ঢাকা   বুধবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৪ | ২২ কার্তিক ১৪৩১

কোনো পরাশক্তি নয়, জনগণের ঐক্যই বাংলাদেশের মূল শক্তি

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

০৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৫ এএম

লগি-বৈঠার হিংস্রতার মধ্য দিয়ে সৃষ্ট নৈরাজ্য, সেনাসমর্থিত ওয়ান-ইলেভেন বিশেষ সরকার, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানোর পেছনে একটি ইন্দো-মার্কিন ব্লুপ্রিন্ট ছিল। হিলারি ক্লিন্টনের বক্তব্য, প্রণব মূখার্জির লেখা এবং উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া তথ্যে এসব বিষয় বেরিয়ে এসেছে। গত ১৬ বছর ধরে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ফ্যাসিবাদী কায়দায় একটি মাফিয়াতন্ত্র চাপিয়ে চাপিয়ে দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মূলের মাধ্যমে স্বৈরশাসনকে চিরস্থায়ী করার মিশন বাস্তবায়ন করছিল। সেখানে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অন্তহীন যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধারাবাহিক ব্যর্থতার বিশ্বরাজনীতিতে নীতিগত পরিবর্তনের কারনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশে পাতানো একতরফতা নির্বাচন পরিহার করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরনের পক্ষে অবস্থান নিলেও ভারতের কারণে তা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক প্রত্যাশা, মানবাধিকার ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার চেয়ে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকাতে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির আওতায় ভারতকে হাতে রাখা তাদের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে গণ্য হওয়ায় দশম, একাদশ ও দ্বাদশ নির্বাচনের আগে পশ্চিমারা সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করলেও কার্যত কোনো কঠোর সিদ্ধান্ত আরোপ করেনি। প্রতিটি ভূয়া নির্বাচনের পরই পশ্চিমারা এর গ্রহণযোগ্যতা ও বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি নিরপেক্ষ ব্যবস্থার আওতায় পুনরায় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার চাপ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু চীন-রাশিয়ার প্রভাব বলয় থেকে ভারতকে নিজেদের পক্ষে রাখতে বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের অবস্থানের সরাসরি বিরোধিতা থেকে বিরত থাকে। স্বৈরশাসকের গুম, খুন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা সংস্থাগুলো নিন্দা ও লঘু নিষেধাজ্ঞা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে। পরিবর্তনের প্রত্যাশায় তাদের উপর নির্ভর করে বসে থাকলে আরো সাড়ে ৪ বছর গুম, খুন, নিপীড়নের পর ২০২৮ সালে আরেকটি ভুয়া নির্বাচনের আগে এবং পরে বিরোধীদল দমন করে অবৈধ ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার পাকা বন্দোবস্ত নিশ্চিত ছিল। দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের সমর্থন নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে দেশের ছাত্র সমাজ জীবন বাজি রেখে স্বৈরাচারের পতনের মধ্য দিয়ে একটি আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের নেক্সাসকে ভন্ডুল করে দিতে সক্ষম হয়েছে। ১৬ বছরে দেশের পুলিশÑ র‌্যাব, বিজিবিকে আওয়ামী লীগের দলীয় বাহিনীতে পরিনত করে রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের যে কোনো কর্মসূচিকে অস্ত্রের জোরে স্তব্ধ করে দেয়ার ব্যবস্থার কথা মাথায় রেখেই ছাত্র-জনতা নিজেদের জীবন বাজি রেখে বিপ্লবী অভ্যুত্থানের কর্মসূচিকে চূড়ান্ত বিজয়ের পথে এগিয়ে নিয়েছিল।

এক-এগারোর বিশেষ সরকারের সময় যোগ করলে দেশের মানুষ ১৮ বছর ধরে জনসমর্থনহীন, অনিবার্চিত ও বিদেশি শক্তির ক্রিড়নক মাফিয়াতান্ত্রিক গোষ্ঠির দ্বারা উৎপীড়িত হয়েছে। এই গোষ্ঠির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে ১৮ বছর সময় লেগেছে। সেই ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের লগি-বৈঠার তা-বের পরই যদি দেশের ছাত্র-জনতা পৈশাচিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত নিতে পারত, কিংবা ২০১১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের সাথে সাথেই যদি এর প্রতিবাদে রাজপথে ঝড় তোলা হতো, তাহলে দেড় যুগ ধরে দেশের মানুষকে এত নিপীড়ন-উৎপীড়ন, বৈষম্য, গুম-খুন এবং দেশের সম্পদের এমন বল্গাহীন পাচার হয়ে দেশটা অর্থনৈতিকভাবে ভেঙ্গে পড়ত না। আর সব সম্ভাবনার কথা বাদ দিলেও, ২ কোটি প্রবাসির কর্মীর পাঠানো রেমিটেন্সের সর্ঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে হাজার হাজার কোটি ডলারের বিদেশি ঋণের বোঝা নিয়ে দেশের অর্থনীতি এমন টালমাটাল অবস্থায় পতিত হতো না। অবস্থার পরিবর্তনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলতে না পারার কারণেই জনগণকে দেড়যুগের প্রলম্বিত দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। ফ্যাসিস্ট-স্বৈরাচারি এবং তাদের বিদেশি পৃষ্ঠপোষকরা ভালো করেই জানে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের দৃষ্টিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে তাদেরকে বহুধা বিভক্ত ও বৈরীতায় ঠেলে দিতে পারলে অবৈধ-অগনতান্ত্রিক ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা সম্ভব। দমন-পীড়ন, গুম-খুন, বিচারের নামে বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের হত্যা কিংবা নিস্ক্রিয় করে দিতে পারলে এক সময় তারা দুর্বল ও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে রাজনীতির মাঠ থেকে হারিয়ে যাবে। দুর্বল ও বশংবদ নেতৃত্ব সৃষ্টির মাধ্যমে গৃহপালিত বিরোধীদল সৃষ্টির অপপ্রয়াসও দেখা গেছে। তবে প্রধান বিরোধীদল বিএনপি কিংবা জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিতে যে পৈশাচিক পন্থা গ্রহণ স্বৈরাচারের জন্য বুমেরাং হয়েছে। কোনো একতরফা নির্বাচনের প্রতি শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষের সমর্থন ছিল না। পরপর চারটি ভুয়া নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষকে একটি কঠিন সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। তা হচ্ছে, ১৬ বছর ধরে দেশে যে সামাজিক-রাজনৈতিক বিভাজন সৃষ্টি করে এন্টাগনিজম ও নির্মূলের রাজনীতি চলছিল, ‘র’-এর মগজধোলাই ন্যারেটিভ সৃষ্টির জন্য একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক কর্মী, সাংবাদিক, গণমাধ্যম ও সরকারি বাহিনী ও দলের অস্ত্রধারি সন্ত্রাসিরাই ছিল এই সমন্বিত তৎপরতার মূল শক্তি। এদের বিরুদ্ধে একটি চূড়ান্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে দেশকে লুটেরা-স্বৈরাচার মুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিতে এতটা সময় লাগার কারণে উত্তরণ অনেকটা দূরূহ হয়ে পড়েছে। দেড়যুগে দেশের সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে একটি পরিবারতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদের আদলে গড়ে তুলতে গিয়ে দল, সরকার এবং রাষ্ট্রকে একাকার করে ফেলা হয়েছে। একটি সক্রিয় জনবান্ধব পুলিশ বাহিনী ছাড়া একটি আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা কল্পনা করা যায় না। শেখ হাসিনা সেই পুলিশ বাহিনীকে নিজের পারিবারিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে গিয়ে নিজ দলের দলান্ধ ক্যাডারদেরই শুধু নিয়োগ দেয়নি। টুঙ্গিপাড়া, গোপালগঞ্জ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ইসলামবিদ্বেষি বিশেষ গোষ্ঠির সমর্থিত ব্যক্তিরাই এই বাহিনী নিয়ন্ত্রণে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে ফেঁসে যাওয়ার আগে কক্সবাজারের ওসি প্রদীপ মিথ্যা অভিযোগে শত শত মানুষকে ক্রসফায়ারে ও নির্যাতন করে হত্যা ও অসংখ্য নারীকে ধর্ষণ করার অভিযোগ উঠেছে। এসব কর্মকা-ের জন্য পুলিশ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী তাকে পুরষ্কৃত করেছেন। মেরিন ড্রাইভকে দীর্ঘদিন ধরে মাদক, অপহরণ ও ক্রসফায়ারের ক্রাইম জোনে পরিনত করার তথ্য কি ডিজিএফআই বা অন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানতো না। এমনটা কেউ বিশ্বাস করেনা। শেখ হাসিনার সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী পরিবারের সন্তান সোহেল তাজ বলেছেন, আওয়ামী লীগ দলটা চালাতো ডিজিএফআই। আর প্রধানমন্ত্রী তার অনুগতদের বলতেন, দুহাতে টাকা বানাতে বলতেন। তার সে পরামর্শ সবাই পালন করেছে। শেখ হাসিনা নিজে গণমাধ্যমে বলেছেন, তার বাসার পিয়নও চারশ কোটি টাকার মালিক।

মেগা প্রকল্পের নামে পরিবার ও দলের নেতাকর্মীদের মেগাদুর্নীতি ও ব্যাংক লুটের সাথে সাথে ভারতীয় অবৈধ শ্রমিক, ব্যবসায়ী, গোয়েন্দা অপারেটিভ এবং বিদ্যুৎ সেক্টরে আদানি গ্রুপের মত কর্পোরেট লুটেরাদের সুযোগ দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা সুপরিকল্পিতভাবে নস্যাৎ করা হয়েছে। দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের সাথে সাথে গণতন্ত্র, সামাজিক-রাজনৈতিক সম্প্রীতি ও জনগণের মধ্যকার সংহতি বিনষ্ট করতে যা কিছু করতে হয়, তাই করেছেন শেখ হাসিনা। জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভের পর প্রথম ভাষন দিতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশের বাস্তবতা তুলে ধরেছিলেন। তিনি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তাদের বিচার না করে ক্ষমা প্রদর্শনের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে শান্তি, সহাবস্থান ও আপস মিমাংসার কথা বলে তিনি ভারত ও পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কোন্নয়েন তাগিদ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য প্রমান থাকা সত্বেও আমরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৯৪ জন যুদ্ধাপরাধীকে ক্ষমা করে দিয়েছি। সেই সাথে দেশেও কলাবরেটর আইনে অপরাধিদের বিচার না করে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে দেশে শান্তি ও সহাবস্থানের পরিবেশ ফিরিয়ে আনার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণের কথা বলেছিলেন। তার পরবর্তী পদক্ষেপ যা’ই হোক, তিনি জাতিকে বিভক্ত করে প্রতিহিংসার রাজনীতি জিইয়ে রাখতে চাননি। তবে গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি দিয়ে অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে শেখ মুজিবের একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠা এবং বিরোধীদল জাসদের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে রক্ষি বাহিনী দিয়ে হত্যার নির্দেশনা শেখ মুজিবই দিয়েছিলেন। তবে স্বাধীনতার চারদশক পেরিয়ে এসে শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের নামে জাতিকে বিভক্ত করে দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির পেছনে মহৎ কোনো জাতীয় লক্ষ্য বা স্বার্থ ছিল না। দেশের সম্পদ লুট করা এবং একদলীয় শাসনের সাথে সাথে ভারতের আধিপত্য চিরস্থায়ী করার জন্য সব রাজনৈতিক শক্তি এবং জাতিকে বিভক্ত ও দুর্বল করাই ছিল মূল লক্ষ্য। সাম্প্রদায়িক জায়নবাদী এবং হিন্দুত্ববাদীরা বিশ্বের দেশে দেশে এই মানুষের মধ্যে জাতিগত বিভক্তি নিপীড়নের ফর্মূলা চাপিয়ে দিয়ে বিশ্বকে আরো অশান্ত ও অনিরাপদ করে তুলতে চাইছে। ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা সে দেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদের সাথে বৈষম্য নীতি আরোপ করে পুরো উপমহাদেশের আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও আভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বিনষ্টের চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে। ভারতের বশংবদ হাসিনা সরকার বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সাম্প্রদায়িক বৈষম্যের শিকারে পরিনত করেছিল। সেই বৈষম্য থেকেই দেশে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন সূচিত হয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনাকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে।

বিশ্বের এক নম্বর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতি সারাবিশ্বে যথেষ্ট প্রভাব সৃষ্টি করে থাকে। তবে জায়নবাদী ও বর্ণবাদী এজেন্ডায় মার্কিন জনগণ এবং বিশ্বসম্প্রদায়ের স্বার্থের প্রতিকূল অবস্থানের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ক্রমে গৌণ হয়ে পড়েছে। বিশেষত মুসলমান দেশগুলোকে বশংবদ করে রাখতে পশ্চিমা দেশগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পদাঙ্ক অনুসরণ করে থাকে। ¯œায়ুযুদ্ধ ও ওয়ার অন টেররিজম পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় ইউক্রেন যুদ্ধ এবং গাজায় যুদ্ধের নামে ইসরাইলের বর্বর গণহত্যা চলছে। ইউক্রেনে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করে সেখানে পশ্চিমা পুতুল সরকার বসিয়ে রাশিয়া বিরোধী সামরিক-রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের কারণে প্রথমে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল এবং আজকের ইউক্রেন আগ্রাসনের পথ তৈরী করা হয়েছিল। অন্যদিকে ফিলিস্তিনের উপর সাড়ে ৭ দশকের ইসরাইলি দখলদারিত্ব এবং গাজার উপর দুই দশকের অবরোধ কায়েম করা হলেও তা চরম যুদ্ধাবস্থার দিকে ঠেলে দেয়ার পেছনে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য নীতির দায় সবচেয়ে বেশি। তিনি জায়নবাদিদের প্রভাবে প্রথমে ইরানের সাথে ৬ বিশ্বশক্তির পারমানবিক সমঝোতা চুক্তি বাতিল করে ইসরাইল বিরোধী সংঘাত উস্কে দিয়েছিলেন। অত:পর আরব-ইসরাইল সংকট প্রশ্নে মার্কিন মধ্যস্থতা ও দ্বিরাষ্ট্রকেন্দ্রিক সমাধানের প্রতিশ্রুতি অগ্রাহ্য করে জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া, সেখানে মার্কিন দূতাবাস স্থাপনের পাশাপাশি তথাকথিত আব্রাহাম অ্যাকর্ডের মাধ্যমে আরব দেশগুলোকে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবি থেকে সরিয়ে নিয়ে এ সমস্যা সমাধানের কবর রচনা করতে চেয়েছিলেন। হামাস-হিজবুল্লাহর প্রতিরোধ যুদ্ধে ইরানের প্রত্যক্ষ সমর্থনের মধ্য দিয়ে সে হিসাব-নিকাশ অনেকটা পাল্টে গেলেও জায়নবাদি এজেন্ডা থেমে থাকছে না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। এখনকার যুদ্ধ ও গণহত্যা ডোনাল্ড ট্রাম্পের অপরিনামদর্শি সিদ্ধান্তের কুফল। ট্রাম্প আবার ক্ষমতায় আসলে কি ঘটতে পারে সে বিষয়ে আন্দাজ করা খুব কঠিন নয়। সে একজন বর্ণবাদী ইসলামোফোবিক। ভারতীয় হিন্দুত্ববাদ এবং জায়নবাদের দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত ট্রাম্প সম্প্রতি বাংলাদেশ নিয়ে ভ্রান্ত ও বিপজ্জনক মন্তব্য প্রকাশ করেছেন। বোঝাই যাচ্ছে, তিনি ভারতীয় গুজব মিডিয়ার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এমন মন্তব্য করে থাকতে পারেন। ওদিকে দিল্লীতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার দোসররা মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়কে হাসিনা-মোদির বিজয় হিসেবে ধরে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মোদির সহায়তায় হাসিনা বাংলাদেশে ঢুকে ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। এসব উজবুকরা যা ইচ্ছা খায়েশ করে করুক। আমরা শুধু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, শুধু দিল্লীর সাউথ ব্লকের সমর্থন নিয়ে জনবিচ্ছিন্ন ও গণধিকৃত হাসিনা দেড় দশক ধরে বাংলাদেশ দু:শাসন চালিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহায়তা ছাড়াই দিল্লীর সেবাদাস সরকারকে ১৬ বছরে গড়ে তোলা সব বাহিনী ও মাফিয়াতান্ত্রিক সা¤্রাজ্যসহ দিল্লীতে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে।

দেশের ৯৫ ভাগ মানুষের সমর্থনপুষ্ট বিপ্লবের মধ্য দিয়ে গঠিত অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম¥দ ইউনূসের দিকে সারাবিশ্বের চোখ। দেশের পুলিশ বাহিনীকে জনবান্ধব বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। সেনাবাহিনী অর্ন্তবর্তী সরকারের সাথে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছে। দেশের জনগণ পতিত স্বৈরাচারের দোসর, দেশি ও আঞ্চলিক শত্রুদের ষড়যন্ত্র ও অপতৎপরতা সম্পর্কে সচেতন রয়েছে। এ সময়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সহায়ক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার ক্ষমতাকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতা ও অনাবশ্যক বিভক্তি ষড়যন্ত্রকারিদের পক্ষে বেশ সহায়ক হতে পারে। রাষ্ট্র মেরামত ছাড়া নির্বাচন জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে না। মৌলিক জাতীয় প্রশ্নে রাজনৈতিক দল এবং জনগণের মধ্যে বিভাজন ও অনাস্থার পরিবেশ হাজারো ছাত্র-জনতার জীবনের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতাবে ব্যর্থ করে দিয়ে আবারো দিল্লীর দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করতে পারে। তবে দেশের মুক্তিকামী জনগণ এ ধরণের পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দায়ী যেকোনো রাজনৈতিক শক্তিকে আওয়ামী লীগের মতই ইতিহাসের আস্তাঁকুড়ে নিক্ষেপ করবে। দিল্লিতে কিংবা ওয়াশিংটনে যে দলই ক্ষমতায় আসুক। বাংলাদেশের জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে বিদেশি দালালদের প্রতিহত করতে পারলে কেউ এখানে দাঁত বসাতে পারবে না। গত ১৬ বছর ধরে ওরা শুধু জাতিকে বিভক্ত করেই স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করেছে। যে কোনো মূল্যে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি অটুট রাখাই এ সময়ে বিপ্লবী জনতার প্রধান কর্তব্য।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে আর্জেন্টিনা দলে ফিরলেন মার্টিনেজ

নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে আর্জেন্টিনা দলে ফিরলেন মার্টিনেজ

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী গ‍্যালান্টকে বরখাস্ত করলেন নেতানিয়াহু

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী গ‍্যালান্টকে বরখাস্ত করলেন নেতানিয়াহু

শমী কায়সার গ্রেপ্তার

শমী কায়সার গ্রেপ্তার

শের এ বাংলা মেডিকেল কলেজের ৫৬তম প্রতিষ্ঠঅ বাষির্কী উপলক্ষে মিলনমেলা ২০ নভেম্বর

শের এ বাংলা মেডিকেল কলেজের ৫৬তম প্রতিষ্ঠঅ বাষির্কী উপলক্ষে মিলনমেলা ২০ নভেম্বর

বাংলাদেশ-আফগানিস্তান সিরিজের স্পন্সর ওয়ালটন

বাংলাদেশ-আফগানিস্তান সিরিজের স্পন্সর ওয়ালটন

সাভারে অভিযানের পর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ভেজাল শিশু খাদ্য তৈরী কারখানা

সাভারে অভিযানের পর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ভেজাল শিশু খাদ্য তৈরী কারখানা

সম্মান বজায় রেখে কাজ করুক সেনাবাহিনী প্রত্যাশা সাধারন মানুষের

সম্মান বজায় রেখে কাজ করুক সেনাবাহিনী প্রত্যাশা সাধারন মানুষের

যশোরবাসীর দুর্ভোগ আর প্রতারণার নাম পদ্মাসেতু রেলপ্রকল্প!

যশোরবাসীর দুর্ভোগ আর প্রতারণার নাম পদ্মাসেতু রেলপ্রকল্প!

আপনার প্রেমিকা খুব দামি গিফট চান! তাঁকে কী ভাবে সামলে নেবেন?

আপনার প্রেমিকা খুব দামি গিফট চান! তাঁকে কী ভাবে সামলে নেবেন?

টেকনাফে ৫০হাজার ইয়াবাসহ মিয়ানমারের নাগরিক আটক।

টেকনাফে ৫০হাজার ইয়াবাসহ মিয়ানমারের নাগরিক আটক।

ফ্যাসিবাদের বিচার এবং পাচারকৃত টাকা ফিরিয়ে আনতে হবে

ফ্যাসিবাদের বিচার এবং পাচারকৃত টাকা ফিরিয়ে আনতে হবে

হৃদয়ে তাঁর নাম লেখা হয়ে আছে

হৃদয়ে তাঁর নাম লেখা হয়ে আছে

শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু রাখার পদক্ষেপ নিতে হবে

শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু রাখার পদক্ষেপ নিতে হবে

প্রত্যেক বন্দীর জন্য মিলিয়ন ডলার দিতে প্রস্তুত নেতানিয়াহু

প্রত্যেক বন্দীর জন্য মিলিয়ন ডলার দিতে প্রস্তুত নেতানিয়াহু

অন্তর্বাস পরে হাঁটা সেই ইরানি তরুণী মানসিকভাবে অসুস্থ

অন্তর্বাস পরে হাঁটা সেই ইরানি তরুণী মানসিকভাবে অসুস্থ

মৃত প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে লড়েছিলেন প্রেসিডেন্ট

মৃত প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে লড়েছিলেন প্রেসিডেন্ট

মণিপুরে এবার নাগাদের সাথে সংঘাত মৈতৈদের

মণিপুরে এবার নাগাদের সাথে সংঘাত মৈতৈদের

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এবার বাংলা ব্যালট পেপার সংযুক্ত

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এবার বাংলা ব্যালট পেপার সংযুক্ত

আগাম ভোট দিয়েছেন ৮ কোটির বেশি মানুষ

আগাম ভোট দিয়েছেন ৮ কোটির বেশি মানুষ

মার্কিন নির্বাচনের আগে উত্তর কোরিয়ার প্রচুর মিসাইল পরীক্ষা

মার্কিন নির্বাচনের আগে উত্তর কোরিয়ার প্রচুর মিসাইল পরীক্ষা