রাবার চাষের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে
০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:১৩ এএম | আপডেট: ০৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:১৩ এএম
বাংলাদেশে রাবার উৎপাদন বাড়ানো ও রাবার প্রক্রিয়াকরণ আধুনিকায়নে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএফআইডিসি) একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যা সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)-এ অনুমোদিত হয়েছে। এটি বাস্তবায়নের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে জীবনচক্র হারানো রাবার গাছ কর্তন, পুনঃবাগান সৃজন, গুণগতমানসম্পন্ন কাঁচা রাবার উৎপাদন ও রাবার প্রসেসিং প্লান্ট আধুনিকায়ন সম্ভবপর হবে এবং দুর্গম ও পাহাড়ি এলাকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশে রাবার চাষ সম্পর্কে বিএফআইডিসি সূত্রে জানা যায়, রাবার একটি লাভজনক কৃষিভিত্তিক শিল্প। মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনে এবং আধুনিক সভ্যতার বিকাশে রাবারের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্বে রাবার থেকে বর্তমানে প্রায় ৪৬ হাজার পণ্য তৈরি হচ্ছে। রাবার বাগানগুলো অত্যন্ত শ্রমঘন কৃষি শিল্প হওয়ায় রাবার উৎপাদক দেশগুলোর বাগানগুলো অশিক্ষিত/অর্ধশিক্ষিত নারী-পুরুষের ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র বিমোচন, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ও গ্রামীণ জনপদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। কার্বন শোষণ ও মাটির ক্ষয়রোধের মাধ্যমে রাবার বাগান পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। প্রাকৃতিক কাঁচা রাবার রফতানির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে। রাবার গাছ রোপণের পর ৬ বছর পরিচর্যা শেষে ৮ম বছরে উৎপাদনে আসে এবং ২৫ বছর অব্যাহত উৎপাদন দেওয়ার পর ৩২-৩৩ বছর বয়সে গাছগুলো অর্থনৈতিক জীবনচক্র হারায়। ঐ সকল গাছ কেটে প্রাপ্ত কাঠ প্রক্রিয়াজাতকরণের পর শক্ত ও টেকসই ১ম শ্রেণীর পর্যায়ের কাঠ হতে উন্নতমানের আসবাবপত্র এবং কাঠজাত সামগ্রী তৈরি করা হয়। মালয়েশিয়া রাবার কাঠ হতে পার্টিকেল বোর্ড,লেমিনেটিং বোর্ড, মিডিয়াম ডেনসিটি ফাইবার বোর্ড ইত্যাদি তৈরি করে বিশ্ববাজারে রাবার কাঠের ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। অপরদিকে শ্রমিক সংকট এবং শ্রমদর বৃদ্ধি পাওয়ায় মালয়েশিয়া পর্যায়ক্রমে রাবার চাষ সংকুচিত করে পামওয়েল চাষে আগ্রহী হয়ে উঠায় বাংলাদেশের জন্য এটি একটি সুবর্ণ সুযোগ হয়ে উঠতে পারে। কাজেই বাংলাদেশে রাবার চাষ অত্যন্ত লাভজনক এবং সম্ভাবনাময় শিল্প হওয়ায় ব্যাপকভাবে রাবার চাষে এগিয়ে আসা একান্ত জরুরি। তবে রাবার সম্পর্কে এদেশের মানুষের তেমন কোন ধারণা নেই, দেশে এ সম্পর্কিত নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য বা প্রকাশনাও নেই।
বাংলাদেশে রাবার চাষের প্রাপ্ত তথ্যাবলিতে জানা যায়, কলিকাতা বোটানিক্যাল হতে ১৯১০ সালে কিছু চারা এনে চট্রগ্রামের বারমাসিয়া ও সিলেটের আমু চা বাগানে রোপণ করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৫২ সালে বনবিভাগ টাংগাইলের মধুপুর, চট্রগ্রামের হাজেরীখিল ও পঞ্চগড়ের তেতুলিয়ায় পরীক্ষামূলক কিছু গাছ রোপণ করে। ১৯৫৯ সালে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার বিশেষজ্ঞ মি. লয়েড এদেশের জলবায়ু ও মাটি রাবার চাষের উপযোগী হিসেবে চিহ্নিত করে রাবার চাষের সুপারিশ করেন। ১৯৬০ সালে বনবিভাগ ৭১০ একরে একটি পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করে চট্রগ্রামের রাউজানে ১০ একর এবং কক্সবাজারের রামুতে ৩০ একর বাগান সৃষ্টির মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে এদেশে রাবার চাষের যাত্রা শুরু হয়। রাবার চাষ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৬২ সালে বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনের নিকট বাণিজ্যিকভাবে রাবার চাষের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়। ১৯৬২ সাল থেকে যাত্রা শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন বাংলাদেশ সরকার এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৭টি, সিলেট অঞ্চলে ৪টি এবং টাংগাইল-শেরপুর অঞ্চলে ৫টি বাগানে রাবার বাগান সৃজন করেছে। বিএফআইডিসি সূত্রে আরো জানা যায়, রাবার চাষের জন্য ভূমি, আবহাওয়া ও বৃষ্টিপাতের বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হয়। কেননা জলবায়ু, আবহাওয়া ও মাটির গঠনের উপর রাবার চাষের সফলতা নির্ভরশীল। সমুদ্র পৃষ্ঠ হতে ১০০-২০০ মিটার উচ্চতার ভূমি রাবার চাষের জন্য সর্বাধিক উপযোগী। মাটির গঠন ৩৫ শতাংশ কাদা ও ৩০ শতাংশ বালি অর্থাৎ বেলে দোঁয়াশ মাটি, মাটিতে নাইট্রোজেন, ফসফেট, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও ম্যাংগানিজ ইত্যাদি পদার্থ কম বেশি থাকা প্রয়োজন। তাছাড়া ভূপৃষ্ঠ হতে নিচে অন্তত ১০০ সে.মি. পর্যন্ত পাথর স্তর মুক্ত ও পানির স্তর ১০০-১৫০ সে.মি. থাকার প্রয়োজন হয়। সারা বছরে গড় বৃষ্টিপাত ২০০-২৫০ সে.মি. এবং গড় তাপমাত্রা ২৫-৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হওয়া বাঞ্ছনীয়। মাটির পি এইচ রেঞ্জ ৪-৫.৫ এর মধ্যে থাকতে হবে। রাবার চাষ এলাকায় পানি জমে থাকতে পারবে না এবং পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা থাকতে হবে। রাবার চাষের জন্য স্থান নির্বাচনের সময় নি¤œবর্ণিত বিষয়ে সঠিক বিবেচনা করার প্রয়োজন হয়। এগুলো হলো: (১) মাটি (২) টপোগ্রাফি (৩) বৃষ্টিপাত (৪) পানি নিষ্কাশনের সুবিধা (৫) যাতায়াতের সুবিধা ইত্যাদি।
রাবার চাষের জন্য নির্বাচিত জায়গায় জংগল ও আগাছা খুব ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হয়। জংগল পরিষ্কার করার কিছুদিন পর জংগল ও আগাছা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হয়। এ কাজটি কমপক্ষে দুবার পুনরাবৃত্তি করতে পারলে ভালো। জংগল কাটা ও পোড়ানোর পর অবশিষ্ট স্ট্যাম্প ও আগাছা ধ্বংস করার জন্য নিয়মানুযায়ী প্রয়োজনীয় রাসায়নিক ঔষধ ব্যবহার করতে হয়। বিশেষ করে ছন এলাকা সমূহের ছন বিনষ্ট করার জন্য নিয়মিত বিরতিতে কমপক্ষে তিনবার গ্লাইফোসেট প্রয়োগ করতে হবে। বাগান জরিপ ও সীমানা নির্ধারণ ও একর প্রতি চারা রোপণের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে প্রতি একরে ২২৫টি হারে রাবার চারা রোপণ করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকার ১৯৮০-৮১ সাল থেকে ১৯৮৪-৮৫ সাল পর্যন্ত ২৮ হাজার ৩২৮ হেক্টর অনুর্বর, পতিত, অন্যান্য খাদ্যশস্য ও ফসল উৎপাদনে অনুপযোগী জমিতে রাবার চাষের জন্য ৫ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প গ্রহণ করে, যার মধ্যে ১৬ হাজার ১৮৭ হেক্টর জমি সরকারি, অবশিষ্ট জমি ব্যক্তি মালিকানাধীন। বিএফআইডিসির মালিকানাধীন রাবার বাগান রয়েছে ১৮টি। বিএফআইডিসি ১৯৮০-৮১ সাল হতে উচ্চ ফলনশীল রাবার চারা রোপণ শুরু করে এবং ১৯৯৭ সালের মধ্যে চট্টগ্রাম, সিলেট ও মধুপুরের ১৩ হাজার ২০৭ হেক্টর জমিতে ১৬টি রাবার বাগান সৃজন করে। বর্তমানে বিএফআইডিসির ১৮টি বাগানের ৩৮ লাখ ৭৮ হাজার রাবার গাছের মধ্যে ২০ লক্ষাধিক গাছ উৎপাদনশীল। বিএফআইডিসি তাদের উৎপাদিত রাবার নিলামে বিক্রি করে। রাবার উৎপাদন এবং বিপণনে বিএফআইডিসি ছাড়া বাংলাদেশ পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় ৩৩০০ একর জমিতে রাবার বাগান রয়েছে। এছাড়া বেসরকারি পর্যায়ে বহুজাতিক কোম্পানি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তারা ২০ হাজার ৮০০ একর জমিতে রাবার চাষ করেছে।
বিএফআইডিসির ১৮টি বাগানে ৩৮ লাখ ৭৮ হাজার রাবার গাছের মধ্যে প্রায় ১০ লাখ অর্থাৎ মোট গাছের ২৫ শতাংশ অর্থনৈতিক জীবনচক্র হারিয়েছে। একটি রাবার গাছের অর্থনৈতিক জীবনচক্র ধরা হয় ৩২ বছর। এছাড়া, রাবার প্রসেসিং করার জন্য চার দশকের পুরোনো যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে সনাতন পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে গুণগতমান সম্পন্ন রাবার উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না। রাবার বাগানের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাওয়ায় এবং কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন করতে না পারায় রাবার প্রসেসিং কারখানাগুলো হুমকির মধ্যে পড়েছে। উন্নতমান ও গুণাগুণ সম্পন্ন রাবার উৎপাদন করতে না পারায় মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক বাজারে বিএফআইডিসি’র টিকে থাকা দুরূহ হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনকে একটি প্রতিযোগিতামূলক, আত্মনির্ভরশীল ও স্বয়ম্ভর কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে উন্নীতকরণের নিমিত্ত এর আওতাধীন ১৮টি রাবার বাগান উন্নয়ন, রাবার প্রসেসিং প্ল্যান্ট আধুনিকায়নের মাধ্যমে গুণগতমান সম্পন্ন কাঁচা রাবার উৎপাদন ও বিপণনের লক্ষ্যে মোট ১৪৫ কোটি (জিওবি ১০০ কোটি এবং বিএফআইডিসির নিজস্ব ৪৫ কোটি) টাকা ব্যয়ে জানুয়ারি ২০২৫ হতে জুন ২০২৮ পর্যন্ত মেয়াদে এ কার্যক্রম বাস্তবায়ন করবে। এ উদ্যোগের প্রধান প্রধান কার্যক্রমগুলো হলো ১০ টি Ribbed Smoked Sheet (RSS) আধুনিক রাবার প্রসেসিং কারখানা স্থাপন, ১০ লাখ নতুন রাবার গাছ প্রতিস্থাপন (কর্তন ও রোপণ), আধুনিক রাবার প্রসেসিং প্লান্ট স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ, প্রাকৃতিক রাবারের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণের জন্য ৫ টি রাবার টেস্টিং ল্যাব স্থাপন, পাঁচটি Effluent Treatment Plant (ETP) স্থাপন, রাবার সংরক্ষণের জন্য ১০টি ওয়ারহাউস/গোডাউন নির্মাণ, হেভি ডিউটি স্কেল ও ফর্ক লিফট সংগ্রহ। রাবার খাতের এ কার্যক্রম শিল্পখাতে টেকসই উৎপাদন ও ভোগ ব্যবস্থা উৎসাহিতকরণের সাথে সম্পর্কিত। বনজ সম্পদ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য প্রতিশ্রুতি জোরদারকরণে এ কার্যক্রম সহায়তা করবে। তাছাড়া লিঙ্গ ও বয়স অনুযায়ী জাতীয় দারিদ্র্য ও অরক্ষিত জনগোষ্ঠীকে টেকসই উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন করতে সহায়তা করবে।
লেখক: উপপ্রধান তথ্য অফিসার, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
নোয়াখালীতে বাসচাপায় শ্রমিকের মৃত্যু,আহত ২
মৃদু শৈত্যপ্রবাহের কবলে নওগাঁ
নির্বাচনের রোড ম্যাপ দেন অতিসত্বর : আবুল কালাম আজাদ
উত্তর কোরিয়ায় নিষিদ্ধ করা হল ‘হট ডগ’
সিংগাইরে ১ সপ্তাহে আত্মহত্যা-৬
মির্জাপুরের অবৈধ সেই ৭ ইটভাটা ভেঙে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে
সীমান্তে সাহসী বাংলাদেশিরা, অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে পুরো দেশকে
দাবানলে পুড়ছে প্যারিস হিলটন, অ্যান্টনি হপকিন্সের কোটি টাকার বাড়ি
‘অতিথি দেবতার মতো’, এই নীতিতে হাসিনার ভিসার মেয়াদ বাড়ালো ভারত
ভূরুঙ্গামারী মহিলা কলেজের গভর্ণিং বডির সদস্য নির্বাচনে মনোনয়ন পত্রের মূল্য ১০ হাজার টাকা
গোয়ালন্দে পাখিদের নিরাপদ আবাসনে গাছে গাছে মাটির হাঁড়ি বসাচ্ছেন একদল যুবক
নভোএয়ার এর ১২ বছরের সাফল্য উদযাপন
ফরিদপুরে বিল্ডিংয়ের দরজার পাশে পড়েছিল কেয়ারটেকারের হাত-পা বাঁধা মরদেহ
ডিএমপির ১২ ডিসিকে বদলি
আবারও অস্ট্রেলিয়ার নেতৃত্বে স্মিথ
‘৪৩তম বিসিএসে বাদ পড়া ২২৭ জনের বেশিরভাগই চাকরিতে যোগ দিতে পারবে’
বিএনপির ২২৭৬ নেতাকর্মীকে ক্রসফায়ারে হত্যার অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে
ভোটার এবার আগের মত ভোট হবে না-মৌলভীবাজারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ. এম. এম. নাসির উদ্দিন
ইহুদি খ্রিস্টানদের স্বর্গরাজ্য পুড়ে ছাই হচ্ছে!
জালিয়াতির প্রশ্ন তুলে শিরোপা হারালেন মিস ইউনিভার্স