ঢাকা   রোববার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪ | ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

ইলতুতমিশ, যার হাত ধরে সার্বভৌম সালতানাতের প্রতিষ্ঠা-১

Daily Inqilab মুসা আল হাফিজ

২২ জুন ২০২৩, ১১:২৯ পিএম | আপডেট: ২৫ জুন ২০২৩, ০৮:১৬ পিএম

সুলতান ইলতুতমিশের নামের উচ্চারণ নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক। এর মূলে আছে ফার্সি গ্রন্থসমূহ। তাজুল মায়াসির, তারিখে ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ, আদাবুল হরব কিংবা তবকাতে নাসিরীতে তার নাম উচ্চারিত হয়েছে বিচিত্ররূপে। এর ব্যাখ্যায়ও রয়েছে বিভিন্নতা। আলফনস্টেন তাকে আলতামিশ বলেছেন, এলিয়ট আলতাশ বলেছেন, পুটি বলেছেন আয়ালতিমিশ। হার্থোল্ড লিখেছেন, তার নামের মূল শব্দ ছিলো আলতুতমিশ, যার মানে হলো রাষ্ট্র চালনায় নিপুণ নেতা। বাদায়ুনীর মতে, সুলতানকে আলতুতমিশ বা ইলতুতমিশ বলা হতো। কারণ, তিনি জন্মগ্রহণ করেন চন্দ্র গ্রহণের রাতে। ফার্সি কবিদের অনেকেই আপন কাব্যে তাকে উল্লেখ করেছেন আলতুমাশ বলে। তা বোধ করি ছন্দমিলের প্রয়েজনে হয়ে থাকবে।

তুর্কি গবেষক হেকমত বায়ুর সকল মত পর্যালোচনা করে দাবি করেন, তার নাম আসলে ইলেতমিশ। পশ্চিমা গবেষকরা একে পছন্দ করেছেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় এনসাইক্লোপিডিয়া অব ইসলামে। আধুনিক ঐতিহাসিকদের কাছে তিনি বিখ্যাত আলতামাশ বা ইলতুতমিশ নামেই। বাল্যকালে সম্ভবত তার নাম ছিলো ইসেতমি। তার পিতা ইলেতমিশ খাঁ ছিলেন তুর্কি ইলবেরি উপজাতির প্রধান। ইলেতমিশের ছিলেন অনেক ছেলেমেয়ে, আত্মীয়। সবার মধ্যে ইসেতমি ছিলেন অনন্য। ভদ্র ও বুদ্ধিমান। সুদর্শন ও ব্যক্তিত্ববান। সাহসী ও প্রতিভাবান। পিতা তাকে স্নেহ করতেন সবার অধিক। কোনোভাবেই তাকে চোখের আড়ালে যেতে দিতেন না। ভাইয়েরা তার সামনে ছিলেন নিস্প্রভ। তারা তাকে হিংসা করতো।

একদিন পিতাকে ধোঁকা দিয়ে তারা ইলতুতমিশকে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা দেখার নাম করে বাইরে নিয়ে আসে এবং জোর করে এক দাসব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দেয়। এক পর্যায়ে বোখারার বিখ্যাত ব্যবসায়ী হাজী বোখারা তাকে কিনে নেন। সেখান থেকে তিনি গজনীতে আসেন জালালউদ্দিন চুস্তকুবার দাস হয়ে। প্রতিভাবান তরুণের কাছে গজনী ছিলো জ্ঞানের এক উন্মুক্ত কেতাব। বড় বড় পÐিত, সাংস্কৃতিক কর্মকাÐ, সাধক ও খ্যাতিমানদের সান্নিধ্য। দাস হলেও জ্ঞান অর্জনে কোনো সীমাবদ্ধতা রাখা হয়নি ইলতুতমিশের জন্য। মহান সাধক শেখ সোহরাওয়ার্দীর দরবারে তিনি যেতেন নিয়মিতই। তাঁর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ তাকে মনের দিক থেকে করে তোলে ভবিষ্যতের ইলতুতমিশ। জালালউদ্দিন চুস্তকুবার একান্ত প্রয়োজনে তাকে বিক্রি করতে চাইলেন। হাজার স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে তাকে ক্রয়ের প্রস্তাব করেন মুহাম্মদ ঘুরি। কিন্তু চুস্তকুবারের প্রয়োজন আরো অর্থ। যদিও পাঁচটি স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে বাজার থেকে তখন দাস কেনা যায়। ঘুরি বিরক্ত হলেন চুস্তকুবারের সীমাতিরিক্ত চাহিদায়। তিনি গজনীতে ইলতুতমিশের বিক্রয় নিষিদ্ধ করলেন।

কুতুবউদ্দিন আইবেক গুজরাট জয় করে যখন গজনীতে ফিরে এলেন, ইলতুতমিশের গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জেনে তাকে ক্রয় করতে আগ্রহী হলেন। সুলতানের আদেশে এ ক্রয় সম্পন্ন হয়। গজনী দরবারে এরপর অল্পসময়রে মধ্যেই ইলতুতমিশের বিদ্যা, দক্ষতা ও দায়িত্বশীলতা স্বীকৃত হলো। ১২০৫ সালে পাঞ্জাবে খোক্কর উপজাতির বিদ্রোহ দমনে অংশগ্রহণ করেন তিনি। এই অভিযানে তার কৃতিত্ব সম্রাটকে মুগ্ধ করে। আস্থাবান করে তার দক্ষতার প্রতি। মিনহাজুস সিরাজ জানান, সুলতান (মুহম্মদ ঘুরি) যুদ্ধে লক্ষ করলেন, ইলতুতমিশের অসামান্য বীরত্ব ও সাহসিকতা। তিনি জানতে চাইলেন, কে এই বীর? যখন তিনি ইলতুতমিশের পরিচয় পেলেন, তাকে ডেকে আনলেন এবং সম্মানিত করলেন। কুতুবউদ্দিনকে আদেশ করেন তাকে পুরস্কৃত করার জন্য, মুক্ত করে দেবার জন্য। আইবেক তাকে ক্রীতদাসত্ব থেকে দেন মুক্তি। যদিও কুতুবউদ্দিন তখনো ঘুরির গোলাম।

ইলতুতমিশ সেনাপতিত্ব ও প্রশাসনিক যোগ্যতায় নিজেকে প্রমাণ করলেন। ক্রমেই তিনি হলেন গোয়ালিয়রের অধিপতি, বারান ও বাদাউনের শাসক। ১২০৬ খ্রিস্টাব্দে আইবেকের জামাতা হন তিনি। আইবেক তাকে দিল্লীতে নিয়ে আসেন এবং দিল্লীর প্রশাসন তাকে আইবেকের সত্যিকার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে বরণ করে নেয়। স্ট্যানলি লেনপুলের মতে, ‘মুহম্মদ ঘুরির চোখে আইবেক যা ছিলেন, আইবেকের কাছে ইলতুতমিশ ছিলেন ঠিক তাই। আইবেক তাকে ঠিক নিজের ছেলে মনে করতেন।’ আইবেকের মৃত্যুর পরে অভিজাতরা আরাম শাহকে দিল্লীর সিংহাসনে বসান। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, আরাম শাহ কুতুবউদ্দিনের পুত্র ছিলেন। কিন্তু মিনহাজুস সিরাজ লিখেন, কুতুবউদ্দিনের কোনো পুত্র ছিলেন না, ছিলেন শুধু তিন কন্যা। (চলবে)

 

 

 

 


বিভাগ : বিশেষ প্রতিবেদন


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-৪
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-৩
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-২
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-১
ব্রিটিশ সরকারের তত্বাবধানে বাহদুর শাহ জাফর ও তাঁর বংশধরদের অবস্থা !
আরও

আরও পড়ুন

নাটকীয় শেষ দশ মিনিটে দুই গোল শোধ করে বার্সাকে রুখে দিল সেল্তা

নাটকীয় শেষ দশ মিনিটে দুই গোল শোধ করে বার্সাকে রুখে দিল সেল্তা

বিবর্ণ সিটিকে ইতিহাদেই বিধ্বস্ত করলো টটেনহ্যাম

বিবর্ণ সিটিকে ইতিহাদেই বিধ্বস্ত করলো টটেনহ্যাম

নটিংহ্যামকে হারিয়ে চার ম্যাচের জয়খরা কাটালো আর্সেনাল

নটিংহ্যামকে হারিয়ে চার ম্যাচের জয়খরা কাটালো আর্সেনাল

স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা জাতীয়করণের দাবী অত্যন্ত যৌক্তিক

স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা জাতীয়করণের দাবী অত্যন্ত যৌক্তিক

পাঠ্যবই ছাপায় অনিয়মে আনন্দ প্রিন্টার্সকে সতর্কতা

পাঠ্যবই ছাপায় অনিয়মে আনন্দ প্রিন্টার্সকে সতর্কতা

দক্ষিণ লেবাননে ৬ চিকিৎসাকর্মী নিহত

দক্ষিণ লেবাননে ৬ চিকিৎসাকর্মী নিহত

জনগণের সাথে জনসংযোগ বাড়াতে হবে

জনগণের সাথে জনসংযোগ বাড়াতে হবে

আমরা যুদ্ধে বিশ্বাসী না কেউ গায়ে পড়লে জবাবের প্রস্তুতি রাখতে হবে: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

আমরা যুদ্ধে বিশ্বাসী না কেউ গায়ে পড়লে জবাবের প্রস্তুতি রাখতে হবে: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

বাফুফের নতুন সভাপতি তাবিথের কাছে ২৭ রেফারির চিঠি

বাফুফের নতুন সভাপতি তাবিথের কাছে ২৭ রেফারির চিঠি

ফের বাড়লো সোনার দাম, ভরি ১ লাখ ৪২ হাজার টাকা

ফের বাড়লো সোনার দাম, ভরি ১ লাখ ৪২ হাজার টাকা

বাংলাদেশে খেলা নিয়ে অনিশ্চিয়তায় হামজা!

বাংলাদেশে খেলা নিয়ে অনিশ্চিয়তায় হামজা!

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেই হবে অনূর্ধ্ব-২০ নারী সাফের খেলা

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেই হবে অনূর্ধ্ব-২০ নারী সাফের খেলা

সিলেটে মাজিদের ফিফটি

সিলেটে মাজিদের ফিফটি

অ্যাম্বাসেডর কাপ উশুতে সেনাবাহিনী চ্যাম্পিয়ন

অ্যাম্বাসেডর কাপ উশুতে সেনাবাহিনী চ্যাম্পিয়ন

মাদক শুধু ব্যক্তিকে নয় পরিবারকেও ধ্বংস করে

মাদক শুধু ব্যক্তিকে নয় পরিবারকেও ধ্বংস করে

সাধারণ মানুষের পেটে লাথি মেরে আ.লীগ নিজেদের ভাগ্য গড়েছে : এমরান সালেহ প্রিন্স

সাধারণ মানুষের পেটে লাথি মেরে আ.লীগ নিজেদের ভাগ্য গড়েছে : এমরান সালেহ প্রিন্স

ধর্মদ্রোহী সরকারের সময় কোনো ধর্মই নিরাপদ ছিল না

ধর্মদ্রোহী সরকারের সময় কোনো ধর্মই নিরাপদ ছিল না

দৌলতখানে শীতকালীন সবজি পরিচর্যায় ব্যস্ত কৃষক

দৌলতখানে শীতকালীন সবজি পরিচর্যায় ব্যস্ত কৃষক

সুন্দরগঞ্জে ছয় পা বিশিষ্ট বাছুরের জন্ম

সুন্দরগঞ্জে ছয় পা বিশিষ্ট বাছুরের জন্ম

বৈষম্যের শিকার কুমিল্লার ১৫ হাজার এতিম শিশু

বৈষম্যের শিকার কুমিল্লার ১৫ হাজার এতিম শিশু