থ্যালাসেমিয়া জন্মগত রক্ত রোগ
২৬ জুলাই ২০২৪, ১২:০৮ এএম | আপডেট: ২৬ জুলাই ২০২৪, ১২:০৮ এএম
থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রক্তস্বল্পতাজনিত রোগ। এটি কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। রক্তের ক্যানসারও নয়। এটি প্রতিরোধযোগ্য। থ্যালাসেমিয়ার বাহক আর থ্যালাসেমিয়ার রোগী এক নয়।
একজন থ্যালাসেমিয়ার বাহক স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠে। তাই কেউ থ্যালাসেমিয়ার বাহক কি না, তা বাহ্যিকভাবে বোঝার কোনো উপায় নেই। তবে থ্যালাসেমিয়ার রোগী জন্মের ছয় মাস বয়স থেকে ফ্যাকাসে হয়ে যায়। শরীর হলুদ হয়ে যায়, ঘন ঘন রক্ত নিতে হয়। পেটের প্লীহা ও লিভার বড় হয়ে যায়। ঠিকমতো শরীরের বৃদ্ধি হয় না। বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়ার বাহক রয়েছে ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। এই বাহকদের মধ্যে পুরুষ ১১ দশমিক ৯ শতাংশ ও মহিলা ১১ দশমিক দুই শতাংশ। ২০২৪ সালে বাংলাদেশের জরিপে সারাদেশের ৮ হাজার ৬৮০ জনের রক্ত পরীক্ষা করা হয়। এদের মধ্যে থ্যালাসেমিয়া বহন করছে ১১ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ, হেপাটাইটিস বি ১ দশমিক ২ শতাংশ ও হেপাটাইটিস সি ০ দশমিক শুন্য ৫ শতাংশ।
এছাড়া এই বাহকদের মধ্যে ১৪ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের ১১ দশমিক ৯ শতাংশ, ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ১২ শতাংশ, ২৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ১০ দশমিক তিন শতাংশ ও ৩০ থেকে ৩৫ বছর বয়সীদের মধ্যে ১১ দশমিক তিন শতাংশ।
বিয়ের আগে থ্যালাসেমিয়া নির্ণয় জরুরী: এই জরিপে উঠে আসে রংপুর বিভাগে সবচেয়ে বেশি থ্যালাসেমিয়া বহনকারী পাওয়া যায়। রংপুরে ২৭ দশমিক ৭০ শতাংশ। এর পরের অবস্থানে আছে রাজশাহীতে ১১ দশমিক ৩০ শতাংশ ও চট্টগ্রামে ১১ দশমিক ২০ শতাংশ। এছাড়া অন্যান্য বিভাগের মধ্যে বরিশালে ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ, ঢাকায় ৮ দশমিক ৬০ শতাংশ, খুলনায় ৮ দশমিক ৬০ শতাংশ, ময়মনসিংহে ৯ দশমিক ৮০ শতাংশ ও সিলেটে ৪ দশমিক ৮০ শতাংশ।
> থ্যালাসেমিয়া কী:
১৯২৫ সালে আমেরিকার টমাস কুলি ও পারোল লি এই রোগটি চিহ্নিত করেন। গ্রিক শব্দ ‘থালসা’ আর ইংরেজি শব্দ রক্তাল্পতা সহযোগে থ্যালাসেমিয়া শব্দটি তৈরি। ‘থালসা ’ অর্থ ভূমধ্যসাগরীয় এবং এ্যানিমিয়া অর্থ ‘রক্তাল্পতা’। ভূমধ্যসাগরের আশেপাশের দেশগুলোতে প্রথম এ রোগ আবিষ্কার হয় বলে এর নামকরণ হয় থ্যালাসেমিয়া। ভূমধ্যসাগর ছাড়া আফ্রিকা এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও থ্যালাসেমিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।
> কারণঃ- ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন জীনের কারণে থ্যালাসেমিয়া হয়। ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন জীন হিমোগ্লোবিনের গ্লোবিন অংশে ত্রুটি সৃষ্টি করে। ফলে লোহিত রক্তকণিকার আয়ু স্বাভাবিক ১২০ দিন থেকে কমে মাত্র ২০-৬০ দিনে নেমে আসে। অপরিপক্ক লোহিত রক্তকণিকার দ্রুত ভাঙনের কারনে রক্তস্বল্পতা দেখা যায়। বাবা অথবা মা, অথবা বাবা-মা উভয়েরই থ্যালাসেমিয়ার ত্রুটিপূর্ণ জীন থাকলে বংশানুক্রমে এটি সন্তানের মধ্যে ছড়ায়। বাবা-মা দুজনই যদি থ্যালাসেমিয়ার বাহক হন, তাহলে শিশুর থ্যালাসেমিয়া নিয়ে ভূমিষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা ২৫%, বাহক শিশু জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা ৫০% আর সুস্থ শিশু জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা ২৫%। ভাই-বোনের (চাচাতো, মামাতো, খালাতো, ফুফাতো) মধ্যে বিয়ে হলে এবং পরিবারে কারো থ্যালাসেমিয়া থাকলে সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত বা বাহক হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।
> প্রকার: থ্যালাসেমিয়া প্রধানত ২ ধরনের। যথা- আলফা এবং বিটা থ্যালাসেমিয়া। ত্রুটিপূর্ণ আলফা গ্লোবিন চেইন উৎপাদনকারী জীনের ত্রুটির দরুণ আলফা থ্যালাসেমিয়া এবং ত্রুটিপূর্ণ বিটা গ্লোবিন চেইন উৎপাদনকারী জীনের ত্রুটির দরুণ বিটা থ্যালাসেমিয়া হয়। আলফা থ্যালাসেমিয়া আবার আলফা থ্যালাসেমিয়া মেজর (হাইড্রপস ফিটালিস) ও আলফা থ্যালাসেমিয়া মাইনর (হিমোগ্লোবিন-এইচ ডিজিজ/আলফা থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট) এ ২ রকম হতে পারে। যেখানে প্রথমটি অনেক মারাত্মক। বিটা থ্যালাসেমিয়া অনুরূপভাবে বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজর (কুলি’স এনিমিয়া) ও বিটা থ্যালাসেমিয়া মাইনর (ট্রেইট) ২ রকম হতে পারে। এক্ষেত্রেও প্রথমটিই বেশি মারাত্মক। থ্যালাসেমিয়া বিভিন্ন হিমোগ্লোবিনোপ্যাথির সাথে একইসাথে সহাবস্থান করতে পারে। এদের মধ্যে আমাদের দেশে প্রধানত হিমোগ্লোবিন-ই বিটা থ্যালাসেমিয়া পাওয়া যায়। সামগ্রিকভাবে বিটা থ্যালাসেমিয়া, আলফা থ্যালাসেমিয়া অপেক্ষা বেশি তীব্র ও মারাত্মক।
> লক্ষণ: বিটা থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে জন্মের ২-৩ বছরের মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ পায়।।
- ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া ও জন্ডিস- থ্যালাসেমিয়া রোগের কারণে রক্তকণিকা ভেঙ্গে গিয়ে শিশুদের জন্ডিস হতে পারে এবং তাদের ত্বক ফ্যাকাশে দেখায়।
- থ্যালাসেমিয়া হলে অনেক বেশি পরিমাণে তন্দ্রা লেগে থাকা ও ক্লান্তি দেখা দিতে পারে।
- থ্যালাসেমিয়ার কারণে বুকে ব্যথা হতে পারে।
- হাত পা ঠন্ডা হয়ে যাওয়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- থ্যালাসেমিয়ার কারণে পায়ে ক্রাম্প হতে পারে।
- থ্যালাসেমিয়া হলে হৃদস্পন্দন বেড়ে যেতে পারে।
- অনেক সময় থ্যালাসেমিয়া হলে শিশুরা আর খেতে চায় না বা খাবারে অনীহা দেখা দিতে পারে।
- থ্যালাসেমিয়ার কারণে শিশুদের বৃদ্ধিতে বিলম্ব দেখা দিতে পারে বা শিশুরা ঠিক মতো বেড়ে ওঠে না।
- অনেক সময় মাথাব্যথা দেখা দিতে পারে।
- মাথা ঘোরা ও অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- ইনফেকশন বা সংক্রমণে সহজেই প্রভাবিত হওয়া এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।
> প্রতিরোধের উপায়ঃ-
একটু সচেতন হলেই আমরা এ রোগ প্রতিরোধ করতে পারি। বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রী বা বাচ্চা নেওয়ার আগে স্বামী-স্ত্রী থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক কি না তা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। দুজন বাহক বিয়ে করবে না। আর দুর্ঘটনা ক্রমে বিয়ে হয়ে গেলেও বাচ্চা নেয়ার আগেই ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন। সুস্থ বাচ্চা পেটে আসলেই কেবল সেটি কন্টিনিউ করবেন, অন্যথায় গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
পৃথিবীর অনেক দেশে, যেমন-সাইপ্রাস ১৯৭৩ সালে, বাহরাইন ১৯৮৫, ইরান ২০০৪, সৌদি আরব ২০০৪ এবং সর্বশেষ পাকিস্তান ২০১৩ সালে বিয়ের আগে পাত্র-পাত্রীর বা বাচ্চা নেওয়ার আগে স্বামী-স্ত্রীর থ্যালাসেমিয়া আছে কি না তা পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করে থ্যালাসেমিয়া রোগকে নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। যে কেউ থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হতে পারে। রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে সহজেই জানা যায় কেউ থ্যালাসেমিয়ার বাহক কি না। বাবা ও মা দুজনেই থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক হলেই কেবল সন্তানের থ্যালাসেমিয়া রোগ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। একজন বাহক এবং অপরজন সুস্থ এমন দুজনের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক হলে সন্তানদের রোগটি হবে না।
> হিমোগ্লোবিনের মান ঠিক রাখার ঘরোয়া পরামর্শঃ-
* ফলিক অ্যাসিডঃ-ফলিক অ্যাসিড এক প্রকার ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স। লাল রক্তকণিকা তৈরিতে এটি প্রয়োজনীয় উপাদান। সবুজ পাতাযুক্ত সবজি, কলিজা, ভাত, শিমের বিচি, বাদাম, কলা, ব্রোকলিতে প্রচুর ফলিক অ্যাসিড পাওয়া যায়।
* বেশীর ভাগ রুগীরই বার বার রক্ত ভেঙ্গে যাওয়ার কারনে শরীরে প্রচুর পরিমান আয়রন জমা হয়, এর বিষক্রিয়া থেকে বাঁচতে তা বের করার জন্য আবার চিলেশনের ওষুধ নিতে হয়।
> থ্যালাসিমিয়ার চিকিৎসা:-
মাইনর থ্যালাসেমিয়াতে লোহিত কণিকা ততটা ভাঙে না, তাই সাধারণত কোন চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। মেজর থ্যালাসেমিয়াতে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন একটি কার্যকর চিকিৎসা। অন্যথায় নিয়মিত রক্ত সঞ্চালন করাতে হয়। বারবার রক্ত নেওয়ার একটি বিপজ্জনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো বিভিন্ন প্রত্যঙ্গে অতিরিক্ত লৌহ জমে যাওয়া। এর ফলে যকৃৎ ও প্লিহা বড় হয়ে যায়, হৃদপিন্ড, মস্তিস্ক, অগ্নাশয় ঠিকমত কাজ করতে পারে না। এগুলো বিকল হয়ে রোগী মারাও যেতে পারে। এ ধরনের জটিলতা প্রতিরোধে আয়রন চিলেশন থেরাপি দেওয়া হয়, অতিরিক্ত লৌহ বের করে দেওয়ার জন্য।
পরিশেষে বলতে চাই, এই রোগ থেকে বাঁচতে সচেতনতা প্রয়োজন। ব্যক্তিগত, সামাজিক, সরকারি, বেসরকারি সব দিক থেকে গণমাধ্যম (জাতীয় ও স্থানীয় টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্র), সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, লিফলেট, সেমিনারসহ বিভিন্ন মাধ্যমে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করতে হবে। এইজন্যই আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগ ও সচেতনতাই পারে থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ করতে।
মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
চিকিৎসক, কলাম লেখক ও গবেষক
মোবাইল : ০১৮২২-৮৬৯৩৮৯
ইমেইলঃ [email protected]
বিভাগ : স্বাস্থ্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
কলকাতায় বাংলাদেশ উপ হাইকমিশনের নিরাপত্তা জোরদার
‘সাইবার মানডে’ উপলক্ষে ওয়েব হোস্টিংয়ে লিমডা হোস্টে চলছে ৬০% পর্যন্ত ছাড়!
ঢাকায় আসছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রী
ফ্যাসিস্ট সরকারের ৮ বছরের নিষেধাজ্ঞার পর অবশেষে মঞ্চে আসছে থিয়েট্রিক্যাল বাহাস ও কন্ঠনালীতে সূর্য
মিলেছে ‘হারিছ চৌধুরী’র ডিএনএ, রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের নির্দেশ
নাম পরিবর্তনের দাবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের
গলায় ফাঁস দিয়ে বৃদ্ধের আত্মহত্যা
আইএসের নৃশংসতার বিচারে জাতিসংঘ ব্যর্থ : নাদিয়া মুরাদ
নোয়াখালীর সুবর্ণচরে ইসকন নিষিদ্ধের দাবিতে হেফাজতের মানববন্ধন
মানিকগঞ্জে হাঙ্গার প্রজেক্টের গণতন্ত্র অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত
এবার ভারতের মালদহে বাংলাদেশিদের জন্য হোটেল ভাড়া বন্ধ ঘোষণা
কিশোরগঞ্জের হাওর-অর্থনীতি বেগবান করতে চলছে কয়েকশ কোটি টাকার প্রকল্প
প্লাস্টিক ব্যবহার রোধে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে: অতিরিক্ত সচিব ফাহমিদা খানম
দেশের ৬৯ কারাগারের ১৯টি ঝুঁকিপূর্ণ, ৭০ জঙ্গিসহ ৭০০ বন্দি এখনো পলাতক
পায়রার রাজস্ব আয় বাড়বে তিনগুণ, দেশের অর্থনীতিতে রাখবে বড় ভূমিকা
মমতা ব্যানার্জির মনে গভীর কট্টরপন্থি হিন্দুত্ববাদ : রিজভী
কঠিন সময় পার করছে বাংলাদেশ : প্রধান উপদেষ্টা
কুড়িগ্রামে সাবেক এমপি পুত্র সবুজ গ্রেফতার
ভারতে ৫.৩ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প
অমৃতসরে স্বর্ণ মন্দিরে পাঞ্জাবের সাবেক উপমুখ্যমন্ত্রী সুখবীর সিং বাদালের ওপর গুলিবর্ষণ