মানবসেবার গুরুত্ব ও ইসলামের অনুপ্রেরণা

Daily Inqilab মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

১৮ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৭ এএম | আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ১২:০৭ এএম

(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
মানবসেবা সর্বোত্তম আদর্শ ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত সর্বপ্রকার সেবাকাজের সর্বোত্তম আদর্শ ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্তের অধিকারী হলেন প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সা.। যে বৃদ্ধা নবীজিকে গালিগালাজ করেছে তার বোঝা রাহমাতুল্লিল আলামিন বহন করে গন্তব্যে পৌঁছে দেন, ফারুকে আযম হযরত ওমর বিন খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুকে দেখা যায় গমের বস্তা কাঁধে বহন করে অভাবীর ঘরে পৌঁছিয়ে দিচ্ছেন- এরকম অসংখ্য নজির মুসলমানের মধ্যে বিরাজমান। ইসলামে বলা হয়েছে আর্ত, দুঃখিনীর সেবায় যথাসম্ভব নিজেকে নিয়োজিত করতে। মহানবী সা. আমাদের জানিয়ে দিয়ে গেছেন কিভাবে জীবনে চলতে হবে। হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা. বলেছেন, রাসূল সা. জীবনে কখনো কোনো সাহায্যপ্রার্থীকে না বলেননি। মানবসেবাকে তিনি নিজের জীবনের ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। নবীজি সা. তাঁর মহৎ কার্যক্রমের মাধ্যমে সেই সময় আরব সমাজের সর্বস্তরের মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন। মক্কার জনসাধারণ তাকে উপাধি দিয়েছিল আল-আমিন যার অর্থ হলো বিশ্বাসী। নবীজি সা. ‘হিলফুল ফুজুল’ নামে একটি সংগঠন করে আর্তমানবতার সেবা, অসহায়দের সাহায্য-সহযোগিতা করে আরবের মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন। রাসূলের এই মানবসেবামূলক কাজ বিধর্মীদের কাছেও প্রশংসনীয় ছিল। রাসূল সা. ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা নিজে না খেয়ে গরিব-দুঃখীকে খাবার দিয়েছেন। অন্যকে সাহায্য করার জন্য নিজের প্রয়োজনকে ত্যাগ করে ছিলেন। জনসেবা ও খেদমতের মূর্ত প্রতীক ছিলেন রাসূলুল্লাহ সা.। সেবার এ গুণটি তাঁর মধ্যে নবুয়তপ্রাপ্তির আগেও বিদ্যমান ছিল। প্রথম ওহিপ্রাপ্ত হয়ে তিনি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়লেন এবং ঘটনা হযরত খাদিজাতুল কুবরা (রা.)-এর কাছে বর্ণনা করলেন। তখন তিনি নিম্নোক্ত বাণী দ্বারা নবী করিম সা.-কে সান্ত্বনা দিলেন। ‘আল্লাহর শপথ! আল্লাহ কখনো আপনাকে লাঞ্ছিত করবেন না। কেননা আপনি আত্মীয়ের প্রতি সদাচরণ করেন, অসহায় ব্যক্তির বোঝা বহন করেন, নিঃস্ব ব্যক্তির অন্ন-বস্ত্রের ব্যবস্থা করে দেন। মেহমানের আপ্যায়ন করেন এবং বিপদগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করেন।’

মানবসেবার পদ্ধতি বিভিন্নভাবে মানুষ একে অন্যের পাশে দাঁড়াতে পারে। যেমন, বিশেষ তহবিল গঠন করে দেশের দানবীর ও শুভাকাক্সক্ষীদের কাছ থেকে যাকাত, ওশর, ফেতরা, কোরবানির চামড়া ও ত্রাণসামগ্রী বা আপৎকালীন ব্যয় বাবদ অর্থ আদায় করে বিশেষ তহবিলে গঠন করে সহায়তা করা। ব্যক্তিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নিরক্ষর লোকদের অক্ষরজ্ঞান ও সহিহ-শুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত, জরুরি মাসায়েল শেখার ব্যবস্থা করা যায়। গ্রাম-গঞ্জের মানুষের সব সময় কাজ থাকে না। তাই এ রকম একটি মাস বেছে নিয়ে কোনো মসজিদে মাসব্যাপী এ ধরনের বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করা যায়। নিজেদের মধ্য থেকে অভিজ্ঞ কোনো দায়িত্বশীল ক্লাস নেবেন অথবা অন্য কোনো উপযুক্ত ব্যক্তিকে দিয়েও ক্লাস নেওয়া যেতে পারে। দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করে অসহায় রোগীদের মধ্যে ফ্রি চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা করা যেতে পারে। তাছাড়া রোগীদের দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করানোসহ চিকিৎসকরা ফ্রি-ফ্রাইডে ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সহজেই এ কাজ করতে পারেন। এমনকি বৃক্ষরোপণও একটি উত্তম সেবা ও সওয়াবের কাজ। রাস্তার পাশে ও পতিত জমিতে গাছ লাগিয়ে সৃষ্টিকুলের খেদমত করা যায়। আল্লাহর রাসূল সা. ইরশাদ করেন, ‘যদি কোনো মুসলমান একটি বৃক্ষ রোপণ করে অথবা শস্য জন্মায় অতঃপর তা থেকে কোনো মানুষ, পাখি বা পশু (ফল-ফসল) ভক্ষণ করে তাহলে সেটি তার জন্য সদকাস্বরূপ গণ্য হবে।

চলমান পরিস্থিতিতে মানবতার সেবায় করণীয় প্রাণঘাতী বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের প্রকোপে বিপর্যস্ত মানবতা। অধিকাংশ মানুষই অসহায় দারিদ্র্যপীড়িত। করোনার কারণে এ অসহায়ত্ব বেড়ে গেছে অনেকগুণ। কর্ম বন্ধ হওয়ায় সাধারণ মানুষের অভাবও বেড়ে গেছে। অভাবের তাড়নায় চিন্তিত অস্থির মানুষ স্বাভাবিক কাজ তথা জীবন-যাপনে গতি হারিয়ে ফেলেছে। মানবতার উপকারে আসে এমন চিন্তাভাবনাও লোপ পেয়েছে। বৈশ্বিক মহামারী করোনায় দুস্থ মানবতার সেবায় মানুষের রয়েছে অনেক করণীয়। প্রাণঘাতী মহামারী করোনায় এ মানবতাবোধের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। কারো প্রতিবেশী যদি পেটে ক্ষুধা নিয়ে রাত যাপন করে, কেউ যদি কোনো পথশিশুকে ক্ষুধার তাড়নায় কাতরাতে দেখে আর সে যদি ক্ষুধার্ত প্রতিবেশী কিংবা ক্ষুধার্ত পথশিশুর পাশে এসে না দাঁড়ায়, তাহলে বুঝতে হবে তার মাঝে মানবতার লেশমাত্রও নেই। যার মাঝে মানবতাবোধ আছে সে অবশ্যই অসহায় দুস্থ মানুষের পাশে এসে দাঁড়াবে। তার সামর্থ্য অনুযায়ী এগিয়ে আসবে সহযোগিতা করবে। আর এটাই মানবতার সেবা। আল্লাহ তায়ালা দুস্থ মানবতার সেবায় নিজেদের আত্মনিয়োগ করতে নসিহত পেশ করে বলেন- তারা আল্লাহর প্রেমে অভাবগ্রস্ত, এতিম ও বন্দীকে আহার্য দান করে। তারা বলে, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমরা তোমাদেরকে আহার্য দান করি এবং তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান ও কৃতজ্ঞতা কামনা করি না। এ আয়াতে আল্লাহ তায়ালা অসহায় ইয়াতিম মিসকিন এবং বন্দীদের খাবার দান করাকে মুমিনের অন্যতম গুণ বা বৈশিষ্ট্য হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। অসহায়দের পাশে না দাঁড়ানো, তাদের খোঁজ-খবর না রাখা, তাদের বিপদে এগিয়ে না আসা; এগুলো কোনো মুমিনের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। বরং মুমিনগণ দুস্থ মানবতার সেবায় সদা তৎপর। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের উদ্দেশে বলেন- মুমিন তারাই যারা অসাড় কাজ-কর্ম বা কথা-বার্তা থেকে বিরত থাকে এবং যারা জাকাত প্রদানে সক্রিয় হয়। এ আয়াতের সমর্থনে অন্য আয়াত দ্বারা দুস্থ মানবতার সেবায় সহযোগিতার খাত বিস্তারিত বর্ণনা করেন। তাতে উঠে এসেছে কারা পাবে এ সহযোগিতা। বর্তমান মহামারী করোনার প্রাদুর্ভাবের এ সময়ে যারা কাজ-কর্মহীন হয়ে বেকার জীবন-যাপন করছেন, জীবন-যাপনে নেই কোনো সহায় সম্বল তারাও দুস্থ ও অসহায়। তাদের সহযোগিতার জন্যই কুরআনের আয়াতে আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের জন্য বিধান জারি করেছেন। কুরআন-সুন্নাহর আলোকেও এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, ইসলাম দুস্থ মানবতার সেবায় নিজেদের আত্মনিয়োগ করতে জোর নির্দেশনা দেয়। শুধু তাই নয়, ধনীর ব্যক্তির জন্য গরিব-অসহায় দুস্থ ব্যক্তিদের সহযোগিতা করা কিংবা জাকাত দেয়াকে আবশ্যক করে দিয়েছে ইসলাম। করোনার এ দুঃসময়ে সমাজের বিত্তবানদের জন্য দুস্থ মানবতার সেবায় এগিয়ে আসা একান্ত আবশ্যক। নিজ প্রতিবেশী থেকে শুরু করে পর্যায়ক্রমে সমাজের সর্বস্তরের দুস্থ মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া ঈমানের একান্ত দাবি। মুসলিম উম্মাহকে করোনার এই প্রাদুর্ভাবের সময় নিজ নিজ উদ্যোগে দুস্থ ও অসহায় মানুষকে সহযোগিতা করতে হবে। ইসলাম মানুষের সেবা ও খিদমতের জন্য, সমাজের উপকারের জন্য নিজের যথাসর্বস্ব বিলিয়ে দিতে উদ্বুদ্ধ করে। মানুষকে সর্বোচ্চ মানবিকতা, পরহিতৈষণা, সহমর্মিতা ও মহানুভবতার শিক্ষা দিয়েছে ইসলাম। এ উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাঁর নবীকে প্রেরণ করেছেন দয়া ও সহমর্মিতার প্রতীক হিসেবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আর আমি আপনাকে সৃষ্টিকুলের জন্য রহমত হিসেবেই প্রেরণ করেছি।’ বিশ্ব জাহানের অধিপতি আল্লাহকে কাছে পাওয়ার অন্যতম একটি মাধ্যম হলো মানবসেবা। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে মানবতার সেবা বা কল্যাণ এবং অসহায় মানুষের সহযোগিতার তাওফিক দান করেন। আমিন। (সমাপ্ত)

লেখক: গবেষক, কলামিস্ট।


বিভাগ : ধর্ম দর্শন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

সমীকরণ মেলানোর রুদ্ধশ্বাস নাটকীয়তা শেষে চেন্নাইকে বিদায় করে প্লে-অফে বেঙ্গালুরু

সমীকরণ মেলানোর রুদ্ধশ্বাস নাটকীয়তা শেষে চেন্নাইকে বিদায় করে প্লে-অফে বেঙ্গালুরু

ইসরাইলি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে

ইসরাইলি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে

প্রোটিন উদ্ভাবনে নতুন উদ্যোক্তাদের সুযোগ দিচ্ছে ইউএসএসইসি-এর পিচ-টু-ফর্ক

প্রোটিন উদ্ভাবনে নতুন উদ্যোক্তাদের সুযোগ দিচ্ছে ইউএসএসইসি-এর পিচ-টু-ফর্ক

স্যানিটেশন কর্মীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা দিতে হারপিক ও সাজেদা ফাউন্ডেশন সমঝোতা

স্যানিটেশন কর্মীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা দিতে হারপিক ও সাজেদা ফাউন্ডেশন সমঝোতা

বড় পরিসরে আর. কে. মিশন রোডে ব্র্যাক ব্যাংকের শাখা উদ্বোধন

বড় পরিসরে আর. কে. মিশন রোডে ব্র্যাক ব্যাংকের শাখা উদ্বোধন

বিএনপি ভোট বর্জন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে : শামসুজ্জামান দুদু

বিএনপি ভোট বর্জন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে : শামসুজ্জামান দুদু

ভালুকার সেই শিশু দত্তক নিতে ৪ আবেদন, সিদ্ধান্ত রোববার

ভালুকার সেই শিশু দত্তক নিতে ৪ আবেদন, সিদ্ধান্ত রোববার

যক্ষা রোগ প্রতিরোধে ওয়ার্ডভিত্তিক প্রচারণা

যক্ষা রোগ প্রতিরোধে ওয়ার্ডভিত্তিক প্রচারণা

সুনামগঞ্জে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের দাফন সম্পন্ন

সুনামগঞ্জে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের দাফন সম্পন্ন

পানির সংকট

পানির সংকট

নীতি ও দুর্নীতির লড়াই

নীতি ও দুর্নীতির লড়াই

শিক্ষা ব্যবস্থার ভয়াল দশা

শিক্ষা ব্যবস্থার ভয়াল দশা

মামলাজট কমাতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে

মামলাজট কমাতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে

ইসলামী আন্দোলনের নেতা অধ্যাপক বেলায়েত হোসেনের দাফন সম্পন্ন

ইসলামী আন্দোলনের নেতা অধ্যাপক বেলায়েত হোসেনের দাফন সম্পন্ন

দালালীকে পেশা হিসাবে নেওয়া প্রসঙ্গে।

দালালীকে পেশা হিসাবে নেওয়া প্রসঙ্গে।

দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হামাস ভয়াবহ আঘাতের মুখে ইসরাইল

দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হামাস ভয়াবহ আঘাতের মুখে ইসরাইল

পথ হারিয়েছে বিশ্ব : জাতিসংঘ

পথ হারিয়েছে বিশ্ব : জাতিসংঘ

তাইওয়ান প্রণালীতে মার্কিন জাহাজের অনুপ্রবেশ

তাইওয়ান প্রণালীতে মার্কিন জাহাজের অনুপ্রবেশ

যুক্তরাষ্ট্রের উচিত আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি না করা

যুক্তরাষ্ট্রের উচিত আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি না করা

গাজা ইস্যুতে বন্ধু হারাচ্ছে ইসরাইল নানামুখী চাপে নেতানিয়াহু

গাজা ইস্যুতে বন্ধু হারাচ্ছে ইসরাইল নানামুখী চাপে নেতানিয়াহু