আসাদ সরকারের পতন : নতুন সিরিয়ায় ইসরাইলি আগ্রাসন
২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম
সিরিয়া মধ্যপ্রাচ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র। প্রাচীনকালে এটি শাম দেশ নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানের লেবানন, জর্ডান, ফিলিস্তিন ও সিরিয়া ছিল শাম দেশের অন্তর্ভুক্ত। এ চারটি পুণ্যভূমির সমন্বিত দেশকে শাম দেশ বলা হতো। মুসলিম বিশ্বে সিরিয়াসহ শাম দেশের ভূমি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। শাম দেশের মাটিতে অনেক নবীর আগমন ঘটেছিল। নূহ (আ.), শু’আইব (আ.), লূত (আ.), জাকারিয়া (আ.), ইয়াহইয়া (আ.), সালেহ (আ.), ইসহাক (আ.), ইউসুফ (আ.) ও ইয়াকুব (আ.) এর জন্ম হয়েছিল প্রাচীন এই ভূখ-ে। শাম দেশকে তাই নবী ও রাসূলদের ভূখ- বলা হয়ে থাকে। খ্রিষ্টপূর্ব আট হাজার সাল থেকে এই ভূমির ইতিহাস ছিল সমৃদ্ধিতে ভরপুর।
আরবদের কাছে সিরিয়ার এলাকা ‘বালাদে শাম’ বলে পরিচিত। পবিত্র কোরআনের সুরা রুমের ‘ফি আদনাল আরদ’ তথা নিকটতর নি¤œ এলাকা বলতে এই সিরিয়াকেই বুঝানো হয়েছে। সিরিয়াতে মানব ইতিহাসের প্রধান প্রধান সভ্যতার পত্তন ঘটেছিল। সভ্যতার চূড়ান্ত সংঘাতগুলি সংঘটিত হয়েছিল এই সিরিয়ার মাটিতে। এ ভূমিকে কেন্দ্র করেই উত্থান ঘটেছিল অনেক জাতিগোষ্ঠীর। এ মাটিতেই ইরানীদের সাথে গ্রিক ও রোমানদের মাঝে যুদ্ধ হয়েছিল। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছিল খ্রিষ্টানদের সাথে মুসলমানদের। সিরিয়ার ভূমিতেই মুসলমানগণ তৎকালীন বিশ্বশক্তি রোমানদের পরাজিত করেছিল। বিজয়ী মুসলিম বীরেরা পৃথিবীতে প্রধান পরাশক্তি রূপে আবির্ভূত হয়েছিল। মুসলিম বীর সালাউদ্দিন আয়ুবী (রহ.) এ ভূমিতেই ইউরোপীয় ক্রসেডার বাহিনীকে পরাজিত করেছিলেন। তিনি মুসলিমদের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করেছিলেন। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে এই সিরিয়া নানা জাতি ও গোষ্ঠীর মধ্যে হাত বদল হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ৬৪ অব্দে রোমানরা সিরিয়া দখল করে নিয়েছিল। পরে রোমের ইহুদি নেতা হেরদ জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। ষোড়শ শতকে তুর্কিরা মামলুকদের পরাজিত করে সিরিয়া দখল করে নিয়েছিল।
আধুনিককালে ১৯২২ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। ফলে সিরিয়া ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক শাসনাধীনে চলে গিয়েছিল। ফ্রান্স কর্তৃক সিরিয়া শাসিত হয়েছিল ২৪ বছর। ১৯৪৭ সালে সিরিয়ায় আত্মপ্রকাশ ঘটে বাথ পার্টি নামে এক রাজনৈতিক দলের। এই দলটি আরব বিশ্বকে একটি একক রাষ্ট্র হিসেবে একীভূত হওয়ার ডাক দিয়েছিল। এর নীতিবাক্য ছিল, ‘একতা, স্বাধীনতা ও সমাজবাদ’। উদ্দেশ্য ছিল, আরব জাতীয়তাবাদের ঐক্য এবং অনারব নিয়ন্ত্রণ। অনারবের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকাও ছিল বাথপার্টির অন্যতম টার্গেট।
১৯৪৬ সালে ফ্রান্সের উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে সিরিয়া। ১৯৬৩ সাল থেকে বাথ পার্টি ক্ষমতা দখল করে সিরিয়ার শাসনভার গ্রহণ করে। ১৯৭১ সালে সিরিয়ায় এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। সদ্য ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পিতা হাফিজ আল আসাদ ক্ষমতারোহণ করেন। টানা ২৯ বছর তিনি সিরিয়ার রাজত্ব পরিচালনা করেন। ২০০০ সালে তার মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর ক্ষমতায় বসানো হয় তার পুত্র বাশার আল আসাদকে। ২০০০ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তিনি স্বৈরাচারী শাসন পরিচালনা করেন। পিতা ও পুত্র মিলে সিরিয়াকে একটি পারিবারিক রাষ্ট্রে রূপান্তর করেন।
পিতা ও পুত্রের পারিবারিক শাসন দীর্ঘ হয় ৫৪ বছর। আসাদের পলায়নের পূর্ব পর্যন্ত দেশে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ চলমান ছিল। দীর্ঘদিন ধরে চলা এই গৃহযুদ্ধে ৬ লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, এ গৃহযুদ্ধে ১৫ লাখ মানুষ স্থায়ী পঙ্গুত্ববরণ করেছে। দেশের অভ্যন্তরে বাস্তুচ্যুত হয়েছে প্রায় ৬১ লাখ মানুষ। আর বিদেশে পালিয়ে গেছে প্রায় ৬০ লাখ নাগরিক। তারা বিভিন্ন দেশে শরণার্থী হিসেবে জীবন যাপন করছে। ফ্যাসিস্ট আসাদ ইহুদিদের মতো পরিকল্পিতভাবে শিশুদের নির্যাতন করেছে। জাতিসংঘের এক তথ্য মতে, গৃহযুদ্ধে ৪০ লাখের বেশি শিশু পঙ্গু ও গৃহহীন হয়েছে। তাদের জন্য কোনো শিক্ষা বা স্বাস্থ্যসেবা নেই। দেশটির অর্থনীতির অবস্থাও শোচনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। অর্থনীতির সার্বিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৫ হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
আসাদ শাসনের পতনের পর দেশটিতে আপাতত ১৩ বছরের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটলো। তবে দেশটিতে স্থিতিশীলতা আদৌ ফিরে আসবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বিশ্বের প্রতিটি দেশ এখন নিজ নিজ স্বার্থে সিরিয়ার ভবিষ্যতের দিকে কড়া নজর রেখে চলেছে। তবে সবচেয়ে বেশি নজর রাখছে রাশিয়া, ইরান, যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক এবং ইসরাইল।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে তুরস্ক ইসলামী গ্রুপগুলোকে সহায়তা করে আসছে প্রথম থেকেই। এখনও তুরস্ক তাদের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখে চলেছে। রাশিয়া আগে থেকেই সিরিয়ার সাথে দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। এ লক্ষ্যে রাশিয়া সিরিয়ার পূর্ব ভূমধ্যসাগরে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। আন্তর্জাতিক ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তন করতে রাশিয়া চেষ্টা চালিয়ে আসছিল। কিন্তু ইউক্রেনের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে রাশিয়া দুর্বল হয়ে যায়। ফলে সিরিয়ায় ইসলামপন্থীদের হাতে আসাদের পতন ত্বরান্বিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র সবসময় তার অস্ত্র ব্যবসা চালু রাখতে সুবিধাজনক অবস্থান অবলম্বন করে। তারা আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে ইসলামী গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তা করে।
ইরান এবং সিরিয়া দীর্ঘদিনের মিত্র রাষ্ট্র। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে, ইরান সৈন্য পাঠিয়েছে এবং আসাদকে সাহায্য করতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। তবে ইসরায়েলের সঙ্গে লেবাননের সংঘর্ষের ফলে ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলি দুর্বল হয়ে পড়ে, যা আসাদ সরকারের পতনকে ত্বরান্বিত করে।
ইসরাইল ১৯৬৭ সালের আরব যুদ্ধে মাত্র ছয় দিনের যুদ্ধে সিরিয়ার গোলান হাইটস দখল করে নেয়। ২০১৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গোলান হাইটসে ইসরাইলের অধিকার স্বীকার করে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ চলাকালে ইসরাইল ইরান-সমর্থিত লক্ষ্যবস্তুতে অব্যাহত বিমান হামলা চালায়।
আসাদের পলায়নের পর ইসরাইল সিরিয়ার বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা, অস্ত্রাগার, গোলাবারুদ সংরক্ষণাগার, বিমানবন্দর, নৌঘাঁটি ও গবেষণাকেন্দ্র লক্ষ্য করে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরাইল বাফার জোনের (জাতিসংঘ ঘোষিত নিরস্ত্রীকরণ অঞ্চল) ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাও দখল করে নিয়েছে। আসাদ সরকারের পতনের পর দামেস্কের শতাধিক স্থানে হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। দেশটির পূর্বে আল-মায়াদিন, উত্তর-পশ্চিমের তারতাস ও মাসায়াফেও ইসরাইল আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। লেবানন সীমান্তের কাসার ক্রসিং এবং দক্ষিণের সামরিক বিমানবন্দর খালখালাহতেও হামলা করেছে তারা। একটি সার্বভৌম দেশের উপর এমন হামলা ইসরাইলি দখলদারিত্বের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ বলেই আমরা মনে করি। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সাংবাদিকদের বলেছেন, গোলান মালভূমি-সংলগ্ন সিরিয়ার যেসব অঞ্চল ১৯৭৪ সাল থেকে নিরস্ত্রীকরণ অঞ্চল ছিল, সেগুলো ‘চিরদিনের জন্য’ ইসরাইলের অংশ হিসেবেই থাকবে। এমতাবস্থায়, আসাদের পতনের বিষয়টিকে নানাজন নানাভাবে বিশ্লেষণ করছে। নিবন্ধের শেষে হাদিসের কিছু দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখ করছি।
হাদিসে এসেছে, শাম দেশের জন্য কল্যাণ কামনা করে নবীজি (সা.) অনেক দোয়া করেছেন। হাদিসের ইঙ্গিত হলো, মুসলিমদের জাতীয় দুর্যোগ ও দুর্দিনে এ দেশের কোনো এক মসজিদের ছাদে অবতরণ করবেন ঈসা (আ.)। তাঁর হাতেই বর্তমান সিরিয়াতে নিহত হবে দাজ্জাল। সিরিয়া তথা শামদেশের এ বিশাল ভূমিই কেয়ামতের ময়দান হবে মর্মে হাদিসে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আমার বিশ্লেষণ হলো, ইসরাইল ও আমেরিকা কর্তৃক মধ্যপ্রাচ্যের এই দখলদারিত্ব টেকসই হবে না। এটি কেবল ঈসা (আ.) ও ইমাম মাহদীর আগমনকে ত্বরান্বিত করছে মাত্র। ইহুদিরা মুসলিম শূন্য করতে গত এক বছরে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নারী ও শিশুকে হত্যা করেছে। কিন্তু তারা বিজয় লাভ করত পারেনি। তাদের এই জুলুম ও অত্যাচার ইহুদিমুক্ত বিশ্ব গড়তেই রসদ যোগাচ্ছে বলে আমি মনে করি। ইসলামের ইতিহাসের হাজার বছরের অতীত শিক্ষা ও হাদিসের ইঙ্গিত এটাই আমাদের জানান দেয়। বর্তমান সময়ের সার্বিক সন্ধিক্ষণ সেটারই বার্তা প্রকাশ করছে। আমরা আছি সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায়। গোটা বিশ্ব যখন ফিলিস্তিনি শিশুদেরকে রক্ষা করতে ব্যর্থ তখন তারা ইমাম মাহদীর আগমনের গান গাইছে। শিশুদের এ গান শুনে ভীত হয়ে পড়েছে বাইডেন ও নেতানিয়াহু। বিচলিত হয়ে হোয়াইট হাউসে খোলা হয়েছে এক মুসলিম প-িতের নেতৃত্বে ‘ইমাম মাহদি গবেষণা সেল’! এসব কারণে হামাস, ইখওয়ান আর হায়আত আত তাহরির আল শামসের মতো মুজাহিদগণ ইসরাইল ও আমেরিকার এই অশুভ তৎপরতাকে ভয় পায় না। বলা যায়, ইহুদিরাই ইহুদিমুক্ত পৃথিবী গড়তে সহায়তা করে যাচ্ছে। ইমাম মাহদী ও ঈসা (আ.) এর আগমনকে তারাই ত্বরান্বিত করছে। মুসলমানদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। শুধু ঈমানটাকে সময়োপযোগী করে শান দিলেই চলবে।
লেখক: অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ইরানে যাত্রীবাহী বাস খাদে পড়ে নিহত ১০
বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী নারী কে, জানেন?
বাংলাদেশি রোগী পেতে সীমান্ত পর্যন্ত মেট্রো চালু করবে ভারত
হাত ফসকে আইফোন পড়ে গেল মন্দিরের দানবাক্সে, ফেরত দিতে অস্বীকৃতি
কুয়াশায় ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে একাধিক দুর্ঘটনা: নিহত ১, আহত ১৫
ঢাকার বায়ুমানে উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই, বিপজ্জনকের কাছাকাছি
উগ্রবাদী সন্ত্রাসী 'সাদ' পন্থীদের কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরায় মানববন্ধন
বাংলাদেশ সীমান্তে অত্যাধুনিক ড্রোন মোতায়েন ভারতের
নরসিংদীতে দুর্বৃত্তের গুলিতে ছাত্রদলকর্মী নিহত
সিনেটে প্রার্থী হতে সরে দাঁড়ালেন লারা ট্রাম্প
আমাদেরকে আর স্বৈরাচার হতে দিয়েন না : পার্থ
মার্চের মধ্যে রাষ্ট্র-সংস্কার কাজ শেষ হবে : ধর্ম উপদেষ্টা
জামালপুরে দুই ইজিবাইকের চাপায় সাংবাদিক নুরুল হকের মৃত্যু
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইনের সামরিক সদর দফতরের দখল নিয়েছে আরাকান আর্মি
ব্রাজিলে বাস-ট্রাক সংঘর্ষে নিহত ৩২
নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়োগ সিরিয়ায়
ঘনকুয়াশায় ৩ ঘন্টা পর আরিচা-কাজিরহাট নৌরুটে ফেরি সার্ভিস চালু
গাজায় যুদ্ধবিরতির আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে
কনসার্ট মঞ্চে স্বৈরাচার হাসিনার বিচার দাবি
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত আরও ১৪ ফিলিস্তিনি