বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসন প্রসঙ্গে
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম
দেশের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে আগস্টের শেষে এসে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ বন্যা। এবারের বন্যাটা অস্বাভাবিক। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নই এ ধরনের বন্যার অন্যতম কারণ। তাঁরা বলছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে হিমালয়ের গ্লেসিয়ার গলছে আশঙ্কাজনক হারে। বরফগলা সেই পানি তার স্বভাব অনুযায়ী নিচের দিকে আসছে আগের চেয়ে অনেক বেশি করে। সমুদ্রের পানির বাষ্পীভবনের হার আগের তুলনায় বেড়ে গেছে। ফলে পাহাড় ও সমভূমিতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণও বেড়ে গেছে। এ ছাড়া মানুষের উৎপাতে পাহাড়ের গাছপালা কমে গেছে। ফলে মাটির ক্ষয়বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পাহাড় আগের মতো পানি ধরে রাখতে পারছেনা। পাশাপাশি পাহাড় ধোয়া পানিতে থাকা পলির কারণে আমাদের নদীনালা-বিল-বাঁওড়গুলো ভরে যাওয়ায় সেগুলো তাদের স্বাভাবিক পানি ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। ১৯ আগস্ট থেকে উজানে ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশের সমগ ্রপূর্বাঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে। এসব অঞ্চলে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের পেছনে উপর্যুক্ত কারণগুলোর সঙ্গে লা-নিনার (খধ-ঘরহধ) প্রভাব আছে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন।
দেশের উত্তর-পূর্ব ও পূর্বাঞ্চলে বন্যায় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৫৭ লাখ মানুষ। পানিবন্দি হয়েছে প্রায় ১০ লাখ। এখন পর্যন্ত মারা গেছে ৫৯ জন। যারা পেরেছে, তারা অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে, হাটে, স্কুলে, বাঁধে, বড়ো সড়কে কিংবা রেলস্টেশনে আশ্রয় নিয়েছে। যারা পারেনি, তাদের চোখের পানি বন্যার পানির সঙ্গে মিশে হয়েছে একাকার। তাদের ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। ধানখেত তলিয়ে গেছে। পুকুর পরিণত হয়েছে অথৈ সাগরে । হাঁস-মুরগি, মাছ, গৃহপালিত পশু ভেসে গেছে সবই। অনেক মানুষ দেশের বিভিন্নপ্রান্ত থেকে এগিয়ে এসেছিল অসহায় বানভাসি মানুষকে উদ্ধার করার জন্য, তাদের কষ্ট লাঘবের জন্য । এদের মধ্যে আছে অনেক ছাত্র-যুবক। তারা শুকনো খাবার, পানি, ওষুধ ও কাপড় নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে আর্ত মানবতার পাশে।
চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনা বিভাগে আকস্মিক বন্যাকবলিত মোট ২৩টি জেলা চিহ্নিত হয়েছে। যার মধ্যে ৯টি জেলা বেশি আক্রান্ত। এই ৯টির মধ্যে রয়েছে কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর এবং সিলেটের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ। জেলাগুলোতে এখনো রয়েছে বন্যার প্রভাব।এবারের বন্যায় অবকাঠামোর ব্যপক ক্ষতি হয়েছে। বন্যায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের কমবেশি দুই হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বন্যায় দৃশ্যমান বড়ো ক্ষতি হয়েছে কৃষিখাতে। অনেক এলাকায়‘কাটার উপযোগী পাকা নাবি আউশ ধান তলিয়ে গেছে। রোপা আমনের বীজতলা, নতুন রোপণ করা আমনধানের খেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেশিরভাগ জায়গায় আমনধান তার বৃদ্ধি পর্যায়ের প্রথমদিকে ছিল। বাণিজ্যিক সবজি খেত ছাড়াও বসতবাড়ি লাগোয়া মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, লাউ, ঢ্যাঁড়শ, করলা, বেগুনখেত তলিয়ে গেছে পানির নিচে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ফল আম, কাঁঠাল, লেবু, আনারস, কলা, পেঁপে, সফেদাও নষ্ট হয়ে গেছে। আকস্মিক এই বন্যার কারণে বেশিরভাগ ফসল নষ্টহয়ে গেছে। এ ছাড়াও বেরিয়ে গেছে পুকুরে চাষকরা মাছ। বাড়িতে পালিতহাঁস-মুরগি গবাদি পশুরমৃত্যু এবং ভেসে যাওয়াসহ অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির খাদ্য এবং অন্যান্য পশুখাদ্য বিনষ্ট হয়েছে।এ দুর্যোগে দুধ, ডিমের প্রায় ৪১১ কোটি টাকা এবং অবকাঠামোসহ অন্যান্য ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৫৯০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা।
বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসনে বাসস্থান, কৃষি, মৎস্য ও স্বাস্থ্য সবচেয়ে বেশি জরুরি। এ অবস্থায় ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নানা রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করছে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো। এজন্য কৃষি মন্ত্রণালয় ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। এরই মধ্যে মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা ক্ষতির প্রকৃতি নির্ধারণ করে ফেলেছেন। কৃষিপুনর্বাসনের প্রয়োজনে তাঁরা তাঁদের কর্মপরিকল্পনাও ঠিক করে ফেলেছেন। সংশ্লিষ্টবন্য কবলিত এলাকায় ত্রান ও দুর্যোগব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়সহ খাদ্য মন্ত্রণালয়ও কার্যক্রম গ্রহণ করে বাস্তবায়ন শুরু করেছে।
এখন আশ্বিন মাস। আমন রোপণের স্বাভাবিক সময় শেষ। এমনকি নাবি আমন রোপণের শেষ সময় ৩১ ভাদ্র। আর উচ্চ ফলনশীল নাবি আমন হিসেবে শতভাগ আলোক সংবেদী জাত বিআর-২২, বিআর-২৩ এবং ব্রি ধান-৪৬ ও ব্রি ধান-৫৪-এর বিকল্প নেই। পাশাপাশি স্থানীয় জাত থেকে বাছাই করা আলোকসংবেদী জাত বিআর-৫, ব্রি ধান-৩৪ ও নাইজারশাইল আবাদ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ব্রির পরামর্শ হলো ১৫ সেপ্টেম্বরের (ভাদ্রের শেষ দিন) মধ্যে রোপণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গোছা প্রতি চার-পাঁচটি চারা ঘনকরে (২০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার) রোপণ করতে হবে। চারা দাপোগ পদ্ধতি বা প্লাস্টিক ট্রে বা ভাসমান বীজতলায় তৈরি করে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে চারার বয়স ১২ থেকে ১৫ দিন হলেই চলবে।এ ধরনের পরিস্থিতিতে আলোকসংবেদী বিআর-২২ এর ৩০ দিনের চারা ২১ আশ্বিন (৬ অক্টোবর) রোপণ করে বিঘাপ্রতি প্রায় ১২ মণ ফলন পাওয়া সম্ভব। তবে একই বয়সের চারা ভাদ্রের শেষ দিনে (১৫ সেপ্টেম্বর) রোপণ করে ফলন পাওয়া গেছে বিঘাপ্রতি ১৬ মণ। আশ্বিনের ১৫ তারিখের (৩০ সেপ্টেম্বর) মধ্যে রোপণ করতে পারলে একটা চলনসই ফলন পাওয়া যাবে। এ ক্ষেত্রে সেপ্টেম্বরের প্রথমে বীজতলায় বীজ ফেলা যেতে পারে। তবে দেরি করে রোপণ করলে ফলন কিছুটা কমে যাবে।
বন্যার পরে চারাগাছ সম্পূর্ণভাবে মাটিতে লেগে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতাপোড়া রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে ৬০ গ্রামথিওভিট ও ৬০ গ্রামপটাশ সার ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করতে হবে। এ সময়ে গাছে মাজরা, বাদামি ও সাদা-পিঠ ঘাসফড়িং, পাতা মোড়ানো এবং পামরি পোকার আক্রমণের হাত থেকে রক্ষার জন্য পোকা বিশেষে হাতজাল, পার্চিং এবং প্রয়োজন হলে অনুমোদিত কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে।
বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বা আংশিক হয়েছে এমন জমির ক্ষেত্রে বন্যার পানিতে ভেসে আসা কচুরিপানা, পলি, বালি এবং আবর্জনা যত দ্রুত সম্ভব পরিষ্কার করতে হবে। পানি সরে যাওয়ার পর ৫-৭ দিন কাদাযুক্ত ধানগাছ পরিষ্কার পানি দিয়ে প্রয়োজনে স্প্রে মেশিন দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে। পানি নেমে যাওয়ার পরপরই সার দেওয়া ঠিক নয়। এতে ধানগাছ পচে যেতে পারে। ১০ দিন পর ধানের চারায় নতুন পাতা গজানো শুরু হলে বিঘাপ্রতি ৮ কেজি ইউরিয়া ও ৮ কেজি পটাশিয়াম দিতে হবে।
বন্যার পানি কমে যাওয়ার পর তিন ধরনের রোগ ঐ সমস্ত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে রয়েছে পেটের সমস্যা, টাইফয়েড, প্যারা-টাইফয়েড, হেপাটাইসিস। এ ছাড়া ছত্রাকের সংক্রমণ, পাঁচড়া, ত্বকের অ্যালার্জিসহ ত্বকের অসুখ বাড়ে। পাশাপাশি শ্বাসের টান, হাঁচি-কাশি বেড়ে যায়। সমস্যা হলো বন্যাকবলিত এলাকায় স্বাস্থ্যকেন্দ্রও পানিতে ডুবে গেছে। স্থানীয়ভাবে চালু ওষুধ ব্যবসায়ীদের ফার্মেসিগুলোও পানিতে ডুবে গেছে। ফলে ঐ সব এলাকার মানুষের কাছে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেওয়া সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িঁয়েছে। সে ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যঝুঁকি মোকাবিলার জন্য নৌ-অ্যাম্বুলেন্স ও ভ্রাম্যমাণ মেডিক্যাল টিমের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বন্যা- পরবর্তী ডায়রিয়া পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রতিটি সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রসহ সকল ফার্মেসিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার স্যালাইন ও ওষুধ সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কোনোভাবেই ওষুধের দাম যাতে না বাড়ানো হয় সে বিষয়ে মনিটরিং জোরদার করা হয়েছে।
লেখক: পিআইডি ফিচার
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
আজ কিশোরগঞ্জের দানবীর, শিক্ষানুরাগী ওয়ালী নেওয়াজ খান এর ৩৮তম মৃত্যুবার্ষিকী
'দুর্বল' দলের বিপক্ষে পয়েন্ট হারাল ইউনাইটেড
সালাহর জোড়া গোলে লিভারপুলের জয়
গুমের দায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২২ সদস্য চাকরিচ্যুত
কুরস্ক অঞ্চলের ৪০ ভাগ খোয়ানোর স্বীকারোক্তি ইউক্রেনের
মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ চীনের সাথে কাজ করতে আগ্রহী: বাণিজ্য উপদেষ্টা
হাজীদের সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষায় সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ধর্ম উপদেষ্টা ড. খালিদ হোসেন
শরীয়তপুরে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের যৌথ কর্মী সভা
মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় সিকিউরিটি গার্ড নিহত
পাকিস্তানকে উড়িয়ে দিল জিম্বাবুয়ে
১৫ দিন রিমান্ড শেষে কারাগারে আব্দুর রাজ্জাক
লক্ষ্মীপুরে ১২০ টাকায় পুলিশে চাকরি পেলেন ৫০ জন
নির্বাচিত সরকারই দেশকে পুনর্গঠন করতে পারে : তারেক রহমান
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জেলা কমিটিতে অচেনা ৭ জন
মৌলভীবাজারে কৃষি ও প্রযুক্তি মেলা শুরু
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের মডেল উদ্ভাবন
ব্রহ্মপুত্রে অবৈধ ড্রেজার বসিয়ে চলছে বালু ব্যবসা
বাঘায় কৃষি শ্রমিককে গলা কেটে হত্যা
কেশবপুরে অবৈধ ইটভাটা বন্ধে বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ
হামলার শিকার হয়েও মুখ খুলতে পারছে না বোয়ালমারীর বহু পরিবার