পথশিশুদের শিক্ষা ও কর্মশিক্ষণে আরো গুরুত্ব দিতে হবে

Daily Inqilab ইনকিলাব

১২ জুন ২০২৩, ০৯:০০ পিএম | আপডেট: ১৩ জুন ২০২৩, ১২:০২ এএম

ইংরেজি দৈনিক ‘নিউএজ’-এ প্রকাশিত এক খবরে শিক্ষাবিদ ও শিশুঅধিকার কর্মীদের বরাতে বলা হয়েছে, শিক্ষিত ও দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ থেকে বঞ্চিত পথশিশুরা দেশের উন্নয়নে অন্তরায় হিসেবে পরিগণিত হতে পারে। বলা বাহুল্য, এ কথার সত্যতা অস্বীকার করা যায় না। যারা রাস্তায় থাকে, খায়, ঘুমায়, এটা-ওটা করে আয়-রোজগার করে জীবনধারণ করে, আমরা তাদেরই পথশিশু বলি। এদের বাড়িঘর, ঠাঁই-ঠিকানা নেই, অভিভাবক নেই, দেখভালের লোকজন নেই। শিক্ষা নেই, চিকিৎসার সুযোগ নেই, ঘুমানোর নিরাপদ জায়গা নেই। নেই পুষ্টিকর খাবারের সংস্থান। ২০২২ সালের গৃহ ও জনশুমারী অনুযায়ী, দেশে শিক্ষার হার ৭৫.৬ শতাংশ, যারা বাংলায় লিখতে ও পড়তে পারে। যারা পথশিশু, তাদের মধ্যে কম সংখ্যকই লিখতে-পড়তে পারে। তাদের মোট সংখ্যা কত সেটা সুনির্দিষ্ট করা বলা যায় না। পথশিশুদের ওপর ২০২২ সালে করা সার্ভেতে কোনো বিশ্বাসযোগ্য পরিসংখ্যান নেই। লেখা-পড়ার সুযোগ থেকে তাদের অধিকাংশই যেমন বঞ্চিত, তেমনি কর্মশিক্ষণের সুযোগও বড় একটা নেই। পথশিশুদের শিক্ষা, কর্মশিক্ষণ এবং অন্যান্য সুযোগ ও সেবার জন্য সরকারের কিছু প্রকল্প ও কর্মসূচি রয়েছে। বেসকারি প্রতিষ্ঠানের তরফেও কিছু প্রয়াস-প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। কিন্তু এসবের ফলে পথশিশুদের সংখ্যা কমছে কিংবা তাদের বড়রকমে উপকার ও কল্যাণ হচ্ছে এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। এর প্রধান কারণ সরকারি-বেসরকারি কর্মসূচিতে এদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত ও স্থায়ী করা যায় না। এডুকেশন ওয়াচের চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জামান আহমেদ যথার্থই বলেছেন, এদের কোনো কর্মসূচিতে আটকে রাখা খুবই কঠিন। এরা কোথাও থাকতে চায় না, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যেতে পছন্দ করে। এ প্রেক্ষিতে তিনি মনে করেন, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো তৎপর হতে হবে। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ ও প্রকল্পগুলো আরো কার্যকর, শক্তিশালী ও সম্প্রসারিত হওয়া উচিত। তিনি মনে করেন, বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষগুলোর জবাবদিহির আওতায় আনা আবশ্যক।

আর পাঁচটা শিশুর মতোই যে-কোনো পথশিশুর খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাপ্রাপ্তির অধিকার রয়েছে। তার নিরাপত্তা ও কর্মলাভের অধিকারও রয়েছে। পথশিশুরা আমাদের সন্তান। কোনো না কোনো কারণে তারা পথশিশুতে পরিণত হয়েছে। তাদের পথশিশু হওয়ার প্রধান কারণ দারিদ্র্য। নদীভাঙন, প্রাকৃতিক বিপর্যয় ইত্যাদি অনিবার্য কারণে তারা নিরূপায় বা নিরালম্ব হয়ে পথশিশু হতে বাধ্য হয়েছে। অনেকের বাবা-মা নেই; থাকলেও লালন-পালন করার ক্ষমতা নেই। বাবা-মার সংসারে ভাঙনও তাদের পথে-পড়ার বিশেষ কারণ। যে কারণেই তারা পথশিশু হোক, তাদের দায়িত্ব সমাজ ও রাষ্ট্র এড়িয়ে যেতে পারে না, তারা অন্যান্য শিশুনাগরিকের মতই শিশুনাগরিক। তাদের শিক্ষা, কর্মশিক্ষণ ও প্রতিষ্ঠার অধিকার নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। সারাদেশের লাখ লাখ পথশিশু দেশের সম্পদ না হয়ে বোঝায় পরিণত হবে, তাদের দ্বারা দেশের নানামুখী অকল্যাণ হবে, এটা কাম্য হতে পারে না। পথশিশুরা পথে ফেলে দেয়া কাগজ, বোতল প্লাস্টিক এবং আবর্জনা থেকে মূল্যবান যা কিছু, সংগ্রহ করে তা বিক্রি করে জীবন ধারণ করে। কেউ মিন্তিগিরি, কেউ রিকশা চালিয়ে, কেউ বা জোগালের কাজও করে থাকে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক ব্যাপার হলো, বিভিন্ন অপরাধী চক্র তাদের নানা রকম অপরাধকর্মে নিযুক্ত করে ফায়দা হাসিল করে। এক সময় রাজনৈতিক কাজে তাদের ব্যবহার করা হতো। এখন মাদক ব্যবসায়ী, সন্ত্রাসী, ছিনতাইকারীরা ব্যবহার করে। অপরাধ জগতে টেনে এনে তাদের অপরাধী বানায়। কেউ হয় সন্ত্রাসী, কেউ কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য, কেউ হয় ছিনতাইকারী, কেউ হয় মাদক কারবারী, কেউ বা চোর-ডাকাত-পকেটমার। যারা দেশ পরিচালক, আমলা, অধ্যাপক, গবেষক, বিজ্ঞানী, কবি-সাহিত্যক কৃষিবিদ, প্রযুক্তিবিদ হতে পারতো তারা হচ্ছে অকর্মন্য, অপকর্মকারী ও অপরাধী। এর চেয়ে মানবিক অপচয় ও দুঃখজনক ঘটনা আর কিছু হতে পারে না।

পথশিশুদের বাঁচাতে হবে, রক্ষা করতে হবে। জাতীয় উন্নয়ন-অগ্রগতির পথে বাধা নয়, তাদের সম্পদে পরিণত করতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা, উপযুক্ত কর্মশিক্ষণ এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের দেশে ও সমাজে গরীব, অসহায়, এতিম ও দোস্তদের দেখা-শোনা, লালন-পালন ও প্রতিষ্ঠা নানাভাবে করা হতো। সমাজের বিত্তবান, মহানুভব ব্যক্তিরা সেটা করতেন। এতিমখানা ও মাদরাসা এক্ষেত্রে বড়রকমের দায়িত্ব পালন করতো। এখনো করে। তবে এখন এতিম, অসহায় শিশুর সংখ্যা বেড়েছে। অবশ্য উদ্যোগ নিলে এখনো এতিমখানা ও মাদরাসাতেই তাদের সুব্যবস্থা হতে পারে। এতিমখানা ও মাদরাসা প্রধানত ধনী ও বিত্তবানদের দান-খয়রাত ও সাহায্যে চলে। এই উভয়ক্ষেত্রে সরকারি সহায়তা পর্যাপ্ত পরিমাণে দেয়া হলে দ্রুত কার্যকর সুফল পাওয়া যেতে পারে। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, সরকারের এদিকে নজর নেই। দেশের এবতেদায়ী মাদরাসা প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। অথচ, তাদের শিক্ষকরা নামেমাত্র সরকারি সহায়তা পান। এবতেদায়ীসহ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের মাদরাসা শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাড়িয়ে বৃত্তি, উপবৃত্তি, দুপুরের খাবার ইত্যাদি দেয়া হলে এতিম-অসহায় ও পথশিশুদের লেখাপড়া যেমন হতে পারে তেমনি অনুরূপ সহায়তা দিলে এতিমখানাগুলো থেকেও ভালো রিটার্ন পাওয়া যেতে পারে। সরকার এদিকে দৃষ্টি দেবে বলে আমরা আশা করি। এইসঙ্গে আমরা এও প্রত্যাশা করি, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আরো কর্মসূচি ও প্রকল্প নেয়া হবে, যাতে পথশিশুরা লেখাপড়া ও কর্মশিক্ষণের সুযোগ লাভ করে নিজেদের জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। দেশ এবং সমাজও তাদের কল্যাণদায়ী সেবা পেতে পারে।

 


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বই আত্মার মহৌষধ
তরুণদের সামরিক প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে
সারবাহী জাহাজে ৭ খুন : দ্রুত তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করতে হবে
গণতন্ত্র ও সাম্যের পথে এগিয়ে চলা বাংলাদেশ রুখে দেয়া আর সম্ভব নয়
রাষ্ট্র সংস্কারে ইসলামের অনুপম শিক্ষা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে
আরও

আরও পড়ুন

অতিসত্বর নির্বাচন হওয়ার দরকার : আমীর খসরু

অতিসত্বর নির্বাচন হওয়ার দরকার : আমীর খসরু

দুর্নীতিগ্রস্ত লুটেরা মাফিয়াদল যাতে বাংলাদেশে আর ফেরত না আসতে পারে : মেজর হাফিজ

দুর্নীতিগ্রস্ত লুটেরা মাফিয়াদল যাতে বাংলাদেশে আর ফেরত না আসতে পারে : মেজর হাফিজ

বঞ্চিত ৭৬৪ কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিচ্ছে সরকার

বঞ্চিত ৭৬৪ কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিচ্ছে সরকার

ক্যাডার বর্হিভূত রাখার সুপারিশ প্রত্যাখ্যান শিক্ষা ক্যাডারের

ক্যাডার বর্হিভূত রাখার সুপারিশ প্রত্যাখ্যান শিক্ষা ক্যাডারের

শেখ হাসিনাসহ ৬৩ জনের নামে মামলা

শেখ হাসিনাসহ ৬৩ জনের নামে মামলা

অভিযানের খবরে পালাল শ্রাবণধারা কারখানার পরিচালক-ম্যানেজার

অভিযানের খবরে পালাল শ্রাবণধারা কারখানার পরিচালক-ম্যানেজার

সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নেই আশানুরূপ সাড়া

সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নেই আশানুরূপ সাড়া

একতাই পারবে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে

একতাই পারবে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে

তিতাস গ্যাস টি.এন্ড ডি. পিএলসি’র ৫% নগদ লভ্যাংশ অনুমোদিত

তিতাস গ্যাস টি.এন্ড ডি. পিএলসি’র ৫% নগদ লভ্যাংশ অনুমোদিত

ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল্লামা সাজিদুর নির্বাহী সভাপতি মাওলানা জুনায়েদ

ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল্লামা সাজিদুর নির্বাহী সভাপতি মাওলানা জুনায়েদ

‘আপনারা আমার খালেদকে ফেরত এনে দেন’ : নিখোঁজ সহ-সমন্বয়কের বাবা লুৎফর

‘আপনারা আমার খালেদকে ফেরত এনে দেন’ : নিখোঁজ সহ-সমন্বয়কের বাবা লুৎফর

২৮ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খেলাফত মজলিসের অধিবেশন প্রেস ব্রিফিংয়ে নেতৃবৃন্দ

২৮ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খেলাফত মজলিসের অধিবেশন প্রেস ব্রিফিংয়ে নেতৃবৃন্দ

ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা

ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা

ইনসেপ্টার বিক্রয় প্রতিনিধির ২২টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ

ইনসেপ্টার বিক্রয় প্রতিনিধির ২২টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ

পিকে হালদারের পাঁচ সহযোগীর ব্যাংক হিসাব ফ্রিজের নির্দেশ

পিকে হালদারের পাঁচ সহযোগীর ব্যাংক হিসাব ফ্রিজের নির্দেশ

ভূমধ্যসাগরে ৮ বাংলাদেশি নিহত

ভূমধ্যসাগরে ৮ বাংলাদেশি নিহত

মুক্তি পেলেন ভারতের সমুদ্রসীমায় গ্রেফতার ১২ বাংলাদেশি

মুক্তি পেলেন ভারতের সমুদ্রসীমায় গ্রেফতার ১২ বাংলাদেশি

আ.লীগকে পুনর্বাসনকারীদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়বে গণঅধিকার পরিষদ

আ.লীগকে পুনর্বাসনকারীদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়বে গণঅধিকার পরিষদ

অন্তর্বর্তী এ সরকারের মধ্যে দুটি সরকার রয়েছে : মাহমুদুর রহমান মান্না

অন্তর্বর্তী এ সরকারের মধ্যে দুটি সরকার রয়েছে : মাহমুদুর রহমান মান্না

হাসিনার নভোথিয়েটার দুর্নীতি মামলার পুনঃতদন্ত শুরু

হাসিনার নভোথিয়েটার দুর্নীতি মামলার পুনঃতদন্ত শুরু