তারেক রহমান : এক যুগনায়কের উত্থান
০৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৪ এএম
ইতিহাস ঘুরে ফিরে আবর্তিত হয়েছে তারেক রহমানের ক্ষেত্রে। এক-এগারোর সরকার ২০০৭ সালের মার্চের ৭ তারিখ তারেক রহমানকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতার পরবর্তী সময়ে অমানুষিক শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন তিনি। আদালতের নির্দেশে চিকিৎসকদল এর সত্যতাও খুঁজে পান। দীর্ঘ আঠারো মাস কারান্তরীণ থাকার পরে জামিনে মুক্তিপ্রাপ্ত হয়ে ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাড়ি জমান তারেক রহমান। ২০০৮ সাল থেকে অদ্যাবধি তারেক রহমান লন্ডনে নির্বাসিত জীবন অতিবাহিত করছেন। এর মধ্যে সহোদর ভাই আরাফাত রহমান কোকোর জীবনাবসান অথবা মা বেগম খালেদা জিয়া’র আইসিইউর জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের মুহূর্তেও তিনি তাদের কাছে থাকতে পারেননি। প্রায় অর্ধশতাধিক মামলার খড়গ বা শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে জীবননাশের চেষ্টা কোনো কিছুই তাকে ফ্যাসিবাদী অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে রাখা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। আয়াতুল্লাহ আল খোমেনি বা তারেক রহমানের ক্ষেত্রে ইতিহাস যেন একই রূপে আবর্তিত হয়েছে। প্যারিসের নির্বাসন জীবন খোমেনিকে বিশ্বের কাছে তাঁর বক্তব্যকে আরও সহজে পৌঁছে দিতে সহায়তা করেছে। লন্ডনের নির্বাসন তারেক রহমানকেও করেছে অপ্রতিরোধ্য, দেশের মিডিয়া তাঁর বক্তব্য প্রচার করতে না পারলেও ভিডিও কনফারেন্সিং, সোশ্যাল মিডিয়া ও আধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে দেশের আনাচে-কানাচে তৃণমূল থেকে জাতীয় পরিসরের নেতাদের সাথে তিনি যুক্ত থেকেছেন, সবাইকে রেখেছেন ঐক্যবদ্ধ। প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার দূরে বসেও গণতন্ত্রকামী কর্মী-সমর্থকদের কাছে তাঁর উপস্থিতি ছিল ‘অমনিপ্রেজেন্স’, দূরে থেকেও তিনি ছিলেন তাদের সাথেই।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) যখন গঠিত হয় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান তখন সরকার প্রধান হিসেবে দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর অনেকেই ভেবেছিলেন ক্ষমতার স্পর্শে গড়ে ওঠা এই দলটির অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়বে। সবাইকে ভুল প্রমাণ করে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে চূড়ান্ত সফলতা ও পরবর্তীতে সরকার গঠনের মাধ্যমে বিএনপি প্রমাণ করে, বাংলাদেশের মানুষের বৃহত্তর অংশের রাজনৈতিক ভাবাদর্শকে প্রতিনিধিত্ব করে এই দলটি। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ, সার্বভৌমত্ব আর অর্থনৈতিক মুক্তির আদর্শিক সেই জায়গাটি এখন আরও প্রবলভাবে দলটিকে জনসম্পৃক্ত করেছে। আর একারণেই বিগত ১৬ বছরে এই দলের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়নি, কোনো-কোনো ক্ষেত্রে বরং আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।
বিগত সাড়ে ১৫ বছরে বাংলাদেশে অন্যতম বড় যে ক্ষতিটি হয়েছে, তা হচ্ছে নানা প্রকরণের সামাজিক বিভাজন সৃষ্টি। ব্রিটিশদের ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ তত্ত্বের মতো এই ভূখণ্ডের মানুষদের মধ্যে নানা দল-উপদলে ‘মনস্তাত্ত্বিক সামাজিক বিভাজন’ সৃষ্টি করা হয়েছে। ঐক্যবদ্ধ জাতিরাষ্ট্র গঠনের পরিবর্তে ফ্যাসিজমের মসনদকে পাকাপোক্ত করার জন্য ‘মনস্তাত্ত্বিক সামাজিক বিভাজন’ সৃষ্টি ছিল ফ্যাসিস্টদের অন্যতম হাতিয়ার। একটি রাষ্ট্রের সফলতা অনেকাংশে নির্ভর করে জাতীয় ঐক্যের সুসংহত অবস্থানের উপর। জাতীয় ঐক্য শক্তিশালী হলে জাতীয় শক্তির বিভিন্ন উপাদান জাতিরাষ্ট্রের উন্নয়নে প্রয়োগ করা যায়, ফলে জাতীয় উন্নয়নের গতি-প্রকৃতি ত্বরান্বিত হয়, নাগরিকদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটে। অপরদিকে জাতীয় ঐক্যের ব্যত্যয় ঘটলে, বিভাজিত সমাজ ব্যবস্থায় জাতীয় ঐক্য সুসংহত করতে গিয়ে রাষ্ট্রকে মূল্যবান জাতীয় শক্তির অপচয় করতে হয়। ফলে বাধাগ্রস্ত হয় উন্নয়ন, অবনমিত হয় নাগরিক জীবনমান। ছাত্র-জনতার জুলাই বিপ্লবের প্রারম্ভ থেকেই তারেক রহমান জাতীয় ঐক্য গঠনের প্রস্তাব উপস্থাপন করে আসছেন। অবশ্য ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পূর্বেই ১৩ জুলাই ২০২৩ তারিখ সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার এবং অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে ৩১ দফা রূপরেখা তুলে ধরা হয়। এরও পূর্বে ভিশন ২০৩০ রূপকল্পের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের একটি রূপরেখা প্রকাশ করা হয়। তারেক রহমান বারবার প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনীতির বিপরীতে সব মত ও পথের সমন্বয়ে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বৈষম্যহীন ও সম্প্রীতিমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে আসছেন। ফ্যাসিজমের উৎখাতের পর তিনি জাতীয় ঐক্য গঠনের প্রয়াস চালাচ্ছেন। তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যে তিনি ঐক্যের বার্তা দিচ্ছেন, পেশীশক্তির উত্থানের পরিবর্তে জনমানুষের পক্ষে কাজ করে জনসমর্থন সৃষ্টির বার্তা দিচ্ছেন। জুলাই বিপ্লব পরবর্তী সময়ে শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে বিএনপির প্রায় অর্ধ-সহস্রাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণ করে তিনি বিএনপির কর্মী-সমর্থকদের প্রতি নৈতিক রাজনৈতিক চর্চার জন্য কঠোর বার্তা দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর এই উদ্যোগ ভবিষ্যতে রাজনৈতিক পরিবেশের গুণগত পরিবর্তনের গোড়াপত্তন করবে। বিএনপির মতো সর্ববৃহৎ দলের গুণগত পরিবর্তনের এই উদ্যোগ অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তিসহ জাতীয় রাজনৈতিক পরিসীমায় এক নবতর সাম্যবস্থার সৃষ্টি করবে।
সহস্রাধিক শহীদের প্রাণ, পঙ্গুত্ব ও অন্ধত্বের বিনিময়ে অর্জিত জুলাই বিপ্লবে ছাত্র-জনতার পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মীদের আত্মত্যাগ থাকলেও তিনি এযাবৎ কৃতিত্বের অংশীদারিত্ব দাবি করেননি, বরং বহুল কাক্সিক্ষত এই বিজয়ের মহানায়ক হিসেবে তিনি রাজপথে জীবন বিলিয়ে দেয়া সেইসব বীর ছাত্র-জনতাকেই মহানায়ক হিসেবে অলংকৃত করেছেন। গণ-অভ্যুত্থানের এই সরকারকে সফলতা বা ব্যর্থতাকে সকলের সফলতা বা ব্যর্থতা হিসেবে দেখেছেন, এই সরকার যেন ব্যর্থ না হয় এ বিষয়ে তিনি সকলের প্রতি সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন। জুলাই বিপ্লব পরবর্তী সময়ে তিনি প্রতিনিয়ত গণঅভ্যুত্থানের সরকারকে সুসংহত করাসহ বিপ্লবী ছাত্র-জনতা ও অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে পারস্পারিক বোঝাপড়া ও পরোক্ষ ঐকমত্য সৃষ্টির প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। ৩১ দফার মাধ্যমে তিনি ভবিষ্যতের যে বাংলাদেশের রূপরেখা উপস্থাপন করেছেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্যের কথা বলেছেন, রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের প্রস্তাব এনেছেন। জ্ঞানভিত্তিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’-কে সামনে রেখে শিক্ষা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের সহযোগে নতুন অভিযাত্রার অভিপ্রায় তুলে ধরেছেন। তিনি তাঁর ভাবনায় পরিবেশ, অর্থনীতি, পল্লী উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, কৃষি, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসহ রাষ্ট্রকাঠামোর সকল গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রের গুণগত পরিবর্তনের রূপকল্প উপস্থাপন করেছেন।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য এই মুহূর্তে সর্বাপেক্ষা জরুরি হচ্ছে একটি ‘জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’। গণতন্ত্রকামী সকল শক্তির পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ভবিষ্যৎমুখী এক নতুন ধারার সামাজিক চুক্তি সেই কাক্সিক্ষত জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। তারেক রহমান জাতীয় ঐক্যের সেই পথরেখা অঙ্কন করেছেন। এই পথ ধরে একসময় ফ্যাসিস্ট বিরোধী সকল রাজনৈতিক শক্তি জাতীয় ঐক্যের ছায়াতলে একত্রিত হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এইসময়ে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক চরিত্র তারেক রহমান। তাঁর নেতৃত্বে থাকা বিএনপি এবং যুগপৎ আন্দোলনে অন্যান্য সহযোগী রাজনৈতিক শক্তির ভবিষ্যৎ গতি-প্রকৃতি ঠিক করবে আগামীর বাংলাদেশের পথরেখা।
সমসাময়িক রাজনীতিতে তারেক রহমানের এই প্রজ্ঞাময় প্রত্যাবর্তন অভাবনীয়। সব থেকে বেশি মিডিয়া প্রোপাগান্ডার শিকার এই মানুষটি আজ এক নতুন বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে চিত্রায়ণ করেছেন। তাঁর এই অভিপ্রায় সফল হলে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম আগামীর ‘জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার’ আমাদের সেই অভিলক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে। তাঁর দূরদর্শী রাজনৈতিক চিন্তা কাক্সিক্ষত সেই বাংলাদেশের বার্তা দেয়।
লেখক: প্রকৌশলী ও কলামিস্ট
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ঘরের মাঠে ফের লজ্জার হার রিয়ালের
লিসবনে বিধ্বস্ত ম্যানচেস্টার সিটি
দিয়াসের হ্যাটট্রিকে লিভারপুলের জয়যাত্রা অব্যাহত
নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে আর্জেন্টিনা দলে ফিরলেন মার্টিনেজ
ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী গ্যালান্টকে বরখাস্ত করলেন নেতানিয়াহু
শমী কায়সার গ্রেপ্তার
শের এ বাংলা মেডিকেল কলেজের ৫৬তম প্রতিষ্ঠঅ বাষির্কী উপলক্ষে মিলনমেলা ২০ নভেম্বর
বাংলাদেশ-আফগানিস্তান সিরিজের স্পন্সর ওয়ালটন
সাভারে অভিযানের পর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ভেজাল শিশু খাদ্য তৈরী কারখানা
সম্মান বজায় রেখে কাজ করুক সেনাবাহিনী প্রত্যাশা সাধারন মানুষের
যশোরবাসীর দুর্ভোগ আর প্রতারণার নাম পদ্মাসেতু রেলপ্রকল্প!
আপনার প্রেমিকা খুব দামি গিফট চান! তাঁকে কী ভাবে সামলে নেবেন?
টেকনাফে ৫০হাজার ইয়াবাসহ মিয়ানমারের নাগরিক আটক।
ফ্যাসিবাদের বিচার এবং পাচারকৃত টাকা ফিরিয়ে আনতে হবে
কোনো পরাশক্তি নয়, জনগণের ঐক্যই বাংলাদেশের মূল শক্তি
হৃদয়ে তাঁর নাম লেখা হয়ে আছে
শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু রাখার পদক্ষেপ নিতে হবে
প্রত্যেক বন্দীর জন্য মিলিয়ন ডলার দিতে প্রস্তুত নেতানিয়াহু
অন্তর্বাস পরে হাঁটা সেই ইরানি তরুণী মানসিকভাবে অসুস্থ
মৃত প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে লড়েছিলেন প্রেসিডেন্ট