তরুণদের সামরিক প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে হবে
২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৬ এএম
তরুণরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। সকল অন্যায়-অবিচার, বাধা-বিপত্তি ও অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে গর্জে উঠার উজ্জীবিত শক্তি হলো তরুণ প্রজন্ম। তরুণরাই পুরাতনকে ভেঙ্গে নতুনের স্বপ্ন দেখায়। বিশেষ করে, তারুণ্যে ভরপুর এই বাংলাদেশ গঠনে তরুণ-যুবকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য ও প্রশংসনীয়। বাংলাদেশ যখন ‘বাংলাদেশ’ হয়নি তখন থেকে আজ অবধি দেশের জন্য সকল আন্দোলন-সংগ্রামে তরুণ জনগোষ্ঠী মুখ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৬৬-এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, ৯০-এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এবং সর্বোপরি ২০২৪-এর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে তরুণ-যুবকদের আত্মত্যাগ আর সাহসী ভূমিকা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রেরণার হাতিয়ার হয়ে থাকবে।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় চার ভাগের এক ভাগ তরুণ। এই তরুণ জনগোষ্ঠীকে উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। কেননা, যে কোনো দেশ বা জাতির সাফল্য ও অর্জন তার তরুণ প্রজন্মকে এড়িয়ে সম্ভব নয়। অদম্য তরুণরা তাদের দূরন্তপনা, অসীম সাহস এবং নব-সৃষ্টির উদ্দীপনা নিয়ে যে কোনো কঠিন বাধা-বিপত্তিকে অতিক্রম করতে পারে। তাই তরুণদের শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, তথ্য-প্রযুক্তি এবং সর্বোপরি সকল প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দেশের যে কোনো সমস্যায় ভূমিকা রাখার উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশ জনবহুল ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। প্রতিবছর বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দূর্যোগে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয় দেশের মানুষ এবং সহায়-সম্পদ। তাছাড়াও বাংলাদেশ ভূপ্রকৃতিগতভাবে বড় ধরনের ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশে যদি বড় ধরনের ভূমিকম্প হয় তাহলে ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হবে, যা কল্পনা করাও দূরহ। দেশের অবকাঠামোগত অবস্থা, অপরিকল্পিত স্থাপনা এবং আয়তনের চাইতে জনসংখ্যার অত্যধিক ঘনত্ব, অপ্রশস্ত রাস্তা-ঘাট, প্রশিক্ষিত উদ্ধারকর্মী ও আধুনিক উদ্ধার সরঞ্জাম বা যন্ত্রপাতির অভাবে অধিকমাত্রার ভূমিকম্পে দেশের ধ্বংসযজ্ঞ কল্পনাকেও হার মানাতে পারে। শুধু তাই নয়, প্রতিবছর বিভিন্ন কল-কারখানায় অগ্নি-দুর্ঘটনার কারণেও প্রচুর প্রাণহানি ও অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় আমাদের। এমতাবস্থায়, আমাদের যদি একটি প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠী থাকে, তাহলে সেটি দেশের যে কোনো দুর্যোগে নিয়মিত বাহিনী ও উদ্ধারকর্মীদের সাথে কাজ করতে পারবে। তাই দেশের তরুণ-যুব জনগোষ্ঠীকে সামরিক বা এর আদলে একটি সামগ্রিক প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা খুবই জরুরি। যদি আমরা বহির্বিশ্বের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, রাশিয়া, ব্রাজিল, ইসরাইল, ইরান, তুরস্ক, সিরিয়া, মিশর, কিউবা, সুইজারল্যান্ড, ইরিত্রিয়া ও সুইডেনসহ অনেক দেশেই তরুণদের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক। দেশ ভেদে নিয়ম-কানুনের ভিন্নতা থাকলেও ঐসব দেশের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য প্রায় অভিন্ন।
পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থা এবং ভবিষ্যতের নানানমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার কথা বিবেচনায় নিয়ে দেশের সামরিক ভারসাম্য, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, নাগরিকদের শৃঙ্খলা ও একটি সুস্বাস্থ্যকর জাতি গঠনের মানসে আমাদেরকেও ধীরে ধীরে তরুণ-যুব জনগোষ্ঠীকে সামরিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাতে করে দেশের তরুণ-যুবকরা একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেশ প্রতিরক্ষা, আত্মগঠন, সুশৃঙ্খল জীবনযাপন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা ও দেশপ্রেমের দীক্ষা পাবে। সাথে সাথে দেশের দুঃসময়ে দেশমাতৃকা রক্ষায় এবং সুস্থ ও বুদ্ধিদ্বীপ্ত তরুণ সমাজ গড়ে তুলতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে, বর্তমান প্রযুক্তির উৎকর্ষের প্লাবনে ‘ডিজিটাল নেটিভ’ বা শিশুকাল থেকে ডিজিটাল ডিভাইসের মাত্রারিক্তি আসক্তির কারণে তরুণ-যুবকরা যেভাবে অলস ও কর্মবিমুখ হয়ে পড়ছে, তা থেকেও তাদের মন-মানসিকতাকে সৃষ্টিশীল কর্মকা-ে প্রভাবিত করার সুযোগ তৈরি হবে। যে কোনো প্রশিক্ষণ মানুষকে পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে, সাহস যোগায় এবং পরিস্থিতি মোকাবেলার দৃঢ় মানসিক শক্তির যোগান দেয়।
সামরিক প্রশিক্ষণ তরুণ জনগোষ্ঠীকে মাদকাসক্তির হাত থেকে রক্ষা করতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারবে। সম্মিলিতভাবে কোনো কাজ করার মানসিকতা সৃষ্টি করবে, বাস্তবজীবনে তারা দায়িত্বশীল হয়ে উঠবে, যে কোনো বিষয়ে বুদ্ধিদ্বীপ্ত ও বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্তে গ্রহণে সক্ষম হবে। পরের কল্যাণে বা যে কারো দুঃখ-দুর্দাশায়, বিপদে-আপদে ঝাঁপিয়ে পড়ার মানসিকতা সৃষ্টি করবে তাদের মধ্যে এবং বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তির নতুন নতুন উদ্ভাবনী চিন্তা-ধারায় তারা উদ্বুদ্ধ হবে। দেশের ব্যাপক তরুণ-যুবক যেভাবে নানান অপকর্মের সাথে জড়িত তা থেকে সরিয়ে আনার জন্য এরকম একটি প্রশিক্ষণ সত্যিই দারুণ ভূমিকা পালন করবে। আর দেশের মানুষ যে হারে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি বিশেষ করে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে তা থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে হলে শারীরিক প্রশিক্ষণ, জীবনযাপন পদ্ধতি এবং খাদ্যাভ্যাসের ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে এবং সেটি সম্ভব হবে যদি দেশের এই তরুণ জনগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা যায়।
প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের মতো জনবহুল এবং উন্নয়নশীল দেশে তরুণ-যুবকদের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ বা সামগ্রিক প্রশিক্ষণ বাস্তবায়ন করা কতটুকু সম্ভব? প্রতিবছর লাখ- লাখ তরুণের প্রশিক্ষণের আওতায় আনতে গেলে যে পরিমাণ অর্থ, প্রশিক্ষণ সরঞ্জাম, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, প্রশিক্ষক দরকার তা আমাদের এই মুহূর্তে নেই। তবে এখন থেকে যদি পরিকল্পনা নিয়ে আগানো যায়, তাহলে তা বাস্তবায়ন করা কোনো ব্যাপার নয়। সরকার যদি চায় তাহলে যে কোনো বিষয় বাস্তবায়ন করা সম্ভব। বিষয়টি অত্যন্ত ব্যয়বহুল হলেও বিগত সরকারগুলো এবং তাদের দোসররা যে পরিমাণ অর্থ লোপাট করেছে তার চাইতে বেশি হবে না। দরকার একটি সুন্দর পরিকল্পনা আর দৃঢ় সিদ্ধান্ত। সরকার যদি চায় সরাসরি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বা যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এমন উদ্যোগ নিতে পারে অথবা সামরিক বাহিনীর বর্তমান/অবসরপ্রাপ্ত অফিসার এবং বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের টাস্কফোর্স গঠন করে এ বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে পারে। আমাদের সীমিত সম্পদ ও আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষিতে কয়েকটি প্রস্তাব উল্লেখ করছি।
১. প্রশিক্ষণের জন্য একটি উপযুক্ত বয়সসীমা নির্ধারণ করা; হতে পারে সেটি ১৮ বছর বা কম-বেশি। এক্ষেত্রে সকলের জন্য প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক না করে প্রাথমিক পর্যায়ে শুধুমাত্র যারা আগ্রহী এবং প্রয়োজনীয় যোগ্যতায় উত্তীর্ণ সেসব তরুণদের প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা।
২. প্রশিক্ষণের মেয়াদকাল ৬-৯ মাস এবং প্রশিক্ষণ শেষে ৩ মাস সামরিক/আধা সামরিক বাহিনীতে সেবা প্রদানের ব্যবস্থা রাখা।
৩. প্রশিক্ষণকালীন সকল খরচ সরকার বহন করবে এবং প্রশিক্ষণ শেষে সামরিক/আধা সামরিক বাহিনীতে সেবা দেয়ার সময় সম্মানি প্রদানের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
৪. এই প্রশিক্ষণ শেষে প্রাপ্ত সনদ জীবনের উচ্চতর শিক্ষা-গবেষণা, চাকরি এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনায় রাখতে হবে। তাহলে দেশের সকল তরুণ-যুবকরা আগ্রহী হবে প্রশিক্ষণ নিতে।
৫. বিভিন্ন ধরনের কর্মমুখী শিক্ষা (স্বল্প মেয়াদী) এই প্রশিক্ষণের অন্তর্ভুক্ত করা যায়, যাতে করে যারা উচ্চতর পড়াশোনা করতে পারবে না তারা কর্মমুখী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যে কোনো চাকরি বা নিজস্ব ক্ষুদ্র কোনো ব্যবসা করে স্বাবলম্বী হতে পারবে এবং প্রবাসে যেতে ইচ্ছুকরা বিদেশে গিয়ে সহজে কাজ পাবে ও দক্ষ শ্রমিক হিসেবে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করতে পারবে।
মোট কথা, আমাদের তরুণ-যুবকদের যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উপযুক্ত মানবসম্পদে পরিণত করা, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করা, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের উপর হুমকি এলে সামরিক বাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশরক্ষায় যেন আত্মনিয়োগ করতে পারে সেই শারীরিক যোগ্যতা ও মানসিকতা সৃষ্টি করা খুবই প্রয়োজন। তরুণদের যদি যৌবনের প্রথম ধাপে এই রকম একটি প্রশিক্ষণের আওতায় আনা যায় তাহলে প্রতিটি নাগরিক দেশের জন্য সম্পদে পরিণত হবে এবং প্রকৃত অর্থেই দেশ সোনার বাংলা হয়ে উঠবে এবং পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে।
লেখক: প্রবাসী প্রাবন্ধিক, সৌদি আরব।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
দক্ষিণ কোরিয়ায় রাজনৈতিক সংকট ,অভিশংসিত প্রেসিডেন্ট ইউন আদালতে হাজির হননি
সালথায় দু'গ্রুপের সংঘর্ষে আহত ১৫, বাড়ি-ঘর ভাঙচুর
শুধু নির্বাচনের জন্য মানুষ জীবন দেয়নি : আসিফ মাহমুদ
নোয়াখালীর কবিরহাটে ১৩ বান্ডেল জাল ডলার ও টাকা জব্দ, গ্রেপ্তার-১
জম্মু-কাশ্মীরে ৫ ভারতীয় সেনা নিহত
অ্যাবারক্রোম্বি সিইও যৌন পাচার মামলায় অভিযুক্ত
চাঁদপুরে সেভেন মার্ডার: নৃশংসতার বর্ণনা দিলো র্যাব
ধার্মিক জামাই পেলে শোবিজ ছাড়বেন প্রিয়াঙ্কা, শেষ ইচ্ছা হাফেজ হওয়া
আন্দোলনে নামলেন এবার ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা
রূপগঞ্জে বিএনপির দুই গ্রুপের সংঘর্ষ, পৌর ছাত্রদলের আহ্বায়ক নিহত
চাঁদপুরে জাহাজে সাতজনকে হত্যা: সেই ইরফান গ্রেপ্তার
নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় মোজাম্বিকে নিহত ১০৩
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আমাদের দেশের গর্ব : সেনাপ্রধান
ব্যারিস্টার ফুয়াদের ছবি সম্পাদনা করে ভুয়া প্রতিবেদন প্রচার
সৈয়দপুরে তালাবন্ধ ঘর থেকে গৃহবধূর লাশ উদ্ধার
পাকিস্তান থেকে সরাসরি আসছে জাহাজ, আমদানি বেড়েছে ২১ শতাংশ
হাসিনা গত ১৫ বছরে দেশের ও নিজের সর্বনাশ করেছে, বাপকে ডুবিয়েছে, দেশকে ডুবিয়েছে: ফজলুর রহমান
আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা প্রশিক্ষণার্থী চিকিৎসকদের
স্বৈরশাসক হটানোর পর গণতন্ত্র পুনঃনির্মাণে শিক্ষার্থীরা
সার্চ কমিটি করে গ্রহণযোগ্যদের স্থানীয় সরকারে প্রশাসক নিয়োগ করার দাবি