ইমাম বোখারী রহ. ঈদরজনীতে ইন্তেকাল করেন
২০ এপ্রিল ২০২৩, ০৮:২৭ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১১:২৪ পিএম
হিজরী ২৫৬ সালের রমজান মাসের শেষ দিবস এবং সাওয়াল মাসের প্রথম বা ঈদ-রজনীতে ইন্তেকাল করেন হাদীস শাস্ত্রের আমিরুল মোমেনিন ও নাসেরুল হাদীস মোহাম্মাদ ইবনে ইসমাইল বোখারী রহ.। তখন পর্যন্ত ইসলামের ইতিহাসে এই প্রথমবার ঈদ-রজনীতে এরূপ শোকাবহ ঘটনায় মুসলমানদের ঈদ-অনন্দ শোকের মাতমে পরিণত হয়ে যায়। ইন্তেকালের সময় তার বয়স ৬২ বছরের চেয়ে ১৩ দিন কমছিল। বলা হয়ে থাকে, দুনিয়ার বুকে আল্লাহর কালাম আল-কোরআনের পর বিশুদ্ধতম গ্রন্থ বোখারী শরীফ। হযরত ইমাম বুখারী (রহ.) যখন মাশায়েখে হাদীসের নিকট গমন করেন, তখন তার বয়স মাত্র এগারো বছর।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বিশেষভাবে হাদীস শাস্ত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ এ ইমামের জীবন ও কর্ম বিশদভাবে আলোচনা করা এখানে সম্ভব নয়, তবে হদীস শাস্ত্রে তাঁর অসাধারণ শ্রম-সাধনা ও গবেষণা চর্চার একটা ক্ষুদ্র প্রয়াস নি¤েœ প্রদত্ত হলো।
ইমাম বোখারীর হাদীস সংকলন তথা ছহীহ বোখারী প্রণয়ন সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একদিন ইমাম বোখারী তাঁর ওস্তাদ ইমাম ইসহাক বিন রাহওয়াইহের হাদীসের দরসে উপস্থিত ছিলেন। ওস্তাদ বললেন, আহা! কেউ যদি শুধু ছহীহ হাদীসগুলি একত্র করে দিত! অতঃপর ইমাম বোখারী একরাত্রে স্বপ্নে দেখলেন, হযরত রাসুলে করীম (সা.) উপবিষ্ট আছেন, আর ইমাম বোখারী তাঁর শরীরে বাতাস করছেন এবং মাছি তাড়াচ্ছেন। বিশেষজ্ঞগণ স্বপ্নের ব্যাখ্যা করলেন, বোখারী রাসুল (সা.) এর হাদীস হতে জাল হাদীসসমূহ অপসারিত করবেন। এরপর তিনি তাঁর বিখ্যাত ছহীহ বোখারী রচনায় আত্মনিয়োগ করেন এবং মক্কায় হেরেম শরীফে বসে তার খসড়া প্রস্তুত করেন। অতঃপর মদীনার মসজিদে নব্বীতে বসে তার চূড়ান্ত রূপ দান করেন। প্রথমে তিনি ইস্তেখারা এবং গোসল করে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়া ব্যতীত কোন হাদীসকেই তাঁর গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেন নি।
ইমাম বোখারী ছয় লাখ হাদীস হতে বাছাই করে তকরারসহ (পুনঃআবৃত্তি) ৭৩৯৭টি এবং তকরার বাদে ২৭৬১টি হাদীসকে তাঁর এই গ্রন্থে স্থান দিয়েছেন এবং দীর্ঘ ১৬ বছর এটা যাচাই-বাছাই কার্যে ব্যস্ত থাকেন। তিনি হাদীস গ্রহণের ব্যাপারে কতিপয় নিজস্ব জরুরি শর্ত আরোপ করেন, যেগুলি উসুলে হাদীসে সবিস্তারে বর্ণিত আছে। এ সম্পর্কে উদাহরণ স্বরূপ এখানে একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে।
কথিত আছে যে, ইমাম বোখারী একবার শত শত মাইল ভ্রমণ করে এক সাধু ব্যক্তির নিকট হাদীস সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখলেন যে, তিনি একটি ঘোড়াকে একটি ভূষির খালি থলি দেখিয়ে ভুলাতে চেষ্টা করছেন। তিনি তখনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, এরূপ ব্যক্তির উপর কোনো আস্থা স্থাপন করা যায় না এবং অবিলম্বে সেখান হতে ফিরে আসলেন। এই ঘটনা হতে অনুমান করা যায় যে, ইমাম বোখারী রহ. হাদীস সংগ্রহ ও সংকলনের ব্যাপারে কত কঠোর নীতির অনুসারী ছিলেন। এতদসত্ত্বেও ছহীহ বোখারীতে ইসলামী শাস্ত্রসমূহের অপূর্ব সমাবেশ দেখতে পাওয়া যায়। এর বিষয়বস্তু এতই ব্যাপক ও বিস্তৃত যে, এতে হযরত নবী করিমের (সা.) প্রতি অহী অবতীর্ণ হওয়ার সূচনা অবস্থা হতে আরম্ভ করে যার দ্বারা ইসলামের বুনিয়াদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত আকায়েদ, এবাদত, মোয়ামেলাত, মানব সৃষ্টি, গাজওয়াহ, তফসীর, ফজায়েল, তিব্ব (চিকিৎসা), আদব, রেকাক (মুক্তি) এবং তওহীদ প্রভৃতি ৫৪টি শাস্ত্রের বিষদভাবে উল্লেখ ছাড়াও শাসন ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক আইন-কানুন ও দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি সম্পর্কে অনেক বিষয়ের বর্ণনা যুক্তি প্রমাণ সহকারে দেখতে পাওয়া যায়।
ইমাম বোখারীর শেষ জীবন অতিবাহিত হয়েছে নানা নির্যাতন উৎপীড়নের মধ্য দিয়ে। সত্যের সাধক, ন্যায়ের পতাকাবাহী ইমাম বোখারী সত্যের তরে অন্যায়কে ক্ষণিকের জন্যও সমর্থন করেন নি। অথচ, এজন্য তাঁকে দীর্ঘকাল তৎকালীন শাসকচক্রের নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। তাঁকে অপদস্ত করার জন্য নানাভাবে যড়ষন্ত্র করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে জনমতকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত তাঁকে জন্মভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে এবং সেই অবস্থাতেই তাঁকে দুনিয়া হতে বিদায় নিতে হয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে।
সে সময় খালেদ বিন সোহলী ছিলেন বোখারার শাসনকর্তা। ইমাম সাহেব যখন বোখারায় হাদীস অধ্যাপনায়রত এবং চতুর্দিকে তাঁর খ্যাতি পরিব্যাপ্ত, তখন শাসনকর্তা সোহলী ইমাম বোখারীকে তাঁর প্রাসাদে উপস্থিত হয়ে তদীয় পুত্রগণকে সহীহ বোখারী ও তারিখ গ্রন্থ শিক্ষা দানের জন্য আবেদন জানান। ইমাম বোখারী নীতির দিক দিয়ে শাসন কর্তার এই প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য বিবেচনা করতে পারলেন না। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন যে, স্বীয় শিক্ষাদান কেন্দ্র পরিত্যাগ করে তিনি শাসনকর্তার প্রাসাদে উপস্থিত হয়ে পবিত্র বিদ্যার অবমাননা করতে প্রস্তুত নন। এ কথা শুনে শাসনকর্তা পুনরায় এই আবেদন জানান যে, প্রাসাদে উপস্থিত হতে যদি তাঁর আপত্তি থাকে, তা হলে ইমাম সাহেবের পাঠাগারেই তাঁর পুত্রগণকে পাঠান যেতে পারে। কিন্তু সে অবস্থায় শাহজাদাগণের সঙ্গে যাতে সাধারণ ছাত্রগণ একত্রে মেলামেশার সুযোগ না পায়, তজ্জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থা করতে হবে। ইমাম সাহেব তদুত্তরে বলে পাঠালেন, আমি আপনার এরূপ অনুরোধ রক্ষা করতে সম্পূর্ণ অক্ষম। কারণ, আমার অধ্যাপনার বিষয়বস্তু রহমাতুল্লিল আলামীন হযরত নবী করিমের (সা.) পরিত্যাক্ত সাধারণ সম্পত্তি। উত্তরাধিকার সূত্রে এতে ছোট-বড়, ধনী-নির্ধন, রাজা-প্রজা সকলেরই সমান অধিকার রয়েছে। কাজেই আমার পাঠাগার ও মসজিদের দ্বার সবশ্রেণির লোকের জন্য সদা উন্মুক্ত। যার ইচ্ছা হবে তিনিই এখানে উপস্থিত হয়ে শিক্ষালাভ করতে পারেন। আমি কারও জন্য কোনো সময়েই কোনরূপ বাধা-নিষেধ আরোপ করতে পারি না। কাজেই আমি আপনার দরখাস্ত মঞ্জুর করতে অক্ষম। যদি এতে আমি আপনার বিরক্তি উৎপাদন করে থাকি, তা হলে আপনি বলপ্রয়োগে আমার শিক্ষাগার বন্ধ করে দিতে পারেন। যে অবস্থায় আল্লাহর দরবারে আমার উপর আপত্তি চলবে।
বোখারার শাসনকর্তা ইমাম বোখারীর নিকট থেকে এরূপ অপ্রত্যাশিত উত্তর পেয়ে দারুণ ক্রোধান্বিত হলেন। তিনি তাঁকে যে কোনো উপায়ে শহর হতে বিতাড়িত করার পন্থা উদ্ভাবনে মনোনিবেশ করলেন। তাঁর দুরভিসন্ধিপূর্ণ ষড়যন্ত্র সফল করার উদ্দেশ্যে ইমাম সাহেবের বিরুদ্ধে জনসাধারণের মনে বিরূপ ধারণার সৃষ্টির প্রয়াস পেলেন। তিনি কতিপয় কুচক্রীর সাহায্যে ইমাম সাহেবের আকিদা ও বিশ্বাসের উপর মিথ্যা অপবাদ রটিয়ে অল্পবুদ্ধি ও হুজুগ-প্রিয় সাধারণ মুসলমানকে বিভ্রান্ত ও দ্বিধাবিভক্ত করে ফেললেন। প্রচার করা হলো যে, ইমাম সাহেব কোরআন মজিদের বচনগুলিকে সৃষ্ট (খালকে কোরআন) বলে বিশ্বাস করেন। এ নিয়ে শহরময় আন্দোলনের ঢেউ উঠল এবং অশান্তির অগ্নিশিখা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল। ইমাম সাহেব সম্বন্ধে জনগণের ভাবাবেগের এই সুযোগে শাসনকর্তা তাঁকে শহর পরিত্যাগের হুকুম জারি করলেন। অবশেষে বাধ্য হয়ে তিনি প্রিয় জন্মভূমি ত্যাগ করে বয়কন্দ নামক স্থানে গিয়ে উপস্থিত হলেন। কিন্তু অন্যান্য স্থানের ন্যায় সেখানেও তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল পেতে রাখা হয়েছিল এবং প্রচার করা হয়েছিল যে, ইমাম সাহেব কোরআন মজিদের বচনগুলিকে সৃষ্ট বাণী বলে বিশ্বাস করেন। কাজেই তাঁর আগমনের পূর্বেই বয়কন্দবাসীরা সমস্ত বিষয় অবগত হয়ে দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়েছিল।
ইমাম সাহেবের গুণগ্রাহী ভক্তবৃন্দ তাঁকে সম্পূর্ণ নির্দোষ মনে করলেন। অপরদিকে দাঙ্গা সৃষ্টিকারী ও ষড়যন্ত্রকারীর দল ইমাম সাহেবের বিরুদ্ধে জনমত বিভ্রান্ত করার কাজে লিপ্ত রইল। ইমাম সাহেব এরূপ দ্বিধা বিভক্ত পরিবেশ ও সংকটজনক পরিস্থিতির ভেতর অবস্থান করা সঙ্গত মনে করলেন না। অতঃপর তিনি সমরকন্দবাসীদের অনুরোধক্রমে সমরকন্দের নিকটবর্তী খরতঙ্গ নামক নিভৃত পল্লীতে চলে যান এবং সেখানে তাঁর এক নিকট আত্মীয়-গালিব বিন জিবরীলের গৃহে আতিথ্য গ্রহণ করলেন। ইমাম সাহেব খরতঙ্গে উপস্থিত হওয়ার পর এক রাত্রে তাহাজ্জুদের নামাজান্তে প্রার্থনা করতে লাগলেন: হে অগতির গতি খোদা, তোমার সৃষ্ট ভূখন্ড এত বিস্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও আজ আমার জন্য অতি সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। জগতে আমার আর টিকবার স্থান নেই। অতএব হে মঙ্গলময়, আমাকে তুমি সান্নিধ্যে গ্রহণ কর।
এর পর ইসলাম গগণের এই আলোক রবি ২৫৬ হিজরী সনের ঈদুল ফিতরের রাতে ইন্তেকাল করেন। পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন যোহরের নামাজান্তে তাঁকে খরতঙ্গ পল্লীর নিভৃত কোণে দাফন করা হয়।
কথিত আছে, ইমাম সাহেবের কবরের মাটি সুগন্ধি হয়ে যাওয়ায় অনেকে ঐ মাটি নিয়ে যেতে থাকে। তাই কবরটি রক্ষাকল্পে তার চারিদিকে প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত করা হয়।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের বিপক্ষে যে একাদশ দিয়ে মাঠে নামছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ
কিশোরগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার কামালসহ তিনজন গ্রেফতার
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
গাজায় যুদ্ধবিরতি ছাড়া বন্দী বিনিময় হবে না : হামাস
শান্তিরক্ষা মিশন মোতায়েন করতে চায় জাতিসংঘ হাইতিতে
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
পুতিন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না : সার্বিয়া
ক্লাইমেট অর্থায়ন ইস্যুতে দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
ট্রাম্পের অ্যাটর্নির বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন আটকে গেল
‘ফিলিস্তিনের পর ইরান, সউদী ও তুরস্ক হবে পরবর্তী টার্গেট’
প্রতি বছর ৩ লাখ নথিবিহীন অভিবাসীকে বৈধতা দানের ঘোষণা স্পেনের
প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে সবচেয়ে অসুখী দেশ জাপান-কোরিয়া
মুসলিম চিকিৎসক
শীর্ষে দিল্লি
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান