গাজাবাসীর ডাকে নো ওয়ার্ক নো স্কুল কর্মসূচি

Daily Inqilab ইনকিলাব

০৮ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৪ এএম

গাজায় নির্বিচার গণহত্যার প্রতিবাদে গাজাবাসী বিশ্বব্যাপী হরতাল পালনের ডাক দেয়। তারা ‘নো ওয়ার্ক, নো স্কুল’ কর্মসূচি প্রতিপালনের আহ্বান জানায়। তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে গত সোমবার বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইহুদিদের দুর্বৃত্তাচার ও গণহত্যার প্রতিবাদে নানা কর্মসূচি পালিত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী সাধারণ হরতাল আহ্বানকারী প্যালস্টাইনিয়ন ন্যাশনাল ও ইসলামিক ফোর্সেস তার এ সংক্রান্ত বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে, গাজায় ভয়াবহতাকে বিশ্ববাসীর কাছে জোর দিয়ে তুলে ধরার জন্য এ হরতাল আহ্বান করা হয়েছে। যুদ্ধবন্ধে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। দাবি জানানো হয়েছে, গাজায় অপরাধের জন্য, ফিলিস্তিনিদের অধিকার লংঘন করার জন্য ইসরাইলের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে। উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০২৩ সালে ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরাইলি হামলা ও আগ্রাসন শুরু হয়, যা এখনো অব্যাহত আছে। মাঝখানে কিছু দিনের জন্য যুদ্ধবিরতি হয়েছিল। যুদ্ধবিরতি শেষ হওয়ার পর ইসরাইল আগের মতই পোড়ামাটি নীতি প্রয়োগ শুরু করেছে। যুদ্ধবিরতির পর পরিচালিত হামলায় আরো কয়েক হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় পাঁচশ শিশুও রয়েছে। এর আগেও ইসরাইলি হামলায় বিপুল সংখ্যক নারী-শিশু নিহত হয়েছে। সবমিলে গাজাযুদ্ধে এ পর্যন্ত ৫১ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত এবং প্রায় এক লাখ ১৬ হাজারের বেশি আহত হয়েছে। গাজার বাড়িঘর, স্থাপনা, রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, মসজিদ ইত্যাদি অধিকাংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের হত্যা ও বিতাড়নের মাধ্যমে গাজাকে খালি করে দখলে নেয়াই মার্কিন-ইহুদি চক্রের মূল লক্ষ্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গাজা দখলের খায়েশ থেকে সেটা বিশেষভাবে স্পষ্ট হয়েছে। গাজাকে বিভক্ত ও দখল করার কাজ এখন চলছে। রাফা অঞ্চলকে নতুন আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। লাগাতার হামলায় নারী-পুরুষ-শিশু নিহত হওয়া ছাড়াও রাফার অন্তত ৯০ শতাংশ বাড়িঘর, যার সংখ্যা কমপক্ষে ২০ হাজার, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। পানির ২৪টি কূপের মধ্যে ২২টি, ৮৫ শতাংশ পয়ঃনিকাশ ব্যবস্থা, ৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ১২টি মেডিক্যাল সেন্টার ধংস ও অকার্যকর হয়ে পড়েছে। গত ২৩ মার্চ রাফা এলাকার একটি সড়কে অ্যাম্বুলেন্সসহ একটি গাড়িবহরে হামলা চালায় ইহুদি বাহিনী। এতে ১৫ জন চিকিৎসাকর্মী নিহত হয়। এই হামলার একটি ভিডিওফুটেজ থেকে দেখা গেছে, ইহুদি বাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের হত্যা করেছে। গাড়িগুলোতে আলো জ্বললেও তাতে হামলা চালানো হয়েছে।

অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ধরে গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন ও গণহত্যা চললেও, ধ্বংসকা- অব্যাহত থাকলেও অন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এই আগ্রাসন ও গণহত্যা বন্ধে কোনো উদ্যোগই নেয়নি। জাতিসংঘ লিপ সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে, ওআইসি যতটা সম্ভব নিরব থাকতেই পছন্দ করছে, মুসলিম দেশগুলোর প্রায় প্রতিটি সরকারই উপেক্ষা দেখিয়ে যাচ্ছে। ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র কার্যত অভিন্ন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন লবির অন্য দেশগুলিও ইসরাইল-মার্কিন অবস্থানেরই সমর্থক। অবশ্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমনকি ইসরাইল-যুক্তরাষ্ট্রেও জনগণ পর্যায়ে গাজাযুদ্ধ ও ফিলিস্তিনি গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ শুরু থেকেই হচ্ছে। গাজাবাসীর বিশ্বব্যাপী হরতালের আহ্বানেও তারা সাড়া দিয়েছে। হোয়াইট হাউসের সামনেও বিক্ষোভ হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যখন গণহত্যা ও যুদ্ধবন্ধে গা করছে না, তখন মজলুম গাজাবাসী বিবেকবান, মানবিক, সহৃদয় বিশ্ববাসীর কাছেই তাদের দুঃখের, বেদনার, অসহায়ত্বের, বিপর্যয়ের, অনিরাপত্তার কথা তুলে ধরার পদক্ষেপ নিয়েছে। তাদের এই হরতালের ডাক কর্মসূচি হিসেবে অভিরত ও অধিকতর কার্যকরযোগ্য। আমাদের দেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, সাংস্কৃতিক সংস্থা এ উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে। জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি, হেফাজতে ইসলাম, খেলাফত আন্দোলন ইত্যাদি রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানিয়েছে। ছাত্রদল, ছাত্র শিবির, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদসহ অন্যান্য ছাত্র সংগঠন বিক্ষোভ-সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই ক্লাস হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। গাজায় ইহুদি আগ্রাসন ও গণহত্যার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ বরাবরই সোচ্চার। বিশেষ করে ছাত্র-তরুণরা এ ব্যাপারে অগ্রগামী। গাজাবাসীর হরতালের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাদের বিভিন্ন কর্মসূচি পালন এর প্রমাণ বহন করে। যে ছাত্র-তরুণরা গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট শাসনের অবসান ঘটিয়েছে, তারা যে-কোনো দেশের মজলুমের পক্ষে এবং আগ্রাসী শক্তির বিপক্ষে দাঁড়াবে, সেটাই তো স্বাভাবিক।

গাজাযুদ্ধে ইহুদিরা সামনে, পেছনে যুক্তরাষ্ট্র। বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রই এ যুদ্ধ চালাচ্ছে, ইহুদিদের দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ, অস্ত্র এই যুদ্ধের নিয়ামক। অর্থ ও অস্ত্র ছাড়া ইসরাইলের পক্ষে এ যুদ্ধ অব্যাহত রাখা কোনো ক্রমেই সম্ভব হতো না। যুক্তরাষ্ট্র যদি বলে, যুদ্ধ বন্ধ, তবে ইসরাইলের পক্ষে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এই বিবেচনায় একথা বলা মোটেই অসঙ্গত হবে না যে, গাজায় যে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও ধ্বংসকা- সংঘটিত হয়েছে বা হচ্ছে, তার জন্য যুক্তরাষ্ট্রই প্রধান দায়ী। কাজেই, যুদ্ধ ও গণহত্যা বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে যুদ্ধ ও গণহত্যা বন্ধ করতে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দৃঢ় ও আন্তরিক হলে গাজাযুদ্ধ অবশ্যই বন্ধ করা সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্র এখন শীর্ষ পরাশক্তি। অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবেও প্রথম। বাহু ও অর্থবলে বলীয়ান হয়ে সে যাচ্ছে-তাই করার দুঃসাহস দেখাতে পারে। কারো ওপর স্যাংশন দেয়, কারো ওপর আগ্রাসন চালায়, কারো প্রতি হামলা ও দখলের হুমকি দেয়, কখনো ইচ্ছেমত শুল্ক আরোপ করে বিশ্বকে অস্থির করে তোলে। এই প্রেক্ষাপটে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মার্কিননীতির পুনর্মূল্যায়ন করার সময় এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মিত্র ইউরোপীয় ইউনিয়নও এখন বুঝতে পারছে, যুক্তরাষ্ট্র যার মিত্র, তার শত্রুর দরকার নেই। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যে অহেতুক বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়, তার উদ্গাতাও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাবিশ্ব। ৯/১১-এর পর যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ শুরু করে, যা আজও চলছে। এর পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার কেউ নেই। ওআইসির ভূমিকা এ ক্ষেত্রে খুবই হতাশাজনক। ওআইসি সক্রিয় হলে পাল্টা অগ্রাসন বা যুদ্ধ না করেও মুসলমান ও মুসলিম বিশ্বের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হতো। মুসলিম বিশ্ব এদিকে কি নজর দেবে?


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

মুসলিম শাসকরা কি ইহুদিদের দাসে পরিণত হয়েছেন?
হাসিনার পতনের পর বিএনপির আট মাস
ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিল : বৈরিতার বহিঃপ্রকাশ
প্রতিবন্ধীবান্ধব অবকাঠামোর অপ্রতুলতা
ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের বিকাশে জোর দিতে হবে
আরও
X

আরও পড়ুন

ইসরায়েলি অবরোধে ত্রাণহীন গাজায় মানবিক বিপর্যয়

ইসরায়েলি অবরোধে ত্রাণহীন গাজায় মানবিক বিপর্যয়

ড. ইউনূসের নেতৃত্ব বাংলাদেশের সমৃদ্ধি আনবে, প্রত্যাশা আমিরাত প্রেসিডেন্টের

ড. ইউনূসের নেতৃত্ব বাংলাদেশের সমৃদ্ধি আনবে, প্রত্যাশা আমিরাত প্রেসিডেন্টের

নদীতে গোসল করতে নেমে প্রাণ গেল দুই বোনের

নদীতে গোসল করতে নেমে প্রাণ গেল দুই বোনের

জীবিত অভিবাসীদের ‘মৃত’ ঘোষণা করে তাড়াচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন

জীবিত অভিবাসীদের ‘মৃত’ ঘোষণা করে তাড়াচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসন

বঙ্গোপসাগরে ৪ ট্রলারে ডাকাতি, গুলিবিদ্ধসহ আহত ৮

বঙ্গোপসাগরে ৪ ট্রলারে ডাকাতি, গুলিবিদ্ধসহ আহত ৮

এক সপ্তাহে যৌথ বাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তার ৬০৮

এক সপ্তাহে যৌথ বাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তার ৬০৮

নিউইয়র্কে নদীতে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত, শিশুসহ নিহত ৬

নিউইয়র্কে নদীতে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত, শিশুসহ নিহত ৬

ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত আরও ৪০ ফিলিস্তিনি

ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত আরও ৪০ ফিলিস্তিনি

রামগতিতে চাঁদা না দেয়ায় কিশোর গ্যাং সদস্যদের হামলায় দিনমজুর আহত, আটক ১

রামগতিতে চাঁদা না দেয়ায় কিশোর গ্যাং সদস্যদের হামলায় দিনমজুর আহত, আটক ১

দোয়ারাবাজার সীমান্তে ভারতীয় খাসিয়ার গুলিতে বাংলাদেশী নিহত

দোয়ারাবাজার সীমান্তে ভারতীয় খাসিয়ার গুলিতে বাংলাদেশী নিহত

ছাগলনাইয়ায় অস্ত্রসহ যুবক আটক

ছাগলনাইয়ায় অস্ত্রসহ যুবক আটক

এবার এসএসসিতে পরীক্ষার্থী কমেছে ময়মনসিংহ শিক্ষাবোর্ডে

এবার এসএসসিতে পরীক্ষার্থী কমেছে ময়মনসিংহ শিক্ষাবোর্ডে

যাত্রী বেশে সিএনজি অটোরিকশা ছিনতাই, গ্রেফতার ২

যাত্রী বেশে সিএনজি অটোরিকশা ছিনতাই, গ্রেফতার ২

নগরকান্দায় বৃষ্টিতে কাঁদায় পিচ্ছিল সড়কে মোটরসাইকেল আরোহী নিহত

নগরকান্দায় বৃষ্টিতে কাঁদায় পিচ্ছিল সড়কে মোটরসাইকেল আরোহী নিহত

সউদীতে পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন ট্রাম্প

সউদীতে পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন ট্রাম্প

ভারতের চেয়ে বেশি কেউ বাংলাদেশের মঙ্গল চায় না

ভারতের চেয়ে বেশি কেউ বাংলাদেশের মঙ্গল চায় না

জার্মানিতে গঠিত হচ্ছে নতুন জোট সরকার

জার্মানিতে গঠিত হচ্ছে নতুন জোট সরকার

সদরঘাটের ব্যবসায়ীকে হত্যা: স্বামী-স্ত্রীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

সদরঘাটের ব্যবসায়ীকে হত্যা: স্বামী-স্ত্রীর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড

সান্দা বিশ্বকাপে স্বর্ণপদক জিতেছেন ইরানের দারিয়াই

সান্দা বিশ্বকাপে স্বর্ণপদক জিতেছেন ইরানের দারিয়াই

সবুজ প্রবৃদ্ধির জন্য অংশগ্রহণমূলক বাণিজ্য ও কৌশলগত অংশীদারিত্বে জোর দিলেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

সবুজ প্রবৃদ্ধির জন্য অংশগ্রহণমূলক বাণিজ্য ও কৌশলগত অংশীদারিত্বে জোর দিলেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান