জামায়াতীকরণ বন্ধ করতে হবে

Daily Inqilab ইনকিলাব

২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০২ এএম | আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০২ এএম

স্বৈরাচার হাসিনার সময়ে বেপরোয়া দলীয়করণ, আঞ্চলিকতা ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রতিটি সেক্টরকে ধ্বংস করা হয়েছিল। বল্গাহীন দুর্নীতি ও দলীয়করণের কারণে সর্বত্র এক ধরনের স্থবিরতা ও বিচারহীনতা দেখা দিয়েছিল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে মানুষের অন্যতম প্রত্যাশা ছিল শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জনপ্রশাসনের মতো খাতগুলোকে বিদ্যমান আমলাতান্ত্রিক দলীয়করণের গ্যাড়াকল থেকে মুক্ত করে সেখানে সৎ, যোগ্য, দক্ষ, অভিজ্ঞ ও মেধাবীদের স্থান করে দেয়া হবে। আদতে তা হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারের ৭ মাসেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অধিদফতরের বিভিন্ন পদে স্বৈরাচারের দোসর ও দলবাজ আওয়ামী লীগাররাই বসে আছে। কিছু কিছু পরিবর্তন যা হয়েছে, সেখানে প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ও বিধি অনুসারে বিগত সময়ে রাজনৈতিক কারণে বঞ্চিতদের পদায়ন না করে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের লোকদেরই নিয়োগ, পদায়ন ও স্থলাভিষিক্ত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত একাধিক রিপোর্টে সাম্প্রতিক সময়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জনপ্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে বেছে বেছে জামায়াতের লোকদের বসানোর একটি চিত্র পাওয়া গেছে। বলা বাহুল্য, লোকবল, জনসমর্থনের দিক থেকে জামায়াত দেশের তৃতীয় কিংবা চতুর্থ দল হিসেবে পরিগণিত হলেও জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর চাপের মুখে আওয়ামী সিন্ডিকেট কোনঠাসা ও অনেকে বিচ্যুত হলেও সে স্থলে জামায়াতের লোকদেরই পদায়ন করা হয়েছে। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে এটি কোনো ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত বহন করে না।

গতমাসে দেয়া বক্তৃতায় বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অভিযোগ করে বলেছিলেন, অন্তর্বর্তী সরকার শিক্ষা বিভাগের সর্বত্র জামায়াতীকরণ করে ফেলেছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কথিত জামায়াতের লোকদের ভিসি এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ তুলে বলেন, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের ১ নম্বর মেধাবী প্রকৌশলী ছাত্র জীবনে ছাত্রদল করতেন, পরিবর্তিত এই সময়ে তাকে প্রধান প্রকৌশলী না করে জামায়াত সংশ্লিষ্ট হওয়ায় ৫ নম্বর ব্যক্তিকে প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। তার এ অভিযোগ যদি সত্য হয়, তাহলে বোঝা যাচ্ছে, বিভিন্ন সেক্টরে প্রশাসন ক্যাডারে জ্যেষ্ঠতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে পদায়ন হচ্ছে না। আওয়ামী ফ্যাসিস্টরা যেভাবে ক্ষমতার সর্বোচ্চ স্তরকে ব্যবহার করে সর্বত্র দলীয়করণ করেছিল, ঠিক একইভাবে অন্তর্বর্তী সরকারের অভ্যন্তরে জামায়াতের প্রভাব কাজে লাগিয়ে সর্বত্র জামায়াতীকরণ চলছে। এ ক্ষেত্রে চেনামুখ বিএনপি সমর্থিত কর্মকর্তারা বিগত ১৭ বছরের মত বঞ্চিতই রয়ে যাচ্ছেন। আওয়ামী ফ্যাসিবাদী বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিজয়ী নতুন বাংলাদেশ প্রশাসনে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার বদলে আরেকটি দলীয়করণের শিকার হবে, এমনটা কারোই প্রত্যাশিত ছিল না। প্রশাসনে নিয়োগ ও পদায়নে আওয়ামীপন্থিদের স্থলে একচ্ছত্রভাবে জামায়াতপন্থিদের অগ্রাধিকারভিত্তিক পদায়ন প্রশাসনে নতুন বৈষম্য ও অসন্তোষ বাড়িয়ে তুলতে পারে। প্রশাসনে বিএনপিপন্থিদের বঞ্চিত রেখে জামায়াতপন্থিদের আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা অশুভ লক্ষণ।
গত ৭ মাসেও সরকারের বিভিন্ন সেক্টরে বিদ্যমান বৈষম্য, অস্থিরতা ও অচলাবস্থার নিরসন হয়নি। অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্টরা শক্তহাতে বৈষম্য নিরসন, শৃঙ্খলা ও গতিশীলতা ফিরিয়ে আনার বদলে একটি বিশেষ দলের লোকদের নিয়োগ ও পদায়নে আগ্রহী বলে অভিযোগ উঠছে। দেশের স্বাস্থ্য খাতের নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা ও দুর্নীতি দূর করে সাধারণ মানুষের জন্য সর্বোচ্চ সেবা নিশ্চিত করতে না পারলেও স্বাস্থ্য উপদেষ্টার একান্ত সচিব এবং স্বাস্থ্য উপদেষ্টার ব্যক্তিগত সচিবের নেতৃত্বে গঠিত সিন্ডিকেট এ খাতে পরিবর্তনে সর্বত্র জামায়াতপন্থী লোকদের নিয়োগ ও পদায়নে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতকে দুর্নীতি, দলীয়করণের গ্যাড়াকল থেকে মুক্ত করতে না পারলে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের অর্জন ও প্রত্যাশা অধরাই থেকে যাবে। বিগত দেড় যুগের অনিয়ম, দলীয়করণ ও দুর্নীতির চক্র ভেঙ্গে প্রশাসনিক কার্যক্রমকে গতিশীল ও জনবান্ধব করতে হলে প্রথমেই এর আভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও বৈষম্য দূর করতে হবে। এ ক্ষেত্রে যদি আওয়ামী সিন্ডিকেটের বদলে জামায়াতী সিন্ডিকেট প্রশাসনের ঘাড়ে চেপে বসে, সে ক্ষেত্রে নতুন দলীয়করণের কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যথাযথ সেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হতে পারে। কথিত সিন্ডিকেট শুধুমাত্র জামায়াতের লোকদের বিভিন্ন পদে বসাচ্ছে, শুধু তাই নয়, সেই সাথে অর্থের বিনিময়ে সাবেক স্বৈরাচারী আমলের সুবিধাভোগী সিন্ডিকেট সদস্যদের পদে বহাল রাখছে অথবা পদায়ন করারও অভিযোগ উঠেছে। পতিত স্বৈরাচারের দোসররা প্রশাসনে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে, এটাই স্বাভাবিক। নতুন বাস্তবতায় ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে অতীতের বৈষম্য ও অস্বচ্ছতা দূর করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। যেখানে পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের বাদ দিয়ে মেধা, জ্যেষ্ঠতা, যোগ্যতা, দক্ষতাই হওয়ার কথা পদায়নের মূল মানদ-। সেখানে তা অগ্রাহ্য করে গুরুত্বপূর্ণ পদে বিশেষ রাজনৈতিক দলের লোকদের বসিয়ে সর্বক্ষেত্রে তাদের লোক দিয়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জনপ্রশাসনে জামায়াতের পাল্লা ভারী করার প্রক্রিয়া কোনো শুভ ফল বয়ে আনবে না। দেশে একটি রাজনৈতিক মেরুকরণ চলছে। এ সময় প্রশাসনে অবশ্যই বৈষম্য নিরসন ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব দিতে হবে। এসব ক্ষেত্রে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জনপ্রশাসনের সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টাদের শৈথিল্য ও নির্লিপ্ত থাকার সুযোগ নেই। প্রধান উপদেষ্টাকেও বিষয়টির দিকে নজর দিতে হবে।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

সুন্দরবন রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধি করা হোক
ইউনূস-মোদি বৈঠক : একটি পর্যালোচনা
গণঅভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশে সংক্ষুব্ধ ‘আমরা’ কারা?
জেনারেল এসির নামে প্রতারণা
সন্তানকে নৈতিক শিক্ষা দিন
আরও
X

আরও পড়ুন

জনতা ব্যাংকের নতুন ডিএমডি মো. নজরুল ইসলাম

জনতা ব্যাংকের নতুন ডিএমডি মো. নজরুল ইসলাম

চাকরি হারানোর ভয় পাচ্ছেন না আনচেলত্তি

চাকরি হারানোর ভয় পাচ্ছেন না আনচেলত্তি

আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক চেয়ারম্যান’স অ্যাওয়ার্ড প্রদান

আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক চেয়ারম্যান’স অ্যাওয়ার্ড প্রদান

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত

বাংলাদেশীদের জন্য মক্কা ও মদিনায় চালু হচ্ছে ‘হজ ম্যানেজমেন্ট সেন্টার’

বাংলাদেশীদের জন্য মক্কা ও মদিনায় চালু হচ্ছে ‘হজ ম্যানেজমেন্ট সেন্টার’

লোহাগাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা আটক

লোহাগাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা আটক

নিবন্ধন আবেদনের সময় বাড়াতে ইসিকে চিঠি দিলো এনসিপি

নিবন্ধন আবেদনের সময় বাড়াতে ইসিকে চিঠি দিলো এনসিপি

আমদানি বন্ধের অজুহাতে হিলিতে বেড়েছে চালের দাম,বিপাকে পাইকাররা

আমদানি বন্ধের অজুহাতে হিলিতে বেড়েছে চালের দাম,বিপাকে পাইকাররা

হাজীগঞ্জে বজ্রপাতে কৃষকের মৃত্যু

হাজীগঞ্জে বজ্রপাতে কৃষকের মৃত্যু

যুদ্ধবিধ্বস্ত সুদানের করুণ চিত্র তুলে ধরলেন বাসিন্দারা

যুদ্ধবিধ্বস্ত সুদানের করুণ চিত্র তুলে ধরলেন বাসিন্দারা

শর্ত পূরণে জুনে মিলতে পারে আইএমএফ এর ঋণের দুই কিস্তি

শর্ত পূরণে জুনে মিলতে পারে আইএমএফ এর ঋণের দুই কিস্তি

গ্রামীণ ব্যাংক থেকে কমানো হয়েছে সরকারের মালিকানা: পরিবেশ উপদেষ্টা

গ্রামীণ ব্যাংক থেকে কমানো হয়েছে সরকারের মালিকানা: পরিবেশ উপদেষ্টা

দেশে তামাক ব্যবহারে প।রতি বছর ১ লক্ষ ৬১ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে

দেশে তামাক ব্যবহারে প।রতি বছর ১ লক্ষ ৬১ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে

আলোচনা ফলপ্রসূ, বার্তা দিলেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব

আলোচনা ফলপ্রসূ, বার্তা দিলেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব

বন্যহাতির অত্যাচারে অতিষ্ঠ পাহাড়িবাসী

বন্যহাতির অত্যাচারে অতিষ্ঠ পাহাড়িবাসী

মাদক সেবনের ভিডিও ধারণ করায় যুবককে কুপিয়ে যখম

মাদক সেবনের ভিডিও ধারণ করায় যুবককে কুপিয়ে যখম

চীনের সব পণ্যের উপর ২৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের খবর ‘বিভ্রান্তিকর’: হোয়াইট হাউস

চীনের সব পণ্যের উপর ২৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের খবর ‘বিভ্রান্তিকর’: হোয়াইট হাউস

টঙ্গীবাড়ীত বজ্রপাতে ১ কিশোর নিহত, আহত ৩

টঙ্গীবাড়ীত বজ্রপাতে ১ কিশোর নিহত, আহত ৩

খুলনায় অপহৃত স্কুল ছাত্রী উদ্ধার

খুলনায় অপহৃত স্কুল ছাত্রী উদ্ধার

চীনের বিরল মৃত্তিকা রপ্তানি বিধি-নিষেধ কেন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ধাক্কা?

চীনের বিরল মৃত্তিকা রপ্তানি বিধি-নিষেধ কেন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ধাক্কা?