রেইনবো নেশন : থটস অফ ডাইন্যামিক লিডার তারেক রহমান
০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম
(পূর্বপ্রকাশিতের পর)
‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’র আদর্শ আমাদের সমস্ত রাজনীতির উপর ভিত্তি করে, যেখানে আমরা বিশ্বাস করি যে আমাদের ধর্ম, রাজনৈতিক অনুষঙ্গ এবং মতাদর্শ ব্যক্তিগত; কিন্তু রাষ্ট্র সবার। জাতীয়তাবাদ নিয়ে আর্নেস্ট গেলনারের ‘নেশনস এন্ড ন্যাশনালিজম’, জন ব্রুনির ‘ন্যাশনালিজম এন্ড দ্য স্টেট’ প্রভৃতি গ্রন্থের সূত্রে বলা যায়, ভৌগোলিক নৈকট্য, ভাষাগত ও ধর্মীয় ঐক্য, ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের অভিন্নতা এবং জাতিকুলগত ঐক্যকে জাতীয়তাবাদের ভিত্তি ও লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। একই ভূখ-ের বাসিন্দাদের পারস্পরিক গভীর একাত্মবোধ বা কোনো এক মনুষ্যগোষ্ঠীর মধ্যে ইনক্লুসিভ বোধ তৈরি করে জাতীয়তাবাদী চেতনা। আসলে একই আর্থসামাজিক স্বার্থ, ঐক্যবোধ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে একাত্মবোধ গড়ে ওঠে, সেটাই প্রকৃত জাতীয়তা।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছিল মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানবিরোধিতা ও শেখ মুজিবের বিশালতার মহাবয়ান (গ্র্যান্ড ন্যারেটিভ)। বাঙালি শব্দটির ইতিহাস হাজার বছরের, আবহমানকালের ঐতিহ্য তার। কিন্তু ৫ আগস্টের(২০২৪) পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘সিভিক ন্যাশনালিজম’ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। বাংলায় একে ‘নাগরিক জাতীয়তাবাদ’ বলা যায়। একই সংস্কৃতি, ভাষা বা ধর্মের ওপর ভিত্তি করে যে জাতীয়তাবাদ তা ‘এথনোসেন্ট্রিজম’ বা ‘জাতিকেন্দ্রিকতা’ দুষ্ট। অধ্যাপক ডোনাল্ড ইপারসিয়েলের মতে, এথনিক জাতীয়তাবাদ কর্তৃত্ববাদী, এমনকি স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা তৈরির অনুকূল অবস্থা তৈরি করে। (দ্রষ্টব্য: https://en.wikipedia.org/wiki/Civic_nationalism). এর বিপরীতে রাষ্ট্রের সীমানা নির্ভর নাগরিকত্বভিত্তিক যে জাতীয়তাবাদ, তাতে কাঠামোগতভাবেই বহুত্ববাদকে অনুপ্রাণিত করে। কারণ, সিভিক ন্যাশনালিজম বা নাগরিক জাতীয়তাবাদে এ একই ভাষা বা সংস্কৃতি নয়, বরং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, উদার নীতি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাস আনাই জাতীয়তার শর্ত। আর্নেস্ট রেনান (১৮৮২), হ্যান্স কোন (১৯৪৪) ও ক্লিফোর্ড গির্টজ (১৯৬৩)-এর গবেষণায়ও পশ্চিমের কার্যকর গণতন্ত্রের বিকাশের পেছনে নাগরিক জাতীয়তাবাদের গুরুত্ব বিবেচনা করা হয়। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের ‘নাগরিক জাতীয়তাবাদে’র আদলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সাফল্য ইতিহাসে স্বীকৃত। রাষ্ট্রীয় আইনগত, নীতিগত ও প্রতিষ্ঠানভিত্তিক জাতীয়তাবাদে যে কেউ সহজেই একীভূত (ইন্টিগ্রেট) হতে পারে।
বাংলাদেশের মূলনীতি সাম্য, ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র, বহুত্ববাদ, ধর্মীয় অসাম্প্রদায়িকতা ও সহনশীলতার ওপর নির্মিত। এজন্য বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। অন্যদিকে বাঙালির সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্ত্বিক মিল থাকলেও ভিন্নতা আছে ভূগোলভেদে। বর্তমানে বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী ভারত রাষ্ট্রের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও আসামের বাংলাদেশ সংলগ্ন জেলাগুলোতে এবং মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে বাস করছে। সাংস্কৃতিক ও জাতিতাত্ত্বিক পরিচয় অভিন্ন হলেও আঞ্চলিক পার্থক্য লক্ষণীয়। ভাষা, খাদ্য, বাসস্থানের ঐক্য থাকলেও সকল বৈশিষ্ট্য একইরকম নয়। বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে সংলগ্ন দেশ বিহার, উড়িষ্যা, আসাম, নেপাল, ভুটান, তিব্বত ও মিয়ানমারের জাতিগুলোর সাংস্কৃতিক সাযুজ্য রয়েছে। বাঙালি পরিচয় সূত্রে বলা যায়, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ সব দিক থেকেই গ্রহণীয় সুসম্পন্ন মতবাদ।
প্রকৃতপক্ষে সিভিক ন্যাশনালিজমের ধারণা বিএনপি’র কাছে নতুন নয়। কারণ, দলটির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যে জাতীয়তাবাদের ধারণা প্রস্তাব করেছিলেন, তা আসলে তাত্ত্বিকভাবে ‘নাগরিক জাতীয়তাবাদে’র সবচেয়ে কাছাকাছি। তবে জাতীয়তাবাদের এই ধারাও যেন কর্তৃত্ববাদে পরিণত না হয়, সে লক্ষ্যে তারেক রহমান কাজ করে চলেছেন। বিভিন্ন দেশের বাস্তবতায় জাতীয়তার ধারণা ভিন্নতর। এজন্য ভাষার ভিত্তিতে নয়, ভৌগোলিক দিক থেকে জাতীয়তা অন্বেষণ করতে হবে। একটি মন্তব্য স্মরণীয়: ‘জাতীয়তাবাদী আদর্শের ভিত্তি গড়ে ওঠে একটি সমসত্তাবিশিষ্ট জনগোষ্ঠীর বিকাশের ইতিহাসের উপর, যে-জনগোষ্ঠীর ভাষা, বাসভূমি, আর্থনীতিক জীবন, মানসিক গড়ন ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অভিন্ন। এরকম একটি জনগোষ্ঠীর প্রাতিস্বিকতা, যা তাদের ক্রমবিকাশের ইতিহাসে প্রতিবিম্বিত হয়, তা জাতীয়তাবাদী চেতনার গভীরে প্রোথিত থাকে।’ (বাঙালি, সংকলন, ১৯৯২, পৃ ৬৮)।
ধর্মীয় বিশ^াসে মানুষ হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ ইত্যাদি। কিন্তু তাদের সকলকে নিয়ে নেশন বিল্ডআপ হয়েছে। যেখানে সম্প্রীতির সূত্রে রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে আছে। শ্রেণিবৈষম্যহীন নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের উপাদান সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদকে কেন্দ্র করে। নানা বৈচিত্র্যের নৃগোষ্ঠীর মানুষের অবস্থান আছে এদেশে। তাদের ভাষা-সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা আলাদা হলেও তাদের পরিচয় বাংলাদেশী। নৃগোষ্ঠী নিয়ে নানান ডিসকোর্স রয়েছে দেশেÑ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী প্রভৃতির বাইরে তাদের বলতে হয় বাংলাদেশী। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জাতীয়তা বাংলাদেশী। এদের জাতীয়তা ভাষা বা ধর্ম দিয়ে নয়। বরং মীমাংসিত বিষয় নিয়ে বিতর্ক তৈরি করেছেন আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা। দেশের সংস্কৃতিকে বিনষ্ট ও ধ্বংস করতে চেয়েছে ভারতীয় আধিপত্যবাদী ডিসকোর্সের বয়ানে।
বাঙালি সংস্কৃতি বলতে যেমন চিন্তা ও অনুভূতির সকল দিক বুঝায়, তেমনি তা কর্মনীতি, কর্মপদ্ধতি এবং চরিত্রের সকল দিককেও পরিব্যাপ্ত করে। এ ভূখ-ের মানুষের বিশ্বাস, আচার-আচরণ ও জীবনধারা নিয়ে যে সাংস্কৃতিক পরিচয় তাকেই সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার বলেছেনÑ Culture is what we are or have. আমরা অথবা আমাদের যা কিছু আছে তাই আমাদের সংস্কৃতি। নৃবিজ্ঞানী টেইলরের মতে, সমাজের সদস্য হিসেবে অর্জিত নানা আচরণ, যোগ্যতা এবং জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্পকলা, নীতি, আদর্শ, আইন, প্রথা ইত্যাদির এক যৌগিক সমন্বয় হল সংস্কৃতি। (টেনলর, ১৯৭৪)। সংস্কৃতির আওতায় রয়েছে ধর্ম, খাদ্য, পোশাক, পোশাক পরার ধরন, ভাষা, বিয়ে, সংগীত, আমরা যা কিছু ন্যায়-অন্যায় বলে ভাবি এবং দৈনন্দিন জীবন যাত্রার আরো অন্তত কয়েক লাখ বিষয়।
অনেকদিন ধরে সংস্কৃতির বয়ানের মধ্যে বিভাজনের ভেদরেখার চেষ্টা চলেছে। আচরণে ও বয়ানে কর্মকা-ে আবরণে আওয়ামী লীগের জমি দখল ও ভোট ব্যাংক সৃষ্টি করে। উল্টো ন্যারেটিভস যে বিএনপি এলে সংখ্যালঘু অত্যাচার থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি নিরাপত্তা দিয়েছে বেশি। সংখ্যালঘু নির্যাতন করেছে আওয়ামী লীগ। একটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। তারা সমাজে অনেক বৈষম্যমূলক শিল্প সংস্কৃতির চর্চার নামে জাতিসত্তাকে নেগেটিভ বা উল্টোপথে নিয়ে যেতে চেয়েছে। বিখ্যাত ব্যক্তিদের দ্বারা ‘কালচারাল টাউট’ শ্রেণির জন্ম হয়েছে। মুসলিম সংস্কৃতি নষ্ট করেছে তারাই।
‘বাংলাদেশের ধর্ম’ প্রবন্ধে আলী আনোয়ার লিখেছেন, ইসলাম শুধু ধর্মীয় তত্ত্ব হিসেবে এদেশে আবির্ভূত হয়নি। এটি এসেছে মুসলমানদের রাজনৈতিক বিজয় ও সামাজিক আধিপত্যের হাত ধরে এবং নিয়ে এসেছে নতুন ধরনের সমাজ সংগঠন। বদরুদ্দীন উমর ‘মুসলমানদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ প্রবন্ধে ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম মুসলমানরা বাঙালি হলো এবং মাতৃভাষা বাংলাকে মর্যাদা দিতে শিখল বলেছেন। তাঁর মতে, ১৯৪৭ সাল থেকে ভাষা ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামÑ তাই অনেকাংশে তাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনেরই সংগ্রাম। (রচনাসংগ্রহ-১, পৃ ১১৭)। একসময় বাংলাদেশে মুসলিম জাতীয়তাবাদ ছিল মুসলিম ঐতিহ্য ও শাসনের অনুভূতি ও চেতনা। এটি ছিল একত্বের আবেগ যা মুসলমানদের একটি সাধারণ একেশ্বরবাদী বিশ্বাস এবং সংস্কৃতি, মূল্যবোধ, রীতিনীতি, অভিজ্ঞতা, ঐতিহ্য, ব্যক্তিগত আইন, জীবন পদ্ধতি এবং আচার-অনুষ্ঠানের একটি সংযোগ।
১৯৭৫ সালের আগস্টে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর এবং একই সালের নভেম্বরে ক্ষমতায় আসার পরপরই মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান বাহ্যিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’কে ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ দিয়ে প্রতিস্থাপন করেন, যা ইসলামভিত্তিক রাষ্ট্রীয় আদর্শকে গ্রহণ করে। জিয়াউর রহমান সরকার (১৯৭৫-৮১) ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সাথে সক্রিয় সহযোগিতার জন্য মুজিব সরকার কর্তৃক সমস্ত ইসলামভিত্তিক রাজনৈতিক দলের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে। যেহেতু বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ (ইন্দোনেশিয়া এবং পাকিস্তানের পরে), এটা অনুমান করা স্বাভাবিক যে ইসলাম দেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ মুসলিমÑ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, বিশ্বের জনসংখ্যার সবচেয়ে দরিদ্র, স্বল্প শিক্ষিত এবং সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অংশগুলির প্রতিনিধিত্ব করে এবং জিয়াউর রহমান বেশ ভালভাবে উপলব্ধি করেছিলেন যে, দেশটি সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য সবচেয়ে কম প্রস্তুত ছিল। জিয়াউর রহমান মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে রাজনীতিতে ইসলামী চরিত্রের প্রচারের একটি পদ্ধতিগত নীতি শুরু করেছিলেন। তার আদর্শ, কর্মসূচি এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে তার শাসনামলকে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে দ্রুত সাফল্য লাভ ছিল রাজনীতিতে ইসলাম এবং বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের অন্তর্ভুক্তি।
বিএনপি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, ধর্ম ব্যক্তির, কিন্তু রাষ্ট্র সবার জন্য এবং আমাদের অন্তর্ভুক্ত সকল সম্প্রদায় সবাই সমান অধিকারের অধিকারী। এ দল ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করার নীতি মেনে চলে। তবে বাস্তবতা হলো বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের সংবিধান ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার অধিকার দিয়েছে, তাই এই তিনটি দেশেই ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল রয়েছে।
৫.
জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভালো ও সৎ রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। কাজের মধ্য দিয়ে তা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। যে কোনো বিষয়কে ম্যাটারালাইজ করার জন্য থটস লাগে, যার উপর ভিত্তি করে কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ হয়। সেই কাজটি জিয়াউর রহমান ও তারেক রহমানের ক্ষেত্রে দেখা যায়। বেগম খালেদা জিয়া শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কর্মপদ্ধতি ও যুগগত চাহিদা বিবেচনায় রেখে অসাধারণ দক্ষতায় দেশ পরিচালনা করেছেন এবং জনগণের কাছে গভীর শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের এপ্রিলে সংবিধান সংশোধন করে ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে লিখলেন: ‘বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাংলাদেশি বলিয়া পরিচিত হইবেন।’ এই ভূখ-ের জনগোষ্ঠীকে বাঙালি নয় ‘বাংলাদেশি’ পরিচয় দিয়ে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষ মানুষের নাগরিকত্ব যেমন স্পষ্ট করে দিলেন তেমনি ‘জাতীয়তাবাদ’ নিয়ে নিজের বক্তব্যের আলোকে বিএনপি’র দর্শন তৈরি হলো। তিনি তার প্রস্তাবিত বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে ‘সার্বিক জাতীয়তাবাদ’ হিসেবে দাবি করেছেন এবং ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ এ দেশের মানুষের জাতিসত্তার খ-িত পরিচয়ই তুলে ধরে বলে মন্তব্য করেছেন। জাতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদ, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ কিংবা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ নয় তিনি ভূখ-কেন্দ্রিক ন্যাশনালিজমে বিশ^াসী ছিলেন। লিখেছেন: ‘একটি অঞ্চলকে ভিত্তি করে রাজনীতি চলতে পারে, গড়ে উঠতে পারে এক নতুন জাতীয়তাবাদ।...তাই আমরা বলি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ হলো সার্বিক জাতীয়তাবাদ।’ (মহিউদ্দিন আহমদ, বিএনপি সময়-অসময়, পৃ ১৩০)।
জিয়াউর রহমান দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর কথা মাথায় রেখে সংবিধানে যুক্ত করেছিলেন, ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ^াস’। মূল সংবিধানের ২৫ অনুচ্ছেদে নতুন একটা উপধারা যোগ করা হয়। তা হলো, ‘রাষ্ট্র ইসলামী সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব সম্পর্ক সংহত, সংরক্ষণ এবং জোরদার করিতে সচেষ্ট হইবে।’ ফলে তার জাতীয়তাবাদ ধারণায় ধর্ম চেতনার সম্পৃক্ততা অনিবার্য ছিল। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ একদিকে যেমন ধর্মভিত্তিক নয়, তেমনি আবার ধর্মবিমুখ নয়। এ জাতীয়তাবাদ প্রত্যেকের ধর্মীয় বিশ^াসী ও ধর্মীয় অধিকারকে নিশ্চিত করে।’ তার কাছে জাতীয়তা কেবল একটা ধারণাগত বিষয় নয়, এটা এমন একটা প্রণোদনা, যা মানুষকে সমৃদ্ধিও দিকে নিয়ে যাবে। তার মনে হয়েছিল, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান নাগরিকদের ধর্মীয় আবেগকে ব্যবহার করলে সমাজে বিএনপি’র গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। অন্যদিকে ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ সার্বিক জাতীয়তাবাদ বলেই আহমদ শরীফ মন্তব্য করেছেন, ‘বাংলাদেশি’ জাতীয়তাবাদ জনগ্রাহ্য হওয়ার দাবি রাখে কারণ এ রাষ্ট্রিক জাতীয়তায়Ñপ্রান্তিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরাও গোত্র-ভাষা-সংস্কৃতিনির্বশেষে সমমর্যাদায় ও সমঅধিকারে স্বীকৃতি পায়Ñজিম্মি থাকে না।’ (বাংলাদেশের জোট রাজনীতি ১৯৫৪-২০১৪, পৃ ১২০)
অন্যদিকে তারেক রহমান বলেছেন, ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’, এই মূলনীতির ভিত্তিতে প্রত্যেক ধর্মাবলম্বী নিজ নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ অধিকার ভোগ করবেন। স্বাধীন বাংলাদেশে কাউকে তথাকথিত ‘সংখ্যালঘু’ হিসেবে দেখা হবে না। বিএনপির নীতি হচ্ছে সকল নাগরিকের সমান অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। ৫ আগস্টের পর যখন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ে এবং পুলিশের উপস্থিতি কমে যায়, তখন বিএনপি জনগণের পাশে দাঁড়ায়, দেশকে রক্ষা করে, জননিরাপত্তা নিশ্চিত করে এবং প্রতিহিংসামূলক সহিংসতার আশ্রয় না নিয়ে সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখে। দুর্গাপূজার মৌসুমে ফ্যাসিবাদী সহযোগীদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করতে, সারা বাংলাদেশে বিএনপি নেতাকর্মীরা মন্দির ও উপাসনালয় পাহারা দিয়েছিল, হিন্দু, খ্রিস্টান এবং বৌদ্ধ সহ সকল ধর্মের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিল, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।
৬.
বর্তমানে দেশে আলোচিত প্রায় সব সংস্কার প্রস্তাবই বিএনপি’র ৩১ দফায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বলে জানিয়েছেন তারেক রহমান। তার মতে, সংস্কারের উদ্দেশ্য বলতে সেটিই বুঝতে হবে, যে সংস্কারের মাধ্যমে সংবিধানের কয়েকটি বাক্য নয়, বরং মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হবে। যুগের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এবং বৈশি^ক পরিস্থিতিকে সামনে রেখে তারেক রহমানের ভাবনা সার্বজনীন। এজন্য বিএনপি’র নেতাকর্মী সকলের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। ৩১ দফা যারা পড়েছেন তারা বিশেষত সুশীল ও নাগরিক সমাজের মধ্যে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। এজন্যই ‘রেইনবো নেশন’ কনসেপ্টের এতো গ্রহণযোগ্যতা। (সমাপ্ত)
লেখক: সাবেক চেয়ারম্যান এবং অধ্যাপক, থিয়েটার অ্যান্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
কলকাতায় বাংলাদেশ উপ হাইকমিশনের নিরাপত্তা জোরদার
‘সাইবার মানডে’ উপলক্ষে ওয়েব হোস্টিংয়ে লিমডা হোস্টে চলছে ৬০% পর্যন্ত ছাড়!
ঢাকায় আসছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রী
ফ্যাসিস্ট সরকারের ৮ বছরের নিষেধাজ্ঞার পর অবশেষে মঞ্চে আসছে থিয়েট্রিক্যাল বাহাস ও কন্ঠনালীতে সূর্য
মিলেছে ‘হারিছ চৌধুরী’র ডিএনএ, রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের নির্দেশ
নাম পরিবর্তনের দাবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের
গলায় ফাঁস দিয়ে বৃদ্ধের আত্মহত্যা
আইএসের নৃশংসতার বিচারে জাতিসংঘ ব্যর্থ : নাদিয়া মুরাদ
নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে হেফাজতের মানববন্ধন
মানিকগঞ্জে হাঙ্গার প্রজেক্টের গণতন্ত্র অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত
এবার ভারতের মালদহে বাংলাদেশিদের জন্য হোটেল ভাড়া বন্ধ ঘোষণা
কিশোরগঞ্জের হাওর-অর্থনীতি বেগবান করতে চলছে কয়েকশ কোটি টাকার প্রকল্প
প্লাস্টিক ব্যবহার রোধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে: অতিরিক্ত সচিব ফাহমিদা খানম
দেশের ৬৯ কারাগারের ১৯টি ঝুঁকিপূর্ণ, ৭০ জঙ্গিসহ ৭০০ বন্দি এখনো পলাতক
পায়রার রাজস্ব আয় বাড়বে তিনগুণ, দেশের অর্থনীতিতে রাখবে বড় ভূমিকা
মমতা ব্যানার্জির মনে গভীর কট্টরপন্থি হিন্দুত্ববাদ : রিজভী
কঠিন সময় পার করছে বাংলাদেশ : প্রধান উপদেষ্টা
কুড়িগ্রামে সাবেক এমপি পুত্র সবুজ গ্রেফতার
ভারতে ৫.৩ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প
অমৃতসরে স্বর্ণ মন্দিরে পাঞ্জাবের সাবেক উপমুখ্যমন্ত্রী সুখবীর সিং বাদালের ওপর গুলিবর্ষণ