ফুলতলী ছাহেব কিবলা মানুষকে জীবনভর আল্লাহর পথে ডেকেছেন
১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৪ এএম
হযরত আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী রহ. [১৯১৩-২০০৮] ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ হিসাবে বাংলাদেশে সমধিক পরিচিত। তিনি সারাটি জীবন মানুষকে আল্লাহর পথে ডেকে গেছেন। তাঁর জীবনের মিশন ও ভিশনই ছিল অন্তরে নবীপ্রেম জাগ্রত করে মানুষকে আল্লাহমুখী করা। নিরন্তর তিনি এ সাধনাই করে গেছেন। তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন আল্লাহর রঙে রঙিন ছিল। তাঁর ইলম, আমল ও তরিকা-তাসাউফের সাধনা তাঁকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল। সেই খুশবু লাখো প্রাণে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এই মহান বুযুর্গ ও ওলিয়ে কামেল। হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ জীবনের শুরুতেই নিজেকে ইলম ও আমলে সমৃদ্ধ করেছিলেন। তিনি প্রচলিত মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে ইলম অর্জনের পাশাপাশি সেই ইলমের বিশুদ্ধতা ও বরকতের জন্য দেশ-বিদেশের প্রখ্যাত আলেম ও বুযুর্গদের সান্নিধ্যে সুদীর্ঘকাল কাটিয়েছেন। রপ্ত করেছেন হাদিসে নববীর অমৃত সুধা, তাফসিরের অন্তর্নিহিত গূঢ়ার্থ ও হিকমাহ। ইলমে কেরাতের জগৎবিখ্যাত উস্তাদদের সাহচার্য্য তাঁকে জগৎবিখ্যাত কুরআনের খাদিমে পরিণত করেছিল।
হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.) ভারতের বদরপুর, বুন্দাশীলের প্রখ্যাত বুযুর্গ ওলি ও হাতেমতাঈ শাহ সূফি হযরত মাওলানা ইয়াকুব বদরপুরী (রহ.) পরম সান্নিধ্যে বেড়ে উঠেন। সেই সময়েই তরিকতের ভান্ডার উপুড় করে ফুলতলী ছাহেবকে দান করেন এই মহান ওলি। বলা হয়, যে বাসন তৈরিকালে সুন্দরতম ও শ্রেষ্ঠতম নমুনায় তৈরি করা হয় তা সবচেয়ে সুন্দর হয়। হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলাহকে এমন যতœ ও সুন্দরতম ছাঁচেই গড়ে তুলেছিলেন তাঁর পীর ও মুরশিদ হযরত বদরপুরী (রহ.)।
বাবা মুফতি মাওলানা শাহ আব্দুল মজিদের বংশ লতিকা ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম ওলি হযরত শাহ কামাল (রহ.) এর সাথে মিলিত হয়েছে। ফুলতলী ছাহেব সিলেটের সুলতান হযরত শাহজালাল ইয়ামনী (রহ.) এর গুপ্তধন হিসাবে অভিহিত করা হয়। তরিকার অধঃস্থন হিসাবে হযরত সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরেলভীর (রহ.) এর অমিততেজ ও সাহস তাঁর রক্তে বহমান ছিল। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ও ন্যায়ের পক্ষে ছিলেন সিংহ শার্দুল। তিনি সুমহান আদর্শ দ্বারা মানুষের মন জয় করেছেন। কী আলিম কী আওয়াম, যারাই তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছে সবাই সোনার মানুষে পরিণত হয়েছে।
ফুলতলী ছাহেব কেরাত শিক্ষার জন্য সুদূর মক্কা শরীফে গমন করেছেন এবং সেখানে তৎকালীন বিশ্ববিখ্যাত ক্বারী শায়খ আহমদ হেজাজি (রহ.)’র কাছে পুরো কুরআন তালিম করেছেন। আহমদ হেজাজি মাক্কী ছিলেন মক্কার বড় বড় আলেম ও ক্বারীদের উস্তাদ। তিনি প্রথমে ফুলতলী ছাহেবের বাড়ি হিন্দুস্থান (পাক ভারত উপমহাদেশ) শুনে ছাত্র হিসাবে গ্রহণ করতে চাননি। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় পরবর্তীতে ফুলতলী ছাহেবকে তাঁর কেরাতের যিম্মাদার বানিয়ে দেন। উস্তাদের এই আমানতকে তিনি এমনভাবে আঞ্জাম দিয়েছেন, যা অতুলনীয় ও অভূতপূর্ব। বর্তমানে বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে দারুল কেরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্টের মাধ্যমে কুরআনের খেদমত ছড়িয়ে পড়ছে, যা দারুল কিরাত নামে মানুষের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত। এছাড়া বহির্বিশ্বে অসংখ্য মসজিদ, মাদরাসা, কেরাত সেন্টারের মাধ্যমে তিনি দ্বীনি খেদমত জারি করেছেন।
ফুলতলী ছাহেব দুই সিলসিলায় হাদিস শরীফের সনদ লাভ করেন। ভারতের রামপুরের বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস হযরত মাওলানা খলিলুল্লাহ রামপুরী (রহ.) এবং অপরজন খ্যাতনামা মুহাদ্দিস মাওলানা অজিহ উদ্দিন রামপুরী (রহ.) থেকে। উভয়ের সনদই রাসূলুল্লাহ (সা.) পর্যন্ত পৌঁছেছে। বিশেষ করে অজিহ উদ্দিন রামপুরী (রহ.) এর উস্তাদ ছিলেন আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশমিরী (রহ.) হাদিস বিশারদদের কাছে প্রসিদ্ধ। তরিকতের ক্ষেত্রে তরিকায়ে চিশতিয়া, কাদরিয়া, নকশেবন্দিয়া, মোজাদ্দেদীয়া ও তরীকায়ে মোহাম্মদীয়ার বরকত ও ইজাজত লাভ করেছেন। এছাড়া তরিকতের প্রখ্যাত বুযুর্গ হযরত মাওলানা গোলাম মুহিউদ্দিন (রহ.)’র কাছ থেকেও চিশতিয়া নিজামিয়া তরিকার সনদও লাভ করেন ফুলতলী ছাহেব।
তরিকত চর্চা মানুষের মনে তাকওয়া সৃষ্টি করে। অন্তরে খুলুসিয়তের তাড়না তৈরি হয়। বান্দা ইবাদতে মজা পায় ও আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে। ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ ছিলেন তার প্রকৃষ্ট নমুনা। একজন তরীকতপন্থী মুসলমান কখনো দুনিয়াবি অর্থবিত্তের লোভ-লালসা, ক্ষমতা, মোহের কাঙাল হতে পারে না। আধ্যাত্মিকতার চর্চা ছাড়া কেউ ঈমানের পূর্ণ স্বাদ পায় না।
দ্বীন প্রচারের ক্ষেত্রে ফুলতলী ছাহেব কিবলা (রহ.) এর পদ্ধতি ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। তিনি ওয়াজের মাহফিলে দীর্ঘ সময় কথা বলতেন না। তবে যতটুকু বলতেন তাতে শ্রোতাদের জন্য ছিল হেদায়াতের শিক্ষা। শুরুতে তিনি কুরআন হাদিস থেকে বয়ান করতেন। উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে দিতেন। বয়ানে কুরআন হাদিসের রেফারেন্স পেশ করতেন। শেষের দিকে তাঁর আশিকিন, মুরিদিন ও মুহিব্বিনদের উদ্দেশ্যে নাসিসাহ্ পেশ করতেন। প্রতিটি মাহফিলেই আগতদের নিয়ে আল্লাহর কাছে তাওবা করতেন। আউলিয়ায়ে কেরাম ও তরিকতের বুযুর্গদের জীবনের শিক্ষা তুলে ধরতেন ও তাদের সাথে নিসবত (সম্পর্ক) রাখার তাকিদ দিতেন। বয়ানের বড় অংশজুড়ে থাকতো হুব্বে রাসূল তথা নবীপ্রেম। তিনি বলতেন, রাসূলের সাথে যার যতো বেশি সম্পর্ক তৈরি হবে তিনি ততোবেশি কামিয়াবি হাসিল করবেন।
তিনি সকল মানুষকে সমান চোখে দেখতেন। যত হীন ও নেহায়েত ব্যক্তিই হোন না কেন কাউকেই তিনি অবজ্ঞা করতেন না। তিনি তাদেরকে সময় দিতেন এবং কথা বলতেন। সপ্তাহের পাঁচ দিন দ্বীনের প্রচারে বাড়ির বাইরে কাটাতেন। দুইদিন নিজবাড়ি ফুলতলীতে অবস্থান করতেন। সেখানে দূর দূরান্ত থেকে আসা মানুষকে নিয়ে বসতেন ও দ্বীনের তালিম দিতেন। এসময় এলাকার অসহায় মানুষের খোঁজ-খবর নিতেন ও তাদের হাজত পূরণ করতেন।
তাঁর দ্বীন প্রচারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল মানুষকে ম্যান টু ম্যান সময় দেওয়া। যখন যে এলাকায় সফর করতেন তখন তাঁর সাথে সম্পর্কিত সকল মানুষের খোঁজ-খবর নিতেন। সম্ভব হলে তাদের বাড়িতে গমন করতেন। তখন প্রতিটি বাড়িই একেকটা মাহফিলে পরিণত হতো। কারণ, তার আগমনের খবর পেলেই মানুষ বাসাবাড়িতে ভিড় করতো। সফরকালে তিনি জানাজায় অংশগ্রহণ করতেন। প্রতিটি সফরেই নতুন নতুন মানুষ তাঁর কাছে দীক্ষা নিতেন। তাঁর জীবদ্দশায় বিশাল এক জনগোষ্ঠীকে তিনি আল্লাহর রঙে রাঙিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর নীতি ছিল আল হুব্বু ফিল্লাহ ওয়াল বুগদু ফিল্লাহ।
হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.) মুসলমানদের ঈমান, আকিদা হেফাযতের জন্য জোর তাকিদ দিতেন। বারবার মুসলিম মিল্লাতকে সতর্ক করেছেন নতুন নতুন ফেরকার কবলে না পরতে। তিনি বলতেন, এমন এক সময় আসবে যখন তসবির দানা ছিঁড়ে গেলে মালাগুলো যেভাবে পরপর ছিটকে পড়ে ঠিক সেভাবে মুসলিমদের সামনে ফেতনা ছড়িয়ে পড়বে। সে সময় নিজ নিজ তরিকায় সাবিত কদম না থাকলে ঈমান হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলতেন, মানুষকে ঈমানহারা করবে গোমরাহ আলেমরা।
আল্লাহর ওলির ইন্তেকালের পর সেই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হচ্ছে। আজকাল আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আকিদা বিধ্বংসী মতবাদ কতিপয় আলেমনামধারী এজেন্টরা প্রচার করছে। দ্বীনি কৃষ্টি-কালচারের উপর আঘাত করা হচ্ছে। দ্বীন প্রচারের অন্যতম মাধ্যম ওয়াজ মাহফিলকে বিতর্কিত করা হচ্ছে। তাফসিরের নামে মঞ্চগুলোকে হাসি-ঠাট্টা ও নাটক-কৌতুকের রঙ্গ মঞ্চে পরিণত করা হয়েছে। কেউ কেউ মাহফিলগুলোকে দলীয় রাজনীতি চর্চার হাতিয়ার বানিয়ে নিয়েছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শান ও মানের খেলাপ শব্দচয়ন করে মুমিনদের কলিজায় আঘাত করা হচ্ছে। এতে দ্বীনি ফায়দার চেয়ে গোমরাহি বাড়ছে। মানুষ বিভক্ত ও বিভ্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু ফুলতলী ছাহেবসহ আগেকার সময়ের সকল পীর বুযুর্গের মাহফিলে মানুষ দুনিয়া ও আখেরাতের কামিয়াবি হাসিলের উদ্দেশ্যে জড়ো হতেন। জীবনের পাথেয় সংগ্রহ করতেন। মানুষকে আল্লাহমুখী করা ও তাঁর নৈকট্য হাসিল করানোই ছিল সেইসব মহান বুযুর্গের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। ফুলতলী ছাহেবের জীবনের শিক্ষা শতাব্দীর পর শতাব্দী মানুষের হেদায়াতের উছিলা হিসাবে জারি থাকবে ইনশাআল্লাহ।
লেখক: পরিচালক, সিরাজাম মুনিরা জামে মসজিদ ও অ্যাডুকেশন সেন্টার, বার্মিংহাম, ইউকে।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
মেয়ের বাড়ি থেকে ফেরার পথে লাশ হলো "মা"!
মীরসরাইয়ে মুন্না খুনের ঘটনায়, পৌর যুবদলের আহ্বায়ক বহিষ্কার
দক্ষিণ কোরিয়ার অভিশংসিত প্রেসিডেন্ট ইউন গ্রেফতার
আজ সারদায় ৪৮০ এসআইয়ের সমাপনী কুচকাওয়াজ
ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত আরও ৬৩ জন ফিলিস্তিনি, মানবিক সংকট চরমে
ছাগলকাণ্ডের সেই মতিউর ও তার স্ত্রী গ্রেফতার
সেন্টমার্টিনে মধ্যরাতে ভয়াবহ আগুন, কয়েকটি রিসোর্ট পুড়ে ছাই
সেন্টমার্টিনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে তিন রিসোর্ট পুড়ে ছাই
শুল্ক রেলস্টেশন দিয়ে ভারত থেকে ২ হাজার ৪৫০ মেট্রিক টন চাল আমদানি
শুল্ক–কর বৃদ্ধির ফলে দেশের তামাক খাতে কী প্রভাব পড়বে
ব্যাংকিং সেবা খাতে এখনো ভারতীয় আধিপত্য
পরিষ্কার বার্তা চায় জনগণ
অবশেষে টিউলিপ সিদ্দিকের পদত্যাগ
কারাগারে এস কে সুর
‘গ্রিনল্যান্ডকে সামরিক এলাকা বানাতে চান ট্রাম্প’
ছাত্রলীগ নেত্রী নিশি দুই দিনের রিমান্ডে
অভি খালাস! তাহলে খুনী কে?
জল্পনা উড়াল চীনা সংস্থা টিকটক কিনছেন না মাস্ক
ধামরাইয়ে খাদ্যদ্রব্য তৈরির কারখানায় ফের আবার ডাকাতির চেষ্টা
রাজউক জোনাল অফিস স্থানান্তর আদেশের প্রতিবাদে মানববন্ধন