চাঁদাবাজি-দখলবাজিতে সর্বদলীয় ঐক্য

Daily Inqilab ইনকিলাব

২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০৩ এএম

সিলেটের সব পাথর কোয়ারী ও বালুমহল থেকে নির্বিচারে পাথর ও বালু তোলা হচ্ছে। এ ব্যাপার কোনো নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না। এই যথেচ্ছ লুটপাটের কারণে সরকার বিপুল অংকের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ভারতের দাসী হাসিনার সরকার ভারত থেকে পাথর আমদানির জন্য সকল পাথর কোয়ারী ও বালুমহল থেকে উত্তোলন বন্ধ করে দেয় ২০২০ সালে এক প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে। রাতরাতি পাথর কোয়ারী ও বালুমহলে স্থবিরতা নেমে আসে। হাজার হাজার শ্রমিক আয়-রোজগার হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ে। প্রজ্ঞাপন বাতিল করে পাথর কোয়ারী ও বালুমহল পুনরায় চালু করার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম হলেও ভারতের স্বার্থরক্ষাকারী সরকার তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। ৫ আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশবৈরী সরকারের পতন ও বিদায় ঘটলে এক নতুন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় ও গণস্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে গত ১৩ জানুয়ারি পূর্বের আদেশ বাতিল ঘোষণা করলে সিলেটসহ সারাদেশের পাথর কোয়ারী, বালুমহল ও সাদা মাটির খনি থেকে পাথর, বালি ও মাটি উত্তোলন উন্মুক্ত হয়ে যায়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ২০১৪ সালে পরিবেশ মন্ত্রণালয় যে গাইড লাইন দিয়েছিল সে অনুযায়ী উত্তোলন হচ্ছে না। স্থানীয় প্রশাসন পাথর ও বালু সম্পদ রক্ষায় সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। ইনকিলাবের খবরে বলা হয়েছে, রোপওয়ে বাংকারসহ জাফলংয়ের পাথর কোয়ারীগুলো ও ভোলগঞ্জের সাদা মাটি প্রায় সাবাড় হতে বসেছে। স্থানীয় প্রশাসনের খবরদারি ও নজরদারির অনুপস্থিতিতে স্থানীয় রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট সিন্ডিকেট এই বেপরোয়া লুটাপাটের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রশাসনের তরফে গঠন করা একটি কমিটির সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০ থেকে ২৫ দিনে জাফলং, ভোলাগঞ্জ ও বিছান্দকান্দি কোয়ারী থেকে দেড়শ’ কোটি টাকার পাথর লুণ্ঠিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, পাথর ও বালুশ্রমিকদের কাছ থেকে ব্যাপকভাবে চাঁদাও আদায় করা হচ্ছে। কয়েকটি চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট এ অপকর্ম করছে। বিএনপি’র নেতাকর্মী, বিজিবি, পুলিশ চাঁদাবাজির সঙ্গে যুক্ত বলে জানা গেছে। পাথর-বালি সম্পর্কিত ব্যবস্থাপনা ও চাঁদাবাজি রহিত করার বিকল্প নেই। পরিবেশ মন্ত্রণালয়সহ স্থানীয় প্রশাসনকে এ ব্যাপারে তৎপর হতে হবে।

দখল, রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন ও চাঁদাবাজির সঙ্গে সাধারণত স্থানীয় প্রভাবশালী, বিশেষ করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও সন্ত্রাসীরা জড়িত। গত প্রায় ১৬ বছর দখল, অর্থসম্পদ বেহাত ও নানা ক্ষেত্রে চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত ছিল পতিত ফ্যাসিস্ট দল ও সরকারের নেতাকর্মী ও সন্ত্রাসীরা। তাদের শোচনীয় বিদায় ও স্থানচ্যুতি হলেও কোথাও কোথাও তাদের অবশেষ এখনও সক্রিয়। অন্যদিকে পতিতদের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিএনপির নেতাকর্মীরা। স্থানীয় প্রভাবশালী এবং সন্ত্রাসীদেরও পালাবদল হয়েছে। এটা সিলেটের পাথর কোয়ারী ও বালুমহল দখল, লুটপাট ও চাঁদাবাজির ক্ষেত্রে যেমন লক্ষ করা গেছে, তেমনি দেশের অন্যত্রও নানা ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। ইনকিলাবের আরেক খবরে বলা হয়েছে, ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার ঢেউখালি ইউনিয়নের মুন্সীরচর এলাকায় অবৈধ ড্রেজার দিয়ে মাটি কাটায় পদ্মায় অসময়ে ব্যাপক ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে বহু বসতবাড়ি এবং কয়েক হাজার একর ফসলি জমি বিলীন হয়ে গেছে। এতদিন এই কাজটি করেছে সদরপুরের আওয়ামী লীগ গ্যাং। এখন সেই গ্যাংই বিএনপির চাঁদর গায়ে জড়িয়ে একই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা বালু-মাটি কাটা হচ্ছে এবং নদীর তীর ঘেঁষে তা রাখা হতো। এভাবে বালু-মাটি লুট হয়ে যাচ্ছে। নদী থেকে ব্যাপক পরিসরে বালি ও মাটি কাটা হলে নদীর পাড় অনিবার্যভাবে ভেঙে পড়বে। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রবাদে বলে, কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ। এখানে প্রভাবশালী, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের লাভ হলেও সমূহ ক্ষতি হয়েছে ও হচ্ছে সাধারণ মানুষের। প্রশাসন নিষ্ক্রিয় কিংবা রাজনৈতিক প্রভাবের কাছে অবনত। এলাকাবাসীর মতে, উপজেলা প্রশাসনের একাংশের সঙ্গে বালু-মাটি লুটেরাদের যোগসাজস আছে। এ ধরনের প্রশ্রয় অব্যাহত থাকলে বালি-মাটি লুট কিংবা নদীভাঙন কোনাটাই রোধ করা যাবে না। এ ব্যাপারে জেলা-উপজেলা প্রশাসন তাদের দায় এড়িয়ে যেতে পারে না, শুধু ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলা নয়, দেশের বিভিন্ন এলাকায় নদী থেকে অবৈধভাবে বালি বা মাটি উত্তোলনের কারবার চলছে অবাধে। নদী দখল করে স্থাপনা নির্মাণ কিংবা মাছ চাষ ইত্যাদিও চলছে। নদী তরল ও কঠিন বর্জ্যরে নিরাপদ ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। যেন নদীর কোনো মা-বাপ নেই। দখল-দূষণে নদীর অবস্থা বিপর্যয়কর বললেও কম বলা হয়। নদীকে জীবন্ত সত্তা বলে অভিহিত করা হয়েছে। অথচ, নদী সুরক্ষার পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেই। রাজধানীর চারপাশের নদীগুলো দখল-দূষণে অস্তিত্বের সংকটে পতিত হলেও তাদের উদ্ধারের ব্যবস্থা নেই। নদী যেমন দিন দিন মরে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে, তেমনি হারিয়ে যাচ্ছে বন ও পাহাড়। তারপরও বনভূমি হ্রাস ও বৃক্ষনিধন অব্যাহত আছে। অন্যদিকে পাহাড় কেটে নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে অবলীলায়। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেটে পাহাড় নিধন, বাড়িঘর ও আবাসিক এলাকা নির্মাণে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলছে। গতকাল একটি ইংরেজি দৈনিকের প্রথম পাতায় একটি ছবি ছাপা হয়েছে। বলা হয়েছে, ছবিটি চট্টগ্রামের পশ্চিম খুলশি এলাকার, সেখানে পাহাড় কেটে আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হচ্ছে। এটা সুরক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা কতৃর্পক্ষ নেয়নি। নদী, বন, পাহাড় প্রকৃতি ও পরিবেশের অচ্ছেদ্য অংশ। এদের লালন করা, রক্ষা করা মানুষের অপরিহার্য কর্তব্য। এতে অবহেলা হলে প্রকৃতি-পরিবেশ বিরূপ হতে বাধ্য, যার খেসারত মানুষকেই দিতে হয়। বন, পরিবেশ ও নদনদী দেখার জন্য আমাদের একাধিক মন্ত্রণালয় আছে। মন্ত্রণালয়গুলো কী করছে, স্বভাবতই সে প্রশ্ন উঠতে পারে। গত সাড়ে ১৫ বছরে বন, পরিবেশ, নদীরক্ষায় তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর, একজন উপদেষ্টার ওপর বন, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য এবং নদী-পানিসম্পদ সম্পর্কিত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব অর্পিত হওয়ায় আশা করা হয়েছিল, তিনি সামগ্রিক পরিবেশ উন্নয়ন ও নদীরক্ষায় নজির সৃষ্টিকারী সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নেবেন। এ আশাবাদের প্রধান কারণ, পরিবেশ আন্দোলনে তার একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, তিনি তেমন উল্লেখযোগ্য কাজ দেখাতে পারেননি। বক্তৃতা-বিবৃতি আর আশ্বাসের মধ্যেই তার দায়িত্বকে সীমাবদ্ধ রেখেছেন। এসব ছেড়ে তাকে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে যেতে হবে, দেখতে হবে এবং নির্দেশ দিতে হবে। নির্দেশ পালিত হচ্ছে কি না, তাও নিশ্চিত করতে হবে। কথায় বলে, সোজা আঙুলে ঘি ওঠে না। ঘি উঠাতে হলে আঙুল বাঁকা করতে হবে। বলাই বাহুল্য, কর্তৃপক্ষীয় কঠোর হস্তক্ষেপ ছাড়া পরিবেশ, নদীরক্ষা এবং বিভিন্ন অনাচার, অন্যায়, দখলবাজি, চাঁদাবাজি, সিন্ডেকেটবাজি রোধ করা সম্ভব নয়।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

সুন্দরবন রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধি করা হোক
ইউনূস-মোদি বৈঠক : একটি পর্যালোচনা
গণঅভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশে সংক্ষুব্ধ ‘আমরা’ কারা?
জেনারেল এসির নামে প্রতারণা
সন্তানকে নৈতিক শিক্ষা দিন
আরও
X

আরও পড়ুন

জনতা ব্যাংকের নতুন ডিএমডি মো. নজরুল ইসলাম

জনতা ব্যাংকের নতুন ডিএমডি মো. নজরুল ইসলাম

চাকরি হারানোর ভয় পাচ্ছেন না আনচেলত্তি

চাকরি হারানোর ভয় পাচ্ছেন না আনচেলত্তি

আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক চেয়ারম্যান’স অ্যাওয়ার্ড প্রদান

আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক চেয়ারম্যান’স অ্যাওয়ার্ড প্রদান

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত

বাংলাদেশীদের জন্য মক্কা ও মদিনায় চালু হচ্ছে ‘হজ ম্যানেজমেন্ট সেন্টার’

বাংলাদেশীদের জন্য মক্কা ও মদিনায় চালু হচ্ছে ‘হজ ম্যানেজমেন্ট সেন্টার’

লোহাগাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা আটক

লোহাগাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা আটক

নিবন্ধন আবেদনের সময় বাড়াতে ইসিকে চিঠি দিলো এনসিপি

নিবন্ধন আবেদনের সময় বাড়াতে ইসিকে চিঠি দিলো এনসিপি

আমদানি বন্ধের অজুহাতে হিলিতে বেড়েছে চালের দাম,বিপাকে পাইকাররা

আমদানি বন্ধের অজুহাতে হিলিতে বেড়েছে চালের দাম,বিপাকে পাইকাররা

হাজীগঞ্জে বজ্রপাতে কৃষকের মৃত্যু

হাজীগঞ্জে বজ্রপাতে কৃষকের মৃত্যু

যুদ্ধবিধ্বস্ত সুদানের করুণ চিত্র তুলে ধরলেন বাসিন্দারা

যুদ্ধবিধ্বস্ত সুদানের করুণ চিত্র তুলে ধরলেন বাসিন্দারা

শর্ত পূরণে জুনে মিলতে পারে আইএমএফ এর ঋণের দুই কিস্তি

শর্ত পূরণে জুনে মিলতে পারে আইএমএফ এর ঋণের দুই কিস্তি

গ্রামীণ ব্যাংক থেকে কমানো হয়েছে সরকারের মালিকানা: পরিবেশ উপদেষ্টা

গ্রামীণ ব্যাংক থেকে কমানো হয়েছে সরকারের মালিকানা: পরিবেশ উপদেষ্টা

দেশে তামাক ব্যবহারে প।রতি বছর ১ লক্ষ ৬১ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে

দেশে তামাক ব্যবহারে প।রতি বছর ১ লক্ষ ৬১ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে

আলোচনা ফলপ্রসূ, বার্তা দিলেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব

আলোচনা ফলপ্রসূ, বার্তা দিলেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব

বন্যহাতির অত্যাচারে অতিষ্ঠ পাহাড়িবাসী

বন্যহাতির অত্যাচারে অতিষ্ঠ পাহাড়িবাসী

মাদক সেবনের ভিডিও ধারণ করায় যুবককে কুপিয়ে যখম

মাদক সেবনের ভিডিও ধারণ করায় যুবককে কুপিয়ে যখম

চীনের সব পণ্যের উপর ২৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের খবর ‘বিভ্রান্তিকর’: হোয়াইট হাউস

চীনের সব পণ্যের উপর ২৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের খবর ‘বিভ্রান্তিকর’: হোয়াইট হাউস

টঙ্গীবাড়ীত বজ্রপাতে ১ কিশোর নিহত, আহত ৩

টঙ্গীবাড়ীত বজ্রপাতে ১ কিশোর নিহত, আহত ৩

খুলনায় অপহৃত স্কুল ছাত্রী উদ্ধার

খুলনায় অপহৃত স্কুল ছাত্রী উদ্ধার

চীনের বিরল মৃত্তিকা রপ্তানি বিধি-নিষেধ কেন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ধাক্কা?

চীনের বিরল মৃত্তিকা রপ্তানি বিধি-নিষেধ কেন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ধাক্কা?