মব জাস্টিস ও নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে কঠোর হতে হবে
১১ মার্চ ২০২৫, ১২:৩৫ এএম | আপডেট: ১১ মার্চ ২০২৫, ১২:৩৫ এএম

রাজধানীর অন্তত চারটি থানায় গত রোববার চুরি-ছিনতাই ইত্যাদির অভিযোগে আটজন গণপিটুনির শিকার হয়েছে। নিহত না হলেও তাদের আহত হয়ে হাসপাতালে যেতে হয়েছে। মব তৈরি করে গণপিটুনি দেয়ার ঘটনা সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রাজধানীসহ সারাদেশে প্রায়ই ঘটছে। বলা যায়, এটা প্রতিযোগিতায় রূপ নিয়েছে। একে বলা হচ্ছে, মব জাস্টিস। আসলে মব ভায়োলেন্স। এতে হতাহতের ঘটনা বাড়ছে। কিছুদিন আগে টঙ্গীতে মব ছিনতাইকারী সন্দেহে একজনকে হত্যা করেছে, সাতকানিয়ায় মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে দু’জনকে হত্যা করেছে, শরীয়তপুরে দু’জন ডাকাতকে হত্যা করেছে। রাজধানীতে দু’জন ইরানী নাগরিক মবের মুখে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করেছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত সাত মাসে মব হামলায় ১১৯ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে অনেকে। বিভিন্ন অভিযোগে মব সৃষ্টি করে মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে, আহত করা হচ্ছে। অভিযোগ সত্য হতেও পারে, নাও হতে পারে। এমন ধারণাও বেশ বদ্ধমূল যে, ব্যক্তিগত শত্রুতা ও বিরোধের সুবাদেও মব সৃষ্টি করে প্রতিশোধ নিতে হামলা ও হতাহত করা হচ্ছে। অভিযোগ সত্য হোক বা না হোক, এভাবে আইন হাতে তুলে নেয়ার এখতিয়ার কারো নেই। মব সৃষ্টি করে কাউকে হত্যা করা বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের নামান্তর। কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে বা কেউ কোনো অপরাধ করলে তাকে আইনের হাওলা করে দিতে হবে। বিচারের ভার নিজ হাতে নেয়ার অধিকার আইন কাউকে দেয়নি। মব জাস্টিস আইনের দৃষ্টিতেই শুধু অবৈধ নয়, গুরুতর অপরাধ নয়, নাগরিক নিরাপত্তা, সামাজিক শান্তি-স্থিতির প্রতিও মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। মব জাস্টিস বেড়ে যাওয়ার কারণ কী, কারা এতে প্ররোচনা ও মদদ দিচ্ছে, সেটা বের করা যেমন দরকার, তেমনি যে কোনো মূল্যে তা প্রতিহত করা দরকার। পর্যবেক্ষকদের মতে, পুলিশ এখনো ট্রমায়। পুলিশকে নতুনভাবে উজ্জীবিত ও সক্রিয় করে তোলা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া, পুলিশের মধ্যে এখনো পতিত স্বৈরাচারের দোসররা রয়েছে, যারা ঠিকভাবে দায়িত্ব পালন তো করছেই না, উপরন্তু আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাতে কাজ করছে। পুলিশ পূর্ণ সক্রিয় ও তৎপর হলে মব জাস্টিস বাড়তে পারতো না। এর বাইরেও পতিত স্বৈরাচারের দলীয় ও অঙ্গ-সংগঠনের সন্ত্রাসীরা রয়েছে, যারা আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটিয়ে সরকারকে ব্যর্থ প্রতিপন্ন করার চেষ্টায় তৎপর। অধিকাংশ ক্ষেত্রে মব সৃষ্টি ও মব অ্যাটাকের সঙ্গে এরা জড়িত। এ সংক্রান্ত বেশকিছু খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হযেছে। দেশকে অস্থির-অস্থিতিশীল করার জন্য পতিত স্বৈরাচার যে আগাগোড়া সক্রিয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রধান উপদেষ্টা স্বয়ং বলেছেন, এ জন্য পতিত স্বৈরাচার বিপুল বিনিয়োগ করেছে। মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার বিকল্প নেই। তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, মব জাস্টিসের বিরুদ্ধে সরকার এখন কঠোর অবস্থান যাবে। যেই মব জাস্টিস করবে, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। সরকারের এই কঠোর অবস্থানকে আমরা সাধুবাদ জানাই।
মব জাস্টিসের পাশাপাশি গত কিছুদিনে নারীর প্রতি সহিংসতা বিশেষত ধর্ষণের ঘটনা বেড়েছে। শিশু থেকে অন্তঃসত্ত্বা পর্যন্ত কেউই ধর্ষকদের কবল থেকে রেহাই পাচ্ছে না। গত সপ্তাহে মাগুরায় বোনের বাসাতে বেড়াতে এসে আট বছরের শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এখন সে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। বীভৎস ও ভয়াবহ এ ঘটনা এবং নারীর প্রতি ক্রমবর্ধমান সহিংসতার প্রতিবাদে দেশজুড়ে গণবিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ রাস্তায় নেমে সমাবেশ, বিক্ষোভ, গণমিছিল করছে। যখন এহেন প্রতিবাদ চলছে তখনও ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। ঢাকার কেরানীগঞ্জ ও সাভার এবং নরসিংদী, বগুড়া ও ঠাকুরগাঁয়ে পাঁচ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ভুক্তভোগীদের দু’জন অন্তঃসত্ত্বা। ২৪ ঘণ্টায় এই ধর্ষণকা- ঘটেছে বলে খবরে উল্লেখ করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, দেশজুড়ে ধর্ষণেও যেন প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের তথ্যমতে, ফেব্রুয়ারির ২৮ দিনে ধর্ষণের অভিযোগে দিনে গড়ে ১৮টি মামলা হয়েছে। নারীকে প্রকাশ্যে হেনস্থা, পিটিয়ে আহত করা, এমনকি হত্যা করার ঘটনাও ঘটেছে সম্প্রতি। এসব ঘটনা মানুষ ও সমাজকে বড় রকমে ধাক্কাই দেয়নি, উদ্বিগ্ন, বিচলিত ও ক্ষুব্ধ করেছে। এর প্রকাশ আমরা রাজপথে দেখতে পাচ্ছি। এই লাগাতার গণপ্রতিক্রিয়ার প্রেক্ষিতে সরকার নড়েচড়ে বসেছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে.জে (অব) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, দেশে ধর্ষকদের কোনো স্থান হবে না। আইনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার কাজ করছে সরকার। ধর্ষণের ক্ষেত্রে সরকারের অবস্থান জিরো টলারেন্স। আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা রেধে আইন সংশোধন করা হচ্ছে। তিনি আরো জানিয়েছেন, ধর্ষণের মামলা ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত ও ৯০ দিনের মধ্যে বিচার শেষ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ওদিকে হাইকোর্ট মাগুরার ঘটনার বিচার বিরতি ছাড়া ১৮০ দিনের মধ্যে শেষ করার নির্দেশ দিয়েছে। বলা বাহুল্য, দ্রুত বিচার ও কঠোর শান্তি মব জাস্টিস কিংবা নারীর প্রতি সহিংসতা বা ধর্ষনের মতো অপরাধ রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। পর্যবেক্ষকদের মতে, বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি আমাদের গড়ে উঠেছে, তার ফলেই বিভিন্ন অপরাধ ক্রমগত বাড়ছে, কোনোভাবেই বোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। দ্রুত বিচার ও উপযুক্ত শান্তি হলে সব ধরনের অপরাধ কমতে বাধ্য।
সাম্প্রতিকালে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ব্যাপক গণউদ্বেগের কারণে পরিণত হয়েছে। চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই-রাহাজানি থেকে শুরু করে দখলবাজি-চাঁদবাজি, খুন-সন্ত্রাসসহ এমন কোনো অপরাধ নেই, যা বাড়েনি বা বাড়ছে না। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতার আসার পর আইনশৃঙ্খলার সুরক্ষাকে প্রধান করণীয় হিসাবে নির্ধারণ করেছিল। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সরকার আইনশৃঙ্খলা সুরক্ষা করতে পারছে না। উত্তরোক্তর আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটছে। এই অবনতির কারণ আমরা কমবেশি সবাই জানি। এই কারণের দোহাই দিয়ে পার পাওয়ার সময় আর নেই। অপরাধ যেই করুক, তার রাজনৈতিক, সামাজিক অবস্থান যাই হোক, সে ছাত্র হোক, সমন্বয়ক হোক বা অন্যােকনো পরিচয়ধারী হোক, তাকে আইনের আওতায় আনতে হবে। উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। দখলবাজি-চাঁদাবাজি, চলছে। কারা করছে, অজানা নেই। এই দখলবাজি-চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের অভিযোগ ছাত্র সমন্বয়কদের কারো কারো বিরুদ্ধেও উঠেছে। শিক্ষার্থীদের নামে আনা অপকর্মও ঘটতে দেখা পাচ্ছে। সরকার শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফেরাতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। অপরাধী অপরাধীই, তার আর কোনো পরিচয় নেই। অপরাধীকে অপরাধী হিসাবেই বিবেচনা করতে হবে। গ্রেফতার, শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। জানা গেছে, পুলিশের মাঠ প্রশাসনকে অপরাধ দমনে কঠোর বার্তা দেয়া হয়েছে। গত রোববার ৬৪ জেলার পুলিশ সুপারদের ভার্চুয়াল বৈঠককে এই বার্তা দেয়া হয়েছে। পুলিশের শীর্ষক নীতিনির্র্ধারণী পর্যায় থেকে বলা হয়েছে, অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। কারো মুখ দেখে আইন প্রয়োগ করা যাবে না। সমন্বয়কসহ অন্য যে কোনো প্রভাবশালী পরিচয়ে বেআইনী কর্মকা-ে জড়ালে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়া হবে না। এই নীতিমালা ও নির্দেশনা যদি যথাযথভাবে অনুসৃত হয়, তবে আইনশৃঙ্খলার উন্নতি ও অপরাধ প্রশমনে অগ্রগতি হবে বলে আশা করা যায়।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

ইসরায়েলের হামলা বন্ধে জাতিসংঘকে কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে-কাজী শিপন

সিরিয়া ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল ও তুরস্ক চুক্তি করবে, আশাবাদ ট্রাম্পের

বনফুল শোরুমে ইসরায়েলি পণ্য বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত

৪৬তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষা পেছাতে পিএসসিতে পরীক্ষার্থীদের অবস্থান

নাসার সঙ্গে আর্টেমিস চুক্তি সাক্ষর করল বাংলাদেশ

রাজশাহীর চারঘাটে মদপানে দু’জনের মৃত্যু

১১ জেলেকে ট্রলারসহ অপহরণ আরাকান আর্মির

ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভে ভাঙচুর-লুটপাটে চার মামলা, গ্রেপ্তার ৫৬

আনফিল্ডেই থাকছেন ফন ডাইক

সব সরকারি হাসপাতালে চালু হবে ফার্মেসি, স্বল্পমূল্যে মিলবে ওষুধ

স্যাট ফুটসাল চ্যাম্পিয়নশিপে উজবেকিস্তানকে হারাল ইরান

ফিলিস্তিনে গণহত্যার প্রতিবাদে নোবিপ্রবিতে সংহতি সমাবেশ ও মানববন্ধন

বান্দরবানে গভীর রাতে বিএনপির অফিস ভাংচুর করেছে সন্ত্রাসারী

শিশু গুলিবিদ্ধের ঘটনা আইয়্যামে জাহেলিয়াতের বর্বরতাকে হার মানিয়েছে: রেজাউল করিম

‘গাজার মুসলিমরা আজ অভিভাবক শূন্য, মুসলিম নেতারা ইসরায়েলের হাতে জিম্মি’

বৈষম্য বিরোধী কর্মচারী ঐক্য ফোরামের কার্য-নিবাহী কমিটি ঘোষণা

দাউদকান্দিতে বসতঘর ও রান্নাঘর দুর্বৃত্তদের আগুনে পুড়ে ছাই

নগরকান্দায় যৌথ বাহিনীর অভিযানে অস্ত্র সহ গ্রেফতার-৪

১১ দিন পর কড়ইতলী-গোবরাকুড়া স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানি শুরু

পাঁচবিবিতে ফিলিস্থিনে ইসরাইলী হামলার প্রতিবাদে ছাত্রদলের বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ