ভারতের সভ্যতায় মুসলমানদের অবদান
১৬ জুন ২০২৩, ১১:৪২ পিএম | আপডেট: ২৫ জুন ২০২৩, ০৮:১৬ পিএম
তাঁর এই প্রাণান্তকর প্রয়াস ব্যর্থ হয়নি। অল্প সময়ের ব্যবধানে পূর্ব ও পশ্চিম পাঞ্জাবের সীমানা পেরিয়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে তাঁর বাণী ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর উন্নত চরিত্র, গভীর সাধনা ও কারামত তথা খোদাপ্রদত্ত অলৌকিক ক্ষমতা দেখে মানুষ অভিভূত হয়ে পড়ে। হাজার হাজার মানুষ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। ‘মানুষে মানুষে কোনো ব্যবধান নেই, সব আদমের সন্তান, আদম মাটি থেকে তৈরি’ মহানবী (সা.) এর অমর বাণী তিনি প্রচার করতে থাকেন। বহু হিন্দু, বৌদ্ধ ও নানা জাতিগোষ্ঠীর মানুষ তাদের নিজ নিজ ধর্মের অনুসারী হয়েও শায়খ দাতা গঞ্জে বখশকে শ্রদ্ধা করতেন এবং সমীহ করে চলতেন। তাদের সামাজিক জীবনাচারে শায়খের শিক্ষার প্রভাব লক্ষ করা যায়।
সূূফীতত্ত্বের মর্মকথা ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন: ‘আল্লাহ তায়ালা সূফীদের বিশেষভাবে তাঁর বন্ধুত্বের রহমত দ্বারা আলাদা করেছেন এবং যাদের তিনি তাঁর রাজত্বের রূহানি শাসক হিসাবে মনোনীত করেছেন এবং তাঁর কর্ম দ্বারা প্রকাশ করার জন্য চিহ্নিত করেছেন এবং বিভিন্ন ধরনের অলৌকিক ক্ষমতা বিশেষভাবে অনুগ্রহ করেছেন। তাঁদের প্রাকৃতিক কলুষতা থেকে মুক্ত করেছেন এবং তাদের কলুষ আত্মা এবং আবেগের বশ্যতা থেকে মুক্তি দিয়েছেন, যাতে তাদের সমস্ত চিন্তাভাবনা একমাত্র আল্লাহ তায়ালার জন্য নিবিষ্ট হয় এবং তাদের ঘনিষ্ঠতা একমাত্র তাঁরই সাথে থাকে। আল্লাহ কিয়ামতের দিন, সূফী সম্প্রদায়কে অন্য সকলের উপরে উন্নীত করবেন এবং তিনি হজরত মুহম্মদ (সা.)’র ধর্মকে হেফাজত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।’
তিনি সর্বদা নসিহত করতেন এবং তাঁর নসিহতগুলো মানুষের চোখ খুলে দিতো। ‘পেট ভরে খাওয়া পশুদের কাজ আর উপোস থাকা অসুস্থদের চিকিৎসা’। ‘এতটুকু ইলম শিক্ষা করা ফরজ যদ্বারা আমল দুরস্ত হয়। আল্লাহ তায়ালা ওইসব মানুষের নিন্দা করেন যারা অলাভজনক শিক্ষা গ্রহণ করে’। ‘ইলম, মাআরিফাত, আমল, হাকিকত নিজের মধ্যে তালাশ করা জরুরি’। ‘নিজের অন্তরের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো অধ্যয়ন করে পরিচ্ছন্ন করা হাতে পায়ে আমল করার চাইতে শ্রেষ্ঠ’। ‘দুনিয়ার ধন-দওলত বেশি হলে নিজেকে আমির ভাবা উচিত নয়, অপর দিকে সম্পদ হারিয়ে গেলে নিজেকে ফকির ভাবাও সমীচীন নয়। সর্বদা একই অবস্থায় থাকতে হবে’। ‘শরীরের মালিকানা মালিকের হাতে। শরীরের লালন ও ধ্বংস মালিকের হাতে ন্যস্ত’।
লাহোরে শায়খের খানাকা ছিল সমসাময়িক ওলামা-মাশায়েখের তীর্থস্থান। সেখানে নিয়মিত পাঠদানের আসর বসত। তিনি মুবাল্লিগদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বিভিন্ন স্থানে প্রেরণ করতেন। ধর্ম, বর্ণ, ধনী, দরিদ্র নির্বিশেষে যে কোনো মানুষ তাঁর খানাকায় এসে তাঁর সান্নিধ্য লাভ করতে পারতেন। অলিয়ে হিন্দাল হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী (রহ.) লাহোরে অবস্থিত শায়খ দাতা গঞ্জে বখশের খানাকায় অবস্থান গ্রহণ করে বেলায়তের উঁচুতর মর্যাদা এবং ফুয়ূয ও বারকাত লাভ করেন। তিনি এই মহান অলির প্রশংসায় লিখেছেন:
‘গঞ্জে বখশে ফয়জে আলম
মাযহারে নূরে খোদা;
নাকিসাঁরা পীরে কামিল
কামিলাঁরা রাহনুমা’।
‘দাতা গঞ্জে বখশ হলেন- দানের ভা-ার, বিশ্বের কল্যাণধারা ও আল্লাহর নূরের প্রকাশস্থল। তিনি অপূর্ণ মানুষকে পীরে কামিল এবং কামিল লোকদেরকে দ্বীনের সত্যিকার পথপ্রদর্শকে পরিণত করেন’।
শায়খের লিখিত ১০টি গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়। সেগুলো হচ্ছে- ১. দিওয়ান, ২. কিতাবে ফানা ও বাক্বা, ৩. আসরারুল খারক্বিল মাঊনাত, ৪. আর রিআয়াতু বিহুক্বু ক্বিল্লাহি তায়ালা, ৫. কিতাবুল বয়ান লিআহলিল আয়ান, ৬. নাহভুল ক্বলুব, ৭. মিনহাজুদ্দীন, ৮. ঈমান, ৯. শরহে কালামে মানসূর এবং ১০. কাশফ আল মাহজুব। উল্লেখ্য, বর্তমানে শুধু ‘কাশফুল মাহজুব’ কিতাব পাওয়া যায়। এটা শরীয়ত ও তরীক্বতের বিভিন্ন বিষয়ের বর্ণনার একটি অনন্য ও প্রামাণ্য কিতাব। কাশফ আল মাহজুব (মারেফতের মর্মকথা) রচনার জন্য তিনি সবচেয়ে বিখ্যাত, যা ফার্সি ভাষায় সূফীবাদের ‘প্রাথমিক আনুষ্ঠানিক গ্রন্থ’ হিসাবে বিবেচিত। কাশফ আল-মাহজুব, সূফী মতবাদ ও অনুশীলনের উপর একটি বিস্তৃত গ্রন্থ, যা আধ্যাত্মিক যাত্রার বিভিন্ন পর্যায়, একজন সত্যিকারের অন্বেষণকারীর গুণাবলী, সূফী ওস্তাদ ও শিষ্যদের শিষ্টাচার, সূফীবাদের বিভিন্ন আদেশ ও নিষেধের মতো বিষয়গুলি স্থান পেয়েছে। সূফীদের অলৌকিক ঘটনা এবং বিস্ময় এবং সূফীবাদ এবং শরীয়তের মধ্যে সম্পর্ক নিয়েও আলোচনা রয়েছে। কাশফ আল-মাহজুব কেবল সূফী সাহিত্যের একটি মাস্টারপিস নয়, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক তথ্যের একটি মূল্যবান উৎসও বটে। এতে ১০০ জনেরও বেশি সূফী সাধকের জীবনী রয়েছে, যারা হজরত দাতা গঞ্জে বখশের আগে বা তার সময়ে বসবাস করেছিলেন। সেইসাথে যেসব উপাখ্যান এবং গল্প রয়েছে তা তাদের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতাকে চিত্রিত করে। এটি ১১ শতকে ইসলামিক বিশ্বের সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। যেমন রাজবংশের উত্থান এবং পতন, মঙ্গোল এবং তুর্কিদের আক্রমণ, সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব-বিতর্ক এবং মুসলিম ও অমুসলিমদের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া।
বইটি উর্দু, ফার্সি, তুর্কি, আরবি, ইংরেজি এবং ফরাসিসহ বেশ কয়েকটি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। এটি বহু শতাব্দী ধরে প-িত এবং সূফীবাদের সন্ধানকারীদের দ্বারা ব্যাপকভাবে পঠিত এবং অধ্যয়ন করা হয়েছে। এটি রুমি, হাফিজ, আত্তার, জামি এবং ইকবালের মতো অন্যান্য অনেক সূফী লেখক ও কবিকেও প্রভাবিত করেছে। যে কেউ সূফীবাদের সারমর্ম এবং চেতনা বুঝতে চায় তাদের জন্য এটি একটি অপরিহার্য গ্রন্থ হিসাবে বিবেচিত হয়। মিশরীয় সূফী প-িত আবুল আজেম এই গ্রন্থটিকে আরবি ভাষায় এবং প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদ আর এ নিকলসন ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন। বাংলাসহ পৃথিবীর বহু গুরুত্বপূর্ণ ভাষায় এটির অনুবাদ বেরিয়েছে। ৪৬৯ হিজরিতে (১০৭৭ খ্রি.) তিনি লাহোরে ইন্তেকাল করেন। প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৬০ হাজার মানুষ শায়খের মাজার জিয়ারত করেন। (সমাপ্ত)
বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার ফোন
রানার অটোমোবাইলস পিএলসির এজিএম সম্পন্ন
আগামী নির্বাচনে ধানের শীষের বিজয়ে ঐক্যবদ্ধ কাজের আহ্বান: এমরান আহমদ চৌধুরী
নকল পণ্য প্রতিরোধে আমদানির উপর শুল্ক কমানোর দাবি বাজারের ২০ শতাংশ খাদ্য মানহীন
লক্ষ্মীপুরে চুরির অপবাদে জনসম্মুখে যুবককে খুঁটিতে বেঁধে নির্যাতন, নাকে খত
বাঘায় মেয়াদ উত্তীর্ণ ৪ ইউপিতে প্রশাসক নিয়োগ
বিশ্বে বছরজুড়ে আলোচনায় যুদ্ধ, নির্বাচন ও মূল্যস্ফীতি
যুক্তরাষ্ট্র আগুন নিয়ে খেলছে : চীন
আওয়ামী দুঃশাসনের বিচার না হলে জুলাই আগষ্টের শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানী হবে: ডা. জাহিদ হোসেন
মেক্সিকোতে প্লেন বিধ্বস্ত হয়ে নিহত ৭
মাথাপিছু ১৪০০ ডলারের চেক পাচ্ছেন ১০ লাখ মার্কিনি
৯১ শিশু খেলোয়াড়সহ ৬৪৪ ক্রীড়াবিদকে হত্যা করেছে ইসরাইল
মোজাম্বিকে ঘূর্ণিঝড় চিডোরে নিহত ৯৪
মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পড়িয়ে সম্মানহানী
রাফালের আগমনে ভারত সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি
উত্তর প্রদেশে নিহত ৩ খলিস্তানি নেতা
ভারতে বাল্যবিবাহবিরোধী অভিযানে আটক ৫০০০
মুজিবল্যান্ড বানিয়ে হিন্দুস্তানে থাকুক আ.লীগ : রাশেদ প্রধান
গ্রেফতার ভয়ে পোল্যান্ড সফর বাতিল করলেন নেতানিয়াহু
পানামা খাল দখলের হুমকিকে ভর্ৎসনা পানামা প্রেসিডেন্টের