জাতীয় ঐক্য ধরে রাখতে হবে

Daily Inqilab ইনকিলাব

২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৬ এএম

ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসান হয়েছে। তিনি ভারতে পালিয়ে জীবন বাঁচিয়েছেন। তার শাসনামল যেমন ছিল রক্তক্ষয়ী, তেমনি পতনের আগে ক্ষমতায় থাকার জন্য তার পোষ্য বাহিনী দিয়ে শত শত ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে রক্তগঙা বইয়ে দিয়েছিলেন। হাজার হাজার ছাত্র-জনতাকে চিরতরে পঙ্গু ও অন্ধ করেছেন। শেষ পর্যন্ত ছাত্র-জনতার প্রবল প্রতিরোধে হার মেনে তাকে পালিয়ে যেতে হয়েছে। ছাত্র-জনতার ঐক্যের মধ্য দিয়ে গঠিত হয়েছে নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়া সমন্বয়কদের তিনজন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হয়েছেন। সরকার গঠনের পরপরই হাসিনা ও মোদির যৌথ প্রযোজনায় সরকারকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য একের পর এক ষড়যন্ত্র এবং চক্রান্ত হয়েছে। এখনও তা চলমান। এসব ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত ছাত্র-জনতা, রাজনৈতিক দলকে সাথে নিয়ে সরকার সফলভাবে মোকাবেলা করেছে। বিতাড়িত ফ্যাসিস্ট হাসিনা এবং তার দোসররা যাতে পুনরায় মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, এজন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সকলে মিলে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলেছে। তবে এই ঐক্যে এখন যেন ছন্দপতন হতে শুরু করেছে। বিশেষ করে বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও নাগরিক কমিটির মধ্যে পরস্পরবিরোধী অবস্থান ঐক্যে চিড় ধরার আলামত পরিলক্ষিত হচ্ছে। সম্প্রতি বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সরকার নিরপেক্ষ থাকতে না পারলে নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন হবে। তিনি মূলত সরকারের মধ্যে থেকে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনে তিন উপদেষ্টার (সমন্বয়ক) পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার দিকে ইঙ্গিত করে এ কথা বলেছেন। এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে তাঁর এ বক্তব্যের পাল্টা জবাব দিয়েছেন তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, বিএনপির মহাসচিবের দাবি আরেকটি ১/১১ সরকার গঠনের ইঙ্গিত। তাঁর এ স্ট্যাটাস সমর্থন করে শেয়ার এবং পাল্টা জবাব দিয়েছেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, সমন্বয়ক সারজিস আলম এবং হাসনাত আব্দুল্লাহ। এ থেকে বিএনপি, সরকারে থাকা উপদেষ্টা ও বাইরে থাকা সমন্বয়কদের মধ্যে এক ধরনের বাহাসের সৃষ্টি হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরপরই বিএনপি তাকে সহযোগিতার কথা যেমন বলেছে, তেমনি দ্রুত নির্বাচন আয়োজনেরও তাকিদ দিয়েছে, এখনও দিচ্ছে। সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো সংস্কার করে নির্বাচন দেয়া হবে। বিএনপিও এ নিয়ে যৌক্তিক সময় দেয়ার কথা বলেছে। সংস্কার কমিটিগুলোর কাজ এখন চলছে। ইতোমধ্যে সরকারের কাছে সংবিধান সংস্কার কমিটিসহ চারটি কমিটি প্রতিবেদন পেশ করেছে। এর মধ্যেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও নাগরিক কমিটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় ২১০টি উপজেলায় কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে এই নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করবে। এই দল সমর্থন করে সরকারে থাকা তিন উপদেষ্টা বিভিন্ন সময়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। এতে রাজনৈতিক মহলে এ ধারণা জন্মেছে, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘কিংস পার্টি’ গঠিত হচ্ছে। এ নিয়ে বিএনপি পরোক্ষভাবে সমালোচনা করেছে। এখন তা নিয়ে দলটির মহাসচিব খোলাখুলিভাবেই কথা বলছেন। অবশ্য, দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নতুন দল গঠনকে স্বাগত জানিয়েছেন। অস্বীকার করার উপায় নেই, সরকারে থেকে রাজনৈতিক দল গঠন ও পৃষ্ঠপোষকতা করলে তার নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এরই মধ্যে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন নিয়ে উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন জেলা সফরে সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাওয়া এবং অর্থের সংস্থান কীভাবে হচ্ছে, তার উৎস নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এর সদুত্তোর পাওয়া যায়নি। ফলে ধরে নেয়া হচ্ছে, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এ দল গঠিত হচ্ছে। বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের আপত্তি এখানেই এবং তা যৌক্তিকতার বাইরে নয়। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ছাত্র সমন্বয়কের অনেকে এখন আর ছাত্র নেই। কেউ উপদেষ্টা হয়েছেন, কেউ সংসারি হয়েছেন। কাউকে কাউকে কম্বল বিতরণ করতে গিয়ে হেলিকপ্টারবাজি করতে দেখা গেছে। সরকারি সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে তাদের এসব কর্মকা- নিয়ে সমালোচনাও হচ্ছে। জনমনে এই পারসেপশন জন্মেছে, সমন্বয়কদের মধ্যে ক্ষমতার ‘লোভ’ কাজ করছে। তারা সরকারে থেকে বা সহযোগিতা নিয়ে আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে চায়। সমন্বয়কদের মধ্যে ইতোমধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছে। কয়েকদিন আগে মারামারি পর্যন্ত হয়েছে। এতে এটা প্রতীয়মাণ হচ্ছে, সমন্বয়কদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং বিএনপির সাথে কথাবার্তার বাহাসের কারণে, যে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিল, তাতে ফাটল ধরেছে। এ সুযোগে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও তার প্রভু ভারতের চলমান ষড়যন্ত্র বেগবান হতে পারে, যা মোটেও কাম্য হতে পারে না। ভিন্নমত পোষণ, বাকস্বাধীনতা এবং পারস্পরিক গঠনমূলক সমালোচনা গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। একের মত, অন্যের পছন্দ না হলেও তা যুক্তি দিয়ে খ-াতে হয়। এখানে জোরজবরদস্তির মাধ্যমে মত প্রতিষ্ঠার সুযোগ নেই। আমরা দেখেছি, শেখ হাসিনার সময় মানুষের কথা বলার ন্যূনতম অধিকার ছিল না। কারো মত যতই যৌক্তিক হোক না কেন, তাকে জুলুম-নির্যাতনের শিকার ও জেলে যেতে হতো। সংসদ থেকে শুরু করে মিডিয়া, কোথাও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছিল না। তার পতনের পর অবরুদ্ধ গণতন্ত্র মুক্তি পেয়েছে। মানুষ কথা বলতে পারছে। তবে যে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছে, তা যাতে পারস্পরিক বাকবিত-ার কারণে বিনষ্ট না হয়, সেদিকে সকলেরই খেয়াল রাখা অবশ্য কর্তব্য।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্রন্ট লাইনে ছাত্ররা থাকলেও তাদের পেছনে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সহায়তা ছিল। এটা ছিল, ফুটপাতের হকার থেকে শুরু করে অন্য সকল স্তরের মানুষের আন্দোলন। এখন এ আন্দোলনের মালিকানা নিয়ে কারো কারো মধ্যে ক্রেডিট নেয়ার প্রবণতা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে, যা দুঃখজনক। এটা গড়ে ওঠা জাতীয় ঐক্য বিনষ্টের আলামত ছাড়া কিছু নয়। এতে পতিত ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও ভারতের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের পথ প্রশস্থ হচ্ছে। ভারত তার ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সাথে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বাংলাদেশ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেছেন বলে জানিয়েছেন। দুই দেশের আলোচনার মধ্যে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনাকে পর্যবেক্ষরা ভারতের ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে মনে করছেন। অন্যদিকে, বিএনপির ভেতরেও ভারতপন্থী কোনো কোনো নেতা রয়েছেন, যারা ভারতের পারপাস সার্ভ করতে ব্যস্ত। দলটির উচিৎ এ ধরনের নেতা চিহ্নিত করে নিস্ক্রিয় করা। ভারত বিএনপিকে ক্ষমতায় আনবে কিংবা ভারত নির্ভরশীলতায় ক্ষমতা যাওয়া সহজ হবে, কেউ যদি এটা মনে করে, তবে তা হবে বড় ধরনের ভুল। কস্মিনকালেও ভারত বিএনপিকে ক্ষমতায় যেতে সহযোগিতা করবে না। মনে রাখা প্রয়োজন, অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর অত্যন্ত গুরুদায়িত্ব অর্পিত। ভেঙেপড়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি সংস্কারের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করে দেশকে স্থিতিশীল করতে সরকার কাজ করছে। এ প্রেক্ষিতে, সমন্বয়ক, সরকার ও বিরোধীদলের সাথে বিভেদ বা অনৈক্য সৃষ্টি হওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক এবং জনআকাক্সক্ষার পরিপন্থী। ড. মুহাম্মদ ইউনূস যে ঐক্যের মাধ্যমে দেশ পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেছেন, তা অব্যাহত রাখতে সকলকে ভূমিকা রাখতে হবে।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

আমাদের জাতিসত্তার অঙ্গীকার
এখন বিভেদ-বিতর্কের সময় নয়
বিদ্যুৎ ব্যবহারে অবহেলা
রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের অবদানের মূল্যায়ন করতে হবে
সংবিধান সংস্কার প্রস্তাব কি গণতান্ত্রিক দেশের সনদ?
আরও

আরও পড়ুন

২০২৮ ইউরো পর্যন্ত জার্মানির কোচ নাগালসম্যান

২০২৮ ইউরো পর্যন্ত জার্মানির কোচ নাগালসম্যান

পাকিস্তানে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে আলোচনা স্থগিত

পাকিস্তানে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে আলোচনা স্থগিত

সাবেক ২৪ এমপি’র গাড়ি নিলামে উঠছে রোববার

সাবেক ২৪ এমপি’র গাড়ি নিলামে উঠছে রোববার

মিরপুরের আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে মরিয়া

মিরপুরের আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে মরিয়া

অ্যালাউন্স ছাড়া কোনো ভাতা পাবেন না রেলকর্মীরা

অ্যালাউন্স ছাড়া কোনো ভাতা পাবেন না রেলকর্মীরা

ড. ইউনূসের পরিবার সম্পর্কে ইন্ডিয়া ডটকম-এর প্রতিবেদন মিথ্যা : প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং

ড. ইউনূসের পরিবার সম্পর্কে ইন্ডিয়া ডটকম-এর প্রতিবেদন মিথ্যা : প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং

ছাত্রদল নেতা মিথুন রিমান্ডে, ছয় সমর্থক কারাগারে

ছাত্রদল নেতা মিথুন রিমান্ডে, ছয় সমর্থক কারাগারে

বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল কুনমিংয়ে ই-পাসপোর্ট সেবা চালু

বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল কুনমিংয়ে ই-পাসপোর্ট সেবা চালু

বিএনপির ‘কথার টোন আ.লীগের সাথে মিলে যাচ্ছে’

বিএনপির ‘কথার টোন আ.লীগের সাথে মিলে যাচ্ছে’

নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে তিনজন আহত

নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণে তিনজন আহত

বাংলাদেশের সংস্কার উদ্যোগকে সমর্থন আল গোরের

বাংলাদেশের সংস্কার উদ্যোগকে সমর্থন আল গোরের

২০২৪ সালে জলবায়ু সঙ্কটে দেশের সোয়া ৩ কোটি শিশুর শিক্ষা ব্যাহত

২০২৪ সালে জলবায়ু সঙ্কটে দেশের সোয়া ৩ কোটি শিশুর শিক্ষা ব্যাহত

মাদারীপুরে মানবপাচারকারীকে গণপিটুনির ভিডিও ভাইরাল

মাদারীপুরে মানবপাচারকারীকে গণপিটুনির ভিডিও ভাইরাল

জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হলে ফিরে আসবে ফ্যাসিস্টরা : কুড়িগ্রামে ডা. শফিকুর রহমান

জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হলে ফিরে আসবে ফ্যাসিস্টরা : কুড়িগ্রামে ডা. শফিকুর রহমান

মোরেলগঞ্জে পল্লী বিদ্যুৎতের মিটার সংকট মিলছে না সংযোগ : গ্রাহকদের ভোগান্তি

মোরেলগঞ্জে পল্লী বিদ্যুৎতের মিটার সংকট মিলছে না সংযোগ : গ্রাহকদের ভোগান্তি

রাউজানে জুমার নামাজে যাওয়ার পথে ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা

রাউজানে জুমার নামাজে যাওয়ার পথে ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা

বাজারে পলিথিন কেন সেটা না ভেবে ভাবুন কেন ব্যবহার করছেন : পরিবেশ উপদেষ্টা

বাজারে পলিথিন কেন সেটা না ভেবে ভাবুন কেন ব্যবহার করছেন : পরিবেশ উপদেষ্টা

আড়াইহাজারে পুলিশ কনস্টেবলকে আটক করলো জনতা

আড়াইহাজারে পুলিশ কনস্টেবলকে আটক করলো জনতা

টিকটকারদের যন্ত্রণায় বিব্রত মেট্রোরেল যাত্রীরা

টিকটকারদের যন্ত্রণায় বিব্রত মেট্রোরেল যাত্রীরা

কুষ্টিয়ার মিরপুরে হত্যা চেষ্টা মামলায় আটক ২

কুষ্টিয়ার মিরপুরে হত্যা চেষ্টা মামলায় আটক ২