নতুন প্রজন্মের চ্যালেঞ্জ
০৩ আগস্ট ২০২৩, ০৮:৩৭ পিএম | আপডেট: ০৪ আগস্ট ২০২৩, ১২:১০ এএম
জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে সর্বস্তরের জীবনযাত্রায়। শিক্ষা, চিকিৎসা, শিল্প, কৃষিসহ মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অকল্পনীয় অবদানকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ আমাদের নেই। কিন্তু তার পরেও একটি পরিস্থিতি আমাদের অস্থির করে তোলে। তা হলো, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অপব্যবহার। এতে আমরা যে পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি, তা সুফলের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। প্রযুক্তির প্রয়োজনমাফিক ব্যবহার যেমন উন্নত জীবনের চাবিকাঠি, ঠিক বিপরীতভাবে প্রযুক্তির অপব্যবহার কিংবা অতিব্যবহার তথা আসক্তি আমাদের ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেয়।
চারপাশে তাকালে সহজেই দৃষ্টিগোচর হবে, আমাদের বর্তমান প্রজন্ম অতিমাত্রায় প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে গেছে। পরবর্তী প্রজন্মের কথা তো বলাই বাহুল্য। যে বয়সে ছেলে-মেয়েরা বিভিন্ন খেলাধুলা ও সৃজনশীল প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত সময় পার করার কথা, ঠিক সেই বয়সেই হাতে মোবাইল নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দিচ্ছে। শুধু ঘণ্টার পর ঘণ্টা নয়, বরং দিনের চব্বিশ ঘণ্টাই সে ডিভাইসের কাছেই উঠ-বস করছে। এক মুহূর্তের জন্যও যদি তাকে মোবাইল থেকে আলাদা করা হয় তবে এমন অবস্থা পরিদৃষ্ট হয় যেন তার প্রাণবায়ু বের হয়ে যাবে। সে প্রয়োজনে খাওয়া ছাড়তে রাজি, ঘুম ছাড়তে রাজি, পড়াশোনা ছাড়তে রাজি, ভালো জীবনযাত্রা ছাড়তে রাজি এমনকি মা-বাবা ও স্বজনদের থেকে দূরে থাকতেও রাজি কিন্তু তার মোবাইল ছাড়তে কোনভাবেই রাজি না। এটা তার জীবনের এমন একটা অংশে পরিণত হয়েছে বা অবিচ্ছেদ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার জীবনের সমস্ত ভালো আর মন্দ, সুখ আর দুঃখ, আনন্দ আর বেদনা যেন শুধু এই মোবাইলটি ঘিরেই ঘুরপাক খাচ্ছে। চব্বিশ ঘণ্টা বুদ হয়ে থাকছে এই ছোট স্ক্রিনে। মাইলের পর মাইল স্ক্রল করে যাচ্ছে। কী দেখছে, কী শুনছে তা সে নিজেই বুঝে না। আর বুঝবে কী করে নেশা কি নেশাখোরকে বুঝতে দেয় যে, সে নেশাগ্রস্ত? এই অবিরত অনর্গল স্ক্রলিং তাকে দিন শেষে কী দিল? কিছুই না। বরং তার জীবন থেকে এমন মূল্যবান সময় কেড়ে নিল, যা তার জীবনকে অনন্য সফলতার দারপ্রান্তে পৌঁছে দেওয়ার জন্য তাকে দেওয়া হয়েছিল। শারীরিকভাবে হয়ে যাচ্ছে আনফিট, মানসিকভাবে হয়ে যাচ্ছে বিকল। সামাজিকতা, মানবিকতা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, ধর্মশিক্ষা, ইহকাল আর পরকালের ধারণা তার অন্তর থেকে ধীরে ধীরে মুছে যেতে থাকে। সে তার হাতের ঐ যন্ত্রটিকেই পৃথিবী মনে করছে। এই ভার্চুয়াল সংকীর্ণতার বাইরে যে বাস্তব এক বিশাল পৃথিবী আছে, এটা সে ভুলে গেছে।
এই বক্তব্য যদি বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, তবে অনুরোধ করব, একটু জরিপ করে দেখার জন্য। আপনার এলাকার দশটি তরুণকে বাছাই করুন এই জরিপের জন্য। তাদের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করুন তারা দিনের চব্বিশ ঘণ্টা কীভাবে কাটায়; কত ঘণ্টা ঘুমায়; কত ঘণ্টা পড়াশোনা কিংবা অন্য কোনো ভালো কাজে ব্যয় করে; পরিবারে কতটুকু সময় দেয়; একা থাকতে নাকি অন্যের সমাগম পছন্দ করে; যখন একা থাকে তখন কী করে; মোবাইলের মাধ্যমে কোন কোন মিডিয়া কিংবা গেমসের অলি-গলিতে সে বিচরণ করে; শারীরিকভাবে ইনডোর কিংবা আউটডোর খেলাধুলা কিংবা বাইরে কোথাও পরিবারের সাথে বেড়াতে যাওয়া হয় কিনা। হলফ করে বলতে পারি, যদি অসত্যের আশ্রয় নিতে না পারে আর আপনি সত্য কথাগুলো জানতে পারেন তবে দশজনের মধ্যে কমপক্ষে আটজনের জীবনযাত্রার গল্প শুনে আপনি আঁতকে উঠবেন। আর এটাই হলো আমাদের তরুণদের দিন গুজরানের হাল-সুরত।
আমি কোনো কল্পরাজ্যের মুখস্থ কথা বলছি না। বরং বাস্তবতা পরিবীক্ষণ করেই বলছি। একদিন এক ছোট ভাইকে মোবাইলে ডুবে থাকার কারণে রাগের স্বরে বলেছিলাম, ‘তোমার মোবাইলটা দাও। আমি ভেঙ্গে ফেলব’। আমি লক্ষ করে দেখেছি, এই কথা শোনার পর তার অবস্থা এমন হলো যেন সে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলল। সে আমার দিকে তেড়ে এসে বলল, ‘আমার জীবনের সব নিতে পারেন কিন্তু মোবাইল নিতে পারবেন না। অন্য সব কথা সহ্য করলেও মোবাইল নিয়ে কথা বলা সহ্য করব না’।
এক অবিভাবক এই সেদিন আমাকে তার হৃদয় ভেঙ্গে যাওয়ার কিছু গল্প শোনালেন, যার মূল চরিত্র ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে মিডিয়ায় আসক্ত তারই ছোট ছেলে। এবছর এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের কথা ছিল। কিন্তু সেই ছেলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে যে, সে পরীক্ষা দেবে না। বাসার একটি রুমে মধ্যেই কাটে তার চব্বিশ ঘণ্টা। সঙ্গী হিসেবে আছে একটি মোবাইল ও একটি ল্যাপটপ। তার মা রুমে খাবার দিয়ে এলে খায়, না দিলে কখনও চেয়ে খাওয়ার চেষ্টা করে না। তার রুমে কেউ যাক, এটা সে অপছন্দ করে। তার বাবা যদি বাজারে কিংবা অন্য কোথাও বাইরে যাওয়ার জন্য বলতে যায় তবে হিতের বিপরীত যা ঘটবার, তাই ঘটে। কারও কন্সাল্টেন্সি করা তো দূরের কথা তার পর্যন্ত পৌঁছাই মুশকিল। আর যদি বেশি বাড়াবাড়ি করা হয় তবে তো সুইসাইডের হুমকি কিংবা ব্ল্যাকমেইল আছেই। সারকথা হলো, এই তরুণের এহেন আসক্তি পুরা পরিবারকে জাহান্নামের টুকরায় পরিণত করেছে।
একজন কিংবা দুইজন নয়, এই চিত্র আজকে লক্ষ লক্ষ তরুণের জীবনের বাস্তবতা। আমার উদ্দেশ্য, সেই লক্ষ তরুণের শেকায়েত করা নয়, বরং আমার উদ্দেশ্য জাতির বিবেকে এই পরিস্থিতির বাস্তব চিত্র এবং ভবিষ্যৎ উত্তোরণের পথ ও পন্থা নিয়ে ভাবনার উদয় করা।
এই ব্যাধি আজ এমনভাবে ছড়িয়েছে, যা কোনো ব্যক্তির পক্ষে প্রশমন করা সম্ভব নয়। এজন্য দরকার সর্বমহলের সচেতনতা। সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করতে হবে অবিভাবক মহলের। সন্তানের গতি-প্রকৃতি নজরে রেখে সার্বক্ষণিক হাতের নাগালে রাখতে হবে। অসৎ সঙ্গ অবলম্বন করা থেকে যে কোনো উপায়ে সন্তানকে বিরত রাখতে হবে। ধর্মীয় বিধি-বিধান পালনে উৎসাহিত করতে হবে। অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কিংবা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো। আর ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেওয়া উচিত সরকারিভাবে। এখনও যদি সরকারিভাবে এই বিষয়টিকে গুরুত্ব না দেওয়া হয় তাহলে আগামীদিনের দেশ পরিচালনার জন্য সুস্থ মানসিকতার যোগ্য নেতৃত্ব খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে যাবে। কাজেই আশানুরূপ ফলের জন্য বার্নিং ইস্যু হিসেবে কনসিডার করে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি বলে মনে করছি।
লেখক: প্রাবন্ধিক
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
লক্ষ্মীপুরে ট্রাফিক পুলিশের অভিযানে সিএনজি চালকদের হামলা, আহত ৪
কানায় কানায় পূর্ণ ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ)-এর ঈসালে সওয়ার মাহফিল
কাপ্তাইয়ে সাক্রাছড়ি জলাশয়ে মাছ চাষ করে স্বাবলম্বী অমল কান্তি তঞ্চঙ্গ্যা
সংস্কার প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই নির্বাচন: প্রধান উপদেষ্টা
তানজানিয়ায় মারবার্গ ভাইরাস সন্দেহে ৮ জনের মৃত্যু, ডব্লিউএইচওর সতর্কতা জারি
নেত্রকোণায় আ.লীগ নেতা লক্ষীগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান তুহিন গ্রেফতার
শামীম ওসমান ও নানক পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা
চাঁদপুর ডাকাতিয়া নদী থেকে বৃদ্ধের অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার
বাংলাদেশ কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব ১৮ ই জানুয়ারি শুরু
ভূয়া আসামি দাঁড় করিয়ে জামিনের ঘটনায় ৪ জনের নামে মামলার নির্দেশ
শরীয়তপুরে ওরশ পালনকে কেন্দ্র করে জেলা হেফাজতে ইসলাম ও আয়োজক - ভক্তবৃন্দের মধ্যে উত্তেজনা
কুমিল্লায় ভিন্ন ধর্মের দুই প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ৩৯ বছর
সিএনজি চালিত অটো রিক্সাভর্তী ভারতীয় মদসহ গ্রেপ্তার ৪
বিএমআই নয়, স্থূলতার জন্য চাই নতুন মানদণ্ড ,প্রস্তাব বিশেষজ্ঞদের
শিল্পকলার জমজমাট আয়োজনে অনুষ্ঠিত হল 'সাধুমেলা'
মোবারকগঞ্জ সুগার মিলের কাজে যোগ দিতে না দেওয়া ১২০ শ্রমিকদের চাকরী বহাল
হুথি লক্ষ্যবস্তুতে মার্কিন হামলার ফুটেজ প্রকাশ
লস অ্যাঞ্জেলেসে চলমান দাবানলে ৬০ লাখের বেশি মানুষ মারাত্মক ঝুঁকিতে
জবির দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ সেনাবাহিনীকে মৌখিক হস্তান্তর,দুটি হল পরিদর্শন রবিবার
কোটচাঁদপুরে পুলিশের সোর্স হত্যা মামলার আসামি কটাকে কুপিয়ে পিটিয়ে হত্যা