মুহম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়-২
০৭ এপ্রিল ২০২৩, ১১:৫৩ পিএম | আপডেট: ২৫ জুন ২০২৩, ০৮:১৩ পিএম
কিছু ইতিহাস লেখক মুসলমান অভিযানকারী ও শাসকদের বিরুদ্ধে এই মর্মে অভিযোগ করতে বিশেষ উৎসাহবোধ করেছেন যে, ১. তারা (মুসলমানরা) নিষ্ঠুর ও অকারণে হত্যাকারী, ২. তারা বলপূর্বক ধর্মান্তরকারী, ৩. তারা মন্দির ধ্বংস ও বিগ্রহ চূর্ণকারী, ৪. তারা নারীহরণ ও নারী অবমাননাকারী। মুহম্মদ বিন কাসিমের বিরুদ্ধেও তারা এসব অভিযোগ এনেছেন। অথচ, মুহম্মদ বিন কাসিম সজ্জন, মানবিক ও সহৃদয় ব্যক্তি হিসেবে খ্যাত ছিলেন। এটা সত্য বটে, তিনি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধকারী অর্থাৎ প্রতিপক্ষের তেমন একটা ছাড়া দেননি। যুদ্ধে প্রতিপক্ষ হত্যা কোনো দোষের বিষয় নয়। এটা যুদ্ধের নিয়ম, তখনই নয়, এখন পর্যন্ত। এখানে একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যেতে পারে। মুহম্মদ বিন কাসিম একটি অঞ্চল জয় করার পর সেখানকার সব রকম কর মওকুফ করে দেন। এটা শুনে হাজ্জাজ বিন ইউসুফ তাকে এক পত্রে তিরষ্কার করেন। তিনি এই নির্দেশও প্রদান করেন যে: যারা কুফরির ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসে তাদের হত্যা করবে। তিনি এও বলেন: যারা বশ্যতা স্বীকার করে নেবে, তাদের নিরাপত্তা দেবে। কারিগর ও ব্যবসায়ীদের ওপর কোনো কর ধার্য করবে না। কৃষিকাজে দক্ষদের সহযোগিতা করবে, তাদের কৃষিঋণ দেবে।
যুদ্ধের নীতি ভালোভাবে জানা থাকা সত্ত্বেও মুহম্মদ বিন কাসিম কোনো কোনো ক্ষেত্রে যে, এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে উদারতা ও সহিষ্ণুতা প্রদর্শন করেছেন, বর্ণিত ঘটনাটি তারই প্রমাণ। তার পক্ষে নির্বিচারে বেসামরিক মানুষ হত্যা কীভাবে সম্ভব হতে পারে? সিন্ধুর বিভিন্ন অঞ্চলে অভিযান পরিচালনার সময় প্রতিপক্ষের যোদ্ধারা মুসলমান যোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়েছে, এটাই তো স্বাভাবিক। অন্যদিকে প্রতিপক্ষের হাতে মুসলমান যোদ্ধারাও নিহত হয়েছে।
মুহম্মদ বিন কাসিম হিন্দুদের ধর্মান্তরে বাধ্য করেছেন এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। স্বেচ্ছায় যারা মুসলমান হয়েছে তাদের কথা আলাদা। মুহম্মদ বিন কাসিমের একটি ঘোষণা আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি, যেখানে তিনি বাপ-দাদার ধর্ম যারা অনুসরণ করতে চায় তাদের ধর্মকর্ম পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়ার কথা বলেছেন। যিনি এহেন ঘোষণা দিতে পারেন, তার পক্ষে জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ কি সম্ভব?
হিন্দুদের মন্দির ধ্বংস ও বিগ্রহ ভাঙ্গার অভিযোগ কতদূর সত্য সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ। দেবল, নিরুন, আলোর প্রভৃতি স্থানে হিন্দু মন্দির মুসলিম বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার কথা জানা যায় বটে, তবে তা যে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপ্রসূত ছিল না, সেটাও স্বীকার্য। যিনি মন্দির মেরামত ও সংস্কারের জন্য রাজকোষ থেকে অর্থ বরাদ্দের ঘোষণা দেন তার পক্ষে সঙ্গত ও উপযুক্ত কারণ ছাড়া মন্দিরের ওপর হস্থক্ষেপ বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না।
প্রসঙ্গত স্মরণ করা আবশ্যক, ধর্মীয় স্থান ও মঠ-মন্দিরে হামলা, ধ্বংস বা ক্ষতি সাধন নতুন কোনো ঘটনা নয় এবং মুসলমানরাই যে কেবল এটা করেছিল, তাও সত্য নয়। ব্রাহ্মণ্য শাসনকালে এটা সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বৌদ্ধদের ওপর ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনুসারী তথা হিন্দুদের অত্যাচার-নির্যাতন ও তাদের প্রায় সমূলে উৎখাত করার ঘটনা ভারতের ইতিহাসের এক মর্মান্তিক অধ্যায়। ওই সময় ভারতের বিভিন্ন স্থানে বৌদ্ধবিহার ও ধর্মীয় স্থান ধ্বংস, দখল ও রূপান্তর স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। ইতিহাসবিদরা লক্ষ করেছেন, ধর্মীয় স্থান, মন্দির ইত্যাদি সুরক্ষিত দুর্গের মতো করে নির্মাণ করার একটা প্রবণতা আগে থেকেই ছিল। ধর্মীয় স্থান, বিহার বা মঠ-মন্দিরে জনসাধরণের ধন-সম্পদ গচ্ছিত রাখার একটা ব্যবস্থাও আগে থেকে ছিল। ফলে এগুলো ধন-সম্পদের ভা-ার হিসেবেও পরিগণিত হতো। কোনো আক্রমণকারী যখন কোনো অঞ্চলে অভিযান চালাতেন, তখন ধর্মীয় স্থান ও উপাসনাস্থলগুলোও তার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হতো ধন-সম্পদের কারণে। এ প্রসঙ্গে সুরজিৎ দাশগুপ্ত তার ‘ভারতবর্ষ ও ইসলাম’ গ্রন্থে লিখেছেন: নালন্দা, বর্তমান বাংলাদেশের পাহাড়পুরে অবস্থিত সোমপুর, কুমিল্লায় অবস্থিত ময়নামতী প্রভৃতি মহাবিহারগুলোর ধ্বংস্তূপের গঠন-বিন্যাস থেকে এটা স্পষ্ট যে, এমন ধর্মস্থানগুলোকে অনার্য পুরগুলোর মতোই দুর্গের ধরনে পরিখা দিয়ে সুরক্ষিত করা হতো। মেগাস্থিনিস নালন্দা মহাবিহারের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা এক সুরক্ষিত দুর্গেরই বর্ণনা। তুর্কীরা দুর্গ বলে ভুল করেই নালন্দা ধ্বংস করেছিল। অবশ্য ময়নামতী মহাবিহার ধ্বংস হয় ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বীদের হাতে। ভোজবর্মার বেলাকলিপি থেকে জানা যায় যে, পরম বিষ্ণুভক্ত জাতবর্মা সোমপুর বিহার ধ্বংস করেছিলেন। দক্ষিণ ভারতের মন্দিরগুলোও একটার পর একটা প্রাচীর দিয়ে সুরক্ষিত করা হতো। দুর্গের চাইতেও বেশি দুর্ভেদ্য করে মন্দির গঠন প্রণালী এটাই নির্ভুলভাবে প্রমাণ করে যে, ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের ভারতীয় ভৌগোলিক সীমানায় প্রবেশ শুরু করার অনেক আগে থেকেই বিহার বা মন্দির নির্মাতারা স্বদেশীয় আক্রমণকারী ও লুণ্ঠনকারী সম্বন্ধে সন্ত্রস্ত থাকতো এবং তাদের প্রতিরোধ করার জন্য ধর্মস্থানগুলোকে দুর্গের মতো প্রাচীর দিয়ে সুরক্ষিত করতো। এ ছাড়া বিহার ও মন্দিরকে দুর্গের মতো সুরক্ষিত করার অন্য কোনো ব্যাখ্যায়ই করা যায় না।
তিনি আরো লিখেছেন: এ কথা সত্য যে, এটা পরোক্ষ প্রমাণ। কিন্তু ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বীরা লিখিত ইতিহাস অল্পই রচনা করেছে। পুরাণই তাদের প্রমাণ। তবে কহলনের ‘রাজতরঙ্গিনী’ থেকে জানা যায় যে, কাশ্মীরের হিন্দুরাজারা পররাজ্য জয় করার সময় বিজিত রাজ্যের মন্দির ধ্বংস করে ধন-সম্পদ লুট করতো। এটা স্বীকার করে নেয়াই ভালো যে, প্রাচীনকালে মঠ-মন্দির ধ্বংস করা সম্বন্ধে লিখিত প্রমাণ খুবই নগণ্য। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না যে, সমকালীন ঘটনাবলী লিপিবদ্ধ করার প্রথা তখনও জনপ্রিয় হয়নি এবং এই প্রথা তারাই ভারতবর্ষে জনপ্রিয় করে, যারা বৈদিক আর্যদের ভারত জয়ের প্রায় আড়াই হাজার বছর পরে ইসলাম নামে বিদেশি ধর্ম নিয়ে এদেশে আসে। সুতরাং, যে যুগের এক আধটা ঘটনার উল্লেখও সুদূরপ্রসারী ইঙ্গিত বহন করে। সে সব উল্লেখের সূত্র ধরে সহজেই অনুমান করা যায় যে, পরিখা-প্রাচীর দিয়ে বেষ্টিত ধর্মস্থানগুলোর ওপর প্রতিবেশী রাজা-মহারাজাদের ললুপ দৃষ্টি থাকতো। এই ধর্মস্থানগুলোতে দেশের সাধারণ মানুষ নিজেদের ধন-সম্পদ জমা রাখত অথবা ধর্মস্থানগুলো ছিল স্বকীয় মাহাত্ম্যে দেশের প্রধান ধনাগার। হরিণ যেমন নিজের মাংসের গুণে শিকারীকে প্রলুব্ধ করে, তেমনই এই ধর্মস্থাগুলোও ধনাগাররূপে ব্যবহৃত হওয়ার জন্য পরাক্রান্ত পুরুষদের প্রলুব্ধ করত এবং এর ফলে ধর্মস্থান ধ্বংসের সঙ্গে ধর্মবিদ্বেষের সম্পর্ক আবিষ্কারের চেষ্টা নিতান্তই কল্পিত, জনশ্রুতিপ্রণোধিত এবং তার পেছনে বাস্তবতার সমর্থন নেই। অতঃপর আশা করা যায় বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে।
ইসলামে নারীর সম্মান ও মর্যাদা অপরিসীম। তার অধিকারও পুরুষের তুলনায় কম নয়। নারী স্বধর্মী বা বিধর্মী যেই হোক, তাকে যথাযথ সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা মুসলামন মাত্রেরই কর্তব্য। নিষ্ঠাবান মুসলমান হিসেবে মুহম্মদ বিন কাসিমের দ্বারা বিজিত হিন্দুদের কোনো নারী অসম্মানিত ও অপমানিত হতে পারে, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এ কথাও মনে রাখা দরকার, মুসলমান নারী-পুরুষ অসম্মানিত ও অপমান হওয়ার প্রতিশোধ নিতেই মূলত মুহম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু অভিযান করেন। কোনো কোনো ইতিহাস লেখক রাজা দাহিরের মহিষী রাণী বাঈ ও রাজপুরোনারীদের বিষপানে আত্মহত্যার প্রসঙ্গ টেনে বলার চেষ্টা করেছেন যে, নারীত্বের সম্মান রক্ষার্থেই তারা জহরব্রত করেন। এতে মুহম্মদ বিন কাসিম ও মুসলিম সৈন্যদের হীন চরিত্র সম্পর্কে যে ইঙ্গিত করা হয়েছে, আদতে তার কোনো ভিত্তি নেই। রাজা দাহিরের দুই কন্যাকে মুহম্মদ বিন কাসিম খলিফার হেরেমের জন্য পাঠিয়েছিলেন বলে কোনো কোনো ইতিহাস লেখক বলেছেন। এরও কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যভিত্তি নেই। বলা হয়েছে, রাজা দাহিরের দুই কন্যা খলিফার কাছে গিয়ে অভিযোগ করেন যে, মুহম্মদ বিন কাসিম তাদের মর্যাদাহানি করেছেন। এতে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে খলিফা মুহম্মদ বিন কাসিমকে মৃত্যুদ- দেন। তার মৃত্যুদ- কার্যকর হওয়ার পর রাজা দাহিরের কন্যাদ্বয় খলিফাকে বলে, তারা মুহম্মদ বিন কাসিমের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করেছিল। এতে খলিফা ক্রোধান্বিত হয়ে তাদের মৃত্যুদ-ে দ-িত করেন। ইতিহাসের নামে যারা এ ঘটনা বর্ণনা বা উল্লেখ করেছেন। বলা বাহুল্য, তারাও এর সত্যতা সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করেছেন। কেউ কেউ এ সম্পর্কে পাল্টা প্রশ্ন করেছেন, রাজ মহিষীসহ পুরনারীগণ জহরব্রত করলেও রাজার দুই কন্যা কীভাবে রক্ষা পায়? এর কোনো উত্তর নেই। এটা যে নিতান্তই গালগপ্প, তাতে সন্দেহ নেই। মনে রাখতে হবে, গল্প বা গালগপ্প ইতিহাস নয়। (সমাপ্ত)
বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
প্রবাসীদের যে জন্য সুখবর দিলো মালয়েশিয়া
জাবি শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় মামলা, তদন্ত কমিটি গঠন, ফটকে তালা, মশাল মিছিল
মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল
"নতুন সিনেমা নিয়ে ফিরছেন গ্লোবাল তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি"
ড. ইউনূসকে নিয়ে খালেদা জিয়ার পুরোনো যে বক্তব্য ভাইরাল
নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি ইসলামী আন্দোলনের শুভ কামনা
আলোচনায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার ‘টুস করে ফেলে দেয়ার’ হুমকি
দীর্ঘ ১৫ বছর সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনি: খোকন
'ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে অভিনেতা তারিক আনাম খানের নাটক'
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
দেশের বাজারে ফের বাড়ল সোনার দাম
সবচেয়ে কম মূল্যে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ দিচ্ছে নেপাল: নেপাল রাষ্ট্রদূত
আগামী নির্বাচন নিয়ে দিল্লি ভয়ংকর পরিকল্পনা করছে: যুক্তরাষ্ট্র জাগপা