সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযান-১
১৩ এপ্রিল ২০২৩, ১১:৫০ পিএম | আপডেট: ২৫ জুন ২০২৩, ০৮:১৪ পিএম
পূর্ব আফগানিস্তানের ক্ষুদ্র রাজ্য গজনী। ৯৬২ খ্রিস্টাব্দে সামানি শাসনের অবসান ঘটিয়ে গজনীর ক্ষমতা অধিকার করেন অলপ্তগীন। তার মৃত্যুর ১৪ বছর পর তার জামাতা সবুক্তগীন (৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে) সিংহাসনে আরোহণ করেন। সবুক্তগীন ছিলেন প্রতিভাবান, উচ্চাভিলাষী ও সুদক্ষ সমরনায়ক।
তিনি একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন এবং রাজ্য জয়ে মনোনিবেশ করেন। একে একে খোরাসান, নিস্তান ও লামখান এলাকা অধিকার করেন। তিনি এভাবে গজনী রাজ্যের বিস্তার ও শক্তি বৃদ্ধি করেন। তারই সুযোগ্য পুত্র সুলতান মাহমুদ ভারত জয়ের মহানায়ক হিসেব স্বীকৃত। ঐতিহাসিকদের কারো কারো অভিমত, অলপ্তগীন-সবুক্তগীন কারোরই ভারতে রাজ্য বিস্তারের ইচ্ছা বা পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু পাঞ্জাবের হিন্দুশাহী রাজা জয়পাল এমন আশংকা করছিলেন, সুলতান সবুক্তগীন হয়তো ভারতে অভিযান চালাতে পারেন। এটা যাতে না পারেন, সেজন্য তিনি ‘আগে আক্রমণের নীতি’ গ্রহণ করেন। পার্শ্ববর্তী হিন্দু রাজাদের কাছে তিনি তার পরিকল্পনার কথা জানান। সে মোতাবেক, কালিঞ্জেরসহ কয়েকটি রাজ্যের সহায়তায় এক বিরাট বাহিনী প্রস্তুত করেন এবং ৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে সবুক্তগীনকে আক্রমণ করেন। দুর্ভাগ্যক্রমে রাজা জয়পালের বাহিনী তুষার ঝড়ের কবলে পড়ে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তার গজনী অধিকারের স্বপ্ন-অভিলাষ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। প্রাণ বাঁচাতে সবুক্তগীনের সঙ্গে তাকে এক অপমানজনক চুক্তিতে আবদ্ধ হতে হয়। কিন্তু স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করার পর তিনি সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করে আবারও যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। আবারও সবুক্তগীনকে আক্রমণ করেন এবং আবারও পরাজিত হন। ভারত থেকে বারবার হামলা চালানের পরিপ্রেক্ষিতে সবুক্তগীন অতিশয় বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ হন। রাজ্যের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিয়ে এ অবস্থায় তার বিচলিত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তিনি রাজা জয়পালকে সমুচিত শাস্তি দিতে চিন্তাভাবনা করেন। কিন্তু আকস্মিক মৃত্যু তাকে সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে। তার সুযোগ্য পুত্র সুলতান মাহমুদ রাজা জয়পালের আগ্রাসী তৎপরতা ও বিশ্বাসঘাতকতার উপযুক্ত প্রতিবিধান করেন।
সুলতান মাহমুদ তার কালে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম বিজেতা, বিশাল রাজ্যসংগঠক, দক্ষ যুদ্ধপরিচালক, বিচক্ষণ সমরনায়ক এবং অমিতবিক্রম যোদ্ধা হিসেবে খ্যাত হয়ে আছেন। তিনি ১০০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১০২৭ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত ভারতে ১৭ বার অভিযান চালান। এই সব অভিযানের একটিতেও তিনি পরাজিত হননি। সিংহাসন লাভের প্রথম তিন বছর পর্যন্ত তিনি আক্রমণকারী ও চুক্তির শর্ত ভঙ্গকারী রাজা জয়পালের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নেননি। এ সময় তিনি খোরাসানে যুদ্ধে ব্যাপৃত থাকেন। ৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি ঐ অঞ্চলের সর্বেসর্বা হিসেবে খলিফার স্বীকৃতি লাভ করেন। অতঃপর দৃষ্টি দেন ভারতের দিকে। ঐতিহাসিকদের কেউ কেউ বলেছেন, ভারত থেকে গজনীর ওপর আগ্রাসী হুমকি ও প্ররোচণা না এলে হয়তো সুলতান মাহমুদ ভারত আক্রমণে আগ্রহী হতেন না। তার সমর প্রতিভার যে পরিচয় মিলেছে, তাতে রাজ্য জয়েচ্ছা স্বাভাবিক বলেই প্রতীয়মান হয়। সে ক্ষেত্রে তার বিজয় অভিযান পূর্বদিকে অর্থাৎ চীনের দিকে যাওয়া ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু ভারতের হিন্দু রাজাদের অবিমৃষ্যকারিতা ও অপরিণামদর্শী আচরণ তাকে ভারতমুখী হতে বাধ্য করে।
অভিযান:
এক. সঙ্গতকারণেই সুলতান মাহমুদ তার আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তু করেন রাজা জয়পালকে। তার আগে ১০০০ খ্রিস্টাব্দে প্রথম যে অভিযান তিনি চালান, সেই অভিযানে খাইবার গিরিপথে অবস্থিত কয়েকটি দুর্গ ও সীমান্ত নগরী অধিকার করেন এবং পরে গজনী ফিরে যান।
দুই. ১০০১ সালে সুলতান মাহমুদ ১০ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে পাঞ্জাবে অভিযান চালান। এটা ভারতে তার দ্বিতীয় অভিযান। হিন্দুশাহী রাজা জয়পালের বাহিনীর সঙ্গে পেশোয়ারে তার বাহিনীর তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে জয়পাল পারজিত হন। বিপুল অর্থ ও ৫০টি হাতি দেয়ার বিনিময়ে তিনি সন্ধি করেন। এভাবে বার বার পরাজয় ও গøানিকর সন্ধিতে রাজা জয়পালের প্রজারা রাজা হিসেবে তাকে মানতে অস্বীকার করে। এমতাবস্থায়, আগুনে ঝাপ দিয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন।
তিন. তৃতীয় অভিযান পরিচালিত হয় ১০০৪ খ্রিস্টাব্দে ভাতিন্ডার রাজা বিজয় রায়ের বিরুদ্ধে। সবুক্তগীনের সময় থেকেই গজনীর সঙ্গে ভাতিন্ডার ভালো সম্পর্ক ছিল। রাজা জয়পালের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সুলতান মাহমুদ ভেবেছিলেন রাজা বিজয় রায়ের সহযোগিতা পাবেন। সে রকম আশ্বাস তিনি তাকে দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজা বিজয় রায় প্রতিশ্রæতি ভঙ্গ করেন। এরই প্রতিশোধ নিতে সুলতান মাহমুদ এ অভিযান চালান। যুদ্ধে বিজয় রায় পরাজিত হন এবং পালিয়ে যাওয়ার সময় বুকে ছুরিকাঘাত করে আত্মহত্যা করেন।
চার. ১০০৫ খ্রিস্টাব্দে চতুর্থ অভিযান পরিচালিত হয় মুলতানের ইসমাইলীয় মতবাদে বিশ্বাসী আবুল ফাতাহ দাউদের বিরুদ্ধে। ভাতিন্ডার রাজার সঙ্গে যুদ্ধে জয় লাভের পর স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের সময় সুলতান মাহমুদের ওপর আক্রমণ চালান দাউদ। ফলে এ বছর তাকে শায়েস্তা করার জন্যই তিনি অভিযান পরিচালনা করেন। পাঞ্জাবের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হওয়ার সময় রাজা জয়পালের পুত্র আনন্দপাল তাকে প্রতিরোধ করেন। যুদ্ধে আনন্দপাল পরাজিত হন। অন্যদিকে সুলতান মাহমুদের আক্রমণের মুখে দাউদ মুলতানের দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। পরে তিনি সুলতান মাহমুদের বশ্যতা স্বীকার করেন। তাকে বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রদান করেন এবং একই সঙ্গে ভ্রান্ত মতবাদ বা বিশ্বাস পরিত্যাগ করার প্রতিশ্রæতি দেন।
পাঁচ. পঞ্চম অভিযান পরিচালিত হয় ১০০৭ খ্রিস্টাব্দে রাজা জয়পালের পৌত্র সুখলালের বিরুদ্ধে। রাজা জয়পালের সঙ্গে যুদ্ধের সময় সুখলাল ইসলাম গ্রহণ করে নেওয়াজ শাহ নাম ধারণ করেন। পরে ইসলাম ত্যাগ করে তিনি হিন্দুধর্মে ফিরে যান। শুধু তাই নয়, ওয়াইহিন্দ থেকে মুসলিম শাসনকর্তাকে তাড়িয়ে দিয়ে নিজেকে স্বাধীন রাজা হিসেবে ঘোষণা করেন। তার অপকর্মের উপযুক্ত প্রতিবিধানের জন্য সুলতান মাহমুদকে এ অভিযান চালাতে হয়।
ছয়. ১০০৮ সালে সংঘটিত হয় ষষ্ঠ অভিযান। এ অভিযানে অগ্রসর হয়ে সুলতান মাহমুদ বুঝতে পারেন, সুখলাল, আনন্দপাল ছাড়াও উজ্জয়িনী, গোয়ালিয়র, কালিঞ্জর, কনৌজ, দিল্লী, আজমীর প্রভৃতি রাজ্যের রাজারা একজোট হয়ে তার বিরুদ্ধে প্রস্তুত। পেশোয়ার ও ওয়াইহিন্দের মধ্যবর্তী স্থানে সুলতান মাহমুদের বাহিনীর সঙ্গে সম্মিলিত হিন্দু বাহিনীর মোকাবিলা হয়। যুদ্ধে পাঞ্জাবের দুর্ধর্ষ কোহকরাও হিন্দুদের পক্ষাবলম্বন করে। তারা সুলতান মাহমুদের বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি সাধান করে। তারপরও সুলতান মাহমুদ বিজয় অর্জন করেন। যেকোনো বিচারে যুদ্ধটা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধ শেষে সুলতান মাহমুদ বেশুমার অর্থ অধিকার করেন।
(চলবে)
বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
প্রবাসীদের যে জন্য সুখবর দিলো মালয়েশিয়া
জাবি শিক্ষার্থী মৃত্যুর ঘটনায় মামলা, তদন্ত কমিটি গঠন, ফটকে তালা, মশাল মিছিল
মাদকের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল
"নতুন সিনেমা নিয়ে ফিরছেন গ্লোবাল তারকা অ্যাঞ্জেলিনা জোলি"
ড. ইউনূসকে নিয়ে খালেদা জিয়ার পুরোনো যে বক্তব্য ভাইরাল
নতুন নির্বাচন কমিশনের প্রতি ইসলামী আন্দোলনের শুভ কামনা
আলোচনায় ফ্যাসিস্ট হাসিনার ‘টুস করে ফেলে দেয়ার’ হুমকি
দীর্ঘ ১৫ বছর সাংবাদিকরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনি: খোকন
'ইউটিউব ট্রেন্ডিংয়ে রয়েছে অভিনেতা তারিক আনাম খানের নাটক'
বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আঞ্চলিক সহযোগিতার আহ্বান
ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর বোর্ড অব গভর্নর সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সম্বর্ধনা
সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীকে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন ও দারুননাজাত মাদরাসা’র সংবর্ধনা
লালমোহনে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে আহত যুবদল নেতা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু
চকরিয়ার বিএনপি নেতা আবু তাহের চৌধুরীর মৃত্যুতে সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাসিনা আহমদের শোক
উইন্ডিজের বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
বেইজিং সংস্কৃতি ও পর্যটন ব্যুরো ও আটাবের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানের সাক্ষাৎ
দেশের বাজারে ফের বাড়ল সোনার দাম
সবচেয়ে কম মূল্যে বাংলাদেশকে বিদ্যুৎ দিচ্ছে নেপাল: নেপাল রাষ্ট্রদূত
আগামী নির্বাচন নিয়ে দিল্লি ভয়ংকর পরিকল্পনা করছে: যুক্তরাষ্ট্র জাগপা