বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ

Daily Inqilab ব্যারিস্টার নাজির আহমদ

১১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৫ এএম

এদেশে আইন পেশা গ্রহণ করেছেন কিন্তু বিচারপতি মোর্শেদের নাম শোনেননি, এমন কাউকেই পাওয়া যাবে না। ইংল্যান্ডে লর্ড ডেনিং ছিলেন বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী বিচারক। আমার মতে, বিচারপতি মোর্শেদ ছিলেন বিংশ শতাব্দীর দক্ষিণ এশিয়ার লর্ড ডেনিং। বিচারপতি মোর্শেদের পুরো নাম সাইয়্যেদ মাহবুব মোর্শেদ।

তিনি ১৯১১ সালের ১১ জানুয়ারি অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন সাইয়্যেদ আবদুস সালিক, যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অত্যন্ত সফল একাডেমিক ক্যারিয়ার সমাপ্তির পর বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন এবং পরে বগুড়া ও দিনাজপুরে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর মা ছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের বোন আফজালুন্নেছা বেগম। ১৯৩৯ সালে বিচারপতি মোর্শেদ কলকাতার সাবেক মেয়র প্রখ্যাত জাতীয়তাবাদী নেতা মোহাম্মদ জাকারিয়ার মেয়ে লায়লা আর্জুমান্দ বানুর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের তিন পুত্রসন্তান ও এক কন্যাসন্তান রয়েছেন, যাঁদের সবাই উচ্চ শিক্ষিত ও দেশে-বিদেশে সামাজিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত।

বিচারপতি মোর্শেদ ১৯২৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় বৃহত্তর রাজশাহী বিভাগ থেকে প্রথম স্থান লাভ করেন। তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে ১৯৩০ সালে বিএ (সম্মান) এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩২ সালে অর্থনীতিতে এমএ পাস করেন। তিনি ১৯৩৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। পরে বিচারপতি মোর্শেদ আইনে উচ্চশিক্ষার্থে বিলেত গমন করেন। ১৯৩৯ সালে তিনি ‘বার-এট-ল’ ডিগ্রি লাভ করেন। উল্লেখ্য, ওই বছর ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া থেকে বার-এট-ল পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী পরীক্ষার্থীদের মধ্যে তিনি প্রথম স্থান লাভ করেন।

পড়াশোনার পাশাপাশি বিচারপতি মোর্শেদ সাহিত্যকর্মে ও সৃষ্টিধর্মী কর্মকা-ে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। শিশুকাল থেকেই সাহিত্যে তাঁর প্রচ- ঝোঁক ছিল। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে থাকাকালীন কলেজ ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেন। তিনি ১৯৩০ দশকে ফিলিস্তিন ও মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে বিলেতের প্রভাবশালী দৈনিক ‘দি গার্ডিয়ান’-এ বেশ কিছু প্রবন্ধ লেখেন। বিগত শতাব্দীর ৪০ দশকে ‘দি স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় কায়েদে আজম সম্পর্কে তাঁর সমালোচনাধর্মী প্রবন্ধ বিচারপতি মোর্শেদ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট মহলে উৎসাহ বাড়িয়ে দেয়। বিচারপতি মোর্শেদ ছিলেন একজন ভালো বক্তা ও বাগ্মী। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিবেটিং সোসাইটিতে নেতৃত্ব দেন। ছাত্রজীবনে খেলাধুলার প্রতিও তাঁর ঝোঁক ছিল। তিনি গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের অন্যতম সংগঠক ছিলেন।

বিচারপতি মোর্শেদ তাঁর আইন পেশা চল্লিশের দশকের প্রথম দিকে কলকাতা হাইকোর্টে প্রথমে শুরু করেন। তাঁর মামা শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের সহকারী হিসেবে কাজ করার পরিবর্তে তিনি তৎকালীন প্রখ্যাত আইনজীবী শরৎচন্দ্র বসু ও এ বি খাইতামের জুনিয়র হিসেবে কাজ করেন। উপমহাদেশ ভাগ হওয়ার পর তিনি ঢাকা হাইকোর্টে যোগদান করেন। ১৯৫৫ সালের প্রথম দিকে ঢাকা হাইকোর্টে তাঁকে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডহক বিচারপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর কিছু ব্যতিক্রমধর্মী সাড়াজাগানো রায়, যথা: দ্য মিনিস্টার কেস, দ্য প্যান কেইস, দ্য বেসিক ডেমোক্রেসি কেস, দ্য মাহমুদ কেস এবং দ্য কনভোকেশন কেস প্রভৃতি, যা পাকিস্তানের ইতিহাসের মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডহক বিচারপতি হিসেবে দেওয়া তাঁর একটি রায়কে ‘লিগ্যাল ক্লাসিক’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বিচারপতি মোর্শেদ ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর প্রবাদসম সাহসিকতা ও প্রচ- সাহসী রায় তৎকালীন সরকারকে ঘাবড়ে দিয়েছিল। তাই সরকার বিভিন্নভাবে তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছিল। কিন্তু বিচারপতি মোর্শেদ ছিলেন প্রচ- ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও বিবেকবান মানুষ। যখন তিনি দেখেছেন তিনি বিবেক দ্বারা তাড়িত হয়ে বিচার করতে পারছেন না, তিনি প্রধান বিচারপতির পদ থেকে নিজেই পদত্যাগ করেন ১৯৬৭ সালের ১৬ নভেম্বর। পদত্যাগের পর বিচারপতি মোর্শেদ প্রায় এক যুগ বেঁচেছিলেন, তবে শেষের দিকে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। আইনের জগৎ ও তার বাইরে সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে বিচারপতি মোর্শেদ ১৯৭৯ সালের ৩ এপ্রিল ইহলোক ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশ এমন একজন আইনের কিংবদন্তিকে হারায়, যার অভাব এখনো পূরণ হয়নি এবং ভবিষ্যতে কখনো পূরণ হবে বলে মনে হয় না।

পদত্যাগের পর বিচাপতি মোর্শেদ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ডিফেন্সকে সংগঠিত করতে সহযোগিতা করেন। তিনি ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে প্রত্যক্ষভাবে যোগদান করেন। আইয়ুব খানের ডাকা রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রদের ১১ দফার পক্ষে ওকালতি করেন। তাঁর বৈচিত্র্যপূর্ণ ক্যারিয়ারে তিনি বহু সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি রোটারি ক্লাব, লায়ন্স ক্লাব, পাক-চায়না ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলা-চায়না ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। এ ছাড়া তিনি বাংলা উন্নয়ন বোর্ড এবং বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য ছিলেন। ১৯৫৬ সালে বিচারপতি মোর্শেদ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সভাপতি ছিলেন। তিনি ‘লিগ্যাল এইড’ নামে আইনি সহযোগিতা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন। এটিই ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম মানবাধিকার সংগঠন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ তাঁকে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে।

বিচারপতি মোর্শেদের আরো কিছু উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক দিক ও ভূমিকা আছে, যা জাতির কাছে এখনো অজানা রয়ে গেছে। ঐতিহাসিক ছয় দফা প্রণয়নে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে যুক্তফ্রন্ট সরকারের ২১ দফা ড্রাফটিংয়ে যাঁদের ভূমিকা ছিল তাঁদের অন্যতম ছিলেন তখনকার তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল আইনজীবী বিচারপতি মোর্শেদ। এই ২১ দফাকে সামারাইজ করে ছয় দফায় রূপান্তরিত করেছিলেন বিচারপতি মোর্শেদ। ১৯৬৬ সালের শেষের দিকের ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাযহারুল হক বাকীর মতে, ‘আর কেউ নয়, বরং সাহস করে বিচারপতি মোর্শেদ আমাদের বার্ষিক কনফারেন্সে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করেন এবং শেখ মুজিবের মতো পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে অত্যন্ত সাহসী দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখেন।’

পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান প্রতিটি অংশের জন্য পাকিস্তান ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ১৫০টি সিট ছিল। কিন্তু যখন বিচারপতি মোর্শেদের ‘ওয়ান ম্যান ওয়ান ভোট’ কনসেপ্ট সম্পর্কিত প্রস্তাব গৃহীত হলো তখন পাকিস্তানের ৩০০ আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান পেল ১৬৯টি। অন্য কথায়, বিচারপতি মোর্শেদ এই রাস্তা পরিষ্কার করেছিলেন যে, যে-ই পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করবে, সে-ই জাতীয় পর্যায়ে সরকার গঠন করবে। তাই বিচারপতি মোর্শেদকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা-প্রবক্তা বলা যেতে পারে।

লেখক: বিশিষ্ট আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও রাষ্ট্রচিন্তক।
[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

মেসির সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জন উড়িয়ে দিলেন সেই সাংবাদিক

মেসির সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জন উড়িয়ে দিলেন সেই সাংবাদিক

দেশের মানুষ হাসিনার ফাঁসি চায় :ভোলায় সারজিস আলম

দেশের মানুষ হাসিনার ফাঁসি চায় :ভোলায় সারজিস আলম

জীবনযাত্রা ব্যয় আরো বাড়তে পারে

জীবনযাত্রা ব্যয় আরো বাড়তে পারে

সাবেক ওসি শাহ আলমকে ধরতে সারা দেশে রেড অ্যালার্ট

সাবেক ওসি শাহ আলমকে ধরতে সারা দেশে রেড অ্যালার্ট

মনে হচ্ছে পারমাণবিক বোমা ফেলা হয়েছে লস অ্যাঞ্জেলেসে

মনে হচ্ছে পারমাণবিক বোমা ফেলা হয়েছে লস অ্যাঞ্জেলেসে

খালেদা জিয়ার চিকিৎসা ভালোভাবেই হচ্ছে

খালেদা জিয়ার চিকিৎসা ভালোভাবেই হচ্ছে

চাল ও মুরগির বাজার অস্থিতিশীল

চাল ও মুরগির বাজার অস্থিতিশীল

সামরিক খাতে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে চায় তুরস্ক

সামরিক খাতে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে চায় তুরস্ক

মানুষ জবাই করা আর হাত-পা ভেঙে দেয়ার নাম তাবলিগ নয় :জুমার খুৎবা-পূর্ব বয়ান

মানুষ জবাই করা আর হাত-পা ভেঙে দেয়ার নাম তাবলিগ নয় :জুমার খুৎবা-পূর্ব বয়ান

মুজিব কোট এখন ‘বাচ্চাদের পটি’

মুজিব কোট এখন ‘বাচ্চাদের পটি’

সীমান্তে প্রতিরোধ ব্যূহ

সীমান্তে প্রতিরোধ ব্যূহ

গণঅভ্যুত্থানে শহীদ আরও ৬ জনের লাশ ঢামেক মর্গে

গণঅভ্যুত্থানে শহীদ আরও ৬ জনের লাশ ঢামেক মর্গে

মালয়েশিয়ায় এনআইডি ও স্মার্ট কার্ড সেবা কার্যক্রম চালু হচ্ছে

মালয়েশিয়ায় এনআইডি ও স্মার্ট কার্ড সেবা কার্যক্রম চালু হচ্ছে

সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী আজ শনিবার

সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী আজ শনিবার

ক্র্যাবের সভাপতি তমাল, সাধারণ সম্পাদক বাদশাহ্

ক্র্যাবের সভাপতি তমাল, সাধারণ সম্পাদক বাদশাহ্

মুকসুদপুরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিএনপির দু’গ্রুপে সংঘর্ষ : আহত ২৫

মুকসুদপুরে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিএনপির দু’গ্রুপে সংঘর্ষ : আহত ২৫

ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক সহযোগী মনে করে তালেবান

ভারতকে গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক সহযোগী মনে করে তালেবান

মাইনাস টু ফর্মুলার আশা কখনো পূরণ হবে না : আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী

মাইনাস টু ফর্মুলার আশা কখনো পূরণ হবে না : আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী

গাজীপুর কারাগারে শ্রমিক লীগ নেতার মৃত্যু

গাজীপুর কারাগারে শ্রমিক লীগ নেতার মৃত্যু

ট্রাম্পের শপথ অনুষ্ঠানে শীর্ষ পর্যায়ের দূত পাঠাবে চীন

ট্রাম্পের শপথ অনুষ্ঠানে শীর্ষ পর্যায়ের দূত পাঠাবে চীন