কর্ণফুলীর তলদেশে উদ্বোধনের জন্য প্রস্তুত বঙ্গবন্ধু টানেল যোগাযোগ দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ কর্মসংস্থান পর্যটন শিল্পায়নে আসবে নতুন গতি

খুলছে সম্ভাবনার দ্বার

Daily Inqilab রফিকুল ইসলাম সেলিম

০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০২ এএম | আপডেট: ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০৪ এএম

প্রস্তুত স্বপ্নের টানেল। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে চলবে গাড়ি। স্বপ্ন এখন বাস্তব। উদ্বোধনের জন্য পুরোপুরি তৈরি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। দেশের প্রথম এই টানেলের সাথে খুলে যাবে অর্থনীতিতে সম্ভাবনার দ্বার। বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ এ অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান সেই সাথে পর্যটন, নগরায়ন, শিল্পায়নে আসবে নতুন গতি।
আগামী অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় এ সুড়ঙ্গ পথের দ্বার উন্মোচন করবেন। টানেলের মাধ্যমে কর্ণফুলী নদীর দুইপাড়ে চীনের সাংহাইয়ের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ বাস্তবায়ন হবে। এ সুড়ঙ্গ পথের মাধ্যমে কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে নির্মাণাধীন গভীর সমুদ্র বন্দরের সাথে দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি চট্টগ্রাম বন্দরের সংযোগ তৈরি হবে। বে-টার্মিনাল এবং সেই সাথে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক হয়ে মীরসরাইতে গড়েওঠা দেশের সবচাইতে বড় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরের সাথে সংযোগ তৈরি হবে।
টানেলকে ঘিরে নদীর ওপাড়ে আনোয়ারায় গড়ে উঠছে একাধিক অর্থনৈতিক জোন। সেখানে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে ব্যাপকহারে শিল্প কারখানা গড়ে উঠছে। হোটেল-মোটেল, বাণিজ্যিক ভবনসহ নগরায়ন হচ্ছে দ্রুতগতিতে। এর ফলে এ সুড়ঙ্গ পথ দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। সহজ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বৃদ্ধি পাবে রফতানি। ফলে দারিদ্র্য দূরীকরণসহ দেশের ব্যাপক আর্থ সামাজিক উন্নয়ন সাধিত হবে। জিডিপিতেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বিগত ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে চট্টগ্রামের উন্নয়নে একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একের পর এক এসব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামবাসীর বহুল প্রতীক্ষিত বঙ্গবন্ধু টানেল এখন বাস্তব এবং দৃশ্যমান। আগামী নির্বাচনের আগে একাধিক মেগা প্রকল্প উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। কর্ণফুলী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল তার অন্যতম। ওইদিন প্রধানমন্ত্রী টানেল প্রান্তে এক সুধী সমাবেশে ভাষণ দেয়ারও কথা রয়েছে।
ইতোমধ্যে টানেল নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ করা হয়েছে। টানেলের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশীদ গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, মূল টানেলের কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। আনুষাঙ্গিক সামান্য কিছু কাজ বাকি থাকলেও যানবাহন চলাচলের জন্য টানেল এখন পুরোপুরি প্রস্তুত। সেপ্টেম্বরের আগেই প্রকল্প কাজ শেষ করার টার্গেট ছিল আমাদের। আমরা তা করতে পেরেছি। তবে কিছু কাজ এখনো চলছে। এটা পুরোপুরি শেষ হতে ডিসেম্বর পর্যন্ত লাগবে। অক্টোবরে উদ্বোধনের পর যথারীতি যান চলাচল শুরু হবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, নদীর তলদেশে দুই সড়ক সুড়ঙ্গপথ, অ্যাপ্রোচ রোড নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। ক্রস প্যাসেজ ও টোল প্লাজার নির্মাণ করা হয়েছে। টানেলের যান্ত্রিক, বৈদ্যুতিক এবং সিভিল ওয়ার্কও শেষ হয়েছে। তবে পতেঙ্গাপ্রান্ত ও আনোয়ারা প্রান্তের সংযোগ সড়কসহ আনুষাঙ্গিক সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ পুরোপুরি শেষ হয়নি। আনোয়ারা প্রান্তে একটি ফ্লাইওভারসহ টানেল সংলগ্ন ছয় লেনের মধ্যে চার লেনের কাজ শেষ হয়েছে। তবে আনোয়ারা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক চার লেনের কাজ এখনো শুরু হয়নি। এর ফলে টানেলের পুরোপুরি সুফল পাওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে। যদিও সড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, সংযোগ সড়ক দ্রুত ছয় লেন করা হচ্ছে। আর চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ছয় লেন করার কাজও খুব শিগগির শুরু করা যাবে।
এদিকে পতেঙ্গা প্রান্তে সংযোগ সড়ক, ইউটার্ন নির্মাণসহ কিছু কাজ বাকি রয়েছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, পতেঙ্গা প্রান্তে ৮০ ভাগ কাজ শেষ করা হয়েছে। চলতি মাসে বাকি কাজ শেষ হলে টানেল চালুর পর যানবাহন চলাচলে কোন সমস্যা হবে না। টানেলের পুরোপুরি সফল পেতে পতেঙ্গা প্রান্তে আউটার রিং রোডকে ঘিরে ৬১৮ কোটি টাকার আরও একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, শিগগির এ প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে আগামী দিনগুলোতে আউটার রিং রোড ও ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজট হবে না। টানেল চালুর আগেই যানবাহনের চাপ সামাল দিতে সিটি আউটার রিং রোডের ফিডার রোড এবং বিমানবন্দর থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত নির্মাণাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালুর প্রস্তুতি চলছে বলে জানান তিনি।
এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে টানেল প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে। নির্মাণ কাজ করছে চীনা কোম্পানি ‘চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন লিমিটেড’। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি জিন পিং যৌথভাবে বঙ্গবন্ধু টানেলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রথম টানেল টিউব নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেন।
প্রকল্পের তথ্যানুযায়ী, ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই টানেলে প্রতিটি টিউব বা সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। একটির সঙ্গে অপর টিউবের দূরত্ব ১২ মিটারের মত। প্রতিটি টিউবে দুটি করে মোট চারটি লেইন তৈরি করা হয়েছে। টানেলের পূর্ব ও পশ্চিম ও প্রান্তে থাকছে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক। এছাড়া ৭২৭ মিটার দৈর্ঘ্যরে একটি ফ্লাইওভার রয়েছে আনোয়ারা প্রান্তে।
নগরীর পতেঙ্গায় নেভাল একাডেমির পাশ দিয়ে ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরতায় নেমে যাওয়া এই টানেল কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ-পূর্বে সিইউএফএল ও কাফকোর মাঝামাঝি এলাকা দিয়ে স্থলপথে বের হয়েছে। ৩৫ ফুট প্রশস্ত ও ১৬ ফুট উচ্চতার টানেলে দুটি টিউব দিয়ে যানবাহন চলাচল করবে। টানেলের উত্তরে নগরীর দিকে আউটার রিং রোড, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কাটগড় সড়ক, বিমানবন্দর সড়ক এবং পতেঙ্গা সৈকত সড়ক দিয়ে টানেলে প্রবেশ করা যাবে।
টানেলটি প্রস্তাবিত এশিয়ান হাইওয়েকে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করবে এবং চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার কমিয়ে দেবে। এই টানেল দিয়ে ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার বেগে যানবাহন চলবে। চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, বে-টার্মিনাল এবং মাতারবাড়ির গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ ত্বরান্বিত করবে। মীরসরাই থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ পর্যন্ত উপকূলীয় মহাসড়ক নির্মাণের পরিকল্পনাও রয়েছে। টানেলের পর উপকূলীয় সড়ক নির্মিত হলে এ অঞ্চলে উন্নয়ন, বিনিয়োগ, শিল্পায়ন ও পর্যটনে নবদিগন্তের সূচনা হবে। বঙ্গবন্ধু টানেল দিয়ে যানবাহন চলাচলের জন্য টোল হারও চূড়ান্ত করেছে সেতু বিভাগ। সম্ভাব্যতা সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী টানেল চালু হওয়ার পর ২০২৫ সাল নাগাদ প্রতিদিন গড়ে ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে। ২০৩০ সালে যানবাহন চলাচলের প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি। আর ২০৬৭ সালে যানবাহনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রতিদিন গড়ে এক লাখ ৬২ হাজার। #


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

ব্যাংকিং সেবা খাতে এখনো ভারতীয় আধিপত্য

ব্যাংকিং সেবা খাতে এখনো ভারতীয় আধিপত্য

পরিষ্কার বার্তা চায় জনগণ

পরিষ্কার বার্তা চায় জনগণ

অবশেষে টিউলিপ সিদ্দিকের পদত্যাগ

অবশেষে টিউলিপ সিদ্দিকের পদত্যাগ

কারাগারে এস কে সুর

কারাগারে এস কে সুর

‘গ্রিনল্যান্ডকে সামরিক এলাকা বানাতে চান ট্রাম্প’

‘গ্রিনল্যান্ডকে সামরিক এলাকা বানাতে চান ট্রাম্প’

ছাত্রলীগ নেত্রী নিশি দুই দিনের রিমান্ডে

ছাত্রলীগ নেত্রী নিশি দুই দিনের রিমান্ডে

অভি খালাস! তাহলে খুনী কে?

অভি খালাস! তাহলে খুনী কে?

জল্পনা উড়াল চীনা সংস্থা টিকটক কিনছেন না মাস্ক

জল্পনা উড়াল চীনা সংস্থা টিকটক কিনছেন না মাস্ক

ধামরাইয়ে খাদ্যদ্রব্য তৈরির কারখানায় ফের আবার ডাকাতির চেষ্টা

ধামরাইয়ে খাদ্যদ্রব্য তৈরির কারখানায় ফের আবার ডাকাতির চেষ্টা

রাজউক জোনাল অফিস স্থানান্তর আদেশের প্রতিবাদে মানববন্ধন

রাজউক জোনাল অফিস স্থানান্তর আদেশের প্রতিবাদে মানববন্ধন

দ্বিতীয় দিনের মতো অনশনে অব্যাহতি পাওয়া এসআইরা

দ্বিতীয় দিনের মতো অনশনে অব্যাহতি পাওয়া এসআইরা

বন্ধ বেক্সিমকো খুলে দেয়ার দাবিতে শ্রমিকদের মানববন্ধন

বন্ধ বেক্সিমকো খুলে দেয়ার দাবিতে শ্রমিকদের মানববন্ধন

আধুনিক ডেটা ওয়্যারহাউজ স্থাপন করবে বিবিএস

আধুনিক ডেটা ওয়্যারহাউজ স্থাপন করবে বিবিএস

পরিবারসহ জ্যাকব ও ছেলেসহ সাবেক মন্ত্রী শাহাব উদ্দিনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

পরিবারসহ জ্যাকব ও ছেলেসহ সাবেক মন্ত্রী শাহাব উদ্দিনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

প্রিন্স মামুনের বিরুদ্ধে চার্জগঠন শুনানির নতুন তারিখ

প্রিন্স মামুনের বিরুদ্ধে চার্জগঠন শুনানির নতুন তারিখ

সামাজিক ও আচরণ পরিবর্তনের বিষয় পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্তির আহ্বান ইউজিসি’র

সামাজিক ও আচরণ পরিবর্তনের বিষয় পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্তির আহ্বান ইউজিসি’র

চুক্তিতে নিয়োগের দৌড়ে নওফেলের জালাল উদ্দিন চৌধুরী

চুক্তিতে নিয়োগের দৌড়ে নওফেলের জালাল উদ্দিন চৌধুরী

পুলিশের চাকরি হারিয়ে ছিনতাইয়ে নামেন হাকিম

পুলিশের চাকরি হারিয়ে ছিনতাইয়ে নামেন হাকিম

ভোটার তালিকা হালনাগাদে সহায়তা করবে ইউএনডিপি

ভোটার তালিকা হালনাগাদে সহায়তা করবে ইউএনডিপি

সাকরাইনে মেতেছে পুরান ঢাকা

সাকরাইনে মেতেছে পুরান ঢাকা