অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শুরু করতে হবে

Daily Inqilab ইনকিলাব

৩০ জুন ২০২৪, ১২:১০ এএম | আপডেট: ৩০ জুন ২০২৪, ১২:১০ এএম

দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি অত্যন্ত দুর্দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। শিল্পোৎপাদনে স্থবিরতা, বেকারত্ব বৃদ্ধি, বিনিয়োগে খরা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আমদানি-রফতানি বাণিজ্য সংকুচিত হওয়াসহ পুরো অর্থনীতি প্রচ- চাপের মধ্যে রয়েছে। এ থেকে সহসা উত্তরণ কিংবা সহনীয় পর্যায়ে আসার মতো কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। আর্থিক সংকট এতটাই প্রবল হয়ে উঠেছে যে, আয়ের সাথে ব্যয় সংকুলান করা কঠিন হয়ে পড়েছে। সরকারকে ব্যাংক এবং বিভিন্ন দেশ ও আর্থিক সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে চলতে হচ্ছে। ডলারের তীব্র সংকটের কারণে আমদানি-রফতানি যেমন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি উৎপাদনও হ্রাস পেয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে, গ্যাস-বিুদ্যৎ সংকট। এতে বহু শিল্পকারখানা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। বহু কারখানা উৎপাদন বন্ধ রেখেছে এবং ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। নতুন বিনিয়োগ দূরে থাক, চলতি বিনিয়োগই উদ্যোক্তারা টিকিয়ে রাখতে পারছে না। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। ডলার সংকটের কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের বিনিয়োগকারিরা লাভের অংশ দেশে নিতে পারছে না বলে পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। অর্থনীতির সব সূচক নি¤œগামী। জিডিপির আকারও দিন দিন কমে যাচ্ছে। আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক চলতি অর্থবছরে জিডিপি গড়ে ৫.৬ শতাংশ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। এই চিত্র থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, দেশের অর্থনীতি কতটা শোচনীয় অবস্থায় রয়েছে।

অর্থনৈতিক এ দুরবস্থার জন্য সরকার বৈশ্বিক মন্দাকে বরাবরই দায়ী করে আসছে। উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবেলায় আগে থেকেই কৃচ্ছ্রসাধনের পথ অবলম্বন করা হয়। আমদানি-রফতানি সীমিত করা, অপ্রয়োজনীয় ও কমগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজ স্থগিত এবং ব্যয় কমানো, সরকারি আবাসিক-অনাবাসিক ভবন নির্মাণ স্থগিত, সরকারি চাকরিজীবীদের বিদেশ ভ্রমণ স্থগিত করাসহ বাহুল্য খরচ কমানোর পদক্ষেপ নেয়া হয়। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে এবারের বাজেটের আকার ছোট করা হয়েছে। কৃচ্ছ্রসাধনের পথ অনুযায়ী, এবারের বাজেটে ১৯টি খাতের ব্যয় কমানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে সাশ্রয় হবে প্রায় ২১ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা। এছাড়া ব্যয় ও বরাদ্দ স্থগিতের মাধ্যমে প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। তবে অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সংবাদ মাধ্যমকে জানান, আর্থিক সংকট মোকাবেলায় অনেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগ উদাসীন। এটি অর্থ বিভাগ পর্যবেক্ষণ করেছে। কোনো কোনো মন্ত্রণালয় সংকটের মধ্যেও কম গুরুত্বপুর্ণ সড়ক, নতুন ভবন নির্মাণসহ স্থাপনা খাতে ব্যয় করার প্রবণতা থেকে বের হতে পারছে না। অর্থনৈতিক জরুরি পরিস্থিতিতে এ ধরনের উদাসীনতা কাম্য নয়। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন বাহিনীর কেনাকাটার ক্ষেত্রেও কৃচ্ছ্রসাধন করা উচিৎ। কারণ, এ মুহূর্তে আমরা কোনো যুদ্ধ পরিস্থিতিতে নেই যে, যুদ্ধের সরঞ্জামাদি লাগবে। এ ধরনের ব্যয়ে সাশ্রয়ী হতে হবে। খাতভিত্তিক বরাদ্দকৃত অর্থ অন্যকোনো উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় করা যায় কিনা, তা চিন্তা করতে হবে। এছাড়া, সরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে জাঁকজমক ও ব্যয়বহুল আয়োজন পরিহার করতে হবে। পর্যবেক্ষকদের মতে, অর্থনৈতিক সংকটের সময় উন্নত বিশ্বসহ বিভিন্ন দেশ কৃচ্ছ্রসাধন প্রক্রিয়া অবলম্বন করে। বিনিয়োগ ও জনগণের আয় বৃদ্ধির জন্য ব্যাপক কর্ম প্রবাহের পদক্ষেপ নেয়। যে চীন থেকে করোনার সূত্রপাত হয়েছিল, সে চীন দূরদর্শীতার পরিচয় দিয়ে শুরু থেকেই অর্থনীতিকে চাঙা রাখার জন্য কৃচ্ছ্রসাধন এবং সরকারিভাবে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর্ম বিস্তারের নীতি গ্রহণ করে। এতে অর্থনীতিতে কোভিডের ধাক্কা দেশটি সহজে রক্ষা পায়। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো এ প্রক্রিয়া অবলম্বন না করায় তাদের অর্থনীতি বড় ধরনের ধাক্কা খায়। মূল্যস্ফীতি রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। কোভিড পরবর্তী সময়ে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি চরম মন্দাবস্থার মধ্যে পড়ে। ফলে সরকার বাধ্য হয়ে সাধারণ মানুষকে একবেলা খাবার ‘স্কিপ’ বা বাদ দিতে বলে। এতে দেশটির সরকার জনগণের চরম সমালোচনার মুখোমুখি হয়। আমাদের দেশ সফলভাবে কোভিড এবং অর্থনীতিতে এর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা করলেও ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বেসামাল হয়ে পড়ে। অর্থনীতি ভঙ্গুর অবস্থার মুখোমুখি হয় এবং তা চলমান রয়েছে। মূল্যস্ফীতি সবোর্চ্চ পর্যায়ে চলে যায়। নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের এখন নাভিশ্বাস চলছে। আয়ের সাথে মানুষ ব্যয় সংকুলান করতে না পেরে প্রয়োজনীয় খাবার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবহণ ও বিনোদন খাতের খরচ কমিয়ে দিয়েছে। অনেকের নুন আনতে পান্তা ফুরানো অবস্থার মধ্য দিয়ে চলতে হচ্ছে। দরিদ্র আরো দ্ররিদ্র, নি¤œবিত্ত দরিদ্রে, মধ্যবিত্ত নি¤œবিত্তে পরিণত হচ্ছে। বেসরকারি বহু প্রতিষ্ঠান খরচ কমাতে কর্মকর্তা ও কর্মচারি ছাঁটাই করছে। এতে বেকারত্ব হু হু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের প্রধান রফতানি খাত গার্মেন্টের রফতানি দিন দিন কমছে। এ খাতে কর্মরত অসংখ্য শ্রমিক ইতোমধ্যে বেকার হয়ে পড়েছে।

অর্থনৈতিক সংকট কবে কাটবে বা স্বাভাবিক হবে, তা অনিশ্চিত। সরকার কৃচ্ছ্রসাধন প্রক্রিয়া অবলম্বন করছে ঠিকই, তবে তা কতটা বাস্তবায়ন হবে, এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে শঙ্কা রয়েছে। অতীতে কৃচ্ছ্রসাধন কর্মসূচি প্রত্যাশা অনুযায়ী সফল হয়নি। বিশেষ করে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং কর্মকর্তারা সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে যথেষ্ট আন্তরিকতার পরিচয় দেয়নি। মন্ত্রী থেকে শুরু করে সচিব পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা যদি অর্থনীতির সংকট যথাযথভাবে উপলব্ধি না করেন, তাহলে কৃচ্ছ্রসাধন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হতে বাধ্য। সরকারের নীতিনির্ধারকদের এ ব্যাপারে কঠোর তদারকি করতে হবে। কৃচ্ছ্রসাধন একটি আপৎকালীণ উদ্যোগ। এটা দীর্ঘসময় চলতে পারে না। এতে উন্নয়ন কর্মকা-সহ প্রবৃদ্ধি অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে। অন্যদিকে, যেসব খাতে হ্রাস করলে প্রবৃদ্ধি অর্জন বাধা হবে না, সেসব খাতে ব্যয় হ্রাস করতে হবে। সরকারকে কৃচ্ছ্রসাধনের পাশাপাশি ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শুরু করতে হবে। উৎপাদনশীল খাতগুলো চিহ্নিত করে কর্মের জোয়ার সৃষ্টি করতে হবে। মানুষের কর্ম সৃষ্টি ও আয় বৃদ্ধি পরিস্থিতি উত্তরণ ত্বরান্বিত করতে পারে।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে : হাইকোর্ট

দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে : হাইকোর্ট

মাগুরায় অজ্ঞাত গলা কাটা লাশ উদ্ধার

মাগুরায় অজ্ঞাত গলা কাটা লাশ উদ্ধার

মাগুরায় অজ্ঞাত গলা কাটা লাশ উদ্ধার

মাগুরায় অজ্ঞাত গলা কাটা লাশ উদ্ধার

মাগুরা পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা কর্মচারীদের কর্মবিরতি পালিত

মাগুরা পল্লীবিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা কর্মচারীদের কর্মবিরতি পালিত

রাজশাহীর চারঘাট থানা চত্ত্বরে রাসেল ভাইপার সাপ

রাজশাহীর চারঘাট থানা চত্ত্বরে রাসেল ভাইপার সাপ

রাজশাহীর চারঘাটে সড়ক দুর্ঘটনায় স্কুল শিক্ষক নিহত, আহত ১

রাজশাহীর চারঘাটে সড়ক দুর্ঘটনায় স্কুল শিক্ষক নিহত, আহত ১

বগুড়ায় আবারো ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত

বগুড়ায় আবারো ট্রেনের বগি লাইনচ্যুত

মধ্য আকাশে শক্তিশালী ঝাঁকুনিতে স্প্যানিশ এয়ারলাইন্স, আহত ৩০ যাত্রী

মধ্য আকাশে শক্তিশালী ঝাঁকুনিতে স্প্যানিশ এয়ারলাইন্স, আহত ৩০ যাত্রী

তুরস্কের মন্ত্রিসভায় রদবদল

তুরস্কের মন্ত্রিসভায় রদবদল

চলতি মাসে বজ্রঝড়-লঘুচাপ-নিম্নচাপ-তাপপ্রবাহ-বন্যা- সবই হতে পারে

চলতি মাসে বজ্রঝড়-লঘুচাপ-নিম্নচাপ-তাপপ্রবাহ-বন্যা- সবই হতে পারে

বাগেরহাটে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতিতে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা

বাগেরহাটে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতিতে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা

সাজেক ভ্রমণে আটকা পড়েছে ৭০০ পর্যটক

সাজেক ভ্রমণে আটকা পড়েছে ৭০০ পর্যটক

রূপগঞ্জে জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে বাড়ি ঘিরে রেখেছে এটিইউ

রূপগঞ্জে জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে বাড়ি ঘিরে রেখেছে এটিইউ

৭২ শতাংশ ব্রিটিশ সুনাককে আর চান না : জরিপ

৭২ শতাংশ ব্রিটিশ সুনাককে আর চান না : জরিপ

ইমরান খানের গ্রেপ্তার বিধিবহির্ভূত, আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন : ওয়ার্কিং গ্রুপ

ইমরান খানের গ্রেপ্তার বিধিবহির্ভূত, আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন : ওয়ার্কিং গ্রুপ

৪ ঘণ্টা পর খাগড়াছড়ির সঙ্গে যান চলাচল স্বাভাবিক

৪ ঘণ্টা পর খাগড়াছড়ির সঙ্গে যান চলাচল স্বাভাবিক

পেকুয়ায় পৃথক ঘটনায় দুই যুবকের মৃত্যু

পেকুয়ায় পৃথক ঘটনায় দুই যুবকের মৃত্যু

টানা বৃষ্টিতে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৪ টি ইউনিটে ১৬৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে

টানা বৃষ্টিতে কাপ্তাই পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৪ টি ইউনিটে ১৬৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে

সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব দাখিল ও প্রকাশ চেয়ে রিটের শুনানি আজ

সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব দাখিল ও প্রকাশ চেয়ে রিটের শুনানি আজ

কাজে যোগ দেননি এখনো, বরখাস্ত হতে পারেন মতিউর

কাজে যোগ দেননি এখনো, বরখাস্ত হতে পারেন মতিউর