হয়রানিমূলক মামলা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে

Daily Inqilab ইনকিলাব

২২ মার্চ ২০২৫, ০১:২৯ এএম | আপডেট: ২২ মার্চ ২০২৫, ০১:২৯ এএম

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শাসনামলে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক, গয়েবি ও ভুয়া মামলাসহ প্রতিহিংসামূলক মামলার বিষয়টি ছিল স্বাভাবিক। বিরোধীদল বিশেষ করে বিএনপিকে দমাতে তার নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নানা ছুঁতোয় একের পর এক মামলা দেয়া হতো। কোথাও একটি ঘটনা ঘটলে সেখানে এক মামলায় বহুজনকে আসামী করে অজ্ঞাতনামা আরও অনেককে আসামী করা হতো। অজ্ঞাতনামাদের জায়গায় পরবর্তীতে ইচ্ছা করে অনেক নিরাপরাধীকে আসামীর তালিকায় ঢুকিয়ে দেয়া হতো। অজ্ঞাতনামা ও গায়েবি এই মামলা নিয়ে সে সময় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও পুলিশ ব্যাপক বাণিজ্য করত। আবার পুলিশ বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের মামলায় জড়ানোর জন্য এতটাই উৎসাহী ছিল যে, মৃত বা বিদেশে রয়েছে, এমন ব্যক্তিদেরও আসামী করত। কোন দিকবিদিক ছিল না। মামলা হয়েছে তো, কেষ্টা বেটার মতো সব দোষ বিএনপির নেতাকর্মীদের ঘাড়ে গিয়ে পড়ত। শুধু বিএনপির নেতাকর্মীই নয়, অন্যান্য দলের নেতাকর্মী ও অসংখ্য সাধারণ মানুষ প্রতিহিংসার শিকার হয়ে এ ধরনের মামলায় আসামী হয়েছে। গ্রেফতার হয়ে জেলে গেছে কিংবা এখনও অনেকে জেলে রয়েছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর ধারণা করা হয়েছিল, এই ভয়াবহ ভুয়া মামলাবাজির অপসংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব হবে। দেখা যাচ্ছে, হাসিনার পতনের পর নতুন প্রেক্ষাপটেও তা অব্যাহত রয়েছে। ভুয়া ও বানোয়াট মামলা অব্যাহত আছে। এমনও দেখা যাচ্ছে, বাদী চেনে না বিবাদীকে, বিবাদী চেনে না বাদীকে, অথচ মামলা দেয়া হয়েছে। এছাড়া পটপরিবর্তনের পর পূর্বশত্রুতা ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে মিথ্যা ও বানোয়াট মামলা অহরহ হচ্ছে। আবার গণঅভ্যুত্থানে হত্যা মামলায়ও অনেক নিরপরাধীকে ফাঁসিয়ে দেয়া হচ্ছে।

নতুন বাংলাদেশের যাত্রায় ধারণা করা হয়েছিল, বিগত ফ্যাসিস্ট হাসিনার অমানবিক ও অবিচারের অপসংস্কৃতির অবসান ঘটবে। বিশেষ করে ভুয়া ও গায়েবি মামলা বলে কিছু থাকবে না। দেখা যাচ্ছে, গণঅভ্যুত্থানকে পুঁজি করে একশ্রেণীর প্রতারক এ ধরনের মামলায় নির্দোষ ব্যক্তিকে ফাঁসিয়ে দিয়ে বাণিজ্য করছে। ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, গণঅভ্যুত্থানের উসিলায় বিভিন্ন প্রতারক চক্র এমন সব বাদি সাজিয়ে মামলা করছে যাকে বিবাদী চিনে না। আবার এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে, যার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে সে জানে না। এক সময় পুলিশ অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট নিয়ে হাজির হয়ে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে। বিগত সময়ে দেখা যেত, আদালতে গিয়ে কেউ মামলা করে নির্দিষ্ট তারিখে আদালতে আসামীর হাজির হওয়ার সমন লুকিয়ে তারিখ পার করে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট জারি করত। আসামী এর কিছুই জানত না। পুলিশ এসে তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যেত এবং আদালত তাকে জেলে পাঠিয়ে দিত। আদালতে গেলেই মামলার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যেত। সেটা লোয়ার কোর্ট থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত। এমনকি লেবার কোর্টেও তাই হয়। এখনো সেটাই দেখা যাচ্ছে। কেউ গিয়ে অভিযোগ করলেই তদন্ত বা বাছ-বিচার ছাড়া ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়ে যায় এবং ভুক্তভোগির হয়রানি ও মানসিক পীড়নের সীমা থাকে না। আদালত যদি মামলা শুরুর আগে অভিযোগ আমলযোগ্য, কি আমলযোগ্য নয়, তার সঠিকতা যাচাই করে নেয়া, তাহলে মানুষের আর হয়রানির সুযোগ থাকে না। এভাবে যে কত শত মানুষ ভুয়া মামলায় গ্রেফতার হয়ে জেল খেটেছে কিংবা খাটছে তার ইয়ত্তা নেই। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে গায়েবি, ভুয়া, মিথ্যা, রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক মামলা ছিল নিপীড়ন-নির্যাতনের অন্যতম হাতিয়ার। এ থেকে রাজনৈতিক নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও রেহাই পায়নি। এখনো তারা এসব ভিত্তিহীন মামলার বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে। অনেকে জেলে আছেন। অনেকে আদালতে দিনের পর দিন হাজিরা দিতে দিতে ক্লান্ত, মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন। কথায় বলে কারো সর্বনাশ করতে হলে তাকে মামলায় ফাঁসিয়ে দাও। মামলা দিয়ে নিরপরাধ অসংখ্য মানুষকে ফাঁসানোর এই ধরনের ভয়াবহ অবিচারের অবসান ঘটানোর বিকল্প নেই।

যারা ফ্যাসিস্ট হাসিনার দোসর এবং তার যেসব নেতাকর্মী মানুষকে দেড় দশকের বেশি সময় ধরে অত্যাচার, নিপীড়ন, নির্যাতন ও হয়রানি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধরা মামলা-মোকদ্দমার মাধ্যমে আইনি বিচার পেতে পারে। তবে গণঅভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে একটি শ্রেণী যে মামলা বাণিজ্য শুরু করেছে, যাকে তাকে আসামী করে হয়রানি করছে, তাদের বিরুদ্ধে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। আদালতে বা থানায় কারো বিরুদ্ধে মামলা হলে, তা আদালতের যেমন তদন্ত করার নির্দেশ থাকতে হবে, তেমনি পুলিশকেও তদন্ত করে মামলার যথার্থতা ও প্রকৃত আসামী চিহ্নিত করতে হবে। কারো বিরুদ্ধে মামলা হলেই তাকে গ্রেফতার করে জেলে নিয়ে যেতে হবে, এ ধরনের প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমারা দেখেছি, ৫ আগস্টের পর ঢালাও মামলার ঢল নেমেছিল। যাকে-তাকে হত্যা মামলায় আসামী করা হয়েছে। বাদী যাকে চিনেও না, তাকেসহ অনেক নিরীহ মানুষকে ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে। এতে সরকারও বিব্রত হয়েছে। আইন উপদেষ্টাও বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। সরকারের তরফ থেকে এ ধরনের মামলার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনেরও নির্দেশনা রয়েছে। এ ধরনের মামলার কারণে মামলার জট দিন দিন আরও বাড়ছে। দেখা যাবে, যে লাখ লাখ মামলার জট লেগে আছে, সেগুলো ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে তাতে অনেক ভুয়া মামলা ও নিরপরাধ মানুষের ভোগান্তির গল্প খুঁজে পাওয়া যাবে। সরকার যদি লাখ লাখ মামলার মধ্যে আমলযোগ্য কিংবা বিচারযোগ্য মামলা পরীক্ষার উদ্যোগ নেয়, তাহলে অনেক গায়েবি ও ভুয়া মামলার নিষ্পত্তি হয়ে জট অর্ধেকে নেমে আসবে। যে চক্র নিরীহ ও নিরপরাধ মানুষকে জড়িয়ে ভুয়া ও গায়েবি মামলা দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে পাল্টা আইনি ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। মামলা দিতে আসলেই থানা বা আদালতের উচিৎ, তা তদন্ত সাপেক্ষে গ্রহণ করা। এতে ভুয়া, হয়রানিমূলক ও গায়েবি মামলার শিকার মানুষের ভোগান্তির অবসান ঘটবে।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

সুন্দরবন রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধি করা হোক
ইউনূস-মোদি বৈঠক : একটি পর্যালোচনা
গণঅভ্যুত্থান-উত্তর বাংলাদেশে সংক্ষুব্ধ ‘আমরা’ কারা?
জেনারেল এসির নামে প্রতারণা
সন্তানকে নৈতিক শিক্ষা দিন
আরও
X

আরও পড়ুন

জনতা ব্যাংকের নতুন ডিএমডি মো. নজরুল ইসলাম

জনতা ব্যাংকের নতুন ডিএমডি মো. নজরুল ইসলাম

চাকরি হারানোর ভয় পাচ্ছেন না আনচেলত্তি

চাকরি হারানোর ভয় পাচ্ছেন না আনচেলত্তি

আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক চেয়ারম্যান’স অ্যাওয়ার্ড প্রদান

আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক চেয়ারম্যান’স অ্যাওয়ার্ড প্রদান

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত

বাংলাদেশীদের জন্য মক্কা ও মদিনায় চালু হচ্ছে ‘হজ ম্যানেজমেন্ট সেন্টার’

বাংলাদেশীদের জন্য মক্কা ও মদিনায় চালু হচ্ছে ‘হজ ম্যানেজমেন্ট সেন্টার’

লোহাগাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা আটক

লোহাগাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা আটক

নিবন্ধন আবেদনের সময় বাড়াতে ইসিকে চিঠি দিলো এনসিপি

নিবন্ধন আবেদনের সময় বাড়াতে ইসিকে চিঠি দিলো এনসিপি

আমদানি বন্ধের অজুহাতে হিলিতে বেড়েছে চালের দাম,বিপাকে পাইকাররা

আমদানি বন্ধের অজুহাতে হিলিতে বেড়েছে চালের দাম,বিপাকে পাইকাররা

হাজীগঞ্জে বজ্রপাতে কৃষকের মৃত্যু

হাজীগঞ্জে বজ্রপাতে কৃষকের মৃত্যু

যুদ্ধবিধ্বস্ত সুদানের করুণ চিত্র তুলে ধরলেন বাসিন্দারা

যুদ্ধবিধ্বস্ত সুদানের করুণ চিত্র তুলে ধরলেন বাসিন্দারা

শর্ত পূরণে জুনে মিলতে পারে আইএমএফ এর ঋণের দুই কিস্তি

শর্ত পূরণে জুনে মিলতে পারে আইএমএফ এর ঋণের দুই কিস্তি

গ্রামীণ ব্যাংক থেকে কমানো হয়েছে সরকারের মালিকানা: পরিবেশ উপদেষ্টা

গ্রামীণ ব্যাংক থেকে কমানো হয়েছে সরকারের মালিকানা: পরিবেশ উপদেষ্টা

দেশে তামাক ব্যবহারে প।রতি বছর ১ লক্ষ ৬১ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে

দেশে তামাক ব্যবহারে প।রতি বছর ১ লক্ষ ৬১ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে

আলোচনা ফলপ্রসূ, বার্তা দিলেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব

আলোচনা ফলপ্রসূ, বার্তা দিলেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব

বন্যহাতির অত্যাচারে অতিষ্ঠ পাহাড়িবাসী

বন্যহাতির অত্যাচারে অতিষ্ঠ পাহাড়িবাসী

মাদক সেবনের ভিডিও ধারণ করায় যুবককে কুপিয়ে যখম

মাদক সেবনের ভিডিও ধারণ করায় যুবককে কুপিয়ে যখম

চীনের সব পণ্যের উপর ২৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের খবর ‘বিভ্রান্তিকর’: হোয়াইট হাউস

চীনের সব পণ্যের উপর ২৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের খবর ‘বিভ্রান্তিকর’: হোয়াইট হাউস

টঙ্গীবাড়ীত বজ্রপাতে ১ কিশোর নিহত, আহত ৩

টঙ্গীবাড়ীত বজ্রপাতে ১ কিশোর নিহত, আহত ৩

খুলনায় অপহৃত স্কুল ছাত্রী উদ্ধার

খুলনায় অপহৃত স্কুল ছাত্রী উদ্ধার

চীনের বিরল মৃত্তিকা রপ্তানি বিধি-নিষেধ কেন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ধাক্কা?

চীনের বিরল মৃত্তিকা রপ্তানি বিধি-নিষেধ কেন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ধাক্কা?