গ্রেনেড হামলা মামলা : তারেক রহমানসহ সবাই বেকসুর খালাস
০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৪ এএম
একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল মামলার রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চের রায়ে বিচারক আদালতের বিচার প্রক্রিয়াকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন। ফলে দণ্ডিত সকল আসামী বেকসুর খালাস পেয়েছেন। বিচারিক আদালত ৪৯ জনকে দণ্ড প্রদান করেছেন, যার মধ্যে ১৯ জন ছিলেন মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ও ১৯ জন ছিলেন যাবজ্জীবন দণ্ডে দণ্ডিত। অবশিষ্ট ১১ জন ছিলেন বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডিত। মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্তদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর। যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আদালত তার রায়ে বলেছেন, মামলার প্রথম ও দ্বিতীয় চার্জশিট শুধু আসামীদের স্বীকারোক্তিমূলক জবান বন্দির ভিত্তিতে দেয়া হয়েছে। কে গ্রেনেড সরবরাহ করেছে ও ছুড়েছে, সেটা তদন্তে উঠে আসেনি। সাক্ষ্য-প্রমাণ দ্বারা গ্রেনেড হামলার ষড়যন্ত্রের বিষয়টিও প্রমাণিত হয়নি। সাক্ষীর কেউ কারো বক্তব্যকে সমর্থন করেনি। এছাড়া অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন (দ্বিতীয় চার্জশিট) ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের পরিবর্তে বিচারিক আদালত আমলে নিয়েছে, যা আইনবহিভূর্ত। আইনবহির্ভূতভাবে আমলে নেয়া চার্জশিটের ভিত্তিতেই চার্জ গঠনসহ বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে, যা আইন অনুমোদন করে না। এসব কারণে বিচারিক আদালতের সাজার রায় বাতিল করা হলো। এখানে বিশেষভাবে স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভেনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয়। এতে ২৪ জন নিহত ও আহত হয় তিন শতাধিক। ওই সময় আওয়ামী লীগ ছিল বিরোধী দলে এবং সবকারে ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট। পরদিন মতিঝিল থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দুটি মামলা করা হয়। ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময় ২০০৮ সালের ১১ জুন মামলার চার্জশিট দাখিল করা হয়। এতে বিএনপির নেতা আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই এবং হরকাতুল জিহাদের নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনকে আসামী করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সরকার পক্ষের আবেদনক্রমে আদালত অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন, এর দু’ বছর পর ৩০ জনকে আসামী করে আদলতে সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা আবদুল কাহার আখন্দ। এই সম্পূরক চার্জশিটে তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবর, কাজী কায়কোবাদসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে আসামী করা হয়। তাদের আসামী করা হয় মুফতি হান্নানের দ্বিতীয় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ভিত্তিতে। যা হোক, বিচারিক আদালত ২০১৮ সালের ২ অক্টোবর এই মামলার রায় প্রদান করেন, যাতে আসামীদের মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বিভিন্ন মেয়াদি দণ্ড প্রদান করেন।
বিচারিক আদালতের রায় কেন হাইকোর্ট একেবারেই বিবেচনায় নেননি, কেন বিচার প্রক্রিয়াকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন, তা হাইকোর্ট স্পষ্ট করেই বলেছেন। এই মামলাকে আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ও প্রতিপক্ষ দমনে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে। তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবর প্রমুখকে আসামী করাতে ও দণ্ড দেয়াতেই এর প্রমাণ মেলে। প্রথম চার্জশিটে তাদের কারো নাম ছিল না। ওই চার্জশিট বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় দেয়া নয়। সেটা ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময় দেয়া। কারো অজানা নেই, ওই সরকার বিএনপি-জামায়াতের বৈরী এবং আওয়ামী লীগের প্রিয় ছিল। ওই চার্জশিট পছন্দ না হওয়ার তার কোনো কারণ ছিল না। তা সত্ত্বেও অধিকতর তদন্ত ও সম্পূরক চার্জশিটের আয়োজন তাকে কেন করতে হলো, সেটা সহজেই বুঝা যায়। মুফতি হান্নানের দ্বিতীয় জবানবন্দিকে, যা আদালতে তিনি প্রত্যাহার করেন, বিচারিক আদালত গ্রহণ করেছে ও তার ভিত্তিতে রায় প্রদান করেছেন। আসামী পক্ষের অন্যতম আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির জানিয়েছেন, ভারতীয় উপমহাদেশের চারশো বছরের ইতিহাসে দ্বিতীয় স্বীকারোক্তি ও দ্বিতীয় চার্জশিটের ভিত্তিতে কাউকে সাজা দেয়া হয়নি। কিন্তু একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার ক্ষেত্রে সেটিই হয়েছে। আদালতে শুনানিকালে মোহাম্মদ শিশির মনির উল্লেখ করেন, মুফতি হান্নানের দ্বিতীয় জবানবন্দির ভিত্তিতে যে অধিকতর তদন্ত হয়েছে, সেটির আইনগত ভিত্তি নেই। সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাজা দেয়া হয়েছে। এ মামলায় আসামীদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নির্যাতনের মাধ্যমে আদায় করা হয়েছে।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মামলা করার, মিথ্যা অভিযোগে প্রতিপক্ষকে নির্যাতন ও হয়রানি করার ঘটনা আমাদের দেশে বিরল ঘটনা নয়। আওয়ামী লীগের বিগত সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে হাজার হাজার মামলা হয়েছে এবং এসব মামলায় লাখ লাখ মানুষকে আসামী করা হয়েছে। বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে। এক এক জনের বিরুদ্ধে একাধিক, এমনকি কারো কারো বিরুদ্ধে শতাধিক মামলাও দায়ের করা হয়েছে। হামলা, মামলা, গুম, খুন, সন্ত্রাস আওয়ামী লীগ সরকারের রীতিমতো কালচারে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেষ পর্যন্ত ওই ফ্যাসিবাদী সরকারের বিদায় হয়েছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে ভারতে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করতে হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের এই প্রায় চার মাস সময়কালে বহু মিথ্যা, বানোয়াট ও গায়েবী মামলা বাতিল হয়ে গেছে। এ প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে। একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা অবশ্যই একটি বড় ঘটনা। এর পক্ষপাতহীন তদন্ত ও ন্যায়বিচার হওয়া প্রয়োজন। অনেকে বলে থাকেন, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার পেছনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র ছিল। প্রতিবেশী ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সংশ্লিষ্টতার কথা বলা হয়ে থাকে। হামলার তদন্তের পর যে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. জয়নুল আবেদিন, তাতে তিনি দায়ী করেছিলেন ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাকে। এই সন্ত্রাসী ও বিপুল সংখ্যক প্রাণ হত্যাহতকারী ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া জাতীয় স্বার্থেই অত্যন্ত জরুরি ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার তা না করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের হাতিয়ার হিসেবে তাকে ব্যবহার করেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের অসৎ উদ্দেশ্যের কারণেই এ মামলার বিচার প্রক্রিয়া অবৈধ ঘোষিত হয়েছে। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচার যেমন হয়নি, তেমনি শাপলা চত্বরের গণহত্যার বিচারও হয়নি। এই দুই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের পাশাপাশি ভারতের সম্পৃক্ততার কথাও বিভিন্ন মহল থেকে উঠেছে। এই দুই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও বিচারের দাবি উঠেছে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে। সরকারকে এ ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নিতে হবে। একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলার ব্যাপারেও সরকারকে যথোচিত ব্যবস্থা নিতে হবে। এই মামলার দণ্ডিতরা খালাসের মাধ্যমে যেমন ন্যায়বিচার পেয়েছেন, তেমনি তাদের পরিবার-পরিজনও স্বস্তি পেয়েছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও দলীয় নেতৃবৃন্দ খালাস পাওয়ায় দলের তরফে শুকরিয়া আদায়, বিজয় মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, মহান আল্লাহর দরবারে আমি শুকরিয়া আদায় করছি। তারেক রহমান বেকসুর খালাস পেয়েছেন, বিএনপির দিক থেকে এর চেয়ে বড় সুখবর আর কিছু হতে পারে না।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ফ্যাসিস্ট সরকারের আট বছরের নিষেধাজ্ঞার পর অবশেষে মঞ্চে আসছে থিয়েট্রিক্যাল বাহাস ও কন্ঠনালীতে সূর্য
মিলেছে ‘হারিছ চৌধুরী’র ডিএনএ, রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের নির্দেশ
নাম পরিবর্তনের দাবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের
গলায় ফাঁস দিয়ে বৃদ্ধের আত্মহত্যা
আইএসের নৃশংসতার বিচারে জাতিসংঘ ব্যর্থ : নাদিয়া মুরাদ
নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে হেফাজতের মানববন্ধন
মানিকগঞ্জে হাঙ্গার প্রজেক্টের গণতন্ত্র অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত
এবার ভারতের মালদহে বাংলাদেশিদের জন্য হোটেল ভাড়া বন্ধ ঘোষণা
কিশোরগঞ্জের হাওর-অর্থনীতি বেগবান করতে চলছে কয়েকশ কোটি টাকার প্রকল্প
প্লাস্টিক ব্যবহার রোধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে: অতিরিক্ত সচিব ফাহমিদা খানম
দেশের ৬৯ কারাগারের ১৯টি ঝুঁকিপূর্ণ, ৭০ জঙ্গিসহ ৭০০ বন্দি এখনো পলাতক
পায়রার রাজস্ব আয় বাড়বে তিনগুণ, দেশের অর্থনীতিতে রাখবে বড় ভূমিকা
মমতা ব্যানার্জির মনে গভীর কট্টরপন্থি হিন্দুত্ববাদ : রিজভী
কঠিন সময় পার করছে বাংলাদেশ : প্রধান উপদেষ্টা
কুড়িগ্রামে সাবেক এমপি পুত্র সবুজ গ্রেফতার
ভারতে ৫.৩ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প
অমৃতসরে স্বর্ণ মন্দিরে পাঞ্জাবের সাবেক উপমুখ্যমন্ত্রী সুখবীর সিং বাদালের ওপর গুলিবর্ষণ
খুলনায় সন্ত্রাসী হামলায় আহত বিএনপি নেতার মৃত্যু
বাড়তি মেদ কমাতে ‘খাওয়া কমানো’ কতটা কার্যকর
কিশোরগঞ্জে সড়ক সংস্কার দাবিতে মানববন্ধন