ঢাকা   শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪ | ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

নৈতিকতা বনাম বৈরাগ্য

Daily Inqilab এ.কে.এম. ফজলুর রহমান মুন্শী

৩১ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০২ এএম | আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০২৪, ১২:০২ এএম

আদর্শ নৈতিকতা মূলত মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের মাঝে মহৎ উদ্দেশ্য পোষণ করা এবং পরস্পরের প্রতি সদাচরণ প্রদর্শন করার নাম। অন্যভাবে বলা যায় যে, পরস্পরের উপর যে মানবিক অপরিহার্য দায়িত্ব ও কর্তব্য আরোপিত আছে সে নির্দেশাবলি, দায়িত্ব ও কর্তব্য আদায় করাকেই নৈতিকতা বলে।

নৈতিকতার এই বিশেষত্বটি খুবই সুস্পষ্ট যে, নৈতিকতার অস্তিত্বের জন্য মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও সম্মিলনের উপস্থিতি একান্ত আবশ্যক, যা বৈরাগ্য, নিভৃত জীবনযাত্রা ও যোগীপনার মাঝে পাওয়া যায় না। এজন্য নির্জন প্রকোষ্ঠ বাস, সৃষ্টিজগতের প্রতি নিস্পৃহতা, দল থেকে বিচ্যুতি, পরিবার-পরিজন, প্রতিবেশী এবং বন্ধু-বান্ধবদের সম্পর্ক ছিন্নকরণ ইত্যাদি আচরণের দ্বারা নৈতিকতা বিকাশের পথকে রুদ্ধ করে দেয়া হয়। কিংবা নৈতিকতা বিকাশের সুযোগ বিনষ্ট করা হয়। এই উৎকট সমস্যা সম্পর্কে পর্যালোচনার প্রয়োজনীয়তা এজন্য যে, সৃষ্টিজগৎ হতে সম্পর্কচ্ছেদ করা এবং নিভৃতবাস এককালে ধর্মীয় উত্তম পুণ্যকর্ম ও দ্বীনদারীর সুন্দরতম ব্যবস্থা বলে স্বীকৃত হয়েছিল। ইসলামের আগমনের পূর্বে খৃস্টান পাদ্রী ও হিন্দু যোগীরা এই নীতির উপরই নিজেদের জীবন অতিবাহিত করত।

এই শ্রেণির জীবনযাত্রাকে তারা নিজেরা এবং অনুসারীরাও সর্বশ্রেষ্ঠ পুণ্যকর্ম বলে অভিহিত করত। কিন্তু মূলত, এই শ্রেণির ধর্মানুরাগী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বেশির ভাগ পর্দারন্তরালে বাস করাকে এজন্য এখতিয়ার করেছিল যে, একদিকে তারা নিজেদেরকে জনসাধারণের দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে রেখে রাজা-বাদশাহদের মতো নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করতে প্রয়াস পেত। অপরদিকে তারা নিজেদের জিন্দেগীকে পর্দারন্তরালে রেখে মিথ্যা পবিত্রতা এবং মিথ্যা দ্বীনদারীর ঢং দাঁড় করাতে চেষ্টা করত।

শেষত, তারা নিজেদের নিভৃতবাসের মিথ্যা আজগুবী ওজরহেতু কারোও সমালোচনার নিশানা না হয়ে পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব, নিকটাত্মীয় এমন কি দেশ ও সম্প্রদায়ের প্রতি দায়িত্ব এবং কর্তব্যসমূহ সম্পাদনের কষ্ট থেকে দূরে সরে থাকত। এজন্য ইসলাম স্বীয় নৈতিক নিময়-নীতির মাঝে বৈরাগ্য, সংসার ত্যাগ, অজ্ঞাত অবস্থান ইত্যাদির প্রতি চরম কুঠারাঘাত করেছে এবং এসব মানবতাবিরোধী লোকাচার বর্জন করার জন্য কঠোর নির্দেশ জারী করেছে।

রাসূলেপাক (সা.) নবুয়ত লাভ করার পর দীর্ঘ তেইশটি বছর নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যদিয়ে মানব সমাজেই বসবাস করেছেন এবং মানবিক যাবতীয় কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছেন। এর জন্য যা কিছু পরিশ্রম ও সাধনা করা দরকার তা তিনি পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত করেছেন। এই জীবন পদ্ধতিই খোলাফায়ে রাশেদীন ও ছাহাবায়ে কেরামের মাঝে বিদ্যমান ছিল। এমনকি ষোলআনা কুরআনে এই মানবিক চেষ্টা, সাধনা এবং বৃহত্তর মানবমণ্ডলীর সাথে সদাচরণের শিক্ষা ভরপুর রয়েছে। নির্জনতা অবলম্বন, সংসার পরিত্যাগ, দেয়ালে ঘেরা জীবনযাত্রা, কাজকর্ম পরিত্যাগ এবং সংসার বর্জনের সামান্যতম ইঙ্গিতও কুরআনে নেই।

একথা অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, দল বা জামাতের দায়িত্ব ও অধিকার পালন করা কেবল মাত্র জামাতের সাথে সম্পৃক্ত থেকেই সম্ভব। দূরে সরে গিয়ে তা সম্ভব নয়। ওইসব লোক যারা জনপদ থেকে বহুদূরে বনে জঙ্গলে অবস্থান করে এবং একান্ত নির্জন বাস অবলম্বন করে তারা কি সমষ্টিগত গণমানুষের অসুবিধা দূরীকরণ ও প্রয়োজন পূরণে সক্ষম? তারা কি বৃহত্তম জনগোষ্ঠির নৈতিক দিকগুলোর হক ও অধিকার আদায় করতে পারে? তারা কি কখনো আশ্রয়স্থল হতে পারে? তারা কি আল্লাহর সৃষ্টিজগতের কোন সেবা করতে সক্ষম? তারা কি জিহাদের মত জীবনসংগ্রামের দায়িত্ব পালন করতে পারে? অথচ এগুলোই হচ্ছে নৈতিক এবাদত-বন্দেগীর উত্তম পন্থা। এজন্যই ইসলামের দৃষ্টিতে মুক্তি প্রত্যাশার পদ্ধতি বৈরাগ্যের মাঝে পাওয়া যায় না।

এ কারণে আল কুরআনে ঘোষণা করা হয়েছে : ‘তোমরা নিজেদেরকে এবং পরিবার-পরিজনদেরকে দোযখের আগুন থেকে বাঁচাও।’ মানুষের দায়িত্ব কেবল নিজেকেই দোযখের আগুন থেকে বাঁচানো, নয়, বরং একই সাথে অন্যদেরকেও বাঁচাতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) সুস্পষ্টভাবে সব মুসলমানকে লক্ষ্য করে বলেছেন : তোমরা সবাই-ই অভিভাবক এবং তোমাদের সবাইকে নিজ নিজ অভিভাবকত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে। সুতরাং এই দায়িত্ব ও কর্তব্যের হাত থেকে কারোও নিস্তার মিলবে না।

সামগ্রিক মুসিবত যখন আসে তখন নির্জন প্রকোষ্ঠে বসবাসকারীকেও ছেড়ে দেয় না। এই আগুন বাহির ও ভিতর সবকিছুকেই জ্বালিয়ে ছাই করে দেয়। এর প্রভাব গুনাহগার ও বেগুনাহ সবাইকে পরিবেষ্টন করে ফেলে। নির্জনবাস অবলম্বনকারীরা তাবলীগের দায়িত্বকে পালন করতে পারে না এবং দলবদ্ধ লোকও পথ নির্দেশনার অভাবে অন্যায় কাজ থেকে বেঁচে থাকতে পারে না। ফলে উভয় শ্রেণিই অপরাধী বলে সাব্যস্ত হয়। কেউই অপরাধ মুক্ত হয় না। এই দুনিয়া মূলত চেষ্টা-সাধনা ধর-পাকড়ের একটি ময়দান। যেখানে সকল মানুষ পরস্পর সাহায্য-সহানুভূতি ও সমঝোতার মাধ্যমে নিজ নিজ পথ অতিক্রম করে। চলার পথে সব মানুষের সাথে যেতে গেলে বেশকিছু দু:খ-কষ্ট দেখা দেয়া স্বাভাবিক।

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : ওই মুসলমান যে মানুষের সাথে মিলেমিশে থাকে এবং তাদের দেয়া দুঃখ-কষ্টকে ধৈর্য সহকারে বরণ করে নেয় সে ওই ব্যক্তি থেকে উত্তম, যে মানুষের সাথে মিশে না এবং তাদের দেয়া দুঃখ-কষ্টকে ধৈর্যেরী সাথে বরণ করে না। এজন্য ইসলাম বৈরাগ্য প্রথাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং এটাকে ঘৃণিত ও পরিত্যাজ্য বলে সাব্যস্ত করেছে।


বিভাগ : শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ ইসলাম


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বড়কে মান্য করুন, বৃদ্ধকে সম্মান করুন-১
সন্তানদের কিসের উপর রেখে যাচ্ছি-২
সন্তানদের কিসের উপর রেখে যাচ্ছি-১
কে অন্ধ, কে চক্ষুষ্মান
সে-ই স্বাধীন যে সিজদা করে এক আল্লাহকে
আরও

আরও পড়ুন

বল হাতে বাংলাদেশের ভালো শুরু

বল হাতে বাংলাদেশের ভালো শুরু

বেনাপোল দিয়ে যাত্রী পারাপার কমেছে অর্ধেক, রাজস্ব আয় ও ব্যবসা বাণিজ্যে ধস

বেনাপোল দিয়ে যাত্রী পারাপার কমেছে অর্ধেক, রাজস্ব আয় ও ব্যবসা বাণিজ্যে ধস

'জুলাই অনির্বাণ’ এ রক্তপিপাসু হাসিনার নির্মমতা দেখে কাঁদছেন নেটিজেনরা

'জুলাই অনির্বাণ’ এ রক্তপিপাসু হাসিনার নির্মমতা দেখে কাঁদছেন নেটিজেনরা

অবশেষে ২৬ মামলার আসামি কুমিল্লার শীর্ষ সন্ত্রাসী আল-আমিন গ্রেফতার

অবশেষে ২৬ মামলার আসামি কুমিল্লার শীর্ষ সন্ত্রাসী আল-আমিন গ্রেফতার

তারেক রহমানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে সিয়ামের বাড়িতে মীর হেলাল

তারেক রহমানের আর্থিক সহায়তা নিয়ে সিয়ামের বাড়িতে মীর হেলাল

মানবপাচারকারীদের প্ররোচনায় : স্বপ্ন পূরণে হাতছানি!

মানবপাচারকারীদের প্ররোচনায় : স্বপ্ন পূরণে হাতছানি!

অবিলম্বে ফারাবিসহ সকল মাজলুম আলেমদের মুক্তি দিন, বিক্ষোভ সমাবেশে নেতৃবৃন্দ

অবিলম্বে ফারাবিসহ সকল মাজলুম আলেমদের মুক্তি দিন, বিক্ষোভ সমাবেশে নেতৃবৃন্দ

জগন্নাথের সহকারী প্রক্টরকে গুলি করে হত্যার হুমকির অভিযোগ

জগন্নাথের সহকারী প্রক্টরকে গুলি করে হত্যার হুমকির অভিযোগ

আপনারা এখন কোথায়: আ.লীগকে জামায়াত নেতা

আপনারা এখন কোথায়: আ.লীগকে জামায়াত নেতা

আনন্দে গুলি ছুড়তে গিয়ে নিজেই গুলিবিদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যু ভারতীয় শিক্ষার্থীর

আনন্দে গুলি ছুড়তে গিয়ে নিজেই গুলিবিদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যু ভারতীয় শিক্ষার্থীর

বিশ্বস্ত পাম বন্ডিকে অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে বেছে নিলেন ট্রাম্প

বিশ্বস্ত পাম বন্ডিকে অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে বেছে নিলেন ট্রাম্প

জনসমর্থন হারাচ্ছে জার্মানির ক্ষমতাসীন দল

জনসমর্থন হারাচ্ছে জার্মানির ক্ষমতাসীন দল

ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামে আহত, নিহত ও কারা নির্যাতিত নেতাকর্মীদের পাশে বিএনপি'র সব সময় থাকবে!

ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামে আহত, নিহত ও কারা নির্যাতিত নেতাকর্মীদের পাশে বিএনপি'র সব সময় থাকবে!

বিপ্লবী সরকারের উপদেষ্টা হবেন বিপ্লবী, তাদের চেতনা থাকবে গতিশীল: রিজভী

বিপ্লবী সরকারের উপদেষ্টা হবেন বিপ্লবী, তাদের চেতনা থাকবে গতিশীল: রিজভী

আয়ারল্যান্ড নারী ক্রিকেট দল এখন ঢাকায়

আয়ারল্যান্ড নারী ক্রিকেট দল এখন ঢাকায়

‘আন্তর্জাতিক আদালতের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাবে কানাডা’

‘আন্তর্জাতিক আদালতের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাবে কানাডা’

সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানাকে আধুনিকায়ন করা হবে- রেলপথ উপদেষ্টা

সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানাকে আধুনিকায়ন করা হবে- রেলপথ উপদেষ্টা

দেড় যুগ পর গোলাপগঞ্জে প্রকাশ্যে জামায়াতের কর্মী সম্মেলনে জনতার ঢল

দেড় যুগ পর গোলাপগঞ্জে প্রকাশ্যে জামায়াতের কর্মী সম্মেলনে জনতার ঢল

উইন্ডিজকে ব্যাটিংয়ে পাঠাল বাংলাদেশ

উইন্ডিজকে ব্যাটিংয়ে পাঠাল বাংলাদেশ

ভাইরাল ভিডিওতে কটাক্ষের শিকার সামান্থা

ভাইরাল ভিডিওতে কটাক্ষের শিকার সামান্থা