ঢাকা   শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪ | ১৮ কার্তিক ১৪৩১

অনন্য চিন্তক-দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ

Daily Inqilab আফতাব চৌধুরী

০২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৫ এএম

প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, সর্বজন শ্রদ্ধেয় দার্শনিক, মানবহিতৈষী, অবিস্মরণীয় ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ আমাদের মধ্যে বেঁচেছিলেন ৯০ বছরেরও বেশি সময়। মৃত্যুর কিছু দিন আগে আমি তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম। ভালো-মন্দ অনেক আলাপ আলোচনার পর বিনয়ের সাথে জানতে চেয়েছিলাম, তিনি লিখছেন না কেন? বললাম, আমার মতো লক্ষ লক্ষ পাঠক আপনার লেখা পড়ার জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে। তিনি জানালেন, শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। পায়ের ব্যথায় নড়াচড়া করা সম্ভব হচ্ছে না। মজা করে তাকে বলেছিলাম, দাদা পা-টা বদলে নিলে কেমন হয়। হেসে বলেছিলেন, আর বদলে লাভ কী! ট্রেনে উঠার সময় তো হয়েই গিয়েছে। এ আলাপের পর মাসখানিক তাঁর সাথে আমার যোগাযোগ ছিল না, বিভিন্ন কাজে আমিও ছিলাম ব্যস্ত। একদিন ভোরে পূবালী ব্যাংকের পরিচালক আলহাজ্ব এম এ রকিব হঠাৎ আমাকে ফোন করে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের মৃত্যুর সংবাদ জানালেন। তখন ক্ষণিকের জন্য হতভম্ব হয়ে পড়েছিলাম। ভাবছিলাম, রকিব ভাই বোধহয় মজা করছেন আমার সঙ্গে। খবরটা বোধহয় সত্য নয়। তাৎক্ষণিক আমি তাঁর মেয়ে সাদিয়া চৌধুরী পরাগের কাছে ফোন করে নিশ্চিত হলাম। আমার জন্য এ ভীষণ দুঃসংবাদটি সত্যই হয়ে গেল।

১৯৭৪ সালে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। ঢাকায় থাকা অবস্থায় তাঁর বাসায় যাওয়া-আসা ছিল। সুযোগ পেলেই দু’কথা বলার চেষ্টা করতাম, প্রশ্ন করতাম কিছু জানার বা শেখার জন্য। তিনি আদর করতেন বলেই পাশে যেতাম কথা বলতাম, দাদা বলেই সম্বোধন করতাম। পরবর্তী পর্যায়ে বৈবাহিক সূত্রে দাদা-নাতি সম্পর্ক আমাদের রয়েই গেল। মজা করে বলতেন, তুমিতো আগে থেকেই আমার নাতি, আমি দাদা, বৈবাহিক সূত্রেও তুমি আমার নাতিন জামাই, মন্দ না আমাদের সম্পর্ক আরো দৃঢ় হলো। আসলে রাশভারি এ মানুষটির ভিতরে যে আরও এক ভিন্ন মানুষ লুকিয়েছিল তার সঙ্গে মেলামিশা না করলে হয়তো জানতেই পারতাম না। আমি তাঁকে যেভাবে দেখেছি, তার মহৎ জীবনের যতখানি জেনেছি, তারই নিরিখে কালের প্রেক্ষিতে তাঁর মূল্যায়ন বক্ষ্যমান প্রবন্ধের লক্ষ্য। তবে কাজটি নিঃসন্দেহে দুরূহ।

অপরিচিত মানুষের সঙ্গে চট করে কথা বলতেন না দেওয়ান সাহেব। কিন্তু একবার মিশে গেলেই হয়, রীতিমত জমিয়ে কথা বলতেন। তাইতো অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে তাঁর সঙ্গে। ক্লান্তিকর কাজের পর অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিত দেওয়ান আজরফের রসে ভরা গল্প ছিল দারুণ উপভোগ্য। স্বীয় মেধাবলে আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তিনি জয়ী হয়েছিলেন। জাত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে ভালবাসতেন। ফলে শিক্ষা-হিতৈষী ও মানবপ্রেমিক হিসেবে এক অনুকরণীয় আদর্শের প্রতীক ও প্রেরণার উৎস হয়ে তিনি অমর হয়ে আছেন। শিক্ষা, সমাজসেবা ও মানব কল্যাণের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিচরণ করেছেন তিনি।

এ মুহূর্তে অনেক কিছুই মনে পড়ে যাচ্ছে। অনেক স্মৃতি। কাগজে লিখতে গিয়ে বা অতীত জানার জন্য প্রতি মুহূর্তে প্রয়োজন তথ্য ও পরিসংখ্যান। সে সময় কম্পিউটার বা ইন্টারনেটও ছিল না এ অঞ্চলে। কিন্তু আমাদের ভরসা ছিলেন দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ। রাজনীতি থেকে অর্থনীতি, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ভিয়েতনামের যুদ্ধ থেকে শুরু করে উপসাগরীয় যুদ্ধ অথবা এ অঞ্চলে তথা উপমহাদেশের অতীত ও বর্তমান বিষয়াদি সম্পর্কে তাঁর ছিল গভীর জ্ঞান। ছিলেন এক জীবন্ত তথ্য ভাণ্ডার। খুব কম লোকই তাঁর কাছে কোনও কিছু জানতে চেয়ে হতাশ হয়ে ফিরেছেন। একজন নিষ্ঠাবান মুসলমান ছিলেন। একই সঙ্গে হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সকল সম্প্রদায়ের কাছে আদর ও কদর ছিল তাঁর। এ যুগে বড় দুর্লভ এ ধরনের ভালবাসা। বিশ্ব বিশ্রুত মনীষীদের সার্থক উত্তরসূরী হিসেবে সাম্প্রদায়িকতার বিষ বাষ্পে জর্জরিত ও ইজম বিভ্রান্ত পৃথিবীর জন্য মহান শিক্ষাই যেন রেখে গেছেন দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ।

দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ অত্যন্ত বলিষ্ঠ নীতির অধিকারী ছিলেন। কোথাও কোনো ভুল থাকলে স্পষ্টভাবে ধরিয়ে দিতে কোনো দিনই দ্বিধা করতেন না। সামনে প্রশংসা করে পিছনে সমালোচনা করতে কখনও দেখা যায়নি তাঁকে। এ দিক দিয়েও তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। প্রায়শই দুঃখ করে বলতেন, এ অঞ্চলের বেশিরভাগ পাঠক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে গুরুত্বহীন বিষয়গুলো নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। নিত্যদিনের জীবন যন্ত্রণা নিয়ে অসংখ্য খবর, প্রবন্ধ, নিবন্ধ প্রকাশ হলেও পাঠকদের সাড়া মেলে নিতান্তই কম। এ নিয়ে তাঁর আক্ষেপ ছিল সতত। ফলে মাঝে মধ্যে অনুযোগের সুরে বলতেন, আর কত লিখব? কাদের জন্যই লিখব? নিজেদের জীবন-যন্ত্রণা সম্পর্কে মানুষ এত নিস্পৃহ! শুধু শুধু লিখে কাগজ নষ্ট করার মানে কিছু হয় কি? কোনো দিনে উচ্চস্বরে কথা বলতে শুনিনি দেওয়ান আজরফের মুখে। সহকর্মী, আত্মীয়-স্বজন কারো সমস্যার কথা শুনলেই বিচলিত হয়ে উঠতেন তিনি। এক নিপাট ভদ্রলোক ছিলেন এ মহান ব্যক্তি।

আজ মনে পড়ছে, ঢাকার জালালাবাদ এসোসিয়েশনের অফিস কক্ষে বসে একদিন কোনও এক বিশিষ্ট ব্যক্তি সম্বন্ধে তাঁর মৃত্যুর পর কাগজের পাতায় স্মৃতিচারণ করে লেখার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। পাশের চেয়ারে বসছিলেন দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ। ঐ ব্যক্তির ছবি কাছে পাচ্ছিলাম না। রসিকতা করে দেওয়ান সাহেবকে বলেছিলাম, দাদা প্রয়োজনে কোনো কিছু না পেলে বড় সমস্যায় পড়তে হয়, বিচলিত হতে হয়। নিজের স্মৃতিচারণ করে বিস্তৃত জীবনের একটা লেখা তৈরি করে আমাকে দিয়ে যাবেন। সঙ্গে একটা ছবিও, যাতে করে সহসাই লে-আউট করে ফেলতে পারি।

না, আমার এ আবদারটুকু তিনি রাখেননি। একেবারে নিঃশব্দে সবার কাছ থেকে তিনি বিদায় নিলেন। সে দিনের সে রসিকতা যে এত তাড়াতাড়ি নির্মম বাস্তব হয়ে দেখা দেবে তা ভাবতে এখনও ভীষণ কষ্ট হয়। কিন্তু এটাতো কাগজের লে-আউট নয় যে, যখন খুশি একটাকে উঠিয়ে আরেকটা বসিয়ে লেখা যায়। এটাতো জীবনের লে-আউট। একবার চলে গেলে শত চেষ্টা করেও ফিরিয়ে আনা যায় না।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

কন্যার নাম প্রকাশ করলেন রণবীর-দীপিকা দম্পতি,দিয়েছেন মিষ্টি ছবি

কন্যার নাম প্রকাশ করলেন রণবীর-দীপিকা দম্পতি,দিয়েছেন মিষ্টি ছবি

তুরস্কে বিজয়ী বাংলাদেশের হাফেজ মুয়াজকে অভিনন্দন জানালেন পীর সাহেব চরমোনাই

তুরস্কে বিজয়ী বাংলাদেশের হাফেজ মুয়াজকে অভিনন্দন জানালেন পীর সাহেব চরমোনাই

সিলেট মহানগর ‘বৈষম্য বিরোধী হকার ঐক্য পরিষদ’র ১৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন

সিলেট মহানগর ‘বৈষম্য বিরোধী হকার ঐক্য পরিষদ’র ১৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন

শেরপুরে তারে জড়িয়ে বন্য হাতির মৃত্যু

শেরপুরে তারে জড়িয়ে বন্য হাতির মৃত্যু

কাঁচা সড়কে জনদুর্ভোগ

কাঁচা সড়কে জনদুর্ভোগ

দেরি করে ভাত দেওয়ায় হত্যা

দেরি করে ভাত দেওয়ায় হত্যা

গ্রামে প্রবেশের সড়ক নেই

গ্রামে প্রবেশের সড়ক নেই

বন্য হাতি হামলা

বন্য হাতি হামলা

পলো বাওয়া উৎসব

পলো বাওয়া উৎসব

গোদাগাড়ীর মহিশালবাড়ী হাটে ময়লার স্তূপ

গোদাগাড়ীর মহিশালবাড়ী হাটে ময়লার স্তূপ

কুয়াকাটায় ব্যবসা বাণিজ্যে গতি ফিরছে

কুয়াকাটায় ব্যবসা বাণিজ্যে গতি ফিরছে

গারো পাহাড়ে কলার আবাদ

গারো পাহাড়ে কলার আবাদ

সেতুর পনেরো শতাংশ কাজ করতেই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ

সেতুর পনেরো শতাংশ কাজ করতেই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ

ডেঙ্গুতে ১০ মাসে মৃত্যু ৩০০

ডেঙ্গুতে ১০ মাসে মৃত্যু ৩০০

বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন এবং বাস্তবতা

বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন এবং বাস্তবতা

স্বেচ্ছায় রক্ত ও চক্ষু দানকে উৎসাহিত করতে হবে

স্বেচ্ছায় রক্ত ও চক্ষু দানকে উৎসাহিত করতে হবে

বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে

বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে

বিদ্যুৎ সংকট আর্থ-সামাজিক অস্থিরতার কারণ হতে পারে

বিদ্যুৎ সংকট আর্থ-সামাজিক অস্থিরতার কারণ হতে পারে

শার্শায় আফিল জুট উইভিং ফ্যাক্টরি শ্রমিক নিহত

শার্শায় আফিল জুট উইভিং ফ্যাক্টরি শ্রমিক নিহত

আফগান সিরিজের বাংলাদেশ দল ঘোষণা,আছে চমক

আফগান সিরিজের বাংলাদেশ দল ঘোষণা,আছে চমক