শায়খ দাতা গঞ্জে বখশ (রহ.)-১
১৫ জুন ২০২৩, ১১:৪১ পিএম | আপডেট: ২৫ জুন ২০২৩, ০৮:১৬ পিএম
ইসলামের আদিকাল থেকেই দক্ষিণ এশিয়া সুফিবাদের জন্য একটি উর্বর ভূমি। অনেক সুফি সাধক তাদের উপস্থিতি এবং শিক্ষা দিয়ে এই অঞ্চলকে আলোকিত ও মুগ্ধ করেছেন। বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষের মধ্যে প্রেম, শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন। একাদশ শতাব্দীতে উপমহাদেশে ইসলামপ্রচার, সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণ ও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব স্থাপনে যেসব সূফী-দরবেশ কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হন তাঁদের মধ্যে হযরত দাতা গঞ্জে বখশ (রহ.)’র নাম তালিকার শীর্ষে। শায়খের আসল নাম সৈয়দ আলী বিন উসমান আল-হুজভীরি। উপমহাদেশের মানুষের কাছে তিনি ‘দাতা গঞ্জে বখশ’ নামে সমধিক পরিচিত। তিনি হযরত মুহম্মদ (সা.)’র সরাসরি অধস্তন পুরুষ। হযরত আলী (রা.)’র বংশধারায় পিতৃ-মাতৃ উভয়দিকেই হাসানী ও হোসাইনী সৈয়দ ছিলেন।
তিনি সুলতান মাহমুদের শাসনামলে আফগানিস্তানের গজনির অর্ন্তগত ‘হুজভীর’ নামক কসবায় হিজরী ৪০০ (১০০৯ খ্রি.) সালে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা গজনিতে সমাপ্ত করে তিনি ৪০ বছর আফগানিস্তান, বাগদাদ, নিশাপুর, দামেস্ক, মক্কা, মদিনা ও ট্রান্সঅক্সিয়ানা সফর করেন এবং সমকালীন ওলামা-মাশায়েখ ও সূফী দরবেশদের সান্নিধ্যে অবস্থান করে জাহেরি ও বাতেনি ইলম হাসিল করেন। সফরে ও বাড়িতে অবস্থানকালে তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামায়াতের সাথে আদায়ে অভ্যস্ত ছিলেন। জুমার নামাজ আদায়ের জন্য তিনি কোনো লোকালয়ে গমন করতেন। আইনশাস্ত্রে তিনি বিভিন্ন প্রাজ্ঞ উস্তাদের অধীনে সুন্নি আইনের হানাফি রীতিতে বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সুন্নি আইনশাস্ত্র হানাফী মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা আবু হানিফা (রহ.) সম্পর্কে শায়খ দাতা গঞ্জে বখশ (রহ.) বলেন: ‘তিনি ইমামদের ইমাম এবং সুন্নীদের আদর্শ’। হানাফী হয়েও ইমাম আহমদ ইবনে হান্বল (রহ.)’র গবেষণাপদ্ধতিকে তিনি সম্মানের চোখে দেখতেন। এতে শায়খের উদারতার পরিচয় মেলে।
শিক্ষা সমাপ্তির পর স্বীয় পীর শায়খ আবুল ফজল মুহম্মদ ইবনে হাসান গজনভি (রহ.) তাকে নির্দেশ দেন, ‘আলী! যাও, নিজের জীবনকে সত্যের প্রচার ও ইসলামের প্রসারের জন্য উৎসর্গ করে দাও। দ্বীনের তাবলিগে আত্মনিয়োগ করো। সমগ্র হিন্দুস্তান কুফর ও শিরকে ভরে গেছে। তুমি লাহোরে যাও এবং সেখানে নিজের অবস্থানকেন্দ্র করে মূর্তিপূজকদের আল্লাহর খাঁটি বান্দা বানানোর কাজ শুরু করো। এ পথে তোমাকে বহু সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে এবং দুঃখ-কষ্টও ভোগ করতে হবে। কিন্তু প্রতিটি কষ্ট ও প্রতিটি সঙ্কটকে আনন্দের সাথে বরণ করো এবং এলায়ে কালেমাতুল্লাহ (আল্লাহর বাণী বুলন্দ করা) ব্যতীত কোনো কিছুর পরোয়া করো না। তুমি আল্লাহর দ্বীনকে সমুন্নত রাখবে, আল্লাহ তোমার নামকে বুলন্দ করবেন। তুমি হিন্দু ভূখÐের রূহানি মৃতদের জীবন্ত করবে। আল্লাহ তোমাকে চিরন্তন জীবন দান করবেন। তুমি আল্লাহর নাম জীবন্ত করো, আল্লাহ তোমায় কিয়ামত পর্যন্ত জীবন্ত রাখবেন।’
হজরত দাতা গঞ্জে বখশ (রহ.) স্বীয় মুর্শিদের এরূপ হৃদয়গ্রাহী ও মর্মস্পর্শী উপদেশ শ্রবণ করে তা পালনে কোনো বৈষয়িক সামান উপকরণ ছাড়াই কালবিলম্ব না করে তৎক্ষণাৎ পদব্রজে রওনা হয়ে যান এবং লাহোরে পৌঁছে খুব দ্রæত সে কাজে আত্মনিয়োগ করেন, যে জন্য তাঁকে প্রেরণ করা হয়েছিল। সে সময় লাহোরে গোর্খ এলাকা কুফর ও শিরকের অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। হজরত আলী হুজভীরি (রহ.)’র বদৌলতে তাওহিদের আলোর রশ্মিগুলো বুলন্দ হয়ে সমগ্র পাঞ্জাবকে আলোকিত করে এবং তারই ওয়াজ এবং তাবলিগের ফলে বিপুলসংখ্যক হিন্দু ঈমান আনে এবং মূর্তির সামনে মাথানতকারীরা একমাত্র আল্লাহর বান্দা হয়ে যায়।
যেসব লোক হজরতের ওয়াজ-নসিহত এবং তাবলিগে মুগ্ধ হয়ে মুসলমান হয়, তাদের মধ্যে ‘রায় রাজু’র নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ ব্যক্তি সুলতান মওদুদ ইবনে মাসউদ গজনভীর পক্ষ থেকে লাহোরের শাসনকর্তা ছিলেন। মুসলমান হওয়ার পর হজরত দাতা গঞ্জে বখশ (রহ.) তাকে ‘শায়খে হিন্দি’ উপাধিতে ভ‚ষিত করেন এবং এ নামেই তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেন (মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী, ইনকিলাব, ঢাকা, ১৩ মে, ২০১৯)।
১০৪০ খ্রিস্টাব্দে তিনি যখন লাহোরে আসেন, তখন লাহোর তথা পাঞ্জাবের পরিবেশ ছিল সম্পূর্ণ অন্ধকার। সেখানে ভ্রান্ত বিশ্বাস, মূর্তিপূজা, প্রতারণা, ধোঁকাবাজি ও যাদু-টোনা ও চারিত্রিক অধঃপতনের ছড়াছড়ি ছিলো উদ্বেগজনক পর্যায়ে। চারদিকে কুফর, শিরক ও বিদআতের সয়লাব। লোভী, চালবাজ ও পথভ্রষ্ট লোকেরা বিভিন্ন বাহানা-অজুহাতে লোকজনের দ্রব্য-সামগ্রী আত্মসাৎ করতো। শুধু তাই নয়, এসব গোমরাহ লোক মানুষকে ধর্মীয় ক্ষেত্রেও পথভ্রষ্ট রাখার জন্য নানা প্রকারের অপকৌশল ব্যবহার করতো। ব্রাহ্মণ ও সন্যাসীগণের বিভিন্ন কলাকৌশল ও যাদুকর্মের হামলা ও চর্চা জোরেশোরে চালু ছিলো। বদমায়েশ ও দুর্বৃত্তরা সরলমনা লোকেরা তাদেরকে নানাভাবে টাকা-পয়সা ও নযরানা দিতে বাধ্য ছিলো। তাদের নিকট সাধারণ মানুষ ছিল অসহায় ও জিম্মি। শায়খের আগমন ছিল ভারতবাসীর জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ।
একাদশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্মতত্ত¡বিদ ও মরমি সাধক শায়খ দাতা গঞ্জে বখশ (রহ.) আল্লাহর একত্ববাদ, ইশকে ইলাহি, হুব্বে রাসুল (সা.), খুলাফায়ে রাশেদুন, ইমাম হাসান (রা.), ইমাম হোসাইন (রা.), ইমাম জায়নুল আবেদিন (রা.), ইমাম বাকের (রা.) ও ইমাম জাফর সাদেকের (রা.) আদর্শ নিজের জীবনাচারে কঠোরভাবে মেনে চলতেন এবং তাঁর শীষ্যদের মেনে চলার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। তিনি তাঁর ওয়াজ-নসিহত, তাবলিগ ও রচনাবলির মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে আল্লাহর সম্পর্ক, মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য, আত্মশুদ্ধি, সচ্চরিত্র গঠন, আন্তঃধর্মীয় সহাবস্থান, জাতপাত ও বর্ণবৈষম্যের মূলোৎপাটন, বিদআত বর্জন এবং ইহ ও পরকালীন জীবনের সমন্বয় সাধনে সারাটি জীবন মেহনত করে গেছেন। (চলবে)
বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
পতিত আওয়ামী স্বৈরাচারের গত ১৭ বছরের নির্যাতন ভুলে যাবার সুযোগ নেই: আমিনুল হক
পাবনা ব্যাপ্টিস্ট চার্চে প্রাক বড়দিন উৎসব অনুষ্ঠিত
পূর্বধলায় শীতার্ত মানুষের মাঝে ইসলামী যুব আন্দোলনের কম্বল বিতরণ
ধর্ম-বর্ণ নয়, সমান মর্যাদায় হোক নাগরিক পরিচয়: জোনায়েদ সাকি
এসবিএসি ব্যাংকের শরিয়াহ্ সুপারভাইজরি কমিটির সভা অনুষ্ঠিত
আ.লীগের হাতেও নির্যাতিত হয়েছিলেন সেই মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু তুলে ধরেনি গণমাধ্যম!
ভারত বাংলাদেশ থেকে বস্তা বস্তা টাকা লুট করেছে : দুদু
আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকে সিটিজেন’স চার্টার অবহিতকরণ সভা অনুষ্ঠিত
মতিঝিলে বিশ্বমানের ডায়াগনস্টিক সেবা প্রদান শুরু আইসিডিডিআর,বি’র
স্বামীর অগোচরে স্ত্রী অন্য কারও সাথে কথা বলা প্রসঙ্গে?
চাঁদপুর মেঘনায় মালবাহী জাহাজে ৭ জনকে কুপিয়ে হত্যা, গুরুতর আহত ১
পতিত স্বৈরাচার হাসিনাকে ফেরাতে ভারতকে চিঠি
যাকাত বোর্ডের ১১ কোটি টাকা বিতরণের প্রস্তাব অনুমোদিত
১৬ বছরে নির্বাচন ব্যবস্থা নির্বাসনে চলে গিয়েছিল : সংস্কার কমিশন প্রধান
জিনিসের দাম একবার বাড়লে কমানো কঠিন: পরিকল্পনা উপদেষ্টা
স্বৈরাচারের দোসর শাহরিয়ার আলমের স্ত্রী-সন্তানসহ দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
মুজিবল্যান্ড বানিয়ে হিন্দুস্তানে থাকুক আ.লীগ : রাশেদ প্রধান
মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পড়িয়ে সম্মানহানী
আওয়ামী দুঃশাসনের বিচার না হলে জুলাই আগষ্টের শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানী হবে: ডা. জাহিদ হোসেন
বাঘায় মেয়াদ উত্তীর্ণ ৪ ইউপিতে প্রশাসক নিয়োগ