যাদের চিন্তাধারায় গড়ে উঠেছে পাশ্চাত্য জীবন দর্শন
১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৬ এএম
উনবিংশ শতকেই সেকুলারিজম ব্যক্তিগত মতাদর্শ বা অসংখ্য মতবাদের উৎস হওয়ার মর্যাদা লাভ করে। এই মতবাদটিকে ভিত্তি করেই চিন্তাবিদগণ তাদের চিন্তা ও মতবাদ রচনার কাজ চালিয়ে গেছেন। এই পর্যায়ে চিন্তাবিদদের মধ্যে তিনজন বিশেষ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং এই তিনজনই চিন্তার ক্ষেত্রে অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি করেছেন। এই তিনজনের একজন হলেন চার্লস ডারউইন। তিনি বিবর্তনবাদী মতবাদের উদগতা। দ্বিতীয়জন সিগমুন্ড ফ্রয়েড। আধুনিক মনস্তত্ত্ব তারই অবদান। আর তৃতীয়জন কার্ল মার্কস। বৈজ্ঞানিক সমাজবাদ তার কল্পনার ফসল। এককথায় এই তিনজন চিন্তাবিদ পাশ্চাত্যের আধুনিক সভ্যতার স্রষ্টা বা নির্মাতা বলে অভিহিত। আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার দার্শনিক ভিত্তিভূমি এই তিনজনের চিন্তাধারাই সম্মিলিতভাবে রচনা করেছে। প্রসঙ্গত বলা যায়, এই চিন্তাবিদ ত্রয়ের দ্বিতীয় এবং তৃতীয়জন সার্বজনজ্ঞাতভাবেই ইসলাম ও মুসলমানদের চির দুশমন ইহুদি বংশজাত। আর প্রথমজন নিজে ইহুদী না হলেও তার সমস্ত চিন্তা ও মত ইহুদিদের দ্বারা ব্যাপক প্রচারিত ও তাদের উদ্দেশ্য সাধনের কাজে সর্বাত্মকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে।
সেকুলারিজম মতাদর্শভিত্তিক ডারউইনের বিবর্তনবাদ বর্তমান সভ্যতাগর্বী পাশ্চাত্য সমাজ ও সংস্কৃতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এ কারণে আজকের মানুষের নিকট আবহমানকালের মানবতা, মনুষ্যত্ব এবং নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতা নিতান্ত মূল্যহীন বিষয়ে পরিণত হয়েছে। মানুষ উন্নত আকৃতিসম্পন্ন পশুতে পরিণত হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই আত্মপ্রকাশ করেছে সিগমুন্ড ফ্রয়েডের চিন্তাধারা। সে চিন্তা ও মতানুযায়ী মানুষ মূলতই একটি ‘বস্তুগত যন্ত্র’ মাত্র। এখানে দেহ ও প্রাণ শক্তির পারস্পরিক দ্বন্দ্ব বলতে কিছুই থাকলো না। কেননা উক্ত ব্যাখ্যা অনুযায়ী প্রাণ কোন স্বতন্ত্র সত্তারূপে গণ্য নয়, তা বস্তুরই বিবর্তনের একটি পর্যায় মাত্র। পাশ্চাত্যের সেকুলার-বিজ্ঞান আল্লাহ অস্বীকারকারী জড়বাদী বিজ্ঞান রূহ বা প্রাণশক্তিকে এড়িয়ে এবং তার স্বতন্ত্র অস্তিত্বকে অস্বীকার করেই সৃষ্টিতত্ত্বের ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছে। আর পুঁজিবাদের ব্যাখ্যায় কার্ল মার্কস বলেছে যে, পুঁজিপতিরা শিল্পের আসল ও মৌলিক মুনাফা নিজেরাই কুক্ষিগত করে। তাই বঞ্চিত শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হয়ে উৎপাদন ব্যবস্থাকে খতম করে, পুঁজিপতি ও পুঁজিবাদকে উৎখাত করে সমস্ত রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব নিজেদের হাতে নিয়ে নেবে বলে এক ভবিষ্যৎবাণী তার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে। ডারউইন, ফ্রয়েড ও কার্ল মার্কসের চিন্তাধারাই বর্তমান পাশ্চাত্য জীবন দর্শনের ভিত্তিপ্রস্তর।
বস্তুত মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে যে জিনিসটি স্বাভাবিক বলে মনে করে, বাস্তব জীবনে তাকেই সত্য করে তোলে। এটাই হল মানব প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য। ডারউইনের ক্রমবিকাশ তত্ত্ব দুর্বলের ধ্বংস ও বিলয় এবং সবল ও শক্তিমানের ঊর্ধ্বতন অনিবার্য করে দিয়েছে। এক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ এবং তার ফলাফলকে অতীব স্বাভাবিক রূপে গণ্য করা হয়েছে। এই প্রেক্ষিতেই মানুষের বাস্তব জীবনের বিশাল ক্ষেত্রে বিভিন্ন ব্যক্তি, শ্রেণি ও জাতির মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও সংগ্রামকে অত্যন্ত স্বাভাবিক, যথার্থ ও কাম্য বলে ধরে নেয়া হয়েছে। আর এর পরিণামে শক্তিমানের বিজয় ও ঊর্ধ্বতন এবং দুর্বল ও শক্তিহীনের পরাজয় ও অবলুপ্তি অত্যন্ত স্বাভাবিক ও যুক্তিসঙ্গত বলে বিশ্বাস করাতে চেয়েছে। এর কোনো একটি ক্ষেত্রে একবিন্দু অস্বাভাবিকতা অনুভূত নয় পাশ্চাত্য সমাজের নিকট। এক কথায় ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতি শাশ্বত ও চরম সত্য বিধানরূপে পাশ্চাত্য সমাজের নিকট চূড়ান্তভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। কিন্তু আবহমান কালের পরম সত্য ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত সমাজের দৃষ্টিতে তা নিতান্তই অন্যায়, জুলুম ও স্বভাব পরিপন্থী কার্যকলাপ রূপে প্রমাণিত। সে দৃষ্টিকোণে সব মানুষই আল্লাহর সৃষ্টি, সকলেই সমান মর্যাদা ও অধিকার সম্পন্ন। শক্তিমানের হাতে দুর্বলের স্বার্থহানি অবৈধ ও অতি বড় অপরাধ। মূল্যমানের দিক দিয়ে তা অত্যন্ত ঘৃণ্য এবং কার্যত অবশ্য পরিত্যাজ্য।
ডারউইনের ক্রমবিকাশ তত্ত্বের আলোকে মানুষ তার পাশবিক পূর্বপুরুষদের স্বভাব গ্রহণ করেছে। চারদিকে পশুসুলভ রীতিনীতির আইন কানুন চালু হওয়া তারই অনিবার্য পরিণতি। বর্তমানের পাশ্চাত্য জাতিসমূহ জাতিসংঘের সমস্ত আন্তর্জাতিক ব্যাপারে এসব আইনের অধীনেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে। ন্যায় বা অন্যায়, শোভন বা অশোভন, জুলুম বা ইনসাফ প্রভৃতির প্রশ্ন তাদের নিকট কোনো গুরুত্বই পাচ্ছে না। বঞ্চিত, নিপীড়িত ও দুর্বল জাতিগুলোর ফরিয়াদ আকাশ বাতাসকে মোথিত করে তুলছে। কিন্তু সেদিকে কর্ণপাত করার কেউ নেই। প্রবল ও পরাশক্তিগুলো খায়ও এবং হুংকারও ছাড়ে। আর ভোটদানের সময় নিপীড়িত জাতিগুলোকে বড় বড় অত্যাচারী জাতগুলোর পক্ষে রায় দিতেও বাধ্য করছে। তা না দিলে তাদের পরিণামও অত্যন্ত ভয়ংকর হওয়া অনিবার্য হয়ে পড়বে। প্রত্যেকটি বৃহৎ শক্তি বৃহৎ শক্তির পক্ষেই কাজ করে। বাহ্যিকভাবে বক্তৃতা-ভাষণে যত বিরোধই দেখানো হোক, আসল কাজে তাদের সকলেরই ভূমিকা সম্পূর্ণরূপে অভিন্ন। কোনো বৃহৎ শক্তি অপর কোনো দুর্বল শক্তির পক্ষে কাজ করলেও তা করে তাকে সমূলে ধ্বংস করার, তাকে চূড়ান্তভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে। তাকে সম্পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বেঁচে থাকার সুযোগ দানের লক্ষ্যে নিশ্চয়ই নয়। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা এদিক দিয়ে খুবই তিক্ত।
ফ্রয়েডের মনস্তাত্ত্বিক মতাদর্শে তো স্পষ্ট ভাষায় মানুষকে যৌন আবেগসর্বস্ব জন্তু বানিয়ে দেখানো হয়েছে। যৌন উচ্ছৃশৃংখলতা ও যথেচ্ছাচারকে অত্যন্ত স্বাভাবিক ও একান্তই সাধারণ ব্যাপাররূপে পেশ করে নৈতিক বিধি-নিষেধ, বাধা-বন্ধন ও নিয়ন্ত্রণকে নিতান্তই অনভিপ্রেত এবং মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার কারণ বলে চিহ্নিত করেছে। ধন-ঐশ্বর্যে মদমত্ত পুঁজিবাদীদের এটাই ছিল কাম্য। ফলে চারদিকে যৌন উচ্ছৃঙ্খলা ও নির্বিশেষে নারী-পুরুষের দৈহিক মিলনজনিত ব্যভিচারের প্লাবন বয়ে গেল। এর পূর্বে পাশ্চাত্য দেশসমূহের পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবন প্রাচ্য দেশীয় পরিবার ও দাম্পত্য জীবনের মতোই সুস্থ ও পবিত্র ছিল। ভিন্ পুরুষের সাথে ভিন্ নারীর গোপনে মিলিত হওয়া প্রাচ্য দেশের মতোই দূষণীয় ও অবাঞ্চিত ছিল। সেখানে যুবতী মেয়েরা কোনো আত্মীয় পুরুষ বা নারীর সঙ্গ ছাড়া ঘরের বাইরে যাতায়াত করতে পারতো না। কিন্তু ফ্রয়েডের মনস্তাত্ত্বিক মতাদর্শ পাশ্চাত্যের নারী-পুরুষকে বাঁধভাঙ্গা জলস্রোতের মতই উদ্দাম ও উত্তাল করে দিয়েছে। অবিবাহিত নারী-পুরুষের পারস্পরিক প্রেম বিনিময় একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। মেয়েরা এখন আর ঘরের রাণী হয়ে থাকতে প্রস্তুত নয়। তারা এখন সভা-সম্মেলনের প্রদীপ শিখা, মঞ্চের গায়িকা, নৃত্যরতা শিল্পী আর অফিসের রিসিপশনিস্ট, বড় সাহেবের ব্যক্তিগত সেক্রেটারি, সহকর্মীদের সহকর্মিণী, টাইপিস্ট, স্টেনো এবং দোকানের বিক্রয়কারিণী ইত্যাদি ইত্যাদি। কুমারিরা এখন মা হতে এবং মারূপে সমাজে পরিচিত হতে এখন আর কোনো লজ্জা বা কোনো সংকোচবোধ করে না। ফ্রয়েডের দর্শন সব দ্বিধা, সংকোচ, লজ্জা বা অন্যায়বোধের অবসান ঘটিয়েছে।
ধন-সম্পদের অসম বণ্টন পুঁজিপতিদের অমানুষিক শোষণ, বিলাস-ব্যসন, লালসা চরিতার্থতা ও বিলাসী জীবন যাপন, সুখ-সাম্ভোগ গরিবদের অনশন ও দুঃখ দারিদ্র্য এবং নৈতিক অবক্ষয় ও মূল্যবোধের প্রচ- অভাব। কাল মার্কসের সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শের জন্য সহায়ক ও অনুকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। শ্রমিক শ্রেণির অসহায় অবস্থা যখন চরমে, তখন তারা ক্রুদ্ধ-বিক্ষুব্ধ হয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো এবং সব রকমের বাধা-বন্ধনকে চূর্ণ করে বন্য হিংস্র পশুর মতো এমনভাবে হুংকার দিল যে, পুঁজি ও পুঁজিদারদের সঙ্গে সঙ্গে নৈতিকতা ও ধর্মের সব নিয়মকানুন ও মূল্যবোধকে নিশ্চিহ্ন করে দিল। রাশিয়ার রক্তাক্ত বিপ্লব কত নিরীহ মানুষের তাজা টাটকা রক্ত ঝরিয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নাই। ১৯১৭ থেকে যে নির্মম রক্তপাতের ধারা শুরু হয়েছে, বর্তমানে দুনিয়ার অন্য বহুসংখ্যক দেশে সেই ধারাই চলছে অব্যাহতভাবে। যে হিংসা, আক্রোশ ও শত্রুতা-জিঘাংসা দিয়ে সমাজতন্ত্রের অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিলো, তা দুনিয়ার দেশে দেশে লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্তের বন্যা প্রবাহিত করে চলেছে। তবু মার্কসীয় দর্শনের রক্ত পিপাসা এখনও নিবৃত্ত হয়নি।
বর্তমান দুনিয়া এমন একটি কারখানায় পরিণত হয়েছে, যেখানে মালিক ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিক শ্রেণি মুখোমুখি হয়ে নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষার কঠিন দ্বন্দ্ব সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে রয়েছে। কোনো পক্ষই অপর পক্ষের নিকট এক বিন্দু নতি স্বীকার করতে প্রস্তুত নয়, কোনো পক্ষই অপর পক্ষের নিকট উন্নত নৈতিকতা, মানবিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যমানের প্রতি এক বিন্দু শ্রদ্ধা জানাতেও আগ্রহী নয়। ডারউইন ও ফ্রয়েডীয় দর্শন তাদের এসব বন্ধন ও বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত করে দিয়েছে। আর কার্ল মার্কসের শ্রেণি সংগ্রামের দর্শন বিশ্ব কারখানায় ‘বিশ্ব ধর্মঘট’ করার জন্য অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বেগমগঞ্জে তারুণ্যের উৎসব-২০২৫ আলোচনা সভা ও পুরুষ্কার বিতরনী অনুষ্ঠিত
ফতুল্লায় শ্রমিকদের সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ
টানা ৪০ রাতের পর সূর্যোদয়
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর গ্রেফতার
বগুড়ার নন্দীগ্রামে তারুণ্যের ফুটবল প্রতিযোগিতার উৎসব
দেশে অবস্থানরত অবৈধ বিদেশি নাগরিকদের আবারও সতর্ক করল সরকার
কালীগঞ্জে জাতীয় বিজ্ঞান মেলার পুরস্কার বিতরণী ও সমাপনী
বাউফলে উপজেলা ছাত্রদলের আহবায়কের বহিষ্কার দাবি
স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের খবর জানালেন জয়
খালেদা জিয়া অনেকটা ভালো আছেন : মির্জা ফখরুল
সুস্থ প্রতিযোগিতা না থাকলে গণমাধ্যমের স্বাভাবিক বিকাশ হবেনা- কমিশন প্রধান
সিংগাইরে স্থানীয় সরকার সংস্কার বিষয়ক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত
মালি আছে, বাগান নেই
পাকিস্তান থেকে চাল আমদানি করবে বাংলাদেশ
নতুন খেলোয়াড় চান গুয়ার্দিওলা
এস আলমের ৬৮ ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ, জব্দ ১৬ সম্পদ
সিলেটসহ দেশের পাথর ও বালু মহাল নিয়ে সরকারের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত
দৌলতপুরে নগদের মার্কেটিং অফিসারকে কুপিয়ে জখম
গোলের সুযোগ নষ্ট, হাভার্টজের পরিবারকে হত্যার হুমকি
ইসলামী আন্দোলনের আয়োজনে ভোলা জেলার উন্নয়ন শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত