশোর গ্যাংয়ের সাথে জড়িত। ১৬ কোটি মানুষের দেশে সংখ্যাটিকে নিতান্ত ক্ষুদ্র মনে হলেও এই কিশোররা যে সমাজের জন্য একেকটি ডিনামাইট হয়ে উঠছে, তা ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। অসংখ্য মানুষ মারার জন্য একটি ডিনামাইটই কিংবা হাজার হাজার মানুষের মিছিল-সমাবেশ পন্ড করে দিতে একটি ককটেল বিস্ফোরণ বা বন্দুকের ফাঁকা আওয়াজই যথেষ্ট। মানুষ প্রাণ বাঁচাতে দিক-বেদিক ছুটতে শুরু করে। কাজেই দেড় সহ¯্রাধিক কিশোর গ্যাং যেভাবে ভয়ংকর ও হিং¯্র হয়ে উঠছে এবং তাদের সাথে আরও যারা যুক্ত হচ্ছে, তাতে গোটা সমাজ ব্যবস্থা অস্থিতিশীল করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। দুই দশক আগে এই গ্যাং চক্রের যখন সূত্রপাত হয়, তখন এত ব্যাপক আকার ধারণ করেনি। এর প্রতিকার না হওয়ায় তার পরিধী ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন যেভাবে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে সমাজ দিন দিন অনিরাপদের দিকে ধাবিত হচ্ছে। কিশোর গ্যাং চক্রের সদস্যদের বেশ-ভুষা, চুলের কাটিং, কথা-বার্তা ও আচারণ-আচরণ কোনো সুস্থ্য মানুষের পক্ষে সহ্য করা কঠিন। এমনকি পাড়া-মহল্লার দেয়ালে দেয়ালে গ্যাং চক্রের নাম দেখেও আঁৎকে উঠে অন্য দিকে চলে যেতে হয়। এই যে চলে যাওয়া বা এড়িয়ে যাওয়া, এটাই কিশোর গ্যাংদের শক্তির মূল উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা পুলকিত হয়ে মনে করছে, মহল্লার মুরুব্বীরাও তাদের ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছে। তাদের ক্ষমতার কাছে নতি স্বীকার করছে। কাজেই আমাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কেউ নেই। তারা নিজেদের অপ্রতিরোধ্য ভাবতে শুরু করেছে এবং অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি করে চলেছে। তাদের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিপক্ষ আরেক গ্যাং। তাদের লক্ষ্য হয়ে উঠেছে, প্রতিপক্ষকে প্রতিরোধ করে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখা। দুঃখের বিষয়, আমরা যারা এড়িয়ে যাচ্ছি, তারা খোঁজ নিচ্ছি না, বিপদগামী এসব কিশোর কারা? তারা কোন পরিবারের সদস্য বা কারা এদের বাবা-মা? সাধারণত পাড়া-মহল্লায় যারা বসবাস করে, তাদের প্রত্যেকের সাথে প্রত্যেকের চেনা-জানা থাকে। এই পরিচিতির সূত্র ধরে যে কিশোরদের বাবা-মা ও অভিভাবকদের সাথে কথা বলবে, এই দায়িত্বটুকু পালন করছে না। অনেকটা উট পাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে ঝড় উপেক্ষা করে যাচ্ছে। কিশোর গ্যাংয়ের সাথে যারা জড়িত, পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, তাদের বেশির ভাগই নি¤œ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। পাশাপাশি রয়েছে উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান। বলা হচ্ছে, এসব কিশোররা প্রযুক্তি ও ভিনদেশি অপসংস্কৃতির শিকার হয়ে বিপদগামী হয়ে পড়ছে। ভিডিও গেম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, টিকটক, পর্ণোগ্রাফি, ভিনদেশি অশালীন সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। এ কথা অনস্বীকার্য, তথ্য-প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা প্রতিরোধ করা যাবে না। তা এগিয়ে যাবেই। এই এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে তার ব্যবহার-অপব্যবহারের বিষয়টির দিকে সতর্ক দৃষ্টি দেয়ার মধ্যেই এর কল্যাণ নিহিত। সমস্যা হচ্ছে, আমাদের অধিকাংশ অভিভাবক এ দিকটি খেয়াল করছে না। তারা মনে করছে, তার সন্তান প্রযুক্তির সাথে যুক্ত হচ্ছে এবং সে দারুণ পারদর্শী হয়ে উঠছেÑএটা অত্যন্ত গর্বের বিষয়। অনেকে আত্মতুষ্টিতে ভোগেন। আমার সন্তান আমার চেয়ে অনেক বেশি জানছে-বুঝছে, নেট চালাতে পারছেÑএই ভেবে পুলকিত হন। অথচ এই আনন্দিত হওয়ার মধ্য দিয়ে তারা যে সন্তানকে ভয়াবহ বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তা একবারও চিন্তা করছেন না। কিশোর গ্যাংয়ের সাথে যারা জড়িত তাদের অধিকাংশই প্রযুক্তির এই অপব্যবহারে উৎসাহী হয়ে অপরাধ প্রবণ হয়ে উঠেছে। ফ্যান্টাসিতে ভুগে বা হিরোইজমে আসক্ত হয়ে, নিজেকে পাওয়ারফুল ভাবা থেকেই গ্যাংয়ের সাথে জড়িয়ে পড়ছে বা গ্যাং তৈরি করছে। যারা তাদের এই হিরোইজমকে অস্বীকার করে, তাদেরকে বশ্যতা স্বীকার করাতে আক্রমণ করছে। এক অপরাধ থেকে আরেক অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এ ধারাবাহিকতায় খুন, ধর্ষণ, মাদক, ছিনতাইয়ের মতো ভয়ানক ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। তাদের অভিভাবকদের অনেকে হয়তো জানেনই না, তার সন্তান কত ভয়াবহ অপরাধ কর্মে জড়িয়ে পড়েছে। অনেকে হয়তো ছেলের এমন অপকর্মের বাহাদুরিতে মনে মনে খুশি হন কিংবা তিনিও তার সঙ্গে শামিল হন। সন্তানের এই অপরাধ কর্ম সম্পর্কে জ্ঞাত-অজ্ঞাত উভয় শ্রেণীর অভিভাবকই যে নিজেদের এবং সমাজকে বিপদে ফেলছেন তা বুঝছেন না বা বুঝতে চাইছেন না। কুপথে সন্তানের চলে যাওয়ার যন্ত্রণা কি, তার অসংখ্য নজির চোখের সামনে থাকলেও তা আমলে নিচ্ছেন না।

তিন.
প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই কিছু না কিছু পাশবিক মানসিকতা থাকে। এই মানসিকতা নিয়ন্ত্রণ ও দমন করেই আদিকাল থেকেই মানুষ সভ্যতার দিকে ধাবিত হয়েছে এবং সভ্য হয়ে উঠেছে। এখন দেখা যাচ্ছে, যতই আধুনিক হচ্ছে, পাশবিকতা এবং কৃপ্রবৃত্তিরও ভয়ংকর প্রকাশ ঘটছে। তা নাহলে, যে কিশোরের বাস্তব জীবনের অনেক কিছুই বোঝার মতো জ্ঞান অর্জিত হয়নি বা তার সে জ্ঞান অর্জনের প্রাথমিক পর্যায়, সে কেন পশুবত আচরণ করবে। খুন, ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটাবে। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, এই কিশোরদের অভিভাবকরাও নিজেদের সভ্যতার কথা ভুলে সন্তানদের সভ্য করে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছে। শুধু কিশোর গ্যাংয়ের সাথে জড়িতরাই নয়, তরুণ, যুবক, বয়স্কসহ প্রায় সব শ্রেণীর কিছু মানুষ খুন, ধর্ষণ, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, মাদক চোরাচালানসহ হেন কোনো অপরাধ নেই যাতে জাড়াচ্ছে না। দেশব্যাপী অপরাধের যে কুপ্রবাহের জোয়ার বইছে, তার লাগাম টেনে ধরার জোর উদ্যোগ নেই। যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর কথা, সেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরই একটি শ্রেণী নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। একটি দেশে যদি আইনশৃঙ্খলার একটি শ্রেণী অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, তবে সে দেশে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা যেমন রয়েছে তেমনি ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীদের ব্যর্থতা কিংবা প্রশ্রয়ের কারণেই কিশোর গ্যাংয় সৃষ্টির অন্যতম কারণ। সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে দেশের সর্বত্র যে ভয়াবহ নৈতিক অবক্ষয় চলছে তা রোধ করতে না পারলে আগামী ১০ বছরে দেশে নিরাপত্তা বলতে কিছু থাকবে না। তখন সমাজে শান্তিতে বসবাস করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। আত্মরক্ষার্থে সাধারণ মানুষও একে অপরের প্রতি আক্রমণাত্মক এবং প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে উঠবে। গত পাঁচ বছরে মানুষের মধ্যে এ প্রবণতা লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে। এ প্রবণতার মূল কারণ, অপরাধ দমনে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না থাকা, পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং নীতি-নৈতিকতা থেকে মানুষের দূরে সরে যাওয়া বা উপেক্ষা করে চলা। অধিকাংশ মানুষের সুকুমারবৃত্তি, লোভ-লালসা ও ক্রোধের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। চোখের সামনে অন্যায় ঘটতে দেখেও প্রতিবাদের পরিবর্তে না দেখার ভান করছে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের যে হাজার বছরের ঐতিহ্য, তা হারিয়ে যাচ্ছে। সিনিয়র-জুনিয়রের আচরণের মধ্যে যে ধরনের ব্যবধান এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ থাকা প্রয়োজন, তা প্রায় বিলুপ্তির পথে। তাদের মধ্যকার আচরণ সমবয়স্ক হয়ে গেছে। পরিবারের অভিভাকরা সন্তানের প্রতি উদাসীন হয়ে যাচ্ছেন। তাদের অধিকাংশই সন্তান কি করছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে, মোবাইলে, ফেসবুকে কাদের সাথে চ্যাট করছে, এ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। এমনকি সন্তান ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে একবেলা একসঙ্গে খেতেও বসছে না। অভিভাবকদের এই উদাসীনতা ও প্রশ্রয় থেকেই সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি হচ্ছে। পরিবারের অভিভাবকের কাছে যদি জুনিয়র সদস্যদের জবাবদিহিতা না থাকে, তবে পরিবার ও সমাজ কোনভাবেই স্থির থাকতে পারে না। তারা দুর্নিবার হয়ে উঠে। এমনকি আপন মানুষকেও খুন করতে দ্বিধা করে না। পারিবারিক শাসন-বারন এবং ধর্মীয় রীতি-নীতির বিষয়টি যে পরিবারের অভিভাবকরা জানে না, এমন ভাবার কারণ নেই। তারা নিশ্চয়ই জানে। মূল বিষয়টি হচ্ছে, তারা আমলে নিচ্ছে না। শুধু পরিবারের অভিভাবকই নয়, সমাজে যাদের প্রভাব বিস্তার করার সক্ষমতা রয়েছে, তাদের সামাজিক দায়িত্ব পালনের অবহেলাও সমাজকে বিশৃঙ্খল করে দিচ্ছে। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলেছেন, সমাজে বর্তমানে যে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তার সঙ্গে পরিবারগুলো তাল মেলাতে পারছে না। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাজ করছে অসম প্রতিযোগিতা। ধনী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর একটি শ্রেণী তাদের মূল্যবোধ হারাচ্ছে। এ অবস্থার জন্য রাষ্ট্রের উদাসীনতা দায়ী। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় খোলামেলা অনুষ্ঠান ও নিষিদ্ধ সম্পর্কের দেশি-বিদেশি বাংলা সিরিয়াল আমাদের পারিবারিক বন্ধন শিথিল করে দিচ্ছে। মানুষের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি করছে। মানুষ তার লক্ষ্যে স্থির থাকতে পারছে না। সব মিলিয়ে সামাজিক, রাজনৈতিক, মিডিয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা ও সাংস্কৃতিক অস্থিরতায় মানুষ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে। এতে সামাজিক সম্পর্কে ভাঙন দেখা দিচ্ছে। এ অবস্থায় রাষ্ট্র, শিক্ষক ও ধর্মীয় নেতাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে যে দায়িত্ব পালন করার কথা, তারা এ দায়িত্ব পালন করছেন না। ফলশ্রুতিতে কিশোর গ্যাংয়ের মতো নতুন নতুন অপরাধী চক্রের সৃষ্টি হচ্ছে।

চার.
পারিবারিক, সামাজিক নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ, ধর্মীয় অনুশাসনÑএসব কোন আইনের মাধ্যমে হয়নি। জীবনকে সুশৃঙ্খল ও সঠিকপথে পরিচালিত করার লক্ষ্যেই মানুষ নিজস্বার্থে এসব মানবিক গুণাবলী ধারণ করেছে। তা নাহলে মানুষ সেই আদিম যুগেই পড়ে থাকত, আজকের সভ্যযুগে বসবাস করত না। আইনের মাধ্যমে অপরাধীকে শাস্তি দিয়ে হয়তো দৃষ্টান্ত স্থাপন ও অন্যদের সতর্ক করা সম্ভব। তবে ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে শোধরানো সম্ভব নয়। এজন্য পরিবার ও সমাজের সৎ এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিদের এগিয়ে আসা উচিত। পরিবার ঠিক থাকলে সমাজে তার প্রতিফলন ঘটে। পরিবারের অভিভাবক শ্রেণীকেই এই গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে। পরিবারের নবীণ সদস্যদের আচার-আচরণ ও চলাফেরার দিকে তীক্ষ্ম নজর রাখতে হবে। তাদের সামনে পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয়মূল্যবোধের চেতনাগুলো তুলে ধরতে হবে। পাড়া-মহল্লায় প্রভাবশালীদের নিজ নিজ এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে উদ্যোগী হতে হবে। প্রয়োজনে অপকর্মে লিপ্তদের পরিবারের অভিভাবকদের সাথে কথা বলতে হবে। স্কুল, কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয়মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে শিক্ষকদের মোটিভেশনাল ভূমিকা রাখা অপরিহার্য। জুমার নামাজের সময় মসজিদের ইমামদের এ ব্যাপারে নিয়মিত বয়ান দেয়া উচিত। এখন আমরা এমন এক সময় অতিক্রম করছি, কেউ ধর্মীয় কথা বললে তাকে বক্রদৃষ্টিতে দেখা হয়। কেউ কথা বলা থামিয়ে দেয়। অথচ উন্নত বিশ্বে এখন মানুষ স্ব স্ব ধর্মের প্রতি সবচেয়ে বেশি ঝুঁকছে। আমাদের দেশ নিশ্চয়ই তাদের চেয়ে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত নয়। তবে আমরা যে পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয়মূল্যবোধ থেকে তাদের চেয়ে এগিয়ে, এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। এই মূল্যবোধগুলো প্রত্যেকের মধ্যে সদা জাগ্রত থাকলেই পরিবার, সমাজ ও দেশ শান্তিতে থাকতে পারবে। এসব মূল্যবোধ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে জাগানো সম্ভব নয়। আমাদের প্রত্যেককে স্ব স্ব অবস্থান থেকে আমাদের চিরায়ত পারিবারিক ও সামাজিক প্রথা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের দিকে দৃষ্টি দিলেই এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব। আধুনিকতা ও অপসংস্কৃতির গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিলে সন্তানদের কি ভয়াবহ পরিস্থিতি হয়, তা তো আমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। যেসব বাবা-মা’র সন্তান কিশোর গ্যাংয়ের সাথে জড়িয়েছে তাদের যেমন সতর্ক হতে হবে, তেমনি তাদের দেখে অন্য বাবা-মাদেরও নিজ সন্তানের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাথে আলাপ-আলোচনা করা প্রয়োজন। তাদের শুধু অপরাধ বা অপরাধীদের ধরণ নিয়ে গবেষণা করলে চলবে না। পারিবারিক ও সামাজিক পরিবর্তন কিভাবে হচ্ছে, কোন দিকে ধাবিত, এসব বিষয় নিয়েও গবেষণা করতে হবে।

darpan.journalist@gmail.com


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

মুসলিম শাসকরা কি ইহুদিদের দাসে পরিণত হয়েছেন?
হাসিনার পতনের পর বিএনপির আট মাস
ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল : বৈরিতার বহিঃপ্রকাশ
প্রতিবন্ধীবান্ধব অবকাঠামোর অপ্রতুলতা
ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের বিকাশে জোর দিতে হবে
আরও
X

আরও পড়ুন

ভারতজুড়ে ওয়াকফ আইন নিয়ে তীব্র বিক্ষোভ ও আইনি লড়াই

ভারতজুড়ে ওয়াকফ আইন নিয়ে তীব্র বিক্ষোভ ও আইনি লড়াই

ভক্ত, দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখোরিত মোরেলগঞ্জের লক্ষীখালি বারুনী স্নানোৎসব ও ধর্মীয় মাতুয়া মেলা

ভক্ত, দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখোরিত মোরেলগঞ্জের লক্ষীখালি বারুনী স্নানোৎসব ও ধর্মীয় মাতুয়া মেলা

ইসরায়েলি অবরোধে ত্রাণহীন গাজায় মানবিক বিপর্যয়

ইসরায়েলি অবরোধে ত্রাণহীন গাজায় মানবিক বিপর্যয়

ড. ইউনূসের নেতৃত্ব বাংলাদেশের সমৃদ্ধি আনবে, প্রত্যাশা আমিরাত প্রেসিডেন্টের

ড. ইউনূসের নেতৃত্ব বাংলাদেশের সমৃদ্ধি আনবে, প্রত্যাশা আমিরাত প্রেসিডেন্টের

নদীতে গোসল করতে নেমে প্রাণ গেল দুই বোনের

নদীতে গোসল করতে নেমে প্রাণ গেল দুই বোনের

জীবিত অভিবাসীদের ‘মৃত’ ঘোষণা করে তাড়াচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন

জীবিত অভিবাসীদের ‘মৃত’ ঘোষণা করে তাড়াচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন

বঙ্গোপসাগরে ৪ ট্রলারে ডাকাতি, গুলিবিদ্ধসহ আহত ৮

বঙ্গোপসাগরে ৪ ট্রলারে ডাকাতি, গুলিবিদ্ধসহ আহত ৮

এক সপ্তাহে যৌথ বাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তার ৬০৮

এক সপ্তাহে যৌথ বাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তার ৬০৮

নিউইয়র্কে নদীতে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত, শিশুসহ নিহত ৬

নিউইয়র্কে নদীতে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত, শিশুসহ নিহত ৬

ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত আরও ৪০ ফিলিস্তিনি

ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত আরও ৪০ ফিলিস্তিনি

রামগতিতে চাঁদা না দেয়ায় কিশোর গ্যাং সদস্যদের হামলায় দিনমজুর আহত, আটক ১

রামগতিতে চাঁদা না দেয়ায় কিশোর গ্যাং সদস্যদের হামলায় দিনমজুর আহত, আটক ১

দোয়ারাবাজার সীমান্তে ভারতীয় খাসিয়ার গুলিতে বাংলাদেশী নিহত

দোয়ারাবাজার সীমান্তে ভারতীয় খাসিয়ার গুলিতে বাংলাদেশী নিহত

ছাগলনাইয়ায় অস্ত্রসহ যুবক আটক

ছাগলনাইয়ায় অস্ত্রসহ যুবক আটক

এবার এসএসসিতে পরীক্ষার্থী কমেছে ময়মনসিংহ শিক্ষাবোর্ডে

এবার এসএসসিতে পরীক্ষার্থী কমেছে ময়মনসিংহ শিক্ষাবোর্ডে

যাত্রী বেশে সিএনজি অটোরিকশা ছিনতাই, গ্রেফতার ২

যাত্রী বেশে সিএনজি অটোরিকশা ছিনতাই, গ্রেফতার ২

নগরকান্দায় বৃষ্টিতে কাঁদায় পিচ্ছিল সড়কে মোটরসাইকেল আরোহী নিহত

নগরকান্দায় বৃষ্টিতে কাঁদায় পিচ্ছিল সড়কে মোটরসাইকেল আরোহী নিহত

সউদীতে পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন ট্রাম্প

সউদীতে পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন ট্রাম্প

ভারতের চেয়ে বেশি কেউ বাংলাদেশের মঙ্গল চায় না

ভারতের চেয়ে বেশি কেউ বাংলাদেশের মঙ্গল চায় না

জার্মানিতে গঠিত হচ্ছে নতুন জোট সরকার

জার্মানিতে গঠিত হচ্ছে নতুন জোট সরকার

সদরঘাটের ব্যবসায়ীকে হত্যা: স্বামী-স্ত্রীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

সদরঘাটের ব্যবসায়ীকে হত্যা: স্বামী-স্ত্রীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড