আল কুরআনে ‘নূর’ প্রসঙ্গ-২
৩০ মে ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ৩০ মে ২০২৪, ১২:০৪ এএম
‘নূর’ সম্পর্কিত ৪৯টি আয়াতে কারীমার অর্থ ও মর্মেও প্রতি গভীর দৃষ্টিতে তাকালে এতে এক অতিন্দ্রিয় ধারণার সন্ধান মিলে এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু বাস্তববাদী ধর্মশাস্ত্রবিদগণ ¯্রষ্টার সাথে সৃষ্টির তুলনা বর্জন করা অথবা অবাস্তব অতীন্দ্রিয়বাদীগণকে প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে আল্লাহর ‘নূর’ বা জ্যোতিতে তাঁর সুপথ প্রদর্শনের প্রতীকরূপে ব্যাখ্যা করেছেন। এই ব্যাখ্যার ব্যাপারে দার্শনিকগণ অপেক্ষা এই ধর্মশাস্ত্রবিদগণই আল কুরআনের প্রকাশ্য অর্থের অধিকতর নিকটবর্তী। আল কুরআনে আল্লাহকে ‘সর্বজ্ঞ’ ও পথ ‘প্রদর্শক’ বলা হয়েছে। এ বিষয়ে ব্যাখার জন্য গভীর চিন্তার প্রয়োজন হয় না। দার্শনিক আল আশয়ারী বলেন: (মাকালাত: ২:৫৩৪) মুতাযিলা সম্প্রদায় ভূক্ত আল হুশায়ন আল নাজ্জার আয়াত নূরের এরূপ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন যে, আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবীবাসীকে সুপথ প্রদান করে থাকেন।’ যায়দিয়াগণ ও নূরকে আল্লাহতায়ালা কর্তৃক ‘সুপথ প্রদর্শন’ বলেই ব্যাখ্যা করেছেন।
আনুমানিক হিজরী একশত সন হতে ইসলামী দর্শনাশাস্ত্রে ‘নূর’ সম্পর্কে এ মতবাদের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই মতবাদ অনুযায়ী আল্লাহতায়ালা মূলত : জ্যোতি, আদিম আলোক এবং এজন্যই তিনি সকল সৃষ্টি, সকল প্রাণ এবং সকল জ্ঞানের মূল উৎস। বিশেষ করে অতীন্দ্রিয়বাদিগণের আবেগ প্রস্তত চিন্তাধারায় সকল সত্তা, সংজ্ঞ ও সমন্বয় ঘটিয়ে তাদের মাঝেই উক্ত ধারণা বিকাশ প্রাপ্ত হয়। আল কুরআনের নূর সম্পর্কিত আয়াত সমূহ (৪৯টি) সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনা, পারসিক ভাবোদ্দীপনা, অতীন্দ্রিয়বাদিগণের প্রন্থাবলী ও পরিশেষে গ্রীকদর্শন এই নতুন ভাবধারার উপাদান যোগিয়ে ছিল। কুকায়ত (মৃ.৭৪৩) এই ধুয়া তোলে যে, উক্ত জ্যোতি হযরত আদম (আ:) হতে আরম্ভ করে নূর নবী হযরত মোহাম্মাদ (সা:) এর মধ্যস্থতায় হযরত আলী (রা:) এর পরিবারে অনুপ্রবেশ করে। চরম পন্থি শীয়ারা এই ধুয়াকে আকড়ে ধরে আছে বলে তাদের প্রতি সুধারণা পোষণ করা যায় না। প্রখ্যাত আত্মিক সাধক সাহল আল তুসতারী (রহ:) নূরের মতবাদ সম্পর্কে যুক্তিতর্ক সহকারে বিস্তারিত ব্যাখ্যাদান করেছেন। কিন্তু এতেও নূরের আসল রূপ অনুধাবন করা সহজলভ্য হয়ে উঠেনি।
ইসলামে ‘নূর’ দর্শনের প্রথম প্রবক্তাগণকে শাশ্বত ও অবিনশ্বরসত্তারূপে নূর ও জুলমাতের (অন্ধকারের) দ্বৈতবাদের দরুন পারস্যের জনৈক ধর্মতত্ত্ববিদের (লোকেমানীর) অনুসারী বলে ‘সৎ’ পন্থিরা সন্দেহ পোষণ করতে লাগল। দ্বৈতবাদীদের আল্লাহ সম্পর্কে ধারণা ও বিশ্বাস হলো এই যে আল্লাহতায়ালা মানুষকে অজ্ঞার অন্ধকারে আচ্ছন্ন করে সৃষ্টি করেছেন। অত:পর তিনি তাঁর নূরের অংশ বিশেষ পতিত করলেন। যার উপর ঐ নূর পতিত হলো সে সুপথ পেল। (জামেয়ে তিরমিজী : কিতাবুল ঈমান, অধ্যায় ১৮)। চিকিৎসাবিদ রাযী (রহ:) গ্রীক দার্শনিকের অনুসারী হওয়া সত্তে¦ও পারশ্যের মতবাদ গ্রহণ করেন আর এ জন্যই বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্রবিদ ও দার্শনিকগণ তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করেন বা তাঁর সমালোচনা করেন। এই দ্বৈতবাদের কারণে অনেক সুফির বিরুদ্ধে ও অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। কারণ ইসলামে আল্লাহর ওপর বিশ্বাসের ক্ষেত্রে দ্বৈতবাদের (আলো ও অন্ধকার) ধারণা একান্তই ভুল ও সত্য বিচ্যুতি ছাড়া কিছুই নয়।
খ্রীস্টিয় নবম শতাব্দি হতে ‘নূর’ সম্পর্কে আলোচনা নব্য আফলাতুনী মতবাদিগণের ‘অদ্বৈতবাদী’ মতবাদের মাধ্যমে প্রবল সমর্থন লাভ করতে থাকে। ইসলামের অদ্বৈতবাদের সাথে নব্য আফলাতুনীদের মতবাদের মিল রয়েছে। এই মতবাদের জনক প্লেটো (মৃ. খৃ. পূ. ৩৪৭) তাঁর ‘পলিটিয়া’ পুস্তকে অতীন্দ্রিয় জগতের ‘সৎ’ স্বরূপমতবাদকে জড়জগতের আলোক স্বরূপ সূর্যের সাথে তুলনা করেছেন। সুতরাং এই তুলনা আলোক ও অন্ধকারের মধ্যে নয়, বরং তা মনোজগতের সঙ্গে এর প্রতিছবি জগতের তুলনা। ঊর্ধ্ব জগতের আলোক বিশুদ্ধ অতি উজ্জ্বল। নি¤œজগতের এই আলোক কথঞ্চিৎ অন্ধকার মিশ্রিত। নব্য আফলাতুনিদের মতে ‘সৎ’ এর ধারণাই হচ্ছে মহান আল্লাহর ধারণা। এবং এটাই হচ্ছে পবিত্র আলোকের ধারণা।
এরিস্টটলের (মৃ. খৃ: পূ. ৩২২) মতে আলোক শরীরী নয়। সুতরাং তার এই মতবাদে ও উক্ত প্রভেদ ধারণা সহজতর হয়ে উঠে। উপরোক্ত মতবাদ সম্পূর্ণ স্পষ্ট না হলেও এতে প্রতীয়মান হয় যে, এরিস্টটল আলোককে সক্রীয় শক্তি হিসেবে গণ্য করেছেন। যা হোক এস্থলে এর কোন গুরুত্ব নেই। নব্য পিথাগোরীর ও নব্য আফলাবুতনিগণ এরিস্টটলের বর্ণিত অনেক শক্তিকে ও প্লেটোর মতবাদকে কোন কোন সময় শক্তি, আবার কখনো কখনো সত্তারূপে বর্ণনা করেছেন। এদের মধ্যে যখন যা ইচ্ছা বলার বাহুল্য দেখা যায়। এদের গতিনতি অস্থিরতায় ভরপুর। এরিস্টটলের মতে অন্ধকার কোন স্বতন্ত্র সত্ত্বা নয়, বরং তা’ আলোকশূন্যতাকেই বুঝায়। সুতরাং দ্বৈতবাদের কবর রচনা এরিস্টটলের হাতেই হয়েছে। তা’সত্ত্ব ও এরিস্টটলকে পূর্ণাঙ্গ অদ্বৈতবাদী বলা যায় না। কারণ আল কুরআন ও সুন্নাতে নাবুবী যে অদ্বৈতবাদের শিক্ষা তুলে ধরেছে, এর সঙ্গে এরিস্টটলের ধর্ম-মতের আদৌ মিল নেই। এর বিশ্লেষণ সামনে আসছে। ধৈর্য ধরে একটু অপেক্ষা করুন।
এরিস্টটলের অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিযুক্ত ধর্ম তত্ত্বের বিকাশ আরবীতে এ বিবৃত হয়েছে যে, (১) আদিম কারণ সৃষ্টিকর্তা আলোকের শক্তিকে আকল বোধি সংক্রামিত করেন এবং আকল কর্তৃক তা’ বিশ্বাত্বায় সংক্রানিত হয়। তারপর আকল হতে বিশ্বাত্বার মধ্যস্থতায় তা’ প্রকৃতিতে সংক্রামিত হয় এবং বিশ্বাতœা হতে প্রকৃতির মধ্যস্থতায় সৃষ্ট নশ্বর বস্তুতে সংক্রামিত হয়। সৃষ্টি বিকাশের এই পদ্ধতি গতিবিধি ব্যতীতই অবিশ্বান্তভাবে চলছে। কিন্তু সে আল্লাহত আলোকের শক্তি নি:সারিত করেন তিনি নিজেও আলোক নূরুন, হুস্নুন, বাহাউয়) আদিআলোক, আলোকের আলোক।
(২) আল্লাহর আলোক তাঁর সত্তার মধ্যে নিহিত। ইহা তাঁর গুণ (সিফাত) স্বরূপ নয়। কারণ গুণবলে তাঁর কিছুই নেই। কাজেই তাঁর আলোক সত্তার (হুবিয়্যাতুন) মাধ্যমেই কার্যকর হয়ে থাকে। সমস্ত জগৎ জুড়ে বিশেষভাবে মানব জগতের ভিতর দিয়ে এই আলোক প্রবাহ চলতে থাকে। অতিন্দ্রিয় মূল হতে প্রথম মানুষে প্রথম মানুষ হতে ইহা দ্বিতীয় মানুষে অনুপ্রবেশ করে এবং তৎপর দ্বিতীয় মানুষ হতে তৃতীয় মানুষে সংক্রামিত হয়। এ সমস্তই তথাকথিত বাস্তব মানুষের মূল।
(৩) অবশ্য জ্ঞানী ও সত্যব্যক্তিদের আত্মাতেই এই আলোক সর্বাধিক অবিমিশ্র রূপে পাওয়া যায়। আর এটাও লক্ষণীয় যে, আধ্যাত্মিক শক্তিরূপে নূর এবং অগ্নি এক নয়। কারণ অগ্নির একমাত্র জড়বস্তুকে দাহনের শক্তি রয়েছে। অবশ্য অপর সকল বস্তুর ন্যায় অগ্নির ও অতীন্দ্রিয় উৎস মূল রয়েছে। কিন্তু আলোক অপেক্ষা জীবনের সাথেই এর সম্পর্ক অধিক। মোটকথা গ্রীক দর্শন তথা এরিস্টটলের ধর্ম তত্ত্বের প্রদত্ত মতবাদের সাথে আল কুরআন ও সুন্নাতে নাবুবীর কোন সম্পর্কেই নেই।
(৪) আলোকের সৃজনধর্মী অধোগতি সম্পর্কে যে ধারাবাহিকতা রয়েছে জ্যোতিময় ঊর্ধ্বজগতে আত্মার উন্নীত হওয়ায় ধারাবাহিকতা ও তদ্রুপ। এই প্রত্যাগমনকালে আত্মা আকলের রাজ্য অতিক্রম করলে তথায় অবিমিশ্র আলোক ও আল্লাহর অনুপম সৌন্দর্য তার দৃষ্টি গোচর হয়। সকল সুফীর লক্ষ্যস্থল এটাই।
(৫) ‘লিডার ডি কুইজিজ’ গ্রন্থের লেখক বলেছেন যে, আল্লাহ সম্বন্ধে কিছুই বলা যায় না। তবুও তিনি তাঁকে আদি কারণ এবং ততোধিক স্পষ্টভাবে অবিমিশ্র আলোক রূপে অভিহিত করেছেন এবং এজন্যই তিনি তাকে সকল প্রাণী ও সকল জ্ঞানের মূল উৎস (আল্লাহতে উজুদ অর্থাৎ সকল অস্তিত্ব ও পরিচিতি আছে বলে ধরে নিয়েছেন। তার এই ধরে নেওয়ার সাথে মূল সত্যের কোন যোগসূত্র নেই। সুতরাং তার এই অভিমতকে মূল সত্যের বাইরের কোন কিছু বলা যায়। আল ফারাবী ও ইবনে সিনা প্রমুখ বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিকগণ আলোকের মতবাদকে সাধারণ দর্শন শাস্ত্রে ও মনস্তত্ত্ব শাস্ত্রে আকলের সাথে সংযুক্ত করেছেন। আল ফারাবী আল্লাহর নূর ও আকলের বহু সমার্থ বোধক শব্দ ব্যবহার করেছেন। যেমন দ্যুতি, উজ্জ্বল ইত্যাদি। ইবনে আবি ওসায়বিয়া রচিত গ্রন্থে আল ফারাবীর এক মুনাজাতের (প্রার্থনা বাক্যের) উল্লেখ আছে। এই মুনাজাতে তিনি আল্লাহকে সকল পদার্থের আদি কারণ এবং ভূম-ল ও নভোমন্ডলের জ্যোতি রূপে উল্লেখ করেছেন। আল ফারাবীর ন্যায় ইবনে সীনা ও ধর্মতত্ত্বের আলোচনা করেছেন এবং এর অধিকতর সম্প্রসারণ করেছেন। তাঁর মনস্তাত্ত্বিক প্রবন্ধ সমূহে তিনি আলোককে আত্মা ও দেহের যোগসূত্র রূপে গণ্য করেছেন। এ স্থলে সূফী সাহল আল তুসতারীর অভিমত লক্ষণীয়। তিনি মানবের উপাদান চতুষ্টয়ে মৃত্তিকার এবং রূহের মধ্যবর্তীতে নূরের স্থান নির্ধারণ করেন। এমনকি এরিস্টটলের শিষ্যগণের আকলের মতবাদকে তিনি তার কিতাব আল ইশারাতে আলকুরআনের ‘নূর’ আয়াতের ব্যাখ্যা স্বরূপ গ্রহণ করেন। তাঁর মতে আলোক হল আকল বিল্ ফিল, আর আগুন হলো আকল ফা-আল্ ইত্যাদি। সুতরাং আল্লাহর নূর এরিস্টলের নওজ সাদৃশ। ইবনে সিনার এই অভিমতই গাযযালীর। চিন্তায় রূপায়িত হয়েছে (মা আরিজ আল কুদ্স ফী মাদারিজ মা’রিফাত আন্ নাফস : কায়রো ১৯২৭, পৃ, ৫৮) (চলবে)
বিভাগ : ধর্ম দর্শন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
রোমাঞ্চকর ম্যাচে বার্সাকে হারিয়ে শীর্ষে আতলেটিকো
জেসুসের জোড়া গোলের রাতে আর্সেনালের বড় জয়
বিলুপ্তির পথে মাটির ঘর
চোর সন্দেহে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ
প্রতিবন্ধী স্কুল শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের অভিযোগ
কেরু চিনিকলে আখ মাড়াই মৌসুমের উদ্বোধন
বিহারিরা কেমন আছে
লক্ষ্মীপুরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি
আসাদ সরকারের পতন : নতুন সিরিয়ায় ইসরাইলি আগ্রাসন
মেটলাইফ বাংলাদেশের গ্রাহকরা ডিসকাউন্ট পাবেন ওশান প্যারাডাইস হোটেলস ও রিসোর্টে
১৫ নারী ও শিশুকে হস্তান্তর
আবাসন ও গার্মেন্ট খাতের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে
মেহেরপুরে বেড়েছে গরম কাপড় বিক্রি
কাশিয়ানীর হাট-বাজার নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব
অ্যানুয়াল বিজনেস কন্টিনিউয়িটি প্ল্যান ড্রিল ২০২৪ আয়োজন করলো ব্র্যাক ব্যাংক
সমস্যায় জর্জরিত আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স
সবুজ গালিচায় হলুদের সমারোহ
আখাউড়ায় ক্ষুদে শিক্ষার্থীদের মেধা বৃত্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত
নিউ ইয়র্কের আদালতে অভিযুক্ত লুইজি
কিউবায় সমাবেশ