অবিস্মরণীয় অধ্যাপক আবদুল গফুর
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৪ এএম
আমরা গভীর বেদনা ও দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, ভাষা আন্দোলনের অগ্রসেনানী, বিশিষ্ট লেখক, চিন্তাবিদ, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক অধ্যাপক আবদুল গফুর আর আমাদের মাঝে নেই। দৈনিক ইনকিলাবের ফিচার সম্পাদক জাতির এই বাতিঘর গত শুক্রবার ঢাকায় ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের এক শতাব্দীরকালের সাক্ষী ছিলেন তিনি। জাতীয় বিনির্মাণ, প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীনতা এই শতাব্দীরই অর্জন। এসবের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন অধ্যাপক আবদুল গফর। তিনি বৃহত্তর ফরিদপুরের রাজবাড়ি জেলার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের জন্ম গ্রহণ করেন ১৯২৯ সালে। স্কুল পর্যায়ে পড়াকালেই তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়েন। ছাত্রকর্মী হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেন এবং সিলেট রেফারেন্ডামে সরেজমিন অংশ নেন। ছাত্র হিসাবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। ১৯৪৭ সালে প্রবেশিকা মানের পরীক্ষায় তিনি বাংলা ও আসামের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। ১৯৪৬ সালে ঢাকার গভর্নমেন্ট ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় নবম স্থান অধিকার করেন। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক মাসের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক আবুল কাসেমের নেতৃত্বে তমদ্দুন মজলিস নামে একটি সংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। মহান ভাষা আন্দোলনের স্থপতি হিসাবে এই সংগঠনের সঙ্গে তিনি সংযুক্ত হয়ে পড়েন তখনই। সংগঠনে আরো যারা ছিলেন, তাদের মধ্যে অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, শাহেদ আলী, সানাউল্লাহ নুরী, আসকার ইবনে শাইখ প্রমুখ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনকে বলা হয় ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার সূচক আন্দোলন। বলা হয়, এই আন্দোলনের অনুপ্রেরণায় ৬২, ৬৯-এর আন্দোলন অতিক্রম করেই আসে ৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম। এরই পরিণতি স্বাধীন বাংলাদেশ। অধ্যাপক আবদুল গফুর ভাষা আন্দোলনের সংগঠক ও নেতাই ছিলেন না ভাষা আন্দোলনের মুখপাত্র তমদ্দুন মজলিস থেকে প্রকাশিত ‘সৈনিক’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক ও পরবর্তীতে সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাভাষার ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ে তার সংগ্রামী চেতনা ও ত্যাগের কোনো তুলনা হয় না। তিনি অনার্স পরীক্ষা না দিয়ে ভাষা আন্দোলনের কাজে নিয়োজিত হন। এর ১১ বছর পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। জাতীয় স্বাতন্ত্র ও স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় এই ত্যাগের কোনো তুলনা হয় কি?
অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, এই স্বাধীনতাসংগ্রামী, জাতিচিন্তক ও আলোর দিশারী মানুষটি যথাযোগ্য মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ২০০৫ সালে তিনি একুশে পদক পেলেও স্বাধীনতা পদক পাননি, সেটা পাওয়ার একশভাগ হক ছিল তার। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কারও পেতে পারতেন, যা পাননি। তিনি দলবাজ ছিলেন না। হয়তো একারণেই কোনো সরকারই তাকে উপযুক্ত সম্মান দেয়নি। জীবনের শেষ কয়েক বছর বার্ধক্যজনিত ও অন্যান্য কারণে শয্যাশায়ী ছিলেন তিনি। এ সময় তার যথেষ্ট আর্থিক সংকট ছিল। ইনকিলাব গত ১৬ বছরে স্বৈরাচারি সরকারের রোষানলে পড়ে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই হিমশিম খেয়েছে। তাকে আর্থিক সহায়তা তেমন একটা দিতে পারেনি। ভাষাসৈনিক অধ্যাপক আবদুল গফুরের শারীরিক ও আর্থিক অবস্থার কথা সরকারেরর লোকেরা জানতো না, এমন নয়। অথচ, তারা এগিয়ে আসেনি। কোনো সাহায্য-সহায়তা দেয়নি। দেশে অনেক ফেইক ভাষাসৈনিক গজিয়েছে। ফেইক মুক্তিযোদ্ধা গজিয়েছে। তারা ভাষাসৈনিক বা মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় দিয়ে সম্মান ও সুবিধা হাতিয়ে নিয়েছেন। অধ্যাপক আবদুল গফুর ছিলেন প্রকৃত ভাষা সৈনিক ও স্বাধীনতাযোদ্ধা। তার মর্যাদা, সম্মান ও দুর্দিনে সহায়তা না পাওয়া কতটা কষ্টের, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কথায় বলে, যে দেশ গুণীর মর্যাদা ও সম্মান দেয় না, সেদেশে গুণীর জন্ম হয় না। আমাদের দেশে প্রকৃত গুণীজনের সংখ্যা কত, তা হয়তো আঙ্গুলে গোনা যাবে। অধ্যাপক আবদুল গফুরের তুল্য গুণীজন কি এখন দেশে আছে?
অধ্যাপক আবদুল গফুর ছিলেন জাতির অভিভাবকস্বরূপ। তিনি ছিলেন সৎ, আদর্শবান এবং সুশৃংখল জীবনের অধিকারী। একই সঙ্গে ছিলেন সহজ সরল, নিরহংকার, সদালাপী ও পরোপকারী। তিনি ইসলামের প্রকৃত অনুসারী ছিলেন। ব্যক্তি জীবন থেকে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত ইসলামের প্রতিষ্ঠা ছিল তার জীবন সাধনার অপরিহার্য অংশ। বৈষম্যহীন, শোষণহীন ও কল্যাণময় সমাজ প্রতিষ্ঠা ছিল তার কাম্য। তিনি বিশ্বাস করতেন, ইসলামের অনুসরণেই সে সমাজ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। ১৯৪৭ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত তার সাংবাদিকতার কাল বিস্তৃত। তিনি ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ, ঢাকার আবুজর গিফারী কলেজে অধ্যাপনা করেছেন। একই সঙ্গে লিখেছেন নানা বিষয়ে গ্রন্থ। তার গ্রন্থাবলীর মধ্যে বিপ্লবী উমর, কোরানী সমাজের রূপরেখা, খোদার রাজ্য, ইসলাম কী এ যুগে অচল, ইসলামের জীবনদৃষ্টি, ইসলামের রাষ্ট্রীয় ঐতিহ্য, শাশ্বত নবী, আমার কালের কথা ইত্যাদি। তার এই রচনাবলী থেকেই সম্যক বুঝা যায়, ইসলামকে তিনি কীভাবে দেখেছেন, কীভাবে মূল্যায়ণ করেছেন। কেনই বা তিনি ইসলামকে প্রাধান্য দিয়েছেন, সেটাও বুঝতে বাকী থাকে না। তার মৃত্যু পরিণত বয়সে হলেও ইনকিলাবের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। জাতির জন্যও এটা বড় ক্ষতি। জাতির বিবেকের, চেতনার অন্যতম আলোকস্তম্ভ নির্বাপিত হলো। তার অভাব পূরণ হওয়ার নয়। আল্লাহপাকের দরবারে তার জন্য আমরা দোয়া করি, তিনি যেন তাকে বেহেশতের সর্বোচ্চ অবস্থানে স্থান দেন। তার পরিবার-পরিজনের প্রতি জানাই গভীর সমবেদনা।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
'দুর্বল' দলের বিপক্ষে পয়েন্ট হারাল ইউনাইটেড
সালাহর জোড়া গোলে লিভারপুলের জয়
গুমের দায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ২২ সদস্য চাকরিচ্যুত
কুরস্ক অঞ্চলের ৪০ ভাগ খোয়ানোর স্বীকারোক্তি ইউক্রেনের
মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ চীনের সাথে কাজ করতে আগ্রহী: বাণিজ্য উপদেষ্টা
হাজীদের সর্বোত্তম স্বার্থ রক্ষায় সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ধর্ম উপদেষ্টা ড. খালিদ হোসেন
শরীয়তপুরে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও ছাত্রদলের যৌথ কর্মী সভা
মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় সিকিউরিটি গার্ড নিহত
পাকিস্তানকে উড়িয়ে দিল জিম্বাবুয়ে
১৫ দিন রিমান্ড শেষে কারাগারে আব্দুর রাজ্জাক
লক্ষ্মীপুরে ১২০ টাকায় পুলিশে চাকরি পেলেন ৫০ জন
নির্বাচিত সরকারই দেশকে পুনর্গঠন করতে পারে : তারেক রহমান
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জেলা কমিটিতে অচেনা ৭ জন
মৌলভীবাজারে কৃষি ও প্রযুক্তি মেলা শুরু
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের মডেল উদ্ভাবন
ব্রহ্মপুত্রে অবৈধ ড্রেজার বসিয়ে চলছে বালু ব্যবসা
বাঘায় কৃষি শ্রমিককে গলা কেটে হত্যা
কেশবপুরে অবৈধ ইটভাটা বন্ধে বিভিন্ন দফতরে অভিযোগ
হামলার শিকার হয়েও মুখ খুলতে পারছে না বোয়ালমারীর বহু পরিবার
ইসলামী আন্দোলনের গণসমাবেশে আ.লীগ নিষিদ্ধের দাবি