মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বঙ্গজয়-১
০১ জুন ২০২৩, ১১:৫৫ পিএম | আপডেট: ২৫ জুন ২০২৩, ০৮:১৫ পিএম

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বঙ্গজয় ইতিহাসে একটি মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা। তার এ ঐতিহাসিক বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলায় রাজনৈতিকভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠার সূচনা হয়। বঙ্গজয়ের আগে তিনি বিহার অধিকার করেন। কুতুব উদ্দিনের আনুগত্য পোষণকারী ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ তারই অনুমোদন ক্রমে বিহার ও বঙ্গবিজয়ে মনোনিবেশ করেন। আফগানিস্তানের হেলমান্দ প্রদেশের গরমশীর জেলার দস্ত-মার্গ এলাকায় ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজির জন্ম। জাতিতে তুর্কি-খলজি ছিলেন তিনি। চার্লস স্টুয়ার্টের মতে, তার জন্ম হয় গরমশীরের ঘোর শহরে। আফগানিস্তানের উত্তর সীমান্ত এলাকায় শহরটির অবস্থান। তার প্রাথমিক জীবন সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। ঐতিহাসিক মিনহাজুস সিরাজ জানান, তার চাচা ছিলেন কশটমÐির শাসক মুহাম্মদ মাহমুদ। এতে এটা স্পষ্ট, তার পরিবার তাকে উন্নত শিক্ষা-দীক্ষাই দিয়ে থাকবে। মিনহাজের বিবরণে তার প্রাথমিক যৌবনের ইতিবৃত্ত এসেছে সংক্ষেপে। গজনীতে তিনি সুলতান মুহম্মদ ঘুরীর সেনাবাহিনীতে কাজ পেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার চেহারা ছিলো অনাকর্ষণীয়, হাত ছিলো স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি লম্বা। দাঁড়ালে হাতের অঙুলির প্রান্তসীমা হাঁটুর নি¤œভাগে থাকতো। শারীরিক এই অসামঞ্জস্যের কারণে কোনো বাহিনীতে তাকে চাকরির জন্য বিবেচনা করা হয়নি।
হতাশ হয়ে তিনি আসেন দিল্লীতে। কুতুব উদ্দিন আইবেকের সেনাবাহিনীতে অন্বেষণ করেন কাজ। সেখানেও একই প্রত্যাখ্যান, একই ফলাফল। এরপর তিনি গেলেন বাদায়ুনে। সেখানে মালিক হিজবরুদ্দীনের সৈন্যবিভাগে পেলেন নি¤œপদের চাকরি। কিন্তু বখতিয়ারের ছিলো উচ্চলক্ষ্য। তিনি এ চাকরিতে স্থির থাকেননি। কিছুদিন পরে বাদায়ুন ত্যাগ করে অযোধ্যায় গমন করেন। সেখানকার শাসনকর্তা মালিক হুসামুদ্দীন তার প্রতিভা উপলব্ধি করেন এবং ভুইলি ও ভাগওয়াত নামক দুই পরগনার জায়গীর দেন। তাকে পাঠিয়ে দেন অযোধ্যা ও বিহারের সীমান্তবর্তী মির্জাপুর এলাকায়। রাজ্যের পূর্ব সীমান্তে সীমান্তরক্ষীর কাজে নিয়োজিত হন ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ। এরপর তিনি রাজ্যবিস্তারের পরিকল্পনা নেন, সম্পদ বৃদ্ধি করেন এবং খলজী স¤প্রদায়ের লোকদের একত্রিত করে গঠন করেন নিজস্ব সেনাবাহিনী। ধীরে ধীরে বাহিনীর আকারও বড় হয়।
আনুমানিক ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে বিন বখতিয়ার মুসলিম অধিকার বিস্তৃত করা ও সীমান্তকে স¤প্রসারিত করার জন্য দক্ষিণ বিহার বিহার আক্রমণ করেন। এরপর ক্রমে ক্রমে বিহার জয় করেন।
বিহার জয় করে তিনি বাংলার দিকে দৃষ্টিনিবদ্ধ করেন। তিব্বতী ধর্মযাজক ঐতিহাসিক লামা তারানাথ তার ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ইঁফফযরংস রহ ওহফরধ (এুধ-মধৎ-পযড়ং-নুঁহ) গ্রন্থে স্পষ্ট করেন, বাংলার একদল বৌদ্ধ প্রতিনিধি মীর্জাপুরে গিয়ে তার সাথে দেখা করে বাংলায় অভিযানের জন্য অনুরোধ করেন, যেন এখানকার বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী ব্রাহ্মণ্যবাদের নির্মমতা থেকে পরিত্রাণ লাভ করে। কেননা, তারা যুগ যুগ ধরে নির্মমতার কবলে পদদলিত হচ্ছিলো। দীনেশচন্দ্র সেন তার বৃহৎবঙ্গে দেখিয়েছেন, ব্রাহ্মণ্যবাদীরা শুধু বৌদ্ধদের অত্যাচার ও তাদের ধর্ম নষ্ট করে ক্ষান্ত হয়নি, তারা বৌদ্ধবিহারসমূহে যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত বৌদ্ধ ভাÐারের সর্বৈব লুণ্ঠন করে লুণ্ঠিত দ্রব্যাদির ওপর স্বীয় নামাঙ্কের ছাপ দিয়ে সামগ্রিকভাবে সর্ববিধ নিজস্ব করে নিয়েছেন। হিন্দুদের পরবর্তী ন্যায়, দর্শন, ধর্মশাস্ত্র প্রভৃতির মধ্যে এ লুণ্ঠন পরিচয় পাওয়া যায়।
মুহম্মদ বিন বখতিয়ার বাংলায় অভিযানের প্রস্তুতি নিলেন। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দের শীতকালে তিনি ঝাড়খন্ডের দুর্গম জঙ্গল পেরিয়ে ল²ণ সেনের অবসরকালীন রাজধানী নদীয়া আক্রমণ করেন। তার বঙ্গজয়ের প্রকৃত তারিখ নিয়ে রয়েছে ভিন্নমত। ১২০০ থেকে ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দ, এই চার বছরের মধ্যে ঠিক কোন সালে তিনি নদীয়া জয় করেন, তা সুস্থির নয়। তবে অনেকের মতে, ১২০২ সালে এ বিজয় সংগঠিত হয়। মুহম্মদ বিন বখতিয়ারের গতি ছিলো খুব দ্রæত। মাত্র ১৭ জন সৈন্য তার সাথে থাকতে পেরেছিলেন। বাকি সৈন্যরা পেছনে পড়ে যায়। তিনি যখন তার সঙ্গীদের নিয়ে নগরে প্রবেশ করেন, নগররক্ষীরা তাদের ঘোড়া ব্যবসায়ী ভেবেছিলো। তিনি রাজপ্রাসাদে গিয়ে অতর্কিত আক্রমণ চালান। ততক্ষণে পেছনের সৈন্যরা এসে তার সাথে যোগ দেয়। আক্রমণের সময় লক্ষণ সেন দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন। ইতোপূর্বে তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন, লম্বা হাতবিশিষ্ট এক তুর্কি যোদ্ধা তার পতন ঘটিয়েছে। তার দরবারের পÐিতরা এর ব্যাখ্যায় মুসলিম আক্রমণের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন। রাজা যখন মুহম্মদ বিন বখতিয়ারের অবয়বের বিবরণ পেলেন, তার কুসংস্কারাচ্ছন্ন মন এর মধ্যে নিজের পতন কল্পনা করে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লো। স্থানীয় সেনাবাহিনীও বিন বখতিয়ারের সমরকুশলতা, গতি ও সাহসিকতার খ্যাতির সামনে ছিলো ভীত। লক্ষণ সেন প্রাসাদের গোপন পথে পালালেন। নৌকাযোগে চলে গেলেন তার রাজধানী বিক্রমপুরে। নদীয়া মুসলিমদের অধিকারে এলো। মুসলিম বিজয় স্থানীয়দের কোনো কিছু ধ্বংস করেনি, বিপন্ন করেনি তাদেরকে। বরং খুলে দিয়েছে মুক্তির দরজা। স্থানীয়রা মুসলিম বিজয়কে ঐশ্বরিক অনুগ্রহ হিসেবে বিবেচনা করলো, যার বিবরণ পাওয়া যায় রামাই পÐিতের বিখ্যাত নিরঞ্জনের রুষ্মা কাব্যে। দীনেশচন্দ্র সেনের ভাষায়, ‘মুসলমানগণ কর্তৃক বঙ্গবিজয়কে বৌদ্ধরা ভগবানের দানরূপে মেনে নিয়েছিল।’ (চলবে)
বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

এক অজু দিয়ে আসর মাগরিব ও এশার নামাজ পড়া প্রসঙ্গে?

আন্তঃধর্মীয় সংলাপের গুরুত্ব

ভেজালের দৌরাত্ম্য

পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে দেশে স্বৈরাচারী শাসক তৈরি হতেই থাকবে ; অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ও ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলে অস্বস্তি

মেঘনা আলমের আটকাদেশ : সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত

সংক্ষিপ্ত বিশ্বসংবাদ

দিল্লিতে ধূলোঝড়ের তাণ্ডবে ২শ’ ফ্লাইট বিঘ্ন

আল-আকসার ইমামকে ৭ দিনের নিষেধাজ্ঞা ইসরাইলের

পর্যটকদের কাছে টিকিট বিক্রি ইসরাইলের

ইউক্রেনকে রেকর্ড ২১ বিলিয়ন ইউরো সামরিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিত্রদের

মার্কিন শুল্ক বিরোধ মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশে নজর চীনের

জনসংখ্যা হ্রাস রোধে হাইস্পিড রেললাইন

১৭ ঘণ্টা পর আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট চালু

হাজার সেনা বরখাস্ত করেছে ইসরাইল

যুক্তরাষ্ট্রে ডিমের দামে সংকটে সাধারণ মানুষ

পশ্চিমবঙ্গে বিক্ষোভ চলছেই মোদির কুশপুতুল দাহ

তহবিলের অভাবে শ’ শ’ কর্মী ছাঁটাই করছে ওচা

পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলে চরম মূল্য দিতে হবে ইরানকে : ট্রাম্প

ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম, নতুন রেকর্ড